হাতে মেহেদী দাওনি? হাতে মেহেদি যদি দাও। তাহলে আরেকটু কষ্ট করে শাড়িও পরে নিয়ো। তারপর সুন্দর করে একটা ছবি তুলে আমাকে দিয়ো। গত চারদিন ধরে ঈদের সালামি নিয়ে বউয়ের সাথে ঝগড়া। এ বছর কোনো সালামি দিতে পারব না, এটা আগেই বলে রেখেছি। সালাম-টালাম করে লাভ নাই। তবুও সে সালাম করে হাত পেতে বসে আছে! বললাম, “ আমার কাছে কোনো টাকা নাই! এবারের ঈদে কোনো টাকা পয়সা পাবে না! ব্যাস, সে হনহন করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। চারদিন হয়ে গেছে কোনো কথাবার্তা নাই। ঈদের দিনে কথা না বলে তো থাকা যায় না। তাই মেসেজটা দিলাম। দশ মিনিট পরে উত্তর আসলো। আমার বাপের কাছেও কোনো টাকা পয়সা নাই। মেহেদিও কিনতে পারি নাই। শাড়িও কিনতে পারি নাই। সুতরাং ছবি-টবি চাইয়া লজ্জা দিবেন না! “
এই মেয়ের শুধু মার্কেটে ঘুরাঘুরির শখ। হাতে পাঁচশ টাকা পেলেই সে মার্কেটে চলে যাবে। দোকানে দোকানে ঘুরে শেষমেশ কিছু না কিনে বাড়িতে ফিরবে। এজন্যই টাকা পয়সা দেই নাই। বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক মার্কেট করা যাবে। বিয়ের পর এবারের ঈদটাই সে নিজের পরিবারের সাথে কাটানোর সুযোগ পেয়েছে। টানা সাত বছর আমাদের সাথেই ঈদ করেছে। ভাবলাম নিজের মত একটা ঈদ কাটাক। তাই আর মেসেজও দেই নাই, ফোনও করি নাই। সমস্যা হয়ে গেছে সৌরভকে নিয়ে। জগতের নিয়ম। মা যেদিকে যায়, ছেলেও সেদিকে যায়। গত ঈদেও বাপ ব্যাটা পাঞ্জাবি পড়ে সারাদিন ঘুরেছি। এই ঈদে পড়ে গেলাম আমি একলা!
“ ছেলের প্রতি দুজনের অধিকার কিন্তু সমান সমান। দিনে তোমার কাছে থাকলে রাতে আমার কাছে থাকবে। সন্ধ্যার দিকে ওকে পাঠিয়ে দিয়ো। এই মেসেজের কোনো উত্তর পেলাম না। সেই সকালে দিয়েছিলাম। এখন একটা বাজে। মা এসে বলল।
“ কই, গেলি না তানিয়াকে আনতে? “
“ নাহ। নিজের পরিবারের সাথে এবারের ঈদ কাটাক। “
“ তোদের কিচ্চা কাহিনী আর ভালো লাগে না। ”
“ বাদ দাও তো। সেমাই আনো। সেমাই খাই। ”
সেমাইয়ের কথা বলতেই গত ঈদের কথা মনে পড়ে গেল। তানিয়া সেমাই রান্না করতে গিয়ে পুড়ে ফেলেছে! সেমাই গেছে শুকনা হয়ে! এরকমটা কীভাবে হয়ে গেল সে বুঝতে পারেনি। তারপর বাচ্চা মেয়েদের মত কান্না শুরু করে দিল! এটা দেখে সবাই হেসেছে। কেউ সামনে কেউ লুকিয়ে! তাঁকে আবার রান্না করার সময় দেওয়া হলো। এবারও একই ঘটনা ঘটল! কেউ খায়নি সে সেমাই, আমি ছাড়া। এরপর সে পণ করেছিল। জিন্দিগিতেও আর সেমাই রান্না করতে যাবে না। এই বছর সেমাই রান্না করার চেষ্টা করেছে কিনা জানা দরকার। ফোন করলাম তাঁর নাম্বারে। পরপর তিনবার। কেউ ধরল না। চারবারের মাথায় সৌরভ ধরল।
“ হ্যালো, আব্বু? “
“ আর আব্বু ডাকিয়ো না। মায়ের কাছেই থাকো। “
“ তুমি যদি তোমার মায়ের কাছে থাকতে পারো। আমি থাকলে অসুবিধা কী? এই ছেলের যুক্তিবিদ্যায় দারুণ দখল। যুক্তি দিয়ে তাঁর সাথে কেউ পারবে না।
“ মাফ কর ভাই। ভুল হয়ে গেছে। এখন বল তোর মা কই? ”
“ আম্মু কান্না করছে। সেমাই রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে! “
“ ফোনটা দে তো তোর মাকে। সে মোবাইল নিয়ে মায়ের কাছে গিয়েছে। কান্নার আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছি। সৌরভ বলল।
‘ আব্বু ফোন করেছে। কথা কও। ’
‘ না। উনার সাথে আমার কোনো কথা নাই। ’
কথাগুলো আমি স্পষ্ট শুনেছি। হ্যাঁ, আব্বু? আম্মু কথা বলবে না এখন। পরে ফোন দিয়ো। শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব দশ মিনিটের! যাব যাব করেও যাওয়া হলো না। চোখে ঘুম এসে গেল। ঘুমিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যার দিকে ফোন বাজছে।
“ হ্যালো, সৌরভ? “
“ নাহ, সৌরভ ঘুমাচ্ছে। “
“ ওহ, তুমি। কী খবর বলো? কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে সে বলল।
“ আপনি কি আমার জন্য বদদোয়া করছেন? “
“ এটা কেমন কথা? বদদোয়া করব কেন? “
“ নাহলে আমি যাই রান্না করছি। পুড়ে যাচ্ছে কেন? হালকা আগুন দিলেও পুড়ে যাচ্ছে! “
“ ঈদের দিনে এরকম অদ্ভুত ঘটনা তোমার সাথে ঘটে। এটা নতুন কিছু না। “
“ পুড়ে যাওয়া সেমাই খাবেন? ”
“ নাহ। আমার আম্মার সুস্বাদু সেমাই রেখে পুড়ে যাওয়া সেমাই খাব কেন? “
“ আমি যে একটুও সেমাই খাইনি! “
“ কেন খাওনি? মানা করেছে কেউ? “
“ এমনিই, রাখছি। ”
এসব কথার মানে হলো। সে এখনো খায়নি। আমাকে যেতে হবে। তাঁর পুড়ে যাওয়া সেমাই খেতে হবে। তারপর সে খাবে! এদিকে বাসা থেকে বের হলেই পুলিশ দৌড়ানি দিচ্ছে। কালকে বড় ভাই বের হয়েছিল। পুলিশ এমন এমন জায়গায় বারি দিয়েছে! দেখাতেও পারছে না! আমারও যদি এই অবস্থা হয় তাহলে মুশকিল হয়ে যাবে! হাতমুখ ধুয়ে বের হওয়াত প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় তানিয়ার মেসেজ। সেলামি আনতে যেন ভুল না হয়! ”
আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি সেটা সে বুঝল কীভাবে? নিশ্চয়ই বড় ভাবীর কাজ! এই মহিলা আমাদের মাঝে গুপ্তচর হিসেবে বেশ ভালোই দায়িত্ব পালন করেন। আল্লাহর নাম নিয়ে বের হলাম। কিছুদূর যেতেই একজন পুলিশ ভাই জিজ্ঞেস করল। এই দাঁড়ান আপনি। কোথায় যান? এখন যদি বলি শ্বশুরবাড়ি যাই। তাহলে সে আমাকে আসল শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে ইচ্ছামত মেরামত করতে পারে। মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো। “ আমার বউয়ের খুব জ্বর। ওষুধ নিতে এসেছি। ” তারপর আর জেরা করল না। আমি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম। কলিং বেল বাজাতেই তানিয়া দরজা খুলল। আমার অপেক্ষাতেই ছিল মনে হয়। দরজা খুলে কোথায় একটু ঈদ মোবারক-টোবারক বলবে। নাহ, সে বলল।
“ সেলামিটা আগে দেন। ” একটু রাগ হলো। শুরু করলাম অভিনয়। এমনভাবে পড়ে গেলাম যেন মাজা ভেঙ্গে গেছে!
“ আরে আরে কী হয়েছে আপনার? “
“ পুলিশ! “
“ পুলিশ মানে? “
“ পিটানি দিছে! আমি শেষ তানিয়া। উফ কী ব্যথা! ”
আমাকে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়া হলো। তানিয়ার চোখ ফাঁকি দেওয়া গেলেও। সৌরভের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় না! তাঁকে খুব কষ্টে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মানানো হয়েছে। যখন দেখলাম সেলামির কথা ভুলেই গেছে মনে হয়। তখন বললাম।
“ কই, আনো তোমার পুড়ে যাওয়া সেমাই। ” সে সেমাই আনলো। খেলাম দুজনে একসাথে। তারপর সে আবার সালাম করল। এবার হাত পেতে বলল। “ এখন যদি টাকা বের না হয়। তাহলে সত্যি সত্যি পিটানি আমি দিব। আর অভিনয় করতে হবে না! ” আমি ঢোক গিলে বললাম, কত? সে মুচকি হেসে বলল।
“ বেশি না, এক হাজার টাকা। আমি তো হৃদয়হীন মানুষ না। গত দুই মাস ধরে অর্ধেক বেতন পাচ্ছেন আমি জানি। এক হাজার দিলেই হবে। একটা শাড়ি আর একটা মেহেদি। এতেই চলে যাবে! ” আমি নিজেকে নিজে গালি দিলাম, তুই একটা গাধা! তানিয়া চোখ উঁচু করে বলল।
“ কিছু বললে? “
“ নাহ, তোমার সেলামি সৌরভের হাতে দিয়ে দিয়েছি। পাঁচ হাজার। এক টাকাও কম না! “
“ আমি সরল হলেও বোকা না। ছেলেকে নকল নোট দিয়ে মানাতে পারবে, আমাকে না! “
এই কথাও সে জেনে গেছে! কীভাবে জানলো? এটাও নিশ্চয় বড় ভাবীর কাজ। আসার আগে বলেছিলাম, ভাবী। নকল নোট নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। ভালো না? ভাবী মাথা নাড়িয়ে বললেন, ভালো। “ আবার ওকে ফোন দিয়ে বলে দিবেন না তো? “
তিনি বললেন, একদম না! মেয়ে মানুষের পেটে কথা থাকে না। এটা আমারই বুঝা উচিত ছিল! আসলে আমার কাছে এক পয়সাও নাই! দুই তারিখে যদি কোম্পানি দয়া করে আরেকটা অর্ধেক বেতন দেয়। তাই তানিয়ার হাতে চুমো খেয়ে বললাম। পকেট তো খালি! এখন কী করব? ” তানিয়া কিছু বলল না। আমার দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চোখটা শীতল হয়ে আসছে। আমার বুকে মাথা রাখল। পকেট খালি সমস্যা নাই। কিন্তু আমার জন্য মনে ভালোবাসাটা যেন এভাবেই সারাজীবন ভরপুর থাকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প