সুখছায়া

সুখছায়া
সকাল সকাল মা’য়ের মানে আমার শাশুড়ির ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। উঠে ই বললেন তাড়াতাড়ি গোসল করে নামাজ সেড়ে নাও কাজ আছে। আমি কিছু না বুঝে দাড়িয়ে রইলাম এরকম তো কখনো করেননি। আজ হঠাৎ কি এমন হল।
অনার্স ফোর্থ ইয়ারে উঠার সাথে সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। অনেক কিছু ভেবে রেখে ছিলাম। কিছু ই করা হয়নি।
মেয়েদের নাকি সবার আগে বিয়ে দরকারি। তাই আমাদের চার বোনের মধ্যে আমি বড় হওয়ায় বাবা কোনো কথা না শুনে বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমিও কিছু বলতে পারিনি। যখন দেখতাম বাবা সব দায়িত্ব নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তখন শুধু মনের মধ্য খুব একটা আঘাত লাগত। ভাবতাম যদি একটু ভরসা হতে পারতাম বাবার..! কিন্তু পরিস্থিতির কাছে সব ই বেমানান। বিয়ে হয়ে যায় আদিবের সাথে। কিন্তু বিয়ের পর পড়ালেখা শেষ করে আদিবের সাপোর্টে চাকরি করার সুযোগ পাই। কোরবানি ঈদের ছুটি চলছে ঈদের ১ দিন বাকি। আজ ছয় সাত মাস হল চাকরিতে আছি। তবে আমার নিজের উপার্জনের কোনো টাকা ই আমি আমার কাছে রাখিনা।
চাকরি করার ১ম শর্ত ছিল এটা। আমি বেতন পুরোটা ই আমার শাশুড়ির কাছে তুলে দিতে হবে। প্রথমে শুনে খুব খারাপ লাগল পরে ভাবলাম আস্তে আস্তে ঠিক করে নিব। তাই করা। তবে ছুটির দিনে এত ভোরে ডাকাডাকির কারণ খুঁজে পেলাম না। নামাজ সেরে রান্না ঘরে আসতে ই দেখলাম আমার শাশুড়ি রান্নাঘরে চা বানাচ্ছেন। পরের বাকি টুকু গিয়ে আমি বানালাম। একসাথে চা খেয়ে রান্নাবান্না তাড়াতারি শেষ করলাম। এটাও উনার নির্দেশ ছিল। খুব কড়া মেজাজের মানুষ কোনো কিছু প্রশ্ন করার জো নেই। রান্না শেষ করে ভালো একটা শাড়ি পড়ে আমরা বাইরে বের হলাম। তবে কোথায় যাওয়া হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না। একটা শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি থামলে সেখান থেকে বেশ কাপড়চোপড় কিনে আনলেন। আমি তাতেও আরো অবাক হলাম। এতজনের কাপড় কি জন্য।
গাড়ি গিয়ে থামল একটা এতিম খানার সামনে। কিছু অদ্ভুত হচ্ছে তবে তা বুঝতে পারছি না। অনেক গুলো বাচ্চার সামনে মা আমাকে বললেন এগুলো এদের হাতে তুলে দিতে। আমি তুলে দিলাম এক এক করে। নতুন জামা পেয়ে কি যে খুশি ওরা যেন চোখ বেয়ে সব আনন্দ উপচে পড়ছিল। নতুন ঈদের জামা। কাপড় গুলো দিয়ে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করল মনে। আমি তখন দেখেছিলাম। ঐ রাগি কড়া মেজাজের মানুষটা কেমন করে এই বাচ্চাদের ভীড়ে বাচ্চা হয়ে রইলেন। এরকম দৃশ্য আমার খুব কম ই দেখা পড়ে। কাপড়গুলো দিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে চলে আসলাম। আবার গেলাম মার্কেটে। সেখান থেকে শাড়ি পানজাবী ড্রেস কিনে আবার ফিরলাম বাসায়।
দুপুরের খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যায় চা খেতে ই হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতে ই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। পিছন থেকে আমার শাশুড়ি বললেন, আসুন বেয়াই ভিতরে আসুন। বাবা মা সবাই ঈদের আগের দিন। তাও এতকিছু নিয়ে এসেছেন দেখে একটু খারাপও লাগল। তারপরও অনেক দিন পর দেখছি বাবা মাকে এটা ই বা কম কিসে। আমি কথা বলে নাস্তা বানাতে গেলাম। রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলাম হঠাৎ পেছনে মা আসলেন। আর বললেন এসব পাঠানোর কি দরকার ছিল আমরা কি চেয়েছি কখনো! তার উপর ঈদের আগের দিন মেয়ের বাড়িতে আসা সেটাও তো কেমন লাগে। আমি বুঝলাম না মা কিসের কথা বললেন। মা এসব আস্তে আস্তে বলছিলেন। আমার শাশুড়ি এসে পড়ায় চুপ হয়ে গেলেন।
কিন্তু আমার মাথায় এখনো ঢুকছে না কি বলছিলেন মা আর কি পাঠালাম আমি। নাস্তা নিয়ে গেলাম সেখানে সবাই গল্প করছেন। চা খেতে খেতে ই বাবা বললেন, এসব লাগবে না আর এসব নেই কিভাবে বলুন তো বেয়াই। কেমন দেখায় না এটা..! এসব কথা বলাতে ই আমার শাশুড়ি সেখান থেকে উঠে গেলেন। বাবা বা আমরা বুঝতে পারলাম না কি হল। বাবা বলছেন কোনো ভুল হয়ে গেল কি! এসব ভাবতে ভাবতে ই আমার শাশুড়ি মায়ের আগমন ঘটল। হাতে বেশ কয়টা ব্যাগ নিয়ে আসলেন। আর আমাকে বললেন এই ব্যাগ গুলো যেন নিজ হাতে আমি আমার বাবা মা’কে তুলে দেই। বাবা মা দুজনে ই মানা করছিলেন। সবকিছুর পরে আবার এসব কেন।
তখন ই বললেন এগুলো তো আমাদের কিছু না। এসব আপনাদের হক। একজন সন্তানের কাছে বাবা মায়ের যে হক থাকে সে হক থেকে এগুলা আপনাদের পাওনা। আপনার মেয়ের উপার্জনের টাকায় এগুলা কেনা হয়েছে বেয়াই এখানে আমার বা আমার ছেলের কোনো কিছু নেই। কথাটা শুনে কেমন জানি একটা আনন্দের বাতাস বয়ে গেল মনে। অনেক ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠল। বাবা নিতে না চাইলে আমার শাশুড়ি দিলেন। তখন বাবার চোখে পানি দেখতে পেলাম। বাবার চোখে পানি দেখে কোনো এক অজানা কারণে আমার চোখে পানিতে ঝাপসা হয়ে গেল।
বাবা বললেন মা রে এ জল শোকের নয় সুখের। আমি জানি আমার ছেলে নেই তাই বলে কখনো আফসোস করিনি যা ছিল তাতে ই খুশি ছিলাম আমার ঘরের রাজকন্যাদের নিয়ে। তাই হয়ত ঐ উপরওয়ালা এত খুশি হয়ে আজকের মত একটা দিন উপহার দিয়েছেন আর দিয়েছেন এরকম একটা মানুষ। জানতে পারলাম আমার সব সেলারি মিলিয়ে আমার শাশুড়ি আমার বাবা মাকে দিয়ে দেন কিছুটা রেখে। আর এই রাখা অংশ থেকে আজকে সকালে এতিমখানার জন্য কাপড়চোপড় আর বাকিটুকু ঘরের সবার জন্য। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তখন শাশুড়ি আবার বললেন আর নেব না মা তোর টাকা শুধু এতটুকু করার জন্য এমন করেছি। এখন সব টাকা পাওয়ার পর ই তোমার বাবার মোবাইলে বিকাশ করে দিবে।
এমন কি হয় কখনো মা..! আমি যতটুকু করার তার থেকে বেশি তুমি করেছো মা আমি কি পারতাম এসব করতে। এত গুছিয়ে সবকিছু তো একজন মা ই পারেন। আর মা থাকতে কেন মেয়ে এসব দায়িত্ব নিবে..! যেমন আছে তেমন থাক। এসব কথা বলছিলাম আর খুব করে কান্না করছিলাম। একজন মেয়ের সব লুকানো ব্যথা একজন মেয়ে ই বুঝতে পারে শুধু দেখতে হয় মন দিয়ে। আমার কান্না দেখে আমার তিন বাবা মাও কাঁদছিলেন। এই ঈদের মত এত খুশির ঈদ আর আসে নি জীবনে আমার..! খুব করে ভালো থাকা যায় এমন মানুষ নিয়ে….
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত