ধ্রুবতারা

ধ্রুবতারা
কলা ভবনের সামনে গত আধা ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে আছি। বাইরে আজকে ঊনচল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রা। মধ্য দুপুরে এমন কড়া রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে আমার প্রচন্ড মাথা ধরে সেই ছোটবেলা থেকেই। এখনো সমস্যাটা রয়ে গিয়েছে। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো একদল মেঘ সূর্যটাকে আপাতত ঢেকে রেখেছে। মোবাইলটা টুং টাং করে বেজেই যাচ্ছে। প্রতি পাঁচ মিনিটে মোবাইলে একটা করে মেসেজ আসছে, “আর বিশ মিনিট”, “আর পনেরো মিনিট”। রাগ করেও যেন আর রাগ করতে পারছি না। কারণ আমি জানি মেসেজের পেছনের ব্যক্তিটি এই আধা ঘণ্টার দেরিতে ইতোমধ্যেই কতটা বিচলিত হয়ে গিয়েছে। এসব মানুষের সাথে রাগ করা যায় না, শুধু সামনে আসলে নাক ফুলিয়ে অভিমানের অভিনয় করতে হয়।
রাগ না হলেও এখানে দাড়িয়ে থাকতে কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ হচ্ছে ঠিকই। এখানকার পরিবেশ, মানুষ, গাড়ির শব্দ, প্রতিটি ধূলিকণা আমাকে প্রচণ্ড নস্টালজিক করে তোলে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে এখানে এক মুহূর্তও দেরি করি না কখনো। শেষ এখানে এসেছিলাম আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর পাঁচ মাস বাইশ দিন আগে। বসন্তের এক ভরদুপুরে নীল শাড়ি পড়া চব্বিশ বছরের আমি লাজ শরমের মাথা খেয়ে, চিরদিনের জন্য নিজের করে পাওয়াএ আশায় মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে অর্ণবকে চিৎকার করে বলেছিলাম, “ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”।
সেদিন আবহাওয়াটা ছিল আজকের মতো। মেঘে ঢাকা আকাশ, চারদিকে মৃদু বাতাস, আর দূর থেকে ভেসে আশা বাসন্তী ফুলের হালকা ঘ্রাণ। তবে তাপমাত্রা ছিল বেশ কম। অথচ অমন শীতল পরিবেশেও আমি দরদর করে ঘামছিলাম অর্ণবের বিরক্তি মাথা শীতল চেহারাটা দেখে। মাথাটা ভো ভো করে ঘুরছিল, যেন যেকোনো মুহূর্তে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো। কয়েক সেকেন্ডের দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে সে সাফ জানিয়ে দিলো, “এখন সম্ভব না, শশী।”
মুহূর্তেই আমার সময় থেমে গেলো। আমি বিস্মিত, হতাশ, এবং নির্বাক হয়ে অর্ণবের কথা শুনতে লাগলাম। একটি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কি অবলীল ভাবে কথাগুলো সে বলে গেল। সিগারেটটা যেন আমার পুড়ে যাওয়া হৃদয়ের একটা প্রতীক ছিল। কমিটমেন্ট করা তার পক্ষে সম্ভব না। তখন কি তার কমিটমেন্ট করার সময়? সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা একটা ছেলের তো তখন ঘুরে বেড়ানোর সময়, দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখার সময়, লাইফটা এনজয় করার সময়। লাইফে এত ইম্পালসিভ ডিসিশন যে নেয়া যায়না। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই অর্ণব আমাকে কি সুন্দর করে জীবনের একটা বড় শিক্ষা দিয়ে দিলো।
অর্ণব যেই সময়ের কথা বলছে, সমাজের চোখে আমার সেই সময় গত হয়েছে অনেক আগেই। আর আমার প্রগ্রেসিভ পরিবারের চোখে তা একদম সীমানার কাছে। তবুও দৃঢ় কণ্ঠে শীতল ভাবে বললাম, “I can wait, I will wait. Take your time.” অর্ণব সিগারেটে শেষবারের মতো টান দিল। এরপর তা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। আমি নিজেকে মাটিতে পিষে যেতে দেখলাম। তাচ্ছিল্যের সুরে, “As your wish” বলে অর্ণব হনহন করে হেটে চলে গেলো। একটাবারের জন্যও আর পেছন ফেরেনি। আমি জানতাম, এই যাওয়াই শেষ যাওয়া। তবুও কেনো যেন থামালাম না। শুধু দেখে গেলাম।
অর্ণবের সাথে আমার পরিচয় ভার্সিটিতে। সবেমাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। এরই মধ্যে ডিপার্টমেন্টের একটা প্রোগ্রামের আয়োজন শুরু হলো। ইংলিশ মিডিয়াম থেকে পাশ করা এলিট ক্লাসের ফ্রেশার হওয়ার সুবাদে একরকম জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। আমিও প্রোগ্রামে পারটিসিপেট করতে গানের দলে যোগ দিলাম। সেখানে পরিচয় অর্ণবের সাথে। ডিপার্টমেন্টে একজন জনপ্রিয় ভোকাল ও গিটারিস্ট। সেই সময়ের প্রচণ্ড স্টাইলিশ এবং ট্রেন্ডি একটা ছেলে। বলা যায় ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের অন্যতম একজন হার্টথ্রব।
রাজনীতি সহ নানা ধরনের গেঞ্জামে আমাদের ঐ প্রোগ্রামটা প্রায় সাড়ে ছয় মাস পিছিয়ে যায়। এরই মধ্যে প্রোগ্রামের সুবাদে সিনিয়র জুনিয়রদের সাথে বেশ খাতির হয়ে যায়। আমি, অর্ণব সহ প্রায় ১২ জনের একটা দল সবসময় একসাথেই থাকতাম। ক্লাস, পরীক্ষার প্রেশার কুকারে রফিক মামার চায়ের দোকান যেন আমাদের ছোট্ট একটা স্বপ্নপুরি। প্রতিদিন সবাই একসাথে মিলে গান, আড্ডা চলে সন্ধ্যারও অনেকটা সময় পেরিয়ে। এরই মধ্যে আমাকে আর অর্ণবকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়। হবেই না বা কেনো? বন্ধুত্বের ফাঁকে ফাঁকে কখন যে আমাদেরও একটা আলাদা জগত তৈরি হতে থাকে নিজেরাও বুঝিনি। আমার ক্লাসের বাইরে অর্ণবের অধীর অপেক্ষা, আমার ওর জন্য বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে দুপুরের খাবার নিয়ে আসা, দুজনের পাশাপাশি বসে থাকা সবই তো স্বচ্ছ কাঁচের মতো দৃশ্যমান ছিল সবার কাছে।
অর্ণবকে আমি যতই দেখতাম মুগ্ধ হতাম। ওর ভরাট কণ্ঠে গাম্ভীর্যপূর্ণ কথা, সামান্য বোঁচা নাক, মায়া ভরা চাহনি, সাবলীল হাসি সব কিছুই আমাকে নেশার মত কাছে টানতো। এই মুগ্ধতা কবে যে পেটের মধ্যে প্রজাপতিদের উড়ে বেড়াতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নিজেও টের পাইনি। জীবনের প্রথম ভালোবাসা, আহা সে কি অনুভূতি! বর্ষার মৌসুমে সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা কেমন অন্ধকার হয়েছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ব্যস্ত হয়ে আমি রিকশা খুঁজছি বাসায় যাব বলে। হঠাৎ অনুভব করলাম মাথার উপর কে যেন ছাতা ধরেছে। তাকাতেই দেখি অর্ণব। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠল, “চলো হাটি”। আমরা পাশাপাশি হাঁটছি, বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তায় জনগণ কমে যাচ্ছে। হঠাৎ অন্য ছাতাটা ফেলে দিয়ে অর্ণব আমার হাত ধরে লিয়নেল রিচির এন্ডলেস লাভ গানটা গেয়ে ওঠে। এতক্ষণে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে, শহরের কোলাহল থেমে গিয়েছে। অর্ণব গান গাচ্ছে, আমরা দুইজন মাঝ রাস্তায় হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজছি, সদ্য শেখা ভুলভাল বোলেরো ডান্স করছি। সেদিন আমি একদম ভেঙেচুরে সেই মানুষটার প্রেমে পড়েছিলাম।
ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামেও এই গানটা দিয়ে দুজন একসাথে পারফর্ম করলাম। আমাদের প্রেম ভার্সিটিতে ততদিনে ফেমাস। আমরা দুইজন ভাবি কাপলদের স্টার আইডল। অর্ণব আর আমি প্রতিদিন দুজন দুজনকে প্রেমপত্র লিখতাম। সময়ের তুলনায় আমি বেশ প্রিভিলেজড ছিলাম। বাসায় তখন আমাদের দুইটা টিএনটি ফোন, একটা ড্রইং রুমে আর একটা আমার ঘরে। অর্ণব রোজ পৌনে এগারোটায় আমাকে ফোন দিত। হাবিবের দোকানে বসে এক কাপ চা এবং সিগারেট শেষ করতে করতে অন্য ঘড়ি ধরে পনেরো মিনিট আমাদের প্রতিদিন কথা হতো। আমাদের প্রেমের নৌকা চলতে থাকে। ফোনে কথা বলার সময় খেয়াল করি, আমার রুমের বাইরে আম গাছে একটি মাকড়সা খুব যত্ন নিয়ে তার ঘর বুনছিল, ঠিক যেমন আমি অর্ণবকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিলাম।
অর্ণবের চলে যাওয়া আমার রৌদ্রজ্জ্বল জীবনে কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো বয়ে গিয়েছিল। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে নাকে মুখে গ্র্যাজুয়েশন এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি। ততদিনে আমার বাসায় আমার বিয়ে নিয়ে রীতিমতো এলাহি কান্ড। রোজ রোজ ঝগড়া বিবাদে অতিষ্ঠ হয়ে মাকে সব খুলে বলার সিদ্ধান্ত নেই। ভেবেছিলাম মা আমার কষ্ট বুঝবে। মা বুঝেছিল ঠিকই, তবে নিজের মত করে! এরপর থেকে শুরু হয় আমাকে সবার থেকে লুকিয়ে অমুক তমুক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া, পানিপড়া খাওয়ানো আরও কত কি। আর প্রতিদিন সবার তাচ্ছিল্যে, খোটা, বকাঝকা তো ডাল ভাতের মতোই ফ্রি ছিল। যখন কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হলো না, তখন সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঘরের রাজকন্যা তখন ঘরের বোঝা। পরিবারের সাথেই থাকি, অথচ একটা জড় বস্তুর থেকেও নিকৃষ্ট আমার জীবন। তখন বুঝেছিলাম, আমরা প্রতিটা মানুষ আসলে দুনিয়াতে কত একা।
মনকে ডাইভার্ট করতে অনেক সাহস করে সিদ্ধান্ত নিলাম পিএইচডি করবো। কিন্তু এবার পরিবার এবং আত্মীয়দের সবাই নাছোড়বান্দা। একা একটা মেয়েকে কিছুতেই তারা একা বিদেশে যেতে দিবে না। নব্বইয়ের শেষের দিকেও মেয়েদের জীবনটা এখনকার মতো সহজ ছিল না। আমার প্রগ্রেসিভ পরিবারও তার ব্যতিক্রম না! মেয়ে বিদেশ যেতে চাইলে যাক, তবে সাথে একজন পুরুষ রক্ষী লাগবে কি না! যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত আমি তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। তখন থেকে ধ্রুব আমার জীবনে।
ধ্রুব আসার পরেও অবশ্য আমি অর্ণবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি বহুবার। ওর দেয়া মেসের ঠিকানায় মোট তেত্রিশটা চিঠি দিয়েছিলাম। আর সেই হাবিবের দোকানের নাম্বারে কল দিয়েছিলাম অগণিতবার। কোনো জায়গা থেকেই কোনো উত্তর মেলেনি। আমার সাথে যোগাযোগ আছে এমন কারো সাথে অর্ণব কোনো যোগাযোগ রাখেনি। একজনের থেকে শুনেছিলাম ও নাকি বিয়ে করে ক্যানাডায় স্যাটল। এরপর আমি আর যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করি নাই।
সেই বছর আমার আর পিএইচডির জন্য যাওয়া হয়নি। বাবার ক্যান্সার ধরা পড়াতে তাকে দেখাশোনার জন্য দেশেই থেকে যাই। কয়েক বছর পর বাবা মারা যান। আমাদের জীবনটা কেমন যেন অগোছালো হয়ে যায়। বিশেষ করে মা একদম ভেঙে পড়ে। তার কি হয়েছিল যে জানে, তবে বারা মারা যাওয়ার পর থেকে মা যেন আমার কষ্টটা আমার থেকেও বেশি অনুভব করতে শুরু করে।
ধ্রুব আর মাকে সাথে নিয়েই কয়েক বছর পর পিএইচডি কমপ্লিট করে, মায়ের আবদার রাখতে আবার দেশে ফেরত আসি। আমাদের ছোট্ট একটা দুনিয়ায় বেশ ছিলাম। শুনেছিলাম, ভালো সময় খুব বেশি দিন থাকে না। মা মারা যাওয়ার পর আবার সেই সাজানো দুনিয়াটা মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে যায়। মা মারা যাওয়ার পরদিন কেনো যেন জীবনের যতকিছু ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে ফেরত আসে চোখের সামনে। সেদিন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে করে কেঁদেছিলাম। আমাকে দেখে ধ্রুবও কান্নাকাটি জুড়ে বসে। সেদিন ধ্রুব প্রথম অর্ণবের কথা জানতে পারে এবং সেটাই শেষ। অর্ণবকে নিয়ে ধ্রুব দ্বিতীয়বার আমাকে কোনোদিন প্রশ্ন করি নাই। মা মারা যাওয়ার পর জমির একদফা ঝামেলা মিটিয়ে আমি আর ধ্রুব সবার থেকে দূরে নিজেদের ছোট্ট একটা বাসায় শিফট করি। সেই থেকে আমি আর ধ্রুব দুইজন দুইজনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আহি, ভালো আছি, খুব বেশি ভালো আছি।
আকাশের মেঘ সরে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। সূর্যের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সূর্যের তাপেই নাকি পুরনো নষ্ট স্মৃতি ঘেঁটে সেটা ঠিক বুঝতে না পারলেও, মাথাটা যে ব্যথায় টনটন করছে তা হারে হারে টের পাচ্ছি। হঠাৎ বুঝতে পারলাম ধ্রুব পাশে এসে মাথার উপর ছাতা ধরেছে। আমি ওর দিকে তাকাতে না তাকাতেই রাগ করে বলে উঠলো, “আম্মু তোমাকে না বলেছি বাইরে ছাতা নিয়ে বের হবা? কোনো কথাই শুনো না তুমি”। নিজে দেরি করে এসে আবার আমাকেই রাগ দেখাচ্ছে লাটসাহেব। আচ্ছা সেলুকাস তো! ধ্রুব অবশ্য আমার রাগ ভাঙানোর প্ল্যানও করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। গরম খিচুরি দিয়ে লাঞ্চ করে, এক প্লেট ঝাল ফুচকা খাওয়ার পর আইসক্রিম খেতে খেতে মা ছেলে হুড তোলা রিক্সায় গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যাবো।
ফুচকা আর আইসক্রিমের প্ল্যানটা আমাদের জীবনে অবশ্য আমাদের একটা রেগুলার এক্টিভিটি হয়ে গিয়েছে। তবুও কখনো একঘেয়েমি লাগে না। বিশ বছর আগে যখন আমাকে সবাই জীবনে পুরুষসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে ব্যস্ত, তখন আমি সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ধ্রুবকে এতিমখানা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। “জীবনে ইম্পালসিভ ডিসিশন নিতে হয় না”, অর্ণবের দেয়া এত বড় শিক্ষার পরেও কেনো যেন নিজেও ইম্পালসিভ ডিসিশনটা নিয়ে নেই। ভেবেছিলাম আমার মা হওয়ার এই বোল্ড সিদ্ধান্তে সবাই নড়েচড়ে চুপ হয়ে যাবে। হয়েছিল এর উলটো। সমাজের আক্রমণ আমাদের উপর তখন এট্যোম ব্যোমের মতো পড়েছিল। ধ্রুবকে নিয়ে সমাজের বিপক্ষে আমার যুদ্ধ ইতিহাসের অলিখিত অন্যতম কঠিন একটা যুদ্ধ ছিল, সেটা আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি।
ধ্রুবকে যখন আমাদের বাসায় নিয়ে আসি, ওর বয়স তখন তিন। ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে, মা পরকীয়ায় করে পালিয়েছে আর বাবা নেশাখোর জুয়াড়ি আর ধ্রুবর ভাগ্যে জুটেছে এতিমখানায় অল্প একটু ঠাই। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম একদম নবজাতক কাওকে নিতে। কিন্তু ধ্রুবর মায়া ভরা চোখে মনটা কেনো যেন আটকে যায়। মনে হয়েছিল আমরা দুইজন যেন একই। ধ্রুব তখন স্পষ্ট ওর নাম, ঠিকানা, বাবা মায়ের নাম পরিচয় বলতে পারে। আমি ভালো নাম পরিবর্তন করি নাই, জোর করে মা ডাকানোর চেষ্টাও করি নাই কোনদিন। শুধু ডাক নাম দিয়েছিলাম ধ্রুব। আমার অমাবস্যার আকাশে ছোট্ট একটা ধ্রুবতারা।
না! ধ্রুবকে আমি অর্ণবের মতো হুট করেই ভালোবাসতে পারি নাই। সময় লেগেছে অনেক। পারেনি ধ্রুব নিজেও। প্রথম কয়েক বছর আমাকে সে নাম ধরে ডাকতো। মা বলতো না দেখে সমাজের লোকেরা যেন আমাদের অপমান করার, খোটা দিয়ে কথা বলার আরও একটি সুযোগ পেয়েছিল। অন্যের রক্ত কি আর নিজের নাড়ি ছেড়া ধন হয় নাকি? তবে ধ্রুবকে যেদিন থেকে চিনেছি, জেনেছি, ভালোবেসেছি, সমাজের বাঁধাধরা নিয়মকে সেদিন থেকে মিথ্যা জেনেছি। হৃদয়ের সাথে যেই সুতো দিয়ে আরেকটি হৃদয় বাঁধা তা নাড়ির টান থেকে কোনো অংশেই কম মজবুত না। আমার কাঁচের মতো চুরমার হয়ে যাওয়া মনকে ধ্রুব একটু একটু করে জোরা লাগিয়েছে, যত্ন করে আগলে রেখেছে এতগুলো বছর।
হঠাত খেয়াল করলাম রিক্সা দিয়ে যাওয়ার সময় এক লাজুক মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে ধ্রুবকে দেখছে আর মুচকি হাসছে। কৌতূহল বসত পাশে তাকিয়ে দেখি আমার ধ্রুবও আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে মেয়েটার সাথে চোখে চোখে কত কথা ফেললো এই অল্প সময়েই। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। আমার ছোট্ট ধ্রুবটা বড় হয়ে গিয়েছে। ওর পাশে এখন আরেকটা তারা সঙ্গী হবে। আমার জন্য ধ্রুবর সময় ভাগ হয়ে যাবে। আমি আবার একলা হয়ে যাবো। ভাবছি এই একলা সময়ে লেখালেখি শুরু করবো। নাকি একটা কুকিং ক্লাস চালু করে দিব? ধ্রুবর সাথে এই নিয়ে পরে কথা বলতে হবে। আপাতত মা ছেলের ফুচকা আর আইসক্রিমের প্ল্যানটা এক্সিকিউট করা যাক।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত