শুকনো পাতা

শুকনো পাতা
মেয়েটিকে আমি এই নিয়ে চার বার দেখতে আসলাম। বিয়ের জন্য একটা মেয়েকে চারবার দেখতে আসা ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি এতে বেশ মজা পাচ্ছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো খুবই বিরক্ত হতো, নয়তো আসতইনা। কিন্তু আমি বেহায়ার মতন ঠিকই আসছি। মেয়ের বাবা মা কিছুটা লজ্জিত তাদের মেয়েকে না পাওয়ার কারণে। মেয়ের বাবা মানে আংকেল আমার কাছে আসলেন। লজ্জিত সুরে বললেন….
–আসলে বাবা আমি খুবই দুঃখিত। মেয়েটা আজও বাসায় নেই, একটু বাইরে গেছে।
-ঠিক আছে সমস্যা নেই আংকেল।
–সমস্যা নেই বললেতো আর হয়না! এই নিয়ে চার বার আসলে তুমি। ব্যাপারটা আমার কাছে কতটা লজ্জাজনক সেটা আমিই বুঝতে পারছি। আসলে আমি কিভাবে বলব বুঝতে পারছিনা।
-হা হা, এত টেনশন নিয়েননা আংকেল। আমার যে খারাপ লাগছে তা না, বেশ ভালোই লাগছে। আমার কথায় মনে হয় আংকেল কিছুটা লজ্জা পেলেন। আংকেল বললেন….
–মেয়েটাকে কত করে বললাম আজ কোথাও যাসনা অথচ দেখো সে তুমি যেদিন আসবে সেদিনই বাইরে চলে যায়।
-কিছু বলে যায়না?
–তাতো বলেই, তবে ওসব আমলে নেইনা।
-কি বলে?
–কি আর বলবে, পাগলি মেয়ে আমার৷ যখনই বিয়ের কথা ওঠে তখনই হুংকার দিয়ে বলবে, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি কুরবানি হতে চাইনা, আমি বিয়ে করবনা৷’
-হা হা ইন্টারেসটিং তো, বিয়ে হলেই বুঝি কুরবানি হয়ে যায়!
–আমার মেয়েটা এরকমই বাবা। অনেকটা পাগলি টাইপ, তবে মনটা অসম্ভব ভালো৷
তখনই আন্টি চা নিয়ে আসলেন। আন্টি জানে আমি চা খাইনা তবুও চা আনেন। আমিও চা ঠান্ডা হয়ে গেলে এক চুমুকে খেয়ে ফেলি৷ প্রথম যেদিন এক চুমুকে চা খেলাম আন্টি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আমি মুচকি হেসে বললাম….
–আমি আসলে গরম চা খাইনা, খাইনা বলতে খেতে পারিনা। জিহ্বা পুড়ে যায়৷ তবে আপনার হাতের চায়ে যে জাদু আছে এটা টের পেয়েছিলাম। তাই ঠান্ডা হওয়ার সাথেসাথে লোভ সামলাতে পারলামনা। এক চুমুকে খেয়ে ফেললাম। অনেক সুন্দর হয়েছে চা টা, আন্টি আপনার হাতে কি জাদু আছে বলতে হবে। সেদিন আন্টি আমার কথায় খুশিতে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন। হয়তো সামান্য একটা চায়ের জন্য কেউ এভাবে প্রশংসা করেনি। মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। সামান্য প্রশংসায়, কৃতজ্ঞতায় এরা চোখ ভিজিয়ে ফেলে। আন্টি সেদিন কাপ নিয়ে চলে গেলেন। তারপর থেকে আমি চা না খাওয়া পর্যন্ত আন্টি জায়গা থেকে যাননা। আমিও প্রতিদিন নিয়ম করে চায়ের প্রশংসা করতাম। আন্টিও বেজায় খুশি। আজ চা খেয়ে আন্টিকে বললাম….
-আন্টি একটা কথা বলব? রাগ করবেন না কিন্তু? আন্টি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। আংকেল মনে হয় বেশ মজা পেলেন৷ তিনি মুচকি হেসে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালেন, আমি কি বলতে চাই সেটা শোনার জন্য। আন্টি বলল….
–হ্যাঁ বাবা বলো?
-আমায় আপনি জাদু শেখাবেন?
–ওমা আমি আবার কি জাদু করলাম ?
-এইযে জাদু দিয়ে এত সুন্দর চা বানান আমার এত ভালো লাগে বলে বোঝাতে পারবনা। আমার খুব ইচ্ছে করছে আপনার কাছ থেকে চা বানানো শেখার, শেখাবেন?
–পাগল ছেলে কি যে বলোনা তুমি! বলেই আন্টি চলে গেলেন। আন্টিযে বেশ লজ্জা পেয়েছে এটা বোঝা গেলো। আংকেল মুচকি হেসে বললেন….
-বাহ! আন্টিকে দেখছি সহজেই হাত করিয়ে নিলে।
–মোটেই না, আন্টি আসলেই অসাধারণ চা বানায়। আমার কথা শুনে আংকেল হেসে ফেললেন। আমি বিষয়টা এড়িয়ে যাবার জন্য বললাম….
–ও আসবে কখন?
-কে! তরী?
–হ্যাঁ।
-কি আর বলব, তুমি যেদিন যেদিন আসো সেদিন তো সন্ধ্যার পরই আসে এর আগে বাসায় ফিরেনা। ওর বিশ্বাস ও বাসায় এলেই তোমার সাথে বিয়ে দিব। হা হা..!
–আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলে কি আপনাদের সমস্যা হবে? আংকেল কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন। পরক্ষণেই বললেন….
-না তা হবে কেন বড়ং আরো ভালো হয়। এই সুযোগে তোমার সাথে আড্ডা দেওয়াও হবে।
–আচ্ছা।
মা আগেই বলে রেখেছিল আমার চাকরি হলেই বিয়ে দিবে। আর বিয়ে তার পছন্দ করা মেয়েকেই করতে হবে। এতে আমার কোন আপত্তি ছিলনা। কারণ আমি জানি মা আমার জন্য পারফেক্ট কাউকেই নির্বাচন করবেন। তো চাকরি হওয়ার পরেই মা উঠে পরে লাগলেন আমায় বিয়ে দেওয়ার জন্য। একসময় রাজি হয়ে গেলাম, মা আগেই পাত্রী ঠিকঠাক করে রেখেছিল। আর পাত্রী এক হিসেবে আমাদের আত্মীয় মায়ের ভাস্যমতে। কারণ পাত্রী হলো বাবার বন্ধুুর ভাইয়ের শালার মেয়ে। হা হা হা… কি অদ্ভুত।
মা ঠিকানা দিয়ে বললেন যাতে আমি একাই মেয়ে দেখতে যাই। কারণ মা এর আগেও কয়েকবার এসে দেখেছেন। ভাবা যায় নিজের ছেলের বউ আগেই ঠিক করে রাখা ছিল। আমি যেদিন যাব সেদিন ফোন করেই গেছিলাম বাট পাইনি। তারপর থেকেই এই অবস্থা আমি যাই পাত্রী হাওয়া। তবে ভালোই লাগে, আমার মনে হয়েছিলো মেয়েটা লুকোচুরি খেলছে। আমিও নাহয় তালমিলাই একটু! সন্ধ্যার একটু আগেই মেয়েটি বাসায় ফিরলো। আমি তখন আঙ্কেলের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। আমি অনেকটা না দেখার ভান করলাম। তবে বুঝলাম যে মেয়েটি রুমে যেতে-যেতে আমায় আড়চোখে দেখছিলো। মেয়েটি আমার সামনে বসা। কথাটা মনে হয় ভুল। কারণ আমিই মেয়েটার সামনে চেহারে বসা। চেয়ারের হাতলে মোটা মার্কার পেন দিয়ে ছোট করে লেখা ‘তরী+তন্নি।’ মেয়েটার নাম কি দুটো? নাকি আরেকটা বোন আছে। বোন থাকলেতো সেটা আমি জানতাম। মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল….
–তন্নিই আমার নাম তরীও আমার নাম।
-বুঝলামনা।
–চেয়ারের হাতলে যে নাম লেখা আছে ‘তরী + তন্নি’ দু’টো নামই আমার।
-ওহ।
মেয়েটাকে এর আগে দেখেছিলাম ফ্যামেলি ফটোতে। প্রথমদিন ছিল সেদিন। সেই ছবিটা মনে হয় বছর তিনেক আগের। তিনবছরে মেয়েরা অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়৷ কারণ আমার সামনে যে মেয়েটা বসা তারসাথে ছবির বেশ বৈষম্য রয়েছে। ছবির মেয়েটির থুতনিতে কোন তিল নেই অথচ সামনের মেয়েটির থুতনিতে একটা তিল রয়েছে। ছবিতে ধবধবে ফর্সা লাগলেও সামনাসামনি অত ধবধবে ফর্সা নয়, তবে শুধু ফর্সা। অদ্ভুত বিষয় হলো মেয়েটির এক কানে ঝুমকো কানের দুল আরেক কান খালি। মেয়েটি আমায় বলল….
–চশমা পরেন কতদিন?
-তিন মাস হলো সবেমাত্র।
–আপনি যে এই নিয়ে চার বার আমায় দেখতে আসলেন বিরক্ত হননি?
-উহু, বিরক্ত হইনি ভালো লেগেছে।
–ভালো লেগেছে? সেটা কেমন?
-জানিনা, তবে বিরক্ত হইনি। প্রতিবারই মনে হয়েছে যে আমি প্রথমবার এসেছি।
–আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবনা।
আমি বেশ অবাক হলাম। হুট করে এমন কথা শুনব সেটা কল্পনাও করিনি কখনো। আমার মনে হলো মেয়েটি কিছুই বলেনি। আমি ভুল শুনেছি। মেয়েটি আবার বলল….
-আমি সত্যি সত্যি আপনাকে বিয়ে করতে পারবনা।
–ওহ তাহলে কি আমি চলে যাব?
-কেন যাবেন?
–আপনি বিয়ে করতে পারবেন তো আমি থেকে কি করব!
-আমি রান্না করতে পারিনা, তাই না করেছি। কারণ হয়তো বিয়ের পর রান্না করতে পারবনা তখন ব্যাপারটা কেমন হলোনা। আমি আকাশ থেকে পরার মতন অবস্থায় হলাম। এই মেয়ে বলে কি! সামান্য রান্না পারেনা জন্যে বিয়ে করতে রাজি নয়। নাকি অন্য কারণ আছে। আমি বললাম….
–রান্না সেটা শিখে যাবেন।
-আমার ইচ্ছে করেনা।
–খিচুরি রান্না করতে পারেন?
-অকর্মার ঢেকি আমি।
–আলু ভর্তা আর ডিম ভাজিতো করতে পারেন?
-হুম এটা পারি।
–তাহলেতো হলোই, প্রতিদিন রোজ তিন বেলা নিয়ম করে আলু ভর্তা ডিম দিয়ে নাস্তা করব।
-হয় হয়, আর তখন ডিমের মতন হয়ে ডিম বাবু হয়ে যাবেন।
–হা হা তা নাহয় হলাম। তবে খিচুরি রান্না আমি করতে পারি। খুব ভালো পারি৷
-আপনার মা বলেছে। আমার কাছে যতবার এসেছে ততবারই আপনার খিচুরির প্রশংসা করেছে। আপনার খিচুড়ি নাকি পৃথিবীর সেরা খিচুরি।
–মায়েরা কখনো মিথ্যা বলেনা।
-ইসসস নিজেই নিজেকে পাম দিচ্ছেন।
–তা একটু দিই মাঝেমাঝে। তবে মা আপনার সাথেও কথা বলেছে দেখি!
-সারাক্ষণ তো আমার সাথেই বলে কথা। শুধু যাওয়ার সময় মা-বাবার সাথে সামান্য কথা বলে চলে যান।
–আমাকে কিছুই বলেনি।
-হুম, আর আপনার মা-ই বলেছে আমায় রান্না না করতে।
–সেটা কেন?
-উনি নাকি আমায় নিজ হাতে রান্না শেখাবেন তাই।
–তলেতলে এতদূর?
-আর আপনি যে ৪ দিনেই আমার অবলা মাকে পটিয়ে বসে আছেন সেটা কতদূর।
–আমি আবার কি করলাম?
-কি আর করবেন। মা’র চায়ের প্রশংসা করেছেন। সেতো সবসময় আপনার কথা বলে। কান ঝালাপালা করে ফেলে বাপরে। আর বাবা সেতো রুবেল বলতেই পাগল। এমন ছিল নাকি বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবেনা।
–হা হা তাহলে মজার ব্যপার সবাই এত প্রশংসা করছে।
-হুম তাতো করবেই।
–আপনার বেলায় রুবেল কে?
-ভাবিনি।
–সময় নিবেন?
-উহুম।
–চলে যাব?
-অনিচ্ছা শুরু হলো বুঝি?
–আমার তাড়া আছে একটু।
-যান।
–আচ্ছা আমি যদি একটু পর একটা কানের দুল নিয়ে এসে আপনার সামনে দাঁড়াই সেটা কি পরবেন? আমি চাই আপনার সব কিছু পরিপূর্ণ থাকুক। মেয়েটি আমার কথায় বেশ হকচকিয়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। সে যে কথার জালে আটকা পরেছে বোঝা গেলো। আমি আবার বললাম….
–এক গুচ্ছ বেলিফুলের মালা নিয়ে এসে যদি সামনে দাঁড়াই রাগ করবেন কি? নাকি খোঁপায় বেলিফুল গুজে দেওয়ার অনুমতি দিবেন?
-(সে নিশ্চুপ)
–বলুন….!
-কানের দুল তো পাবেননা। এটা অনেক খুঁজেছি আমি পাইনি, তাইতো একটাই পড়ছি।
–আরেক কানের দুল যদি আমি হই?
-আমার ঝুমকো কানের দুল লাগবে।
–সেটা যদি আনতে পারি?
-দুল পরিহীতা মানুষটা আপনার।
বলেই মেয়েটি মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। এই মুহূর্তে আমি মেয়েটাকে একদম কাছ থেকে লক্ষ করলাম। তার মুখে এখনো মৃদু হাসি। ঠোঁট টিপে হাসি যাকে বলে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। যেভাবেই হোক আমার একটা ঝুমকো কানের দুল কিনতে হবে ঠিক সেইরকম। কারণ দুল পরিহিতা মানুষটাকে আমার প্রয়োজন। বড্ড বেশি প্রয়োজন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত