হরি মাস্টার

হরি মাস্টার

বাড়ির দরজায় সাইকেলটা কোনো মতে ঠেসিয়ে ক্লান্ত,বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের ছোট্ট দশ বাই আট এর রুমে ঢুকলো হরি মাস্টার।হরি কোনো স্কুল বা কলেজের মাস্টার

না,একজন ছাপোষা সাধারণ টিউশন মাস্টার,তাও লোকে তাকে হরি মাস্টার বলেই ডাকে।হয়তো কিছুটা বিদ্রুপের ছলেই।পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলি,হরি একজন তিরিশ

বছর বয়সি শিক্ষিত বেকার।হায়ার সেকেন্ডারি,গ্র্যাজুয়েশন,এমএসসি সবেতেই ভালো রেজাল্ট আছে তার,নেই কেবল একটা চাকরি।ছোট্ট একটি একতলা বাড়িতে মা

আর তার বাস।তাদের সংসার চলে তার দু চারটে টিউশনের জোরে।আজ অনেক আশা করে চাকরির ইন্টারভিউর রেজাল্ট দেখতে গিয়ে ফিরতে হলো সেই হতাশ হয়ে ।

এক মাস আগে হওয়া ইন্টারভিউটা সে খুব ভালো ভাবেই দিয়েছিলো ,তবে এখন চাকরি তো আর ইন্টারভিউর জোরে হয় না।হয় মামা-কাকা,আর ওপরমহলের

জোরে,যা তার নেই।তাই এবারও হলো না।বাড়ি ফিরেই নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়লো সে। আর তার মাথায় ভিড় করতে থাকলো পুরুনো দিনের

সবকথা, সেই মাধ্যমিকে লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করে সায়েন্সে পড়ে, স্টার মার্কস নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার কথা,তারপর ভালো নম্বর পেয়ে অঙ্কে অনার্স

করা,অনেক অর্থাভাব নিয়েও নিজে টিউশন পড়িয়ে এমএসসি করা। পুরোনো শিক্ষকদের কথা,বিশেষ করে অঙ্ক শিক্ষক মেঘনাদ বাবুর কথা,কতো আস্থা ছিলো তাদের

হরির ওপর।মনে পড়ে যায় পুরানো বন্ধুদের কথা তাদের অনেকই আজ বিদেশে সেটলড,বাকিদের অনেকেই বড়ো বড়ো পোস্ট এ।এমনকি এখন তো তার অনেক

ছাত্রেরও চাকরির খবর আসে,তাতে তার আনন্দ,গর্বই হয়,কিন্তু মনের মধ্যে একটা চাপা গুমোট জমে যায় যখন শোনে কোনো অভদ্র,পড়াশোনায় একদম শূন্য ছাত্রও

শুধু টাকার জোরে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাত্ই ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে এলো,আস্তে আস্তে স্বপ্নলোকে প্রবেশ করতে থাকলো হরি মাস্টার।

মোবাইলের alarm এর বিকট আওয়াজে হঠাত্ ঘুমটা ভেঙে গেলো হরির।ছটা বেজে গেছে,টিউশন পড়াতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে,পুজোর আগে ক্লাস নাইনের

আজই শেষ টিউশন।পুজোর পর পরই আবার ইউনিট টেস্ট,আজ ওদের সাজেশনস দিতেই হবে।স্থানীয় সরকারি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক আগের বছর থেকে টিউশন

শুরু করায় হরির ছাত্রসংখ্যা দিন দিন কমছে ,কি এক অদৃশ্য জাদুবলে তার সাজেশন এর একটি প্রশ্নও ফ্লপ হয় না!এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বেশ বিরক্ত হয়েই

উঠে পড়লো সে।হাতমুখ ধুয়েই, মাকে বলে সেই পুরোনো সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো হরি মাস্টার।তার টিউশন রুম বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরের

স্থানীয় বাজারে।সাইকেলে মেরে কেটে আট,দশ মিনিট লাগে।তবে আজ সাইকেল চালাতে চালাতেও হাজার রকম ভাবনায় ডুবে যাওয়ায় বোধহয় একটু বেশিই সময়

লাগলো।সেখানে পৌঁছেই দেখলো সাকুল্যে যে বারোজন ছাত্র পড়ে তারও পাঁচজন absent,পুজোর হাওয়া লেগেছে আর কি!এতে তার মেজাজ আরও বিগড়ে

গেল,সাজেশনস দিয়েই টিউশন ছুটি দিয়ে দিলো হরি,একেবারে দশ দিনের লম্বা পুজোর ছুটি।এরপর সেই ফাঁকা রুমে আবার ভাবনার দুনিয়ায় ডুবে যেতে থাকলো সে।

বাবার কথা, মারা যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে হাসপাতালে বাবার সেই আবেগঘন চাউনির কথা,কলেজ প্রেমিকা

রাধার তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা,মায়েরও ইদানিং খুব শরীর খারাপ হচ্ছে মাঝেমাঝেই,মা যখন থাকবে না তখন কতোটা একা হয়ে যাবে সে, এসব ভাবতে ভাবতেই হরির

গাল বেয়ে জলের ধারা নামতে শুরু করল।

আচমকা রুমের আলোটা নিভে যাওয়ায় আবার সম্বিত ফিরে পায় হরি।লোডশেডিং হয়েছে, এদিকে আটটা বেজে গেছে,সে তাড়াতাড়ি রুমের চাবি বন্ধ করে সাইকেল

নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৃষ্ণদার চা দোকানে যাওয়ার জন্য।প্রতিদিনই টিউশন ছুটির পর কৃষ্ণদার চা দোকানে কিছুটা আড্ডা দেয় সে,আরও অনেক টিউশন মাস্টাররাও

আসে,এই সময়টা কৃষ্ণদার দোকানটা গমগম করে।কেটলির ফুটন্ত চা আর সিগারেটের ধোঁয়া পরিবেশটাকে জাঁকিয়ে তোলে।আর চলতে থাকে সেই চিরপরিচিত

আলোচনা গতবারের batch টা ভালো ছিলো না কি এবারের টা,গ্রুপ ডি র প্রশ্ন টা বেশ standard ছিলো।তবে আজ মুড ভালো না থাকায় হরি একদম কোনার ফাঁকা

বেঞটায় গিয়ে বসলো।আজ কারোর সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করলো না হরির।সেই একই একঘেয়ে গল্প,হয়তো এই বাংলার হাজার হাজার কৃষ্ণদার দোকানে লাখ লাখ

মাস্টারের আড্ডা চলছে এই সময়,কিন্তু গপপো ওই এক!এসব ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো হরি।চুমুক দিয়েই মুড খানিকটা চাঙ্গা হলো ওর,নাহ্ এলাচ দিয়ে

চা টা বেড়ে বানিয়েছে কৃষ্ণ দা,যে কারোর মুড ভালো করতে পারে এই চা।ভালো মেজাজে ভালো চিন্তা আসতে বাধ্য,হরিরও মনে পড়লো কাল ষষ্ঠী।মাকে গতবছর

পুজোর পর একটাও শাড়ি কিনে দিতে পারেনি সে।আজ দুজন ছাত্র বেতন দিয়েছে,তাই হরি ঠিক করে ফেললো আজ মায়ের জন্য শাড়ি নিয়ে ই বাড়ি ফিরবে।এই ভেবে

চায়ের কাপে শেষ চুমুকটি দিয়ে উঠে পড়লো হরি।কাউন্টার একদম ফাঁকা থাকায়,কৃষ্ণদাকে তাড়াতাড়ি করে চায়ের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো সে।বাইরে

বেরিয়ে সাইকেল টা নিতে গিয়েই হরির চোখ পড়লো কৃষ্ণদার চা দোকানের সামনের মদ ভাটির দিকে।সেখানে একটি সাদা মারুতি গাড়ি এসে থেমছে,আর গাড়ি থেকে

নামছে চারজন কমবয়সী ছেলে।তাদের মধ্যে একজনকে হরি চেনে,স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান নারান মন্ডলের ছোটো ছেলে সুভাষ।বাকিরা বোধহয় ওর বন্ধু,সুভাষ এখনো

স্কুলে পড়ে,তাতেই এলাকায় তার নামে কত কি শোনা যায়!সত্যি প্রধানের আস্কারা তে দিন দিন দাপট বাড়ছে ওর,অথচ প্রধানের বড় ছেলে রঞ্জিত আজ এক নামকরা

কলেজের প্রফেসর,ঠিক উল্টো বাপ আর ছোটো ভাই এর থেকে।হরির জন্যও কিছু ব্যবস্থা করবে কথা দিয়েছে রঞ্জিত।এসব ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাইকেলে

চড়ে বসলো হরি।

হরির সাইকেল থামলো চৌমাথার সামনে শিবানী বস্ত্র কুটিরে।দোকানটা এই কয়েক বছর হলো খুলেছে,দোতলা বেশ বড়ো দোকান।তবে এই কয়েক বছরে এলাকায় বেশ

নাম হয়ে গেছে।এই দোকানে আসার অবশ্য আরো একটা কারন আছে হরির,দোকানের মালিক অবনী বাবুর ছেলে নিমাই হরির ছাত্র,অবনীবাবু অমায়িক

ভদ্রলোক,হরিকে বেশ খাতির টাতির করেন।আর এলাকার সবচেয়ে পুরানো শাড়ির দোকান,আদি বস্ত্র বিপণনীতে বেশ কিছু টাকা ধারও আছে হরির,তাই এখন আর

ওদিকে যায় না সে।হরিকে ঢুকতে দেখেই অবনীবাবু ওর কুশলাদি জানতে চাইলেন।তারপরই ছেলের পড়াশোনার মতিগতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে,এ নিয়ে হাল্কা

অভিযোগও করলেন।হরি হালকা করে মার্কামারা উওর দিয়ে সে সব উতরে জানালো তার আসার কারন।সে মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছে শুনেই অবনীবাবু জোরে

ডাক দিলেন এক কর্মচারীর দিকে।কর্মচারী এসে হরিকে নিয়ে ওপর তলায় চলে গেলো।এই কর্মচারীটি বোধহয় নতুন এসেছ, হরি কিছু বলার আগেই সে অনেকগুলো

রঙিন দামি দামি শাড়ি নিয়ে এসে তার সামনে হাজির করলো।সারা দিনের ধকলে হরি এমনিতেই খুব বিরক্ত ছিলো,শেষ অবধি সে বেশ অসহিষ্ণু গলায় বললো,”দাদা

রঙিন শাড়ি না,সাদা থান,লাল পাড় ওরকম দেখান।”এই শুনে সে ধীরে ধীরে তিন চারটে শাড়ি বের করে আনলো বেশ হতাশ ভাবে।হরি ওর দিকে মন না দিয়ে একটা

শাড়ি পছন্দ করে তার দাম জানতে চাইলো।সে এবার বেশ হতাশার সাথেই বললো,”দাম সাতশো চল্লিশ মতো,তবে ডিসকাউন্ট নিয়ে আপনার ছশো ষাট পড়বে।” সেই

শাড়িটিই পছন্দ করে হরি নেমে এলো কাউন্টারে অবনীবাবুর কাছে।অবনীবাবু অমায়িক হাসি হেসে হরির কাছ থেকে টাকা নিতে নিতে আরো একবার জানতে

চাইলেন,ছেলের ব্যাপারে।ঠিক তখনই হঠাত্ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় হরি স্তব্ধ হয়ে গেলো।হরির মনে পড়ে গেলো সুভাষ আর ওর বন্ধুদের সাথে নিমাইও তো

ভাটিতে ঢুকেছিল।অথচ হরির তখন যে কেনো মনে পড়েনি নিমাই এর নাম,এটা ভেবেই সে বিস্মিত হয়ে গেলো।নিমাই তিন বছর যাবত্ তার কাছে টিউশন পড়ছে,সেই

ক্লাস সেভেন থেকে এবার মাধ্যমিক এর টেস্ট অবধি,এই দুদিন আগেই ওদের পুজোর ছুটি দিয়েছে সে,অথচ নিমাই কে বেমালুম চিনতেই পারলো না তখন!

সত্যি,দিনদিন স্মৃতিটাও পাতলা হয়ে আসছে।এদিকে অবনীবাবু শাড়ির পাকেট ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন হরির দিকে,তিনি এবার একটু গলা খাঁকরালেন।সম্বিত

ফিরে পেয়ে হরি শাড়িটা নিয়ে,তাকে দায়সারা গোছের একটা উওর দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো।ঘড়িটা একবার দেখে নিলো হরি,সাড়ে নটা বাজে,এবার বাড়ি ফেরা

দরকার।

সাইকেলে যেতে যেতে বারবার আনমনা হয়ে পড়ছিলো হরি,এলাকাটা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।খোলামেলা ভাবে নেশা,অসভ্যতা,জুয়া আরো কত কিই না চলছে

এখন চারপাশে।নিমাই ছেলেটাই তো পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলো,অথচ এত কম বয়সেই এরা বখে যাচ্ছে।এমন সময় আচমকাই একটা গাড়ির তীব্র আলো পড়লো

হরির চোখে,খুব জোরে হর্নের আওয়াজ,আর সাথে সাথে ই ব্রেক কষার শব্দ।হরি সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো, যদিও সে পিচ থেকে নেমেই সাইকেল চালাচ্ছিলো,কিন্তু

সাদা মারুতিটা গতি কমাতে না পেরে সোজা ধাক্কা মারলো ওর সাইকেলে।ঠিক সেই মুহূর্তেই সাইকেল ছিটকে পড়লো একপাশে,আর খুব জোরে পিচ রাস্তায় আছড়ে

পড়লো হরির দেহটা।মারুতিটা কিছুটা দূরে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে,আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো।এরপর কয়েক সেকেন্ডে সব চুপচাপ,তারপর শুরু

হয়ে গেলো মানুষের
কোলাহল,চিত্কার,আশেপাশের দোকান থেকে লোকজন ছুটে আসতে থাকলো।কাছে এসে তারা দেখলো রাস্তার একপাশে পড়ে আছে একটা সাইকেল,একটু দূরে

শিবানী বস্ত্র কুটির এর সেই শাড়ির পাকেট,রাস্তাজুড়ে রক্ত,আর হরি মাস্টারের নিথর দেহ।ঠিক এইসময় হঠাত ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেনো চেঁচিয়ে উঠলো,”প্রধানের

ছেইলাটা মাস্টার কে খুন কইরলো,কদ্দিন আমরা পইড়ে পইড়ে মাইর খাবো।আজ শালা পোধানের একদিন কি হামাদের একদিন!!

 

………………………………………………….(সমাপ্ত)……………………………………

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত