—কিরে তোর বিয়ে নাকি ভেঙ্গে গেছে?
— আহারে বেচারি! ব্উ সেজে গুজে বসে ছিল। কিন্তু জমাই ই এলো না।বলেই হু হাঁ করে হাসতে লাগলো ওরা তিনজন। তাদের কথায় কান না দিয়ে বাড়ির দিকে দ্রুত রওনা দেয় নূরী, হাতে ঔষধের প্যাকেট।ওরা এলাকার বখাটে,কেউ তাদের কিছু বলার সাহস করে না।খুব ভয়ংকর যে তারা।
গতকাল নূরীর বিয়ে ছিল। সব কিছু ঠিক ছিল কিন্তু মুহূর্তের শীর্ষে পৌঁছে বর বিয়ে করবেনা বলে অর্ধেক রাস্তা থেকে পালিয়ে যায়। নূরীর মা রাফিয়া বেগম দুই বার বেহুঁশ হয়ে যায়। কি হবে তার মেয়ের? দশ বছর আগে তার স্বামী মারা যায়। যাওয়ার সময় কিছু রেখে যায়নি মূলত তাদের সর্বোচ্চ কেড়ে নিয়ে গেছে। মহামারী ক্যান্সার থেকে রেহাই পায়নি। সেই থেকে একটু একটু করে সংসার টা রক্ষা করে চলছে। সমাজের কতো ধরনের মানুষ আর তাদের মুখোশধারী দুর্বৃত্ত চেহারার সাথে পরিচিত হয়েছে তিনি তার জানা নেই।
যখন নূরীর মায়ের চেতনা ফিরে আসে তখন খুব কান্না করে।নূরী তখন ও ব্উ সেজে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।সে কিছু ভাবতে পারছে না এখন তার কি করা উচিত? সেকি আত্মহত্যা করবে? না না । কেন করব? আমি তো কোনো ভুল করেনি। যাঁরা ভুল করে তারা দিব্যি ভালো থাকে, হেসে খেলে বেশ থাকে তাহলে? বিয়ের সাজপোশাক খুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে মায়ের কাছে যায়। তাকে যে শান্তনা দিতে হবে।
— মা তুমি কেঁদো না, আমি তো আছি।দেখো কিছু হয়নি আমার।
— তোকে সমাজের চোখে দোষী বানিয়ে দিলাম আমি। আল্লাহ কেন আমাদের সাথে এমন করেন?
— আল্লাহ কখনো কারো ক্ষতি করে না।যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে।
ছোট বোনকে মায়ের কাছে রেখে নূরী তার বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদে। কি থেকে কি হয়ে গেল? এমন টা তো হ্ওয়ার কথা ছিল না?পরের দিন সকালে দেখি মায়ের খুব জ্বর।তাই ঔষধ আনতে যাই আসার সময় বখাটে তিনজন ছেলে নূরীর উদ্দেশ্য উক্তিগুলো করেছিল। কিছু না বলেই চলে এসেছিলো কেননা তাকে এমন অনেক কথা শুনতে হবে। নিজেকে সব সময় তৈরি থাকতে হবে এগুলো সহ্য করতে। নিপা ( নূরীর বোন) ক্লাস নাইনে পড়ে। আর নূরী এইচএসসি দিয়েছে। এখন একটাই স্বপ্ন জীবনে এগিয়ে যাওয়া। তিন দিন পর পাশের প্রতিবেশী এসে বলল
— ভাবী কেমন আছেন?
— আছি এই কোন রকম।
— তো নূরীকে নিয়ে কিছু ভাবছেন?
— কি ভাববো ভাবী? যা হ্ওয়ার তা তো হয়েছে।
— কি বলব আর ভাবী, আপনার মেয়ের সমালোচনা তো সব খানেই হচ্ছে। কোথায় যাওয়া যায় না।এই মেয়ের কি আবার বিয়ে হবে?
— কেন হবে না ? আমার মেয়ের কি দোষ? ওর তো কোনো দোষ ছিল না সব তো ছেলে ,,,,কথা শেষ না হতেই
— সবাই তো আর এটা বলবে না। আপনার মেয়েকেই দোষ দিচ্ছে। আমি বলি কি আমার কাছে ভালো একটা পাত্র আছে।তবে,,
— তবে কি ভাবী?
— ছেলের দুইটা ছেলে মেয়ে আছে। ব্উটা একটু পাগলাটে তাই।আর কোনো খারাপ দিক নেই। আমি নূরীর কথা বলছি
— আপনার কথা শেষ হয়ে থাকলে আসতে পারেন। আমার মেয়ে এতো পচে যায়নি যে সতীনের সংসার করে।
— ভালো কথা বললাম কিন্তু মান দিলেন না।দেখব আপনার ওই অপয়া মেয়েকে কে বিয়ে করে?
এভাবে কয়দিন যায়।নূরীর মায়ের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে যায় । দুইটি যুবতী মেয়ে নিয়ে সমাজে টিকে থাকা যে কত কষ্টেকর সেটা তিনি হারে হারে টের পাচ্ছে। পাড়ার অনেকেই খারাপ প্রস্তাব দেয় মেয়েদের নিয়ে। তিনি তা এড়িয়ে যায় কিন্তু কত দিন আর? এখন ভয়ে আর মেয়েদের ছেড়ে কাজে যায় না। কেননা কয়েকদিন আগে বখাটেরা রাতে এসে উৎপাত শুরু করেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করে ওইদিন তাড়িয়ে ছিল।ভয় হয় খুব। রাতে নূরীর মা তাকে বলে
— নূরী আমার যদি কিছু হয় তাহলে তুই নিপাকে মানুষ করতে পারবি তো?
— মা তুমি এই কথা বলছো কেন? তোমার কিছু হবে না। আজ আমার জন্য তোমাকে ছোট হতে হচ্ছে সবার কাছে। আমরা এখান থেকে চলে যাব মা ।থাকবো না আর এখানে।
— তুই বল আমাকে তুই নিপারে দেখে রাখতে পারবি না?
— পারব মা খুব পারব।
ওইদিন মা মেয়ে মিলে অনেক কাঁদে।নূরী মনে মনে বলে আর কাঁদবে না। তাকে কিছু একটা করতে হবে। তখন তার একটা স্যারের কথা মনে পড়ে যে তাকে অনেক সাহায্য করছে । স্যার যদি কিছু একটা সমাধান করতে পারে।ভেবেই স্যার কে কল দেয় ।পর পর তিন বার কল দেওয়ার পর আর দেয় না। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো রিসিভ করে স্যার বলে কাল ওনার সাথে দেখা করতে। স্যারকে সব বলব কাল। সকালে
— মা আমি একটু স্যারের বাসায় যাব ৪০ টাকা দিবা?
— মলিন কাপড়ের ভাঁজে গিঁট খুলে ৫০ টাকার নোট বের করে দিল।বলল তাড়াতাড়ি আসবি রাস্তায় কেউ ডাকলে দাঁড়াবে না।
— আচ্ছা। সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল।
স্যারের বাসায় যাওয়ার পর স্যারকে সব খুলে বললাম। বাসায় থাকা যে তাদের জন্য কতটা বিপজ্জনক তাও বললাম। স্যার ভেবছিল এডমিশন এর বেপারে জানার জন্য তার শরনাপন্ন হয়েছে কিন্তু এখন ভিন্ন। স্যার আগে থেকেই জানতো নূরীর দারিদ্র্যতা কিন্তু এতোতা ভয়াবহ তা জানতো না।তাই তিনি বলেন তার একটা কোচিং সেন্টারে আছে যেখানে ছোট ছেলে মেয়েদের পড়ায়। যদি নূরী বাংলা ও ইংরেজি পড়ায় তাহলে মাসে ৭০০০ পাবে।নূরী এতোটা খুশি হয় যা প্রকাশ করার মতো নয়। স্যারের পায়ে ধরে সালাম করে কান্না করে দেয়। স্যার ও অনেক খুশি হয়। কিন্তু থাকবে কোথায় ? স্যার বলল তার ছাদে দুইটা রোম খালি চাইলে থাকতে পারবে ।
স্যারকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বাড়িতে রওনা দিল। মনে মনে অনেক আনন্দ হচ্ছে এই বুঝি দুঃখ ঘুচলো।তার মাকে আর কষ্ট করতে হবে না।বোন ও ভালো স্কুলে ভর্তি হবে।এসব হাজারো চিন্তা করে বাড়িতে আসতেই দেখে অনেক মানুষ।এতো ভীড় কিসের? ভীড় ঠেলে ভিতরে যেতেই দেখে নিপা মাটিতে বসে কান্না করছে। বুকটা মুচড়ে উঠলো,,নূরীকে দেখা মাত্রই নিপা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে
— আপারে তারা আমার মাকে মেরে ফেলেছে।দেখ কতো ডাকছি ওঠেই না। ওরা বলছে মা নাকি আর নেই দুনিয়ায়। তুই একবার ডাক দে না, দেনা একবার। নূরী তার মায়ের কাছে এগিয়ে গেলো। বললো
— মা দেখো আমাদের সব কষ্ট শেষ।উঠো না তুমি দেখো।তোমায় আর কাজ করতে হবে না মা।মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস টা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো কথা বের হচ্ছে না,সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভিতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে,যার শব্দ কেউ শুনতে পাচ্ছে না। চোখটা বন্ধ হয়ে আসলো। যখন চোখ খুললো তখন দেখে তার মায়ের মলিন কাপড়টি নেই সেখানে সাদা কাপড়ে আবৃত করেছে।কেউ বলছে শেষ বারের মতো মায়ের মুখ খানি দেখতে, নূরী পারলো না দেখতে।আজ যদি ছেলে হতো তাহলে মাটি দিতে পারতো কিন্তু নূরীর সেই অধিকার নেই। তার মাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে , নিপা যেতে দিচ্ছে না মায়ের পিছনে ছুটছে। নূরী কিছুই করছে না, নির্জীব হয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে।
কেউ কেউ বলছে বখাটেরা এসে আবার ভাংচুর করেছে। আমাকে খুঁজেছে পায়নি বলে নিপার দিকে হাত বাড়ায় ছুটাছুটি করতে গিয়ে মা হঠাৎ স্ট্রোক করে।ভয়ে পালিয়ে যায় ওরা।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে নূরী, কি করবে এখন? তার মা বলেছিল নিপাকে যেন দেখে রাখি।এ কোন সংগ্রামে ফেলে চলে গেলো তার মা? জীবন সংগ্রামে নূরী কি পারবে জয়ী হতে? আঁধার নেমে আসছে রাতে যদি আবার কেউ আসে?? না না আমি হারতে পারব না,মাকে দেওয়া কথা যে রাখতেই হবে।রাত ঘনিয়ে আসতেই নিপাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় মায়ের কবরের কাছে। শেষ বিদায় নিয়ে দ্রুত পায়ে শব্দহীন ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল দুইবোন।
গল্পের বিষয়:
গল্প