খাবার খেতে খেতে বাপকে কহিলাম,
– আব্বা, তোমার কি স্কুল কলেজ বা ভার্সিটির কোন বান্ধুবী নাই?
কথা শুনে আব্বা মনে হয় ব্যক্কল হয়ে গেলেন। পুত্রের কাছে এরকম প্রশ্ন পিতা আশা করেন নাই। আব্বা বলেন,
– ছিল বৈকি!
– আমার কিন্তু একটা কাছের বান্ধুবী হয়ে গেছে।
– ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না হতেই বান্ধবী করে ফেললি?
– জি আব্বা। বান্ধবী থাকার অনেক সুবিধা। শিটপত্র নিয়ে টেনশন করতে হয়না।
– বাহ ভাল।
– আব্বা তোমার বান্ধুবীর কথা বলো। কথা শুনে আব্বা খুকখুক করে কাশি দিলেন। আম্মা পাশে বসে আছেন। কাশি দিয়ে হয়তো আমাকে ইশারা করলেন। ইশারায় যেন বলছেন, “তনয় তুই থেমে যা” কলিংবেল বেজে উঠল। আমি দরজা খুলে দিলাম।
– কিরে আপু, এত দেরি করলা কেন?
– অটি তে ছিলাম। এক মহিলার ছেলে হয়েছে। সিজার।
– এখন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়। ১২টা বাজতে চলছে। এমনিও তোমাকে অনেক টায়ার্ড দেখাচ্ছে।
– হ্যাঁ রে যাই তনয়।
আপু পেশায় ডাক্তার। ঈদের পরে বিয়ে। হবু দুলাভাইও পেশায় ডাক্তার। দুলাভাই খুব আমুদে। প্রেমের বিয়ে। আফসুস কত বসন্ত পার করে দিলাম গার্লফ্রেন্ড পেলাম না। ১২টা বাজতে ৫ মিনিট। আপুর বার্থডে। একটু পরে আপুকে সারপ্রাইজ দেয়া হবে। আপু ঘুমিয়ে গেছে। প্রতিদিনই আপু ক্লান্ত থাকে। এসে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ১২টা। আমি, আব্বু, আম্মু একটা ছোটখাট কেক নিয়ে আপুর রুমে ঢুকলাম। তারপর হ্যাপি বার্থডেএএএএএএএএ করে ধুম চিত্কার। আপু ঘুম ভেঙ্গে ভড়কে গেল। কেকটা টেবিলে রেখে আপুকে বিছানা থেকে টেনে আনলাম। মোমবাতির আলোয় আপু কেক দেখলেন।
– আম্মা আব্বা তোমাদের প্ল্যান তাইনা?
– কয় কি! সবকিছু করলাম আমি। আর ক্রেডিট পাচ্ছে উনারা। ছোট ভাইকে ক্রেডিট দিতে শিখো।
– ওরে আমার বান্দর ভাইরে! আয় তোরে কেকটা খাইয়ে দি। আপু কেক কেটে সবাইকে খাইয়ে দিলেন। বাবা বললেন,
– তোর কি লাগবে মামনি? কোনদিন কিছু চাস না।
– কিছু চাইনা বাবা। আমাকে সেরা গিফট দিয়ে দিসো। একটা পরিবার।
আপু বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আজ আমার জন্মদিন না বাবা। আজ আমার জন্মদিন না।”
– ছি মামণি। এভাবে বলিস না। আপুকে ধরে বললাম,
– কাঁদবি নাতো আপু। অসহ্য লাগে। এই নাও তোমার গিফট।
– কি আছে রে?
– তুমি যা ভয় পাও সেটা
– মানে?
– উড়ন্ত তেলাপোকা।
– তবে রে হতচ্ছাড়া আমি দৌঁড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। পরের দিন ইফতারের পর আপু আমাকে বলল,
– চল শপিং করব।
– মেয়েদের সাথে শপিং করা বিরাট ঝামেলা।
– কোন কথা হবে না। তাড়াতাড়ি রেডি হ।
আপু চোখ রাঙানি দিলেন। মানে আমাকে যেতেই হবে। মেয়েদের সাথে শপিং করলে যা হয় আরকি! দশটা দোকান ঘুরে বেড়াবে। আপুও সেরকম। আম্মুর জন্য শাড়ি, আব্বার জন্য পান্জাবি, আমার জন্য আবার জিন্স, গেন্জি কিনলেন।
– নিজের জন্য কিছু নিবা না?
– একদিনেই সব করব নাকি? আরো দিন পরে আছে। চল এখন যাই। আমরা রিকশা নিলাম। আপুকে বললাম,
– দুটা পান্জাবি কিনলা কেন?
– এমনি।
– আরেকটা নিশ্চয় দুলাভাইয়ের জন্য।
– আরে নাহ। পরে বলছি। এই মামা এখানে থামেন তো। তনয় তুই বোস। আমি আসছি।
আপু একটা বস্তির ভেতর ঢুকে গেলেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পর আপু আসলো।
– কি ব্যাপার কোথায় গেছিলা?
– বলব পরে। মামা চলেন। রিকশা চলছে। আপুর কল আসল। মোবাইলটা কানে নিলেন। চুপচাপ শুনে রেখে দিলেন।
– কি হয়েছে আপু? কে কল দিল?
– তনয়, আমার একটা প্রিয় জায়গা আছে। চল সেখানে বসে গল্প করি।
– চল। আমি আর আপু একটা পুকুরপাড়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর আপু বললেন,
– বাবারা অনেক অদ্ভুত হয়। এই যেমন আমার নিজের বাবার চেহারা মনে নাই। পিচ্চিকালে আমাকে এতিমখানায় রেখে দিলেন । আরেক বাবা আমাকে মেয়ে করে ঘরে নিয়ে গেলেন। পেলাম তোর মত ভাই। একটা পরিবার মা বাবা। যেদিন আমি মেডিকেলে চান্স পেলাম, সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল বাবা। বাবা বললেন, এখন আমি গর্ব করে বলতে পারব আমার মেয়ে ডাক্তার।
– দেখ আপু এসব এতিমখানার কথা তুলবি না। তুই আমার আপু। আমার বড় বোন। ঈদের পর বিয়ে। জানিস তোর বিয়ের পর আমি একা হয়ে যাব। একদম একা। ভাবলেই কষ্ট লাগে।
– ছি এভাবে বলিস না। জানিস পাঁচদিন আগে এক ছেলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। মেকানিংয়ের কাজ করত। পরিবারে শুধু ওর বাবাই আছে। আগুনে পুড়ে ছেলেটার যায়যায় অবস্থা। ওর চিকিত্সার সব দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। ও কালকে বলল, তার শখ ছিল বাবাকে নতুন পান্জাবি কিনে দিবে। ঈদে একসাথে নামাজ পড়বে।
– ও আচ্ছা। ঐ বস্তিতে তাহলে পান্জাবি দিতে গেছিলা।
– হ্যাঁ। উনি এখন নতুন পান্জাবি পড়ে রাতের খাবার নিয়ে ছেলের কাছে যাবেন।
– তাহলে তুমি এখানে বসে আছো কেন? হাসপাতালে যাও। ছেলে তার বাবাকে নতুন পান্জাবি তে দেখে খুশি হবে। এ দৃশ্য দেখবা না?
– না।
– কেন?
– হাসপাতাল থেকে একটু আগে কল এসছিল। ছেলেটি মারা গেছে। পিতা হাসপাতালে গিয়ে তার ছেলের লাশ দেখবে।
আমি আপুর দিকে তাকালাম। তার চোখে পানি চিকচিক করছে। চোখে পানি, আর ঠোঁটে মলিন হাসি দিয়ে বললেন, “আমি অবশ্য এসব দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। এখন আর কিছু মনে হয় না। ডাক্তার তো। মন অনেক শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে দেখতে ইচ্ছা করছে নারে। একদমই না!” আবার নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতার মাঝে আমি আপুর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে থাকলাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প