“আজকে আমি শাড়ি পরছি! শাড়ির নিচে ছায়া-ব্লাউজ কিছু পরি নাই। খবরদার আমার দিকে তাকাবি না।” রাতে ঘরের বাতি বন্ধ করে যখন চোখে ঘুম লেগে আসে।তখনই মাথার কাছে ফিসফিসিয়ে এক মহিলা কথাগুলো বলেন। আমি আগ্রহ নিয়ে সাথে সাথে মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করি। অথচ অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাই না। তিনি আমাকে ঠাস করে চড় মেরে বলেন, “মাথা তুলতে নিষেধ করেছি না? করেছি কী করি নাই?” আমি আবার মাথা নিচু করি। ছোট করে নিশ্বাস ছেরে বলি, “দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতে আপনার আমার কাছে এসে শাড়ি পরতে হবে কেন?”
“তোর তো দেখছি সাহস কম না। ভুতের মুখে-মুখে তর্ক করিস?”
“আপনি ভুত নাকি?”
“ভুত তো আমার স্বামী। আমি পেত্নী। তোরা মানুষরা আমাদের ছেলে-মেয়ে সবাইকে ভুত বলিস কেন? আমরা কি তোদের সবাইকে “নারী” বলি?”
“আপনারা কী বলেন তা আমি কীভাবে জানব? তা আপনার স্বামী কই?”
“আমার স্বামী তোর গার্লফ্রেন্ডের ঘরে বসে আছে। তুই নাকি তাকে সময় দিস না?
“হাবিজাবি কথা বলবেন না। তাকে আমার গার্লফ্রেন্ড এর ঘর থেকে আসতে বলেন। লজ্জা করে না মেয়েদের ঘরে একা একা যেতে?”
“শোন আমরা তোদের মতো নিলজ্জ-বেহায়া না। তোর গার্লফ্রেন্ড যখন জামা-পাজামা চেইঞ্জ করে তখন লটকন ফিরেও তাকায় না।”
“লটকন কে?”
“আমার স্বামীর নাম। উনার পুরো নাম “চান্দা-বাগা বলোজ পিলু কহতগ পিচুবিকলী”। আমি তাকে ভালোবেসে “লটকন” ডাকি।”
“লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ জালীমিন।”
“দোয়া ইউনুস পড়ছিস কেন? আমি কি খারাপ পেত্নী নাকি যে দোয়া পড়ার সাথে সাথে ফুস করে উড়ে যাব? আমি নিজেও ফজর আর এশার নামাজের পর আল্লাহর জিকির করি।”
“আপনি তাহলে কেমন পেত্নী?”
“আমি নিম গাছের পেত্নী। তবে ঈদ-কুরবানীতে তুলসী কিংবা অর্জুন গাছে বান্ধবীদের বাসায় বেড়াতে যাই। তোদের তেঁতুল গাছের দোপালীর মতো না।”
“দোপালী কে?”
“চিনিস না? মাঝেমধ্যে নগ্ন হয়ে তোর আম্মুসহ বিল্ডিং এর বাকীদের ভয় দেখায়।”
“আপনার নাম কি?”
“আমার ইসলামী নামে নাম “মদিনা বেগম”। তবে লটকন ভালোবেসে চন্দ্রমুখী ডাকে।”
“বাহ! দেবদাস সিনেমার নায়িকা?”
“লটকন বলেছে আমার হাসি মাধুরীর চেয়েও সুন্দর আর গায়ের রং ঐশ্বরিয়ার চেয়েও সাদা।”
“আমি কি আপনাকে একবার দেখতে পারি?”
“না না! লটকন আমাকে পরপুরুষের সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছে। তুই অবশ্য আমার ছেলের মতো। তোর বয়েসি আমার এক ছেলে ছিল। নাম ছিলো তরমুজ।”
“ছিলো মানে? এখন কোথায়?”
“বেঁচে নেই। একজন মেয়ের প্রেমে পরছিলো পরে আর বিয়া হয় নাই। কান্না করতে করতে মরে গেছে।”
“কান্না করতে করতে মরে গেছে?”
“হুঁ। তোগো কানলে যেমন পানি পরে আমরা কানলে আলো ঝড়ে।”
“কীসের আলো?”
“আমরা ভূত পেত্নীরা আলো-বাতাসের তৈরি। বেশী কান্নাকাটি করলে শরীর থেকে আলো বের হয়ে যায়।শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন ভূত-পেত্নীরা অসুস্থ হয়ে পরে।” “সবকিছু মাথার উপর দিয়া যাচ্ছে। তরমুজের সাথে মেয়েটার বিয়ে হলো না কেন?” “মেয়েটা তোদের মতো রক্ত মাংসের মানুষ ছিল আর আমার ছেলে ভূত। তেলে-জলে কখনো মিশ খায়? খায় না।” মদীনা বেগম গুমরে কেঁদে উঠলেন। আমি তাকে কি বলে সান্তনা দেবো বুঝলাম না। তিনি প্রায় পাঁচমিনিট একইভাবে কাঁদলেন। তারপর ফুচফুচ শব্দ করে বললেন, “বেশি কাঁদলে আমার সর্দি লাগে।”
“কান্না করিয়েন না। আপনি কান্না করলে আমার খারাপ লাগে।”
“তোর খারাপ লাগবে কেন?” “আমি কারো কান্না সহ্য করতে পারি না। তার উপরে আবার মেয়ে মানুষের কান্না।”
তিনি বললেন, “তোর কথা শুনে আমার তরমুজের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি একটু তোর মাথায় হাত রাখতে পারি?”
“রাখুন।” আমার মাথায় কারো হাত অনুভব করিনি। শুধু হালকা ঠান্ডা বাতাসে চুলগুলো উড়তে লাগলো। তিনি কোমল গলায় বললেন, “একদিন বোরকা পরে তোর সাথে দেখা করবো নে। তুই আমাকে দেখলে ভয় পাবি নয়তো এখুনি দেখা করতাম। আমার চেহারা একবার আগুনে পুড়ে খারাপ হয়ে গেছে তবে আমি সত্যিই আগে অনেক সুন্দর ছিলাম। লটকন আমাকে ছেড়ে যায়নি। বরং মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় সে আমাকে আগের চেয়ে বেশী ভালোবাসে! লটকন অনেক সুদর্শন পুরুষ চাইলেই আরেকটা বিয়ে করতে পারতো। বল পারতো না?”
“পারতো।”
“কিন্তু তিনি তা করেননি।” মদিনা বেগম দীর্ঘশ্বাস নিলেন। কিছুক্ষন পর আবার বললেন, “তুই লটকন এর জায়গায় হলে কী করতি?” আমি কী উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না।
“চুপ করে আছিস কেনো বল কি করতি?”
“আমি জানি না কি করতাম। ঘুম পাচ্ছে ঘুমোবো।”
“জানিস না মানে। তুই ঘুমোতে পারবি না। উঠে বস।
আমাকে উত্তর দে। সত্যি উত্তর দে, মিথ্যা বললে কিন্তু আমরা ধরতে পারি।” অন্য একদিন বলবো। তুই আজই বলবি। ওঠ! উঠে বস বলছি। হঠাৎ তার গলার স্বরটা অন্যরকম অদ্ভুত লাগলো। আমি উঠে বসে দেখি আম্মু বললেন, “কী হয়েছে?” আমি বললাম, “মদিনা বেগম কোথায়?”
“মদিনা বেগম কে? ঘুমের ঘোরে একা একা কথা বলছিস কেন? আজ নিশ্চয়ই তাবিজ বালিশের নিচে রাখিসনি।”
একটা বিষয় বলে রাখা দরকার! আম্মুর মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি একা একা কথা বলি। হিহি করে হাসি। রাত বাড়লে কখনো ছেলেদের আবার কখনো মেয়েলী গলায় গান করি। এই কারনে তিনি পানি পড়া, তাবিজ-টাবিজ কোথাথেকে নিয়ে এসেছেন। একটা তাবিজ বালিশের নিচে রেখে ঘুমোনোর নিয়ম আমার সেটা মনে থাকে না। মনে না থেকে অবশ্য ভালো হয়েছে। আমি মদীনা বেগমের দেখা পেয়েছি। যদি তাবিজ রেখে ঘুমোতাম মদিনা বেগমের দেখা পেতাম না। আম্মু এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বললি নাতো মদিনা বেগম কে?”
“কেউ না। হয়তো আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি।”
“আদা-লবঙ্গ দিয়ে এক কাপ রং চা বানিয়ে দেবো? খেলে ভালো লাগবে।”
“তুমি জানোনা আমি রং চা খাই না?”
“মাজার থেকে লবঙ্গ পড়া এনেছিলাম ওটা রঙ চায়ের সাথে মিশিয়ে খেতে হয়।”
“আমি খাবো না। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি খাও।”
আম্মু হতাশ হয়ে চলে গেলেন। পুরো একদিন আমি মদিনা বেগমের বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম। যদি রাতে তিনি আবার আসেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন “আমার ভালোবাসার মানুষের চেহারা পুড়ে গেলে আমি কি করতাম? তাহলে কী উত্তর দেব?” দুপুরে খাবার টেবিলে আম্মুকে বললাম, “যদি কিছু মনে না করো, তোমায় একটা কথা বলি!” আম্মু বললেন, “এতো ভনিতা করার কি আছে? বলে ফেল!” “যদি তোমার ভালোবাসার মানুষের চেহারা পুড়ে যায় তুমি কি করবে?” আম্মু চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালেন। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “তুই আমার সাথে একবার নীলগঞ্জের পীর বাবার কাছে চল। তোর কাছে আমি আর কিছু চাই না।” সেদিন রাতে আগেই আমি আম্মুর রেখে যাওয়া তাবিজ বালিশের নিচ থেকে সরিয়ে ঘুমোলোম। শেষ রাতের দিকে মদিনা বেগম এসে বললেন, “শাদবিন ঘুমিয়েছিস?”
“না ঘুমাইনি। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
“আমার আসার জন্যে তাবিজ সরানোর দরকার নেই। আমি এমনিতেই আসতে পারতাম।”
“আপনি সব বুঝতে পারেন?”
“সব না কিছু কিছু জিনিস পারি। আর কিছু বিষয়ে কনফিউশান থাকে। তোকে গতকাল যে প্রশ্নটা করেছিলাম ওটা আজ আর করব না।”
“কেনো করবেন না?”
“কাল কনফিউশান ছিলো আজ নেই। এখন তুই কী উত্তর দিবি আমি জানি।”
“কী উত্তর দেব?”
“সকাল থেকে তুই আমার আর লটকনের বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছিস। যদি হুট করে কেউ তোকে এই প্রশ্ন করতো তুই সাথে সাথে মিথ্যা বলতি “আমি আমার ভালোসার মানুষের পাশে থাকব!”
“এখন কি বলব?”
“এখনও একই উত্তর দিবি তবে আজকেরটা সত্যি।”
“কীভাবে?”
“ওই যে বললাম তুই আমার আর লটকনের বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছিস। সেই ভাবনা তোর মাঝে অতিরিক্ত মূল্যবোধ আর বিবেক সৃষ্টি করেছে। তাই তোর প্রেমিকার প্রতি যেটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিলো সেটুকুও পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই আজ সত্যি কথা বলবি!” আমি আর মদিনা বেগম দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। মদিনা বেগম বললেন, “তোর জন্যে মায়া হয়ে গেছে। আমি তোর ঘরে আসা যাওয়া করি প্রায় তিন মাস। তোর সাথে কথা বলছি দু’তিন দিন হবে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন গলায় গান গাই। তোর আম্মু শুনতে পায়, কিন্তু তুই নাক ডেকে ঘুমিয়ে থাকিস।”
“এসব কেনো বলছেন?”
“কারন আমি বেড়াতে যাবো আবার কবে আসবো ঠিক নেই।”
“কোথায় বেড়াতে যাবেন?”
“কাল যাবো সৌদি আরব তারপর লটকন কোথায় নিয়ে যাবে জানি না।”
“আবার কবে আসবেন?”
“জানি না। এমনও হতে পারে আর নাও আসতে পারি। তোর আম্মু এমনিতেই তোকে নিয়ে দুঃচিন্তায় থাকেন।”
“আসবেন না কেনো। মাঝেমধ্যে আসবেন।”
“তোকে আমার অনেক ভালো লেগেছে। তোকে একটা উপহার দিয়ে যাচ্ছি। জিনিসটা আমার ছেলের ছিলো।”
“কই দেখি!”
“এখন দেখতে হবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখিস।তোর পড়ার টেবিলে রেখে গেলাম।”
“আপনি এখুনি চলে যাবেন?”
“না লটকন এসেছে তোর সাথে দেখা করবে তারপর যাব।”
“কোথায় তিনি?”
“তোর সিলিং ফ্যানের উপরে বসে আছেন।”
“কী বলেন ফ্যান তো চলছে।”
“তাতে ওর কিছু হয় না। ওর আরো মজা লাগে।”
“আমার সাথে কথা বলবে না?”
“না ওর আবার লজ্জা বেশী। তোদের মধ্যে যেমন মেয়েদের লজ্জা বেশী আমাদের মধ্যে আবার ছেলেদের লজ্জা বেশী।তোর গার্লফ্রেন্ড কে লটকন একটা কলম উপহার দিয়ে এসেছে। একটা কলমের মধ্যে চারটা রঙ। লাল-নীল, হলুদ আর বেগুনী।” মদিনা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। আম্মু সকালে ডেকে ফোনটা হাতে দিয়ে বলল, “দেখতো সকাল থেকে তোর কোন বান্ধবী তোকে খুঁজছে। বলল, জরুরি কথা।” আমি ফোন ধরতেই আয়েশা (গার্লফ্রেন্ড) বলল, “তুমি কীভাবে জানলে আমি এমন একটা কলম বহুদিন ধরে খুঁজছি?”
“কীসের কলম?”
“তুমি জানো না? সকাল সকাল “লটকন” নামের একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে বাসায় কলম পাঠালে।” আমি চমকে উঠলাম! আম্মু সাথে সাথে পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওমা এতো সুন্দর ডায়রিটা কখন কিনেছিস? আমাকে আজকাল কিছু দেখাসও না।” ফোনের ওপাশ থেকে আয়েশা তখনও বলছে, “তোমায় একটা রঙিন চিঠি লিখবো বলে কতোদিন ধরে এমন একটা কলম খুঁজছিলাম। আমি তো কখনো তোমায় বলিনি। প্লিজ বলোতো বলেছি কিনা?”
আম্মু ততক্ষনে ডায়রির পাতাটা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে বললেন, “তুই দেখছি এই ডায়রিতে গল্পও লিখেছিস “তরমুজের গল্প”। এটা কেমন গল্পের নাম? অদ্ভুত! আমাকে শুনালি না। ” আমি আয়েশার ফোনটা রেখে আম্মুকে বললাম, “ওই গল্পটা মদিনা বেগমের ছেলের গল্প। গল্পটা শেষ করা হয়নি। তোমাকে অন্য কোনোদিন শুনাব।”
গল্পের বিষয়:
গল্প