অপেক্ষা

অপেক্ষা
অনুর সাথে রিক্সায় বসে আছি। রিক্সা ভাড়া বাচানোর জন্য আমি মাঝেমাঝেই অনুর রিক্সায় উঠে পড়ি। মাঝপথে নেমে ভাড়া দিতে গেলেই অনু গম্ভীর গলায় বলবে,
— এ্যাইইই মামা! ভাড়া নিওনা ওর কাছ থেকে। আমিও আর জোড়াজুড়ি করিনা তেমন। ভাড়া দিতে না পারায় আমি লজ্জিত, এমন একটা ভাব নিয়ে চলে আসি। একঘন্টা হয়ে গেলো জ্যাম ছোটার কোন নেই। ভ্যাপসা গরমে দুজনেই ঘেমেটেমে একাকার। মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে মেকাপ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে দুবার আফসোস করে ফেলেছে অনু। তৃতীয়বার আফসোস করতে গিয়ে চমকে উঠে বললো,
— এ্যাইই রিফাত! রিক্সার হুড উঠা। তাড়াতাড়ি… আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম। হুট করে এই বিরক্তিকর গরমে হুড উঠানোর মানে কি? আশেপাশের উচু বিল্ডিং এর কারনে রোদের তাপটাও তো লাগছেনা। অথচ এরআগে তীব্র রোদের মধ্যেও অনু কখনও রিক্সার হুড উঠাতে  দেয়নি। উঠাতে গেলেই রেগে গিয়ে বলতো,
–“আশেপাশে কতো মানুষ দেখছিস না? আমাদের খারাপ ভাববে।” আমি অনেকটা বিভ্রান্ত হয়ে বললাম,
— আর ইউ সিরিয়াস? গরমে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
— তোকে হুড উঠাতে বলছি, উঠা তাড়াতাড়ি। ফিসফিস করে বললো অনু। আমি ওরই ডায়লগ কপি করে বললাম,
— অনু! আশেপাশে কতো লোক দেখছিস? তারা কি ভাববে?
— গাধার বাচ্চা! পাশের রিক্সায় বাবা।
আমি পাশে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। আসলেই তো, আমার ঠিক দু ফিট দূরের একটা রিক্সায় আশফাক সাহেব বসে আছেন। তাকে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য আমার সেন্স কাজ করতেছিলোনা। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে পৃথিবীর সবথেকে ভয়ানক প্রানীর নাম কি?আমি এক কথায় উত্তর দিবো, “আশফাক তালুকদার।”
এই ভয়ের পেছনে কোন কারন নেই, আজ পর্যন্ত কখনও এই লোকের সাথে আমার কথা পর্যন্ত হয়নি। শুধু কয়েকবার দূর থেকে দেখেছি। কিছুকিছু ভয়ের কোন কারন থাকেনা। যেমন মেয়েদের তেলাপোকা ভীতি আর আমার আশফাক তালুকদার ভীতি। তাড়াতাড়ি করে হুড উঠাতে গিয়ে বা’হাতে বেশ ভালোরকমের ব্যাথা পেয়েছি। কিন্তু এদিকে অনুর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই৷ চুপ করে বসে আছে আমার পাশে। যেকেউ একপলক দেখেই স্পষ্ট বুঝে যাবে, এই মেয়েটা এখন রেগে আছে। মেয়েদের মুড সুইং যেমন খুব দ্রুত হয় ঠিক তেমনি সেটা বোঝাও যায় খুব দ্রুত। হয়তো সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের এমন করেই বানিয়েছেন। যখন রাগবে তখনকার চেহারা থাকবে একরকম, কান্না করলে একরকম আবার হাসলে আরেকরকম। তাদের সেই প্রত্যেকটা রুপই আকর্ষণীয়, একেক পুরুষ নারীর একেক রুপের প্রেমে পড়ে যায়। কেউ কেউ আবার নারীর প্রতিটা রুপেই মুগ্ধ হয়ে বলে, ” তুমিই আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।”
— অনু! অনুউউউউ! আরেবাবা! এই সিম্পল ব্যাপারে রাগ করে নাকি কেউ? অনু চুপ করে আছে। ওর রাগ ভাঙানো আমার কাছে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ গুলোর একটা। তবুও আমি ওর রাগ ভাঙানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম।
ওকে নিয়ে আমার স্বরচিত ছড়া টাইপের কবিতাটা শোনানো শুরু করতেই কেউ একজন আমার শার্টের কলার ধরে টেনে রিক্সা থেকে নামালো। একি! অনুর বাবা, আশফাক তালুকদার। হিংস্র বাঘের মতো আমার শার্টের কলার ধরে রেখেছে। তার আরেকটা পরিচয় আছে, শাহবাগ থানার ওসি। তার থেকেও বড় ব্যাপার এই লোক নাকি এপর্যন্ত তিনটা এনকাউন্টার করেছে। আমি কি তাহলে চার নম্বর হতে যাচ্ছি? ভাবতেই আমার দুটো হার্টবিট মিস হলো। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে, পুলিশের হাতের দুটো চড় খেয়েও আমার কোন ব্যাথা অনুভূত হলোনা। থানায় আনার বেশ কিছুক্ষন পর সম্বিত ফিরে পেলাম। সামনেই অনুর বাবা বসে আছেন, খুব মনোযোগ দিয়ে কাগজে কি যেন লিখছিলেন। আমি একটু নড়েচড়ে বসতেই চোখ রাঙিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি কাচুমাচু করে বললাম,
— স্যার! অনুর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমরা জাস্টফ্রেন্ড। একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার কথা শুনে আশফাক সাহেব দাত কটমট করে বললেন,
–“চুপ বেয়াদব! তোর জাস্টফ্রেন্ডগিরি দেখাচ্ছি আজকে!” আমার ভয় হতে লাগলো, জাস্টফ্রেন্ড শব্দটা ব্যবহার করাটা মনেহয় ঠিক হয়নি। অনেকেই এটাকে নেগেটিভ ভাবে নিয়ে নেয়। আশফাক সাহেবও হয়তো নেগেটিভ ভাবে নিয়েছে শব্দটা।
জীবনে কখনও পুলিশের পাল্লায় পড়িনি। কিভাবে ছাড়া পেতে হবে সেসব ব্যাপারেও কোনরকম অভিজ্ঞতা নেই। একবার ভাবলাম, মুচকি হাসি দিয়ে অনুর বাবার হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট গুজে দিবো কিনা!কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এ কাজ করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার চান্স বেশি। অগত্যা নির্বিকার হয়ে বসে রইলাম। পাশেই একজন কে বেদম পেটাচ্ছে, আসামির চিৎকারে কানে ঝিম ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা। মনেমনে ভাবলাম, এটাও কি আমার মতো রিক্সা কেস নাকি? ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। অনু আসলো ঘন্টাখানেক পর । এতোক্ষনে তাহলে ওর রাগ ভেঙেছে। এখন আর ভয় লাগছেনা আমার। নিশ্চয়ই অনু আমাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমি শুনতে পেলাম, অনু ওর বাবাকে গম্ভীর গলায় বলছে!
— বাবা! রিফাতকে ছেড়ে দাও। ও কোন অন্যায় করেনি।
— অন্যায় করেনি মানে? আমার মেয়ের সাথে রিক্সা নিয়ে ঘুরবে আর আমি তাকে ছেড়ে দেবো ভাবছিস?
— ভাবছিনা।
ছাড়তে তো হবেই। পুলিশের মেয়ের সাথে রিক্সায় ঘোরাটা এদেশের আইনে কোন অন্যায় কাজ নয়। অন্যায় হলে আমি নিজেও অপরাধী। একজন অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে তুমি তো আরও বড় অপরাধ করেছো বাবা! আমি ঘাপটি মেরে পুলিশ বাবা আর আইনজীবী মেয়ের কথোপকথন শুনছি। আইনজীবী না ঠিক, হাফ আইনজীবী। অনু আইনের ছাত্রী, থার্ড ইয়ার রানিং। আর আমি বায়োকেমিস্ট্রির। আলাদা ডিপার্টমেন্ট হওয়ার পরেও কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের ভালো একটা ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে। দুজনের তর্কটা বেশ জমে উঠেছে। মনেহচ্ছে লাইভ টকশো দেখছি, বেশ উপভোগ্য। কথা চলাকালীন হুট করেই অনু নিজের মাথায় রিভলবার তাক করে বললো,
— বাবা! তুমি ওকে ছাড়বে নাকি আমি গুলি করবো? আমার চোখে পানি চলে আসলো। অনু আমার জন্য এরকম টা করতে পারে আমি ভাবিনি কখনও। তাহলে কি অনুও আমাকে ভালোবাসে? ছিইই! কিসব ভাবছি আমি। এটাতো অসম্ভব। ও কেনো আমাকে ভালোবাসবে। আমি ওকে ভালোবাসি বলেই তো আর ও আমাকে ভালোবাসবেনা। ভালোবাসায় এমন কোন নিয়ম নেই। থাকলে হয়তো ভালো হতো। মাঝেমাঝে আমার ইচ্ছে হয়, অনুও আমাকে ভালোবাসুক। কিন্তু এই ইচ্ছে হওয়াটাও হয়তো পাপ। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার সেই ইচ্ছেটা পাপ হলেও সবাই সেই পাপে পাপী হয় নির্দ্বিধায়। থানা থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ের দোকান থেকেএকটা স্টার সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিলাম। অনু থানাতেই রয়ে  গেছে, আমাকে কিছুটা রাগীরাগী কন্ঠে বলেছে,
— “তুই বাসায় চলে যা রিফাত। আমি পরে যাবো” আমার ইচ্ছে ছিলো, অনু আমার সাথে আসুক খনিকটা পথ। কিন্তু আসেনি। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে শুরু করলাম। মেসে ফিরে গিয়ে একটা লম্বা গোছল দেয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা ইচ্ছে করছেনা এখন। মেস ম্যানেজার হানিফ ভাই এসে একগাল হেসে বললেন,
— কি রিফাত ভাই! মনটন খারাপ মনে হইতেছে ইদানীং! এনি প্রবলেম? আমি সত্যি গোপন করে একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললাম,
— না ভাই, তেমন কিছুনা।
দুদিন ধরে অনুর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। না থাকাটা অস্বাভাবিক না। এমনিতে আমার ফোন দেয়ার খুব একটা প্রয়োজন পড়েনা , অনুই আমাকে সবসময় ফোন দেয়। দিনে কম করে হলেও তিনবার কথা হয় আমাদের। কিন্তু দুদিন হলো অনু ফোন দিচ্ছেনা, আমিও দিচ্ছিনা। আমি চাইনা অনু কোনভাবে বুঝতে পারুক যে আমি ওকে ভালোবাসি! কিছুকিছু সম্পর্ক এভাবেই টিকে থাকুক, স্থায়ীত্বের খাতিরে। তারও দুদিন বাদে আমি অনুকে ফোন দিলাম, কারন আজ ওর বার্থডে। বার্থডে উইস করার জন্য ফোন দেয়াটা সবাই স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। অনু ফোন রিসিভ করে কোন কথা বললোনা। আমি এপাশ থেকে বললাম,
— শুভ জন্মদিন অনু!”
— থ্যাংক ইউ।
— তোকে বলেছিলাম না? তোর জন্মদিনে তোকে নৌকায় চড়াবো? কাল রেডি থাকিস।
— আচ্ছা। আমি ফোন রেখে দিলাম। চারদিন বাদে অনুর সাথে কথা বলায় কষ্টটা মনেহয় আরও ভারী হয়েছে। অনেক আগে একবার অনু আমাকে বলেছিলো ওর নৌকায় চড়ার খুব শখ। কখনও নৌকায় চড়েনি। আমি বলেছিলাম,
— আচ্ছা ঠিকাছে। এটা তোর জন্মদিনের উপহার হিসেবে তোলা রইলো। পরদিন সকাল সকাল আশুলিয়া গিয়ে আগেই নৌকার বন্দোবস্ত করে ফেললাম। এক ঘন্টা ৫০০ টাকা হিসেবে। নৌকা রেডি করে অনুর জন্য অপেক্ষা করছি। অনু ওর বয়ফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে আসছে। হয়তো এতো সুন্দর একটা মুহুর্তের সাক্ষী দুজন একসাথে হতে চাচ্ছে। আর আমি একটা তিক্ত মুহুর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছি হয়তো। এর আগে আমার সামনেই ওর বয়ফ্রেন্ডকে চুমু খেয়েছিলো একবার। দৃশ্যটা আমার কাছে খুব কষ্টদায়ক ছিলো। মাঝেমাঝে ওদের ঝগড়া হয়। মধ্যস্থতা করার দায়িত্বটা আসে আমার উপর। খুব সুন্দর ভাবে ওদের দুজনকে মিলিয়ে দিয়ে মনেমনে কষ্ট পাই। যদিও আমার কষ্ট পাওয়া উচিৎ না। ওর বয়ফ্রেন্ড আছে জেনেও ওকে ভালোবাসাটা আমার অন্যায়। কিন্তু ভালোবাসা তো কোন নিয়ম মেনে হয়না, জাস্ট হয়ে যায়।
এতো রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো, ভালোবাসা রোগের ভ্যাকসিন কেনো এখনও আবিষ্কার হয়নি? নাকি এই রোগ বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে? ওদের দুজনকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে পাশের একটা চায়ের দোকান থেকে সিগারেট ধরালাম। দায়িত্বটা সঠিক ভাবে শেষ করতে পেরে নিজেকে হালকা লাগছিলো অনেকটা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, আসলেই কি আমার দায়িত্ব শেষ? আমাদের দায়িত্বের তো কোন শেষ নেই। একেরপর এক দায়িত্ব চলে আসে। নিজের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসার প্রতি দায়িত্ব, ফ্যামিলির প্রতি দায়িত্ব। আর এসব দায়িত্বই আমাদের বেচে থাকার প্রেরণা যোগায়। দায়িত্বগুলো আমাদের মৃত্যুর ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে জয়েন করেছি। পঁচিশ হাজার টাকা স্যালারি। এখনও মেসে থাকি, তাই দিব্যি চলে যায়। মাস শেষে আম্মাকে দশ হাজার টাকা পাঠাই। আম্মা টাকা হাতে পেয়েই আমাকে ফোন দেয়, ফোন দিয়ে প্রতিবারই বলে,
— বাবা! পাশের গ্রামের জলিলের মাইয়া আছেনা! আয়েশা? মাইয়াডা খুব ভালো। তুই যদি বলিস তাহলে আমি আম্মাকে থামিয়ে দিয়ে বলি,
— ” আম্মা আমি এখন বিয়ে করবোনা। সময় হলে তোমাকেবলবো।” আম্মা ভাবে আমি হয়তো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এখন বেশি চিন্তিত, তাই বিয়ের কথা ভাবছিনা। অথচ কেউ জানেনা আমি কেবল অপেক্ষা করছি। এই বুঝি কোন একটা মিরাকল ঘটে গেলো। অনু এসে আমাকে বললো,
— ” বোকারাম! আমিও যে তোকে ভালোবাসি বুঝিস না সেটা?” হয়তো আমার মতো এমন হাজারো প্রেমিক তার ভালোবাসার অপেক্ষায় বসে আছে। একটা মিরাকল ঘটার অপেক্ষায় দিন গুনছে। সবারই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় একদিন।
কারওটা শেষ হয় মিরাকল দিয়ে, কারওটা তিক্ত বাস্তবতার মধ্যদিয়ে। ঠিক তেমনি আমারও অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে এসেছে। এইতো! আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যাস। তারপর মুক্তি। আগামী বিশ তারিখ অনুর বিয়ে, ওর প্রেমিকের সাথেই। একটা ভালোবাসার হ্যাপি এন্ডিং হতে যাচ্ছে। সবাই ওদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। অথচ আমরা কেউই জানিনা, প্রতিটা হ্যাপি এন্ডিং লাভ স্টোরির সাথেসাথে একটা স্যাড এন্ডিং স্টোরি লেখা হয়ে যায়। সেই স্টোরিটা কখনও প্রকাশিত হয়না, মনের মধ্যে অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি হয়েই পরে থাকে অনন্তকাল ধরে। গত পরশু অনু আমাকে কার্ড দিতে এসেছিলো। বেশ প্রানবন্ত লাগছিলো ওকে। হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বললো,
–” সবার আগে কিন্তু তোকেই আমার বিয়ের কার্ড দিলাম। সো সবার আগেই আসতে হবে তোকে। বিয়ের সব দায়িত্ব কিন্তু তোর উপর।” আমি মনেমনে অট্টহাসি হেসে বলি, ” দায়িত্ব! আমরা দায়িত্ব মুক্ত হতে চেয়েও বারবার দায়িত্বের জালে ফেসে যাই কেমন করে?” কিন্তু দাত বের করে হাসি দিয়ে মুখে বললাম,
–” আরেহ! তোর বিয়েতে দাওয়াত না দিলেও আমি যেতাম। আর দায়িত্বের কথা বলতে হবেনা আমাকে। শুধু ঐ ভয়ংকর প্রানীটাকে খাচায় ভরার ব্যবস্থা করিস প্লিজ।”
–” ভয়ংকর প্রানী মানে?”
–“আশফাক তালুকদার। মানে তোর বাবা।”
কথাটা বলেই দুজনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। বিয়ের দিন অনুর বাবার মুখোমুখি হলাম আরেকবার, হয়তো শেষবার। আজব ব্যপার, এখনও আমার বুক কাপছে। আসলেই কিছুকিছু ভয়ের কোন মানে নেই। আমি আশফাক সাহেবের মুখোমুখি হতেই আমতা আমতা করে বললাম,
–“স্যার, কেমন আছেন?” আজকে তাকে অন্যরকম লাগছে। শুরুতে ভয় লাগলেও আস্তে আস্তে সে ভয়টা কেটে যাচ্ছে। ভয় কেটে গিয়ে আস্থা তৈরি হচ্ছে লোকটার উপর। হয়তো কেউ যখন খুব খুশি থাকে তখন সে যতোই ভয়ংকর হোক, তার চেহারা থেকে ভয়ংকর ভাবটা চলে যায়। আজকে হয়তো আশফাক সাহেব অনেক খুশি। তিনি হাসিমুখে আমাকে বললেন,
–“এইতো বাবা! ভালো আছি। তোমার অবস্থা ভালো তো?” আমি আনমনেই বললাম, “জ্বি আংকেল”
— তা, এখন তোমার কয়টা জাস্টফ্রেন্ড আছে? প্রশ্নটা করেই অনুর বাবা হো হো করে হাসলেন। আমিও তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে হাসলাম। রাত ১২ টা বেজে গেছে। মাত্রই অনুকে বিদায় দেয়া হলো ফুল দিয়ে সাজানো একটা সাদা গাড়িতে করে। গাড়ির সামনে “শুভ বিবাহ” লেখা একটা সাইনবোর্ডের মতো লাগানো। লাল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো অনুকে। অনেক সময় নিয়েই আমি অনুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ও সেটা খেয়াল করেনি। কেনো যেন অনুকে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিলো,
— “অনু! আমার দায়িত্ব কি তাহলে শেষ?” ওদের বাসার গেট পেড়িয়ে রাস্তায় চলে এসেছি৷ এখনও দু একটা গাড়ি হর্ন বাজিয়ে সাইই করে ছুটে যাচ্ছে। রাতের এই সময়টাতে ড্রাইভাররা গাড়ি চালিয়ে বেশ মজা পায় মনেহয়। রাস্তা একদম ফাঁকা থাকে। ১২০ প্লাস স্পীড ওঠানো যায় চাইলেই। একটু পরপর দু একজন লোক সামনে পড়ছে, ওরা দিনশেষে ফুটপাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ কেউ আবার ফুট ওভারব্রিজের উপরে উঠে ঘুমায়। আমি খুব সন্তর্পণে তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ আম্মার ফোন আসলো, প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আম্মা আমাকে ফোন দেয়। আমি ফোন রিসিভ করেই বললাম!
— আম্মা! আয়েশার বাবার সাথে কথা বলো। আগামী মাসেই বিয়ে করবো।” আম্মা কিছুটা অবাক হয়ে বললো, “হঠাৎ কইরা বিয়ার ভুত চাপলো যে?” আমি মৃদু হাসি দিয়ে আম্মার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাই। বলতে চেয়েও বলিনা,
— “আম্মা আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত