বাসার সামনে গিয়ে কলিংবেলটা বাজানোর সাথে সাথেই দরজাটা খুলে গেল। আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন একজন শাড়ি পরা ভদ্রমহিলা। চেহারায় একটা অমায়িক ভাব বিদ্যমান। আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই সামনের মূর্তিটি বলে উঠলো, “কে আপনি? ” আমি বললাম, “ইন্সুরেন্স কোম্পানী থেকে এসেছি; কিছু কাগজে সাইন করতে হবে আপনাকে।” আমাকে ভেতরে আসতে বললেন উনি। তারপর ভদ্রতা দেখিয়ে বললেন,” আপনি বসুন, আমি আপনার জন্য কফি করে আনছি।” আমি বললাম, “না ম্যাডাম, আমার এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি হলেই চলবে।” পাশেই রেফ্রিজারেটরটা ছিলো। তারপর অভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে বললাম,”এই তো ফ্রিজ, আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি , আপনি অযথা ব্যস্ত হবেন না।”
আমি রেফ্রিজারেটরের দিকে অগ্রসর হয়েছি দেখে মহিলাটি প্রচন্ড রাগ আর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললেন, “ফ্রিজে পানি নেই, আপনি বসুন আমি কফি আর নরমাল পানি নিয়ে আসছি।” অগত্যা আবার বসে পড়লাম। ঘরটা ছোটখাটো হলেও বেশ গোছানো এবং পরিপাটি। সেই সাথে ঘরের প্রতিটি দেওয়াল থেকে ভেসে আসছে ফুলের সুগন্ধ। গন্ধটা এতই তীব্র ভাবে ব্যাপিত হয়েছে যে আমার মস্তিষ্ক সেটাকে সুগন্ধ না ভেবে দুর্গন্ধ ভাবার সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে। গন্ধটা যেন এ বাড়ির কোনো এক বিস্ময়কর রহস্যকে ঢেকে রাখতে চায়।
এই ছোট্ট ঘরটিতে জ্বলছে একটা ঈষৎ লালচে আলো। বেশ একটা ভৌতিক পরিবেশ। বসার ঘর থেকেই লক্ষ্য করলাম যে মহিলাটি আমাকে বেশ কয়েকবার লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। মহিলাটি কি তবে ভয় পেলেন?
আমার এক স্যার বলতেন কেউ অযথা ভয় পেলে তার ভয় কে বাড়িয়ে দিতে হয়। আমি স্যারের উপদেশ মোতাবেক রেফ্রিজারেটরের পাশে বেশ একটা সাহেবি ভঙ্গিতে পায়চারি করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে রেফ্রিজারেটর টা খুলছি, আর সাথে সাথেই বন্ধ করে দিচ্ছি। এই বন্ধ ও খোলার মাঝে বেশ একটা আনন্দ আছে। ছোটবেলায় এরকম দুষ্টুমি করতাম মাঝে মাঝেই। আজ বড় হয়েও অভ্যাসটা গেল না। মানুষকে ভয় পাওয়াতে আমার বেশ ভালো লাগে। ৮মিনিট পর মহিলাটি ২কাপ কফি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরে এলেন। মহিলাটির হাত তখন হালকা কাপছে। তারমানে আমার এই ছেলেমানুষি সে লুকিয়ে দেখেছে! আর দেখে বেশ খানিকটা ভয়ও পেয়ে গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম কফির কাপের রং দেখে। একটা কাপ সাদা এবং আরেকটা নীল। আমাকে নীল কাপটা এগিয়ে দিতেই বলে উঠলাম, “মাফ করবেন, নীল রঙটা আমার কেমন জানি অপছন্দের, আপনি সাদাটা আমাকে দিন। “
আমার অভদ্রতার কারনে কিনা জানিনা, মহিলাটির চোখ লাল হয়ে উঠলো। তারপরও সাদা কাপটিই দিলেন।
আমি কফি খেলাম কিন্তু মহিলাটি খেলেন না। কফি শেষ করে পানির গ্লাসে হাত দিতে যাচ্ছি এমন সময় যে ঘটনাটা ঘটলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বুকের দিকে তাক করে মহিলাটি একটা পিস্তল ধরে আছেন। বললেন, “ডোন্ট মুভ ; কে আপনি? “
আমি দুইহাত উচু করে মহিলাটির চেহারা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি আর নিজের হৃদস্পন্দন গুনছি। দেখলাম মহিলাটির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমার থেকে বেশি ভয় বোধহয় উনি পেয়েছেন ভেবে, এই পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পেলো। আমি অপেক্ষা করে আছি রাইট অপরচ্যুনিটির। মহিলাটি ক্রমেই আমার কাছে চলে এলেন। আমার বুকের দিকে পিস্তলটার মাথা লাগিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আপনি মরতে চলেছেন। মরার আগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে যেতে পারেন। “
আমি একদম স্থির ভঙ্গিতে বসে রইলাম। মহিলাটি তার হাতের যন্ত্রটা আমার মাথার দিকে তাক করলেন। আমার সামান্য একটু ভুল হলেই যন্ত্রটা থেকে একটা ধাতব বুলেট আমার মস্তিষ্ক ভ্রমণ করে বেরিয়ে যাবে। আমি মহিলাটির মনোযোগ অন্যদিকে নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মহিলাটি তাতে মোটেও আগ্রহ দেখালেন না। দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ৭টা ৫৮ বাজে। আমার মনে একটা ক্ষীন আসার আলো ফুঁটে উঠতে লাগলো। নিজের সময়জ্ঞান নিয়ে মনে মনে নিজেকে অনেক বাহবা দিলাম। আমি জানি আমার পরিচয় না জানা পর্যন্ত মহিলাটি আমাকে মারবে না। ৮ টা বাজতে আর ১০ সেকেন্ড বাকি। মহিলাটকে অবাক করে দিয়ে আমি গুনতে শুরু করলাম – …৯….৮…৭…….১। শূন্য বলার সাথে সাথেই
হঠাৎ আমার এলার্ম ঘড়িটা বেজে উঠলো। একটা ভয়ঙ্কর রকমের করুন সুরে ভরে উঠলো ঘরটা। বোধকরি সেই সুরের আওয়াজ আমার সামনে ঝুকে থাকা মহিলাটির কর্ণ ভেদ করে হৃদয়ে পৌছে গেছে। এক অদ্ভুত কম্পন অনুভব করলাম। এলার্ম ঘড়িটার সুরটা আকষ্মিক ভাবে আমাকে এর আগেও অনেকবার সাহায্য করেছে। পরিস্থিতি বুঝে আমি এলার্ম দিয়ে রাখি। এলার্মে বাজা সুরটা আমার বেশ ভালো লাগে। সুরটা হৃদপিন্ডে একটা কম্পন তুলে দেয়। আমার ক্ষেত্রে কম্পনটা আনন্দের আর আমার সাথে সাথে যারা শোনে তাদের জন্য ভয়ের। মানুষের ভয় বড় রহস্যময় একটা অনুভুতি। হাতে পিস্তল থেকেও লাভ নেই যদি কিনা মনে ভয় থাকে। আমি বরাবরই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। আমার কাজে এই একটা বিষয়ে দক্ষ না হলে চলে না । মহিলার হাতের পিস্তলটা এখন আমার হাতে। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ থেকে নীল আভা বের হচ্ছে; মনে মনে তার নাম দিলাম নীলাক্ষি। আমি আর কথা বাড়ালাম না। রেফ্রিজারেটরের সামনে চলে এলাম।
মহিলাটি এবার কাঁদতে কাঁদতে বললেন ,” কে আপনি? ” আমি বললাম, “আমি পেশায় একজন সার্জন।এ পেশায় বেশ নামডাক আছে আমার। কিন্তু আমার আরেকটা পেশাও আছে। যেটা সবাইকে বলিনা। আপনাদের মত কিছু মানুষদেরকেই বলি। এটা অবশ্য শখের পেশা বলতে পারেন। আমি কাঠের হৃদপিন্ড বানাই। কাঠের হৃদপিণ্ড হওয়ার আগে ওগুলা যখন একটা গাছের অংশ ছিলো, তখন ওগুলারও প্রাণ ছিলো।
মহিলাটি ভয়ে এবং বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, “নীল রঙের কাপটিতে আপনি অচেতন হওয়ার ওষুধ মিশিয়েছিলেন। আপনি যেমন আমার দিকে নজর রাখছিলেন, তেমনি আমিও রেখেছি। তবে আজ থেকে নয় ; বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। বেশকিছুদিন যাবত আমি মারত্মক কিছু পিশাচ শ্রেণির খুনীদের হৃদপিণ্ড সংগ্রহ করছি। সে হিসেবে আপনি আমাকে সিরিয়াল কিলারও ভাবতে পারেন।”
মহিলাটি বিস্ময়ের সাথে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম – “আপনি একটা মানুষরূপী পিশাচি ; এলিজাবেথ বিথোরির থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন আপনি যদি আপনাকে থামানো না হয়। নিজের সহজ সরল স্বামীকে খুন করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছেন।আর নিজের আট মাসের বাচ্চা কে, মানুষের রক্ত-মাংস খান নাকি?”
সামনে বসে থাকা পিশাচিকে আর আমার প্রশ্নের জবাব দিতে দিলাম না।খানিকটা জোর করেই নীল কাপের কফিটা তাকে খাওয়াতে হলো। তিনি যখন পুরোপুরি অচেতন তখন ব্যাগ থেকে আমার সার্জারি করার বাক্সটা বের করলাম। হার্টের সার্জারি করার অভিজ্ঞতা থাকায় মহিলাটির হৃদপিণ্ড বের করে আনতে খুব বেশি সময় লাগলো না। তার রক্তমাখা হার্টখানা যে স্থানে ছিলো, সে স্থানে নিজের হাতে তৈরি একটা কাঠের হৃদপিণ্ড বসিয়ে সেলাই করে দিলাম।
ফ্রিজে আরো একজনের জায়গা ছিলো। মহিলাটিকে তার স্বামীর পাশে জড়োসড়ো করে কোনোরকমে রেখে ফ্রিজের ঢাকনাটা দিয়ে দিলাম। তারপর ফ্রিজের সাথে একটা চিরকুট ঝুলিয়ে আমার এলার্ম ঘড়ির করুন সুরটা গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলাম। চিরকুটে লেখা ছিলো –
” স্যার, আমাকে খুঁজে আর সময় নষ্ট করবেন না; দেশে চোর ডাকাতের উপদ্রবে মানুষ অস্থির। আমি কথা দিচ্ছি আর মাত্র ৫টা খুনীর হৃদপিণ্ড সংগ্রহ করে আমার নিজের হৃদপিণ্ডটা আপনাকে উপহার দিয়ে যাবো। বেশ কিছুদিন হলো আমার নিজেরও একটা কাঠের হৃদপিণ্ড পরে দেখার সখ হয়েছে। হাহ হাহ হা…….”
গল্পের বিষয়:
গল্প