মায়বিনী

মায়বিনী
হঠাৎ-ই কপালে কারো নরম ঠোটের কোমল ছোঁয়া পেলাম। নিশ্চই রূপার! ও ছাড়া আর কে বা হবে। আমি তাকালাম না। ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। স্পর্শটা আরেকবার পাবার আসায়। যদি ভুলে আরেকটা দিয়ে দেয়! সেই আশায়। আমার ঘুমটা পুরোপুরি আসেনি৷ কেবল চোখ লেগে এসেছিল। রূপা ঘরে ছিল না৷ স্টাডি রুমে কী জানি করছিল৷ আমি একবার নক করে এসেছিলাম। সে বলল শুয়ে যেতে। শুয়ে যাওয়ার কিছু সময় পরেই রূপা এই কাজটা করে। আমার কপালে তার নরম ঠোঁট দুটো ছোঁয়ায়।
আমি প্রবল আগ্রহে দ্বিতীয় ছোঁয়াটি পাবার অপেক্ষা করলাম। আমার আগ্রহ বিফলে গেল। রূপা সেই ভুলটা করেনি৷ পাশ থেকে উঠে গেল যেন। আমি তা অনুভব করলাম। আমি আস্তে করে চোখ খুলে চাইলাম। রুপা উঠে গিয়ে আলিমারির দিকে এগোয়। আমি ওকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করি৷ তখনই আমার চোখ যায় ওর হাতের দিকে। আমি কিছুটা চমকে উঠি। আমার বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড় করে উঠে। ছোট্ট একটা কালো কালারের ডায়েরি ওর হাতে। যেটাতে আমি আমার বিভিন্ন সময়ে ভালো লাগার মানুষ গুলোর কথা লিখে রাখতাম।
ও আস্তে করে ডায়েরিটাকে আলিমারির একেবারে নিচের একটা ড্রয়ারে এক কোনায় লুকিয়ে রাখল। আমার মাথায় তখন ভাবনায় ভরপুর। মেয়েটা ডায়েরিটা পেলো কোথায়? স্টোর রুমে? আশ্চর্য! আমি ভেবেছিলা ওটা হারিয়ে গিয়েছে। রূপা উঠে দাঁড়ালো। ও যখন পিছন ফিরবে আমি ঠিক তখনই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম। এমন ভাব করলাম যেন আমি গভীর ঘুমে কাতর। ও ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। ঠিক আমার বালিশের কাছে চলে আসে। আমি তার চুলের ঘ্রাণ পাই। গায়ের সেন্টের ঘ্রাণটা এখনও যায়নি। কেমন অদ্ভুত মোহময় একটা ঘ্রাণ। আমার যেন ঘোর ধরে। অনুভূতি গুলো শিরশিরিয়ে উঠে। রুপা তার কোমল হাতে আস্তে করে কিছু সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর পূর্বের ন্যায় আবার চট করে কপালে চুমু খায়।
আমার কাছে কেমন জানি ভালো লেগে উঠল। আমার গোপন কথা গুলো জেনে যাওয়ায় রুপা আমার উপর রেগে যায়নি। এ’ই অনেক। আমিতো এতক্ষন বেশ ভয়েই ছিলাম। এই ঢেকে তুলে একগাদা ঝাড়ি শুনাবে বলে। ভয়টা দুর হয়ে আনন্দের শিহরন বইতে থাক্র হৃদয় পল্লিতে। এই ছোট ছোট চুমু গুলো আমায় আবার নতুন করে ভালোবাসতে শিখায়। আমি নতুন কিছু অনুভব করি যেন। অদ্ভুত আনন্দময় কিছু। ওর প্রতিটা ছোঁয়ায় আমি আমি ভালোবাসা অনুভব করি। একটু কমও না। বরং বেশিই বলা চলে। আমি অনুভব করি তীব্র আস্থা ভরা একটি আত্মাকে। রুপা আর আমার পাশে থাকল না। উঠে কোথায় যেন চলে গেল। কিছু সময় পরও রুপা আসল না। আমি আস্তে করে উঠে গেলাম।পাগলিটা নিশ্চই ছাদে গিয়েছে!
আমি ছাদে যেতেই দেখলাম রূপা দোলনাটায় বসে আছে। একেবারে চাঁদের দিকে মুখ করে। যেন চাঁদ আর সে প্রেম করছে। এদের চোখাচোখি হচ্ছে৷ দৃষ্টি প্রেম হচ্ছে৷ অথচ প্রেমিকার চেহারা ভর্তি বিষন্নতা। কেমন নির্বিকার উদাসিনতা। আমার কেন জানি খুব হিংসে হয়। আমি ধীর পায়ে গিয়ে তার পিছনে দাঁড়াই। সে মৃদু স্বরে গান গাচ্ছে। আমি তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। তার চিকুন স্বরে গানের প্রতিটা কলি কেমন যেন মোহময় হয়ে উঠছে। একদম হৃদয়ের গভীরে লাগছে। প্রতিটি চরণ যেন একেবারে হৃদয়ের মধ্যখানে গিয়ে ভালো লাগা ছড়াতে থাকে। আমি শুনে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে তার পাশে বসলাম। সে তখনও গান গেয়ে চলছিল। আমি শুনছিলাম।
গান শেষে আমি মৃদু স্বরে বললাম,
:এত রাতে ছাদে এলে যে? সে নিচের দিকে তাকিয়ে উদাসী স্বরে বলে,
:এমনিই। ভালো লাগছিল না।
:মন খারাপ?
:নাহ্!
আমি কিছু বললাম না।শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম; ঠিক চাঁদটার দিকে মুখ করে। কোন একটা ফুলের ঘ্রাণ বাতাসের সাথে ভেসে আসছে। ঘ্রাণটা একেবারে নাকের ভিতর দিকে হৃদয়ে চালান হয়ে যায়। সেদিকে ধ্যান দিলাম না। আমি উজ্জ্বল চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়। তারপর বললাম,
:ডায়েরিটা পড়েছ তাই না? পিছন থেকে চট করেই কোন আওয়াজ আসে না। কিছু সময় পর কারো উপস্থিতি টের পাই পাশে। সাথে উত্তরটাও। বলল,
:পড়েছি তো বটেই।তবে কিছু রহস্য যেন রয়েই গেল।
:কি?
:তোমার শেষ ভালোলাগার মানুষটার নামটা আমি জানতে পারিনি। কে গো সেই মায়াবিনী? কী নাম তার? যাকে তুমি এত ভালোবাস।এখনও!
তার কণ্ঠে কেমন না বলা আর্তনাদ। কিছুটা অস্বস্তি কিংবা হিংসে ভরা দৃষ্টি। কেমন তার এই মহারানীর কোমল স্বর। বললাম,
:বলব। সব বলব তোমায়। তবে একটা শর্তে।
:বল! কী শর্ত? যেকোন শর্ত আমি মেনে নিতে রাজি।
কেমন দ্রুত ও স্পষ্ট তার জবাব৷ যেন সমস্ত ব্যাপারটা জানার ভীষণ আগ্রহ তার। আমি খানিকটা রসিকতার স্বরে বললাম,
:এত ইচ্ছা! কেন? খুব জ্বলছে?
:না জ্বলে কী আর উপায় আছে? তোমার সব স্বপ্ন তো সেই অপরিচিতাকেই নিয়ে! অথচ যার সত্যিকার অংশীদার আমি। এখন সেই মায়াবিনী আমার অংশে ভাগ বসিয়েছে। তাহলে তুমিই বল আমার জ্বলবে না। বল! জ্বলবে না?
আমি মৃদু হাসলাম পাগলিটার কান্ড দেখে। বললাম,
:আমি কিন্তু সব টুকু লিখিনি ডায়েরিতে!
:আরো বাকি আছে? তার কাতর ভরা প্রশ্ন৷ বললাম,
:হুম! আজ সব খুলে বলব।যা পড়েছো তা এবং যা পড়োনি, তাও।
:বল না! আমার যে আর অপেক্ষা করতে মন চাইছে না।
:শর্ত?
:বল। কী শর্ত?
:মুখটা এমন প্যাঁচার মত করে রাখবা না। আমার খারাপ লাগে। তোমার কালো মুখখানা দেখলে কিন্তু আমি আর বলব না।
:আচ্ছা। ঠিক আছে। এই দেখ হাসলাম। সত্যিই সত্যিই পাগলিটা হাসল। প্রানহীন হাসি যাকে বলে আরকি।যে হাসিটা ভালোবাসা নেই, যেখানে স্পষ্ট ব্যাথা অনুভব করা যায়৷ কিছু সময় অপেক্ষা করে থেকে বললাম,
:শোনো! সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। ট্রেনে করে ফিরছিলাম। আমি বসেছিলাম ঠিক ট্রেনের বাঁ পাশের একটা কামরায়। আমার ঠিক বিপরীতে ডানদিকের কামরাটায় বসেছিল মেয়েটা। মেয়েটা যখন বাইরে বৃষ্টি দেখায় ব্যাস্ত তখন আমি ব্যাস্ত ছিলাম তাকে দেখায়৷ সেই মায়াবিনীকে দেখায়।
আমার আমার কামরা থেকে তাকে স্পষ্ট দেখছিলাম। জানো? মেয়েটার পাগল করার মতো দুটো চোখ আছে। যা আমার চোখের সামনে এখনও ভেসে বেড়ায়। বার বার তার প্রেমে ফেলতে বাধ্য করে। আমি চাইলেও যেন চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। যেন আমার চোখ গুলো মায়াবিনীর দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যই তৈরি হয়েছে। এ যেন নিজের সম্পদ। হঠাৎই কিছু একটা আমাকে ওর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে।উন্মাদনায় ভাসিয়ে নিচ্ছে। আমি এসব প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিলাম না৷ এসব আমার কাছে কেমন ড্রামা ড্রামা লাগতো৷ কিন্তু তাকে দেখার পরই আমার সমস্ত কিছু পাল্টে গেল। আমার পুরো দুনিয়াটাই যেন পরিবর্তন হয়ে যায়। এই বলে আমি রূপার দিকে তাকাই। আঃ এ কী চেহারা বানিয়ে রেখেছে মেয়েটা। একেবারে গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বিষন্ন মায়ায়। মুখখান কী ভীষণ মলিন। অথচ আমি শর্ত দিয়েছিলাম মন খারাপ করা যাবে না। সে শর্তটা মানছে না। এটা অন্যায়। আমি বললাম,
:এটা কিন্তু কথা ছিল না রূপা। তুমি একদম মন খারাপ করতে পারবে না বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু আমি আর বলব না। তার কেমন ভেজা উত্তর,
:এই বারের জন্যে মাপ করে দাও। আর করব না। প্লিজ!আসলে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না।
:আচ্ছা। শোনো বাকিটা! মুখ কালো করবা না বলে দিলাম৷ আমার খারাপ লাগবে তাহলে। আমার কাছে একটা জিনিস খুব অদ্ভুত লেগেছে। জানো রুপা!আমি তার দিকে এতটা সময় তাকিয়েছিলাম,অথচ মেয়েটা আমার দিকে একবারও ফিরে চায়নি। আমি যে ওই ট্রেনে ছিলাম সেটা হয়ত মেয়েটা উপলব্ধিই করতে পারেনি। তবুও আমি নেশা কাতুর হয়ে মেয়েটার তাকিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
অথচ আমি জানতাম মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর। কেউ তাকিয়ে থাকলেও তা আঁচ করতে পারে৷ কিন্তু সেদিন মেয়েটা এই ব্যাপারটা কেন জানি পারল না৷ ব্যাপারটা অবশ্য আমার জন্যে ভালোই হলো। যাই হোক, সেদিন মেয়েটা ট্রেন থেকে নেমে জনসমুদ্রে হারিয়ে যায়। আমি পুরো স্টেশনটা তন্ন তন্ন করে খুঁজি। কিন্তু পাই না। মেয়েটা হারিয়ে যায়। নিয়ে যায় আমি হৃদয়টাকে। আমার ক্লান্ত, ভালোবাসায় ডুবে থাকা আত্মাটাকে। রূপা, আমার ক্লাস নাইনে থাকতে একটা মেয়েকে ভালো লাগত, ইন্টারেও একটাকে ভালো লেগেছিল।তখন আমার তাদের প্রতি এতোটা ভালো লাগা অনুভূত হয়নি যতোটা এই অপরিচিতার জন্যে হয়েছে। তখন হয়তো সেটা ছিল বয়সের দোষ৷ কিছু এখনকার এটা? এই টান? এই পাগলকরা অনুভূতি? এসব কী? বয়সের দোষ তো নিশ্চয়ই নয়।
বাড়ি ফেরার পর থেকেই আমি কিছুটা উন্মাদ প্রবণ হয়ে যাই। চোখ গুলো যেন আমরণ অনশন করে। যেন তাদেরকে সেই মায়াবিনীকে দেখাতেই হবে। আমি শুধু বললাম,খুঁজে বের কর তোদের মায়াবিনীকে। আমি খুঁজতে পারব না। চোখ গুলো তা মেনে নিল এবং ঠিকই তাদের মায়াবিনীকে খুঁজে নিল। দ্বিতীয় বার দেখা হয় মেয়েটার বাড়িতে। ভাগ্য হয়তো আমার প্রতি প্রসন্ন ছিল৷ কিংবা হয়তো আল্লাহ তা-ই চাইছেন৷ আমি সেদিন চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই দেখলাম একটা মেয়ে নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কী জানি বলছে। আমি একটু ভালো করে তাকাই। দেখি ছোট একটা ছেলেকে। সে নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। উপর থেকে ওকে মেয়েটা কী জানি বলছে। খুব সম্ভব কিছু একটা কিনে আনতে বলছে। চোখ গুলো যে এত তাড়াতাড়ি খুঁজে নেওয়ার কাজটা সেরে ফেলবে তা আমার বোধগম্য ছিল না। যার যেটা দরকার সে সেটা খুঁজে নিবেই। মাঝখানে লাভটা হল আমার। হৃদয়ের! আমার হৃদয়ের।
সেদিন বাড়ি ফিরে আসি আনন্দে মুখরিত একটা হৃদয় নিয়ে। একটা রঙিন পৃথিবী নিয়ে। আশে পাশের সব কিছুই যেন তখন রঙিন মনে হয়। এক অন্য রকম খুশির মধ্যে বাস করতে শুরু করি। মনের ভেতরে তুমুল তোলপাড় শুরু হয়। আনন্দের তোলপাড়। মায়াবিনীকে বার বার দেখার তোলপাড়। প্রতিদিন মায়াবিনীকে দেখতে যাব, দেখতে পাব বলে মনের ভেতর এক আকৃত্রিম শিহরন সৃষ্টি হয়। সেই শিহরণ আমার সমস্ত দেহে আনন্দের বার্তা পাঠায়। বন্ধু সমাবেশে গেলে আড্ডায় মন জমে না। মায়াবিনীকে নিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকি। বার বার সেই দু’চোখ ভেসে উঠে আমার নেশা কাতুর দু চোখের মাঝে। মাঝে মাঝে ঠোট বাঁকা করে মৃদু হাসি আনমনে। এই নিয়ে কতো কথা শুনেছি বন্ধুদের কাছ থেকে তার অন্তঃ নেই। তারা কারন জানতে চায়। কী দুর্ভাগ্য আমার! আমি কারনটাও স্পষ্ট বলতে পারি না। বলতে পারি না সেই অপরিচিতার কথা।
অপরিচিত একগুচ্ছ মায়ার কথা। কেন? জানি না! সত্যিই আমি জানি না। এরপর প্রতিদিন মায়াবিনীকে দেখার জন্যে সব কাজ ফেলে চলে যেতাম তার সন্ধানে। তার বাড়ির ধারে। চুপি চুপি,আড়াল হয়ে তাকে দেখতাম। যখন তাকে দেখা যেত তখন। সামনে যাওয়ার বিন্দু মাত্র সাহস আমার তখন ছিল না। জানি না! তখন কি হয়েছিল আমার। কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে আমার মাঝে। আনমনে রাস্তা পার করতাম। ফুটপাতের মাঝে হাঁটতাম আনমনে। বেশ কয়েকবার কয়েকটা লোকের সাথে ধাক্কা খেয়েছি।কেউ পড়ে গিয়েছে।আমি হাত বাড়িয়ে তাকে উঠাতাম। কী করুন স্বরে ক্ষমা চাইতাম আমি। লোকটা আমার এমন অদ্ভুত ভঙ্গি দেখে চট করেই কিছু বলত না। আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলত, “লোকটা পাগল নাকি?” আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। খুব সুন্দর করে হাসতাম।
মনে মনে বলতাম সত্যিই আমি পাগল হয়ে গেছি। সত্যিই! অন্য সময় হলে লোকটাকে বেশ কিছু কড়া কথা বলে দিতাম। কয়েকটা মেরেও দিতাম। কিন্তু আজ কী হলো! মারা তো দূরে থাক একটা কথাও বলতে পারলাম না। কী পরিবর্তনটাই না দেখা দিল আমার মাঝে। অদ্ভুত সেই পরিবর্তন। কোন সময় কোন ভিখারিকে দু’টাকা পর্যন্ত দিতাম না। কিন্ত আজ! আজ দশটাকা দিতে গিয়ে দিয়ে দিলাম একশ টাকা। আনমনে। মনের অবচেতনে। লোকটা একশ টাকার চকচকে নোটখানা দেখে তৃপ্তির হাসি দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “অনেক বড় হও বাজান! অনেক বড় হও। আমার থেকে কেন জানি অদ্ভুত ভালো লাগল। অন্য সময় সে মাথায় হাত বুলিয়ে কেমন বাজে অনুভূতি হতো! ভাবতাম লোকটার অপরিষ্কার হাত মাথায় লেগেছে! ছিহ! কিন্তু আজ? আজ কেন জানি তা হয়নি। তার শক্ত চামড়ার হাতের স্পর্শও কেমন জানি কোমল লাগল। পরম মায়ায় তা মাথা পেতে নিলাম।
এমন কিছু পরিবর্তটাই না দেখা দিল আমার মাঝে। যেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে আর ঠিক আগের মত কন্ট্রোল করতে পারছি না। কেউ একজন ভিতরে বসে নিজেকে কন্ট্রোল করছে। সে আমার সব নিয়ন্ত্রণ নিজের করে নিয়েছে। আমি বার বার তাকে খুঁজি। পেয়েও যাই সেই মায়াবিনীকে। যে আমার ভিতরে নিজের বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে। নিজের একটা ঘোরময় জগৎ সংসার তৈরী করে বসেছে।
বৃষ্টি হয়। টুপটুপ শব্দ করে। আমি কান পেতে শুনি। যেন মায়াবিনী আসছে। ধীর পায়ে। নুপুরের ঝন ঝন আওয়াজ নিয়ে। বৃষ্টি মাখা বেলি ফুলের মাতাল করা গন্ধের হাওয়া আমার নাক দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছে যায়। আমি তা গ্রহন করি তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধ মনে করে। যেন এই ঘ্রাণটা মনের প্রতিটি পরশে শান্তির আবরন দিয়ে যায়। আমি তা হৃদয়ের দেয়ালে মাখাই। নীলাভ বজ্রপাতের আলো আমার ঘরের দেয়ালে আছড়ে পড়ে। আমি সে আলোয় মায়াবিনী ছায়া খুঁজে বেড়াই। নিজেকে একটু সেই আলোয় ভিজিয়ে নেই। যেন মনে হয় মায়াবিনীর রূপের আলো আমার গায়ে আছড়ে পড়ছে। আমি তা পরম মায়ায় নিজের গায়ে মাখাই। জানো রূপা, এই ছাদের প্রতিটা বালুকণা সাক্ষি, আমি মায়াবিনীর জন্যে কত কত রাত এভাবে একা বসে কাটিয়েছি।
চাঁদের আলোয় নিজের ছায়াকে মায়াবিনীকে কল্পনা করে কতো গল্প-কল্প করেছি। যেন সে আমার খুব পাশে,একেবারে গায়ের সাথে গা এলিয়ে বসে আছে। আমার রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র সাক্ষি। তাদের সাক্ষি রেখে লিখেছি কত আবোলতাবোল কবিতা। লিখেছি কত গল্প। সাক্ষি ছিল আমার ভাঙ্গাচোরা সেই মোবাইল। এই বুড়ো দু আঙুলও। দু’চোখ সাক্ষি ছিল। সাক্ষি ছিল ফেসবুক নামক জায়গাটার প্রতিটা বন্ধু। যারা উন্মাদ হয়ে থাকত কখন গল্প দিব আমি। কখন তারা আমার সেই আবোলতাবোল কথা গুলো গিলবে। জানো রূপা, রূপা! আমি পিছন ফিরে চাইলাম। দেখলাম আমার মায়াবিনী দোলনায় বসে দু’চোখ ভাসাচ্ছে। আমি দু’পা ফেলে ওর সামনে গেলাম তড়িৎবেগে। ওর পাশে বসে বললাম,
:অ্যাই রুপা! অ্যাই! তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে না বললাম কাঁদবে না। একদম না! আমার কষ্ট হয় জানো না?
ও দু’চোখ মুছে বলল,
:তুমি আমাকে এত ভালোবেসেছ যে কোনদিন কল্পনাই করতে পারিনি যে তোমারও এমন রঙিন একটা অতিত আছে। একটা সময় তুমিও কাউকে ভীষণ ভালোবাসতে। কীভাবে পারলে তুমি, দুজন মানুষকে ভীন্ন রকমে এতো ভীষণ ভালোবাসাতে?
:আমি মোটেও ভীন্ন দুজন মানুষকে ভীন্নভাবে ভালোবাসিনি। আমি একজনকেই ভালোবাসেছি আমার মত করে। যেমন করে মায়াবিনীকে ভালোবেসেছি। জিবনে একজনকেই মন প্রান দিয়ে ভালোবেসেছি আমি।
:মানে?
:আমার কোলে মাথা রাখো। আর একদম কান্না করবা না। আমি যা বলছি মনযোগ দিয়ে শোনো৷ এই গল্পটা আজ তোমার শোনা উচিৎ। এটা তোমার অধিকার।
:আচ্ছা বলো। এই বলে ও আমার কোলে মাথা রাখল। আম আবার কল্পনায়য় ডুব দিয়ে ফিরে গেলাম অতিতে। ঠিক যেখানে এসে থামলাম সেখান থেকে শুরু করলাম।
-একদিন কি করেছি জানো? মায়াবিনীর চোখ দিয়ে হুট করেই কোন ট্রাফিক সিগন্যাল না মেনে লুকিয় লুকিয়ে ঢুকে পড়লাম মায়াবিনীর হৃদয় গহ্বরে।একেবারে হারিয়ে গেলাম।
জানি না, কেমন একটা নেশার মতো হচ্ছিল৷ আমার মনে হচ্ছিল আমি মায়াবিনীর চোখ দিয়ে তার হৃদয় পড়তে পারছি৷ তার হৃদয়ের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারছি। কিন্তু জানো! আমাকে না খুব হতাশ হতে হয়। মায়াবিনীর মনের কোঠরের একটা দরজাও আমার জন্যে খোলা ছিল না। একটাও না। আমি পাগলের মত খুঁজলাম। কিন্তু একটা দরজাও খোলা পেলাম না। প্রতিটা দরজায় উপর লিখা, “আমার আগন্তুক স্বামি ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিশেধ।” একটু হতাশ হলাম। চারপাশ ঘুরা শেষে যখন একেবারে শেষ দরজাটার সামনে এলাম তখন আমাকে খুব অবাক হতে হল। সেখানে তার স্বামির কথা লিখা নেই। অন্য কেউ একজনের কথা লিখা। যেখানে তার স্বামিও ঢুকতে পারবে না।
জানো কে সে? একজন লেখক। যে আবেগের বসে গল্প লিখত তার মায়াবিনীকে নিয়ে। আর আমার মায়াবিনী ছিল তার ক্ষুদে পাঠক। যার জন্যে আমার মায়াবিনী অনেক কেঁদেছে। নিজের অব্যক্ত কথা গুলো সেই আবেগি লেখককে বলতে না পারায় খুব কেঁদেছে আমার মায়াবিনী। আমার খুব খারাপ লাগল। কারন মায়াবিনীর হৃদয়ে আমার জন্যে বিন্দু মাত্র জায়গাও নেই। অনেক খুঁজেছিলাম সেই লেখক কে।কিন্তু পাই নি তখন। পেয়েছি তো বটেই। একটু দেরিতে। আমি বিমর্ষ হৃদয় নিয়ে ফিরে এলাম মায়াবিনী হৃদয় গহ্বর থেকে। যেন সারা বেলা ভিক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা এক ক্লান্ত ভিক্ষুক। ক্ষুদার্ত কাক যেমন গৌধুলি লগ্নে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে ঠিক সেভাবে আমি ফিরে এলাম মায়াবিনীর হৃদয় থেকে। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য যেহেতু করেছি সেহেতু শাস্তি পেতেই হবে।
আমার ঠিক তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি এতক্ষণ মায়াবিনীর দিকে এক রোখা হয়ে তাকিয়েছিলাম। আমার কেবল মনে হচ্ছিল হঠাৎই একরকম ঘোর ধরল আমার চোখে৷ আমি যেন কোথাও ডুবে যাচ্ছি৷ মায়াবিনীর মায়ায় আকৃষ্ট হচ্ছি৷ আমি ভাবছিলাম, আমি মায়াবিনীর হৃদয় গহ্বরে প্রবেশ করে তার গভীরের কথা গুলো জেনে গিয়েছি৷ যেটা আমার অন্যায় হয়েছে। আমি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম তার দিকে৷ পাশ থেকে আমার বন্ধুর মৃদু ধাক্কায় আমি বাস্তবে ফিরে আসি। ঘোর কাটাতেই দেখলাম মায়াবিনী সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাগত চেহারা নিয়ে। আমার থেকে কেন জানি সেটাও খুব ভালো লাগল। আমি মৃদু হাসলাম। আমার হাসি দেখে মায়াবিনীর রাগটা আরেকটু ছড়ে যায়। ঠাশ করেই একটা চড় বসিয়ে দেয় আমার গাল বরাবর। বলে,
-স্টুপিড ছেলে কোথাকার। কেউ মেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকে? লজ্জা করে না? সে আমায় অপমানিত করলো৷ আমি তা পরম মায়ায় মাথা পেতে নিলাম। যেন কোমল কিছুর স্পর্শ পেলাম। আমাকে বকেঝকে মায়াবিনী চলে গেল হন হন করে। রেস্টুরেন্ট এর প্রতিটা মানুষ আমাকে দেখছে। যেন আমি কোন নতুন পশু যাকে সদ্য আনা হয়েছে চিড়িয়াখানায়। মানুষ ভীড় করে আমাকে দেখছে। আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকাতেই দেখলাম সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটা কথাও বলতে পারছে না। তার দৃষ্টি ভর্তি প্রশ্ন৷ আমি চুপ করে থাকি৷ মায়াবিনীর যে টেবিলে বসেছে সেদিকে নজর যায়৷ কিছু একটা দেখি যেন৷ আমি আস্তে করে উঠে যাই। নীল কালারের ডায়েরিটাকে আস্তে করে সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে আসি। কেউ টেরও পায়নি। রূপা হুট করেই আমার কোল থেকে মাথা তুলল। আমার দিকে প্রশ্নবাণ হয়ে তাকিয়ে থাকল। আমি থামলাম না। বললাম,
:সেদিন আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। খুব খুশি। কারন মায়াবিনীর হৃদয় কোঠরে যে লেখকের নাম লেখা ছিল সেই লেখক আর কেউ নয়। আমি নিজেই। আমার আবোলতাবোল লেখা গুলো মায়াবিনী পড়ত। নিজেকে আমার গল্পের মায়াবিনী চরিত্র কল্পনা করত।
রাত দিন আমাকে নিয়ে ভাবত। নিজের অব্যক্ত কথা গুলো না বলতে পারায় লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। কেন জানি লেখা গুলো পড়ে আমার চোখ ভিজে এল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে বলে। বেশ কয়েকটা চিঠি পেয়েছিলাম ডায়েরিটার ভিতরে। সব গুলোই ছিল আমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে মায়াবিনীর স্বপ্ন গুলোর কথা। আমি এক এক করে প্রতিটা চিঠি পড়লাম। পড়ে নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার দুজন দুজনকেই ভালোবাসি। একই ভালোবাসা। শুধু পথটা ভিন্ন। দুজনের রাস্তাটা ভিন্ন। আমি প্রচন্ড অবাক হই যখন জানতে পারি আমার মায়াবিনী আমাকে না দেখেই ভালোবেসেছে। পবিত্র ভাবে। কোন খুঁত ছাড়াই। মসৃণ ভাবে ভালোবেসেছে। আমি এত স্বল্প ভালোবাসায় তৃপ্ত ছিলাম না। মায়াবিনীকে নিজের করে পাওয়ার অদম্য নেশ চড়ে বসল মাথায়। যেন মায়াবিনীকে আমার পেতেই হবে। যে একজন অচেনা মানুষকে এতটা ভালোবাসতে পারে সে নিশ্চই নিজের স্বামিকে আরো বহু গুনে ভালোবাসবে।
আর সেই অচেনা মানুষটি যদি তার স্বামী হয় তাহলে তো কথাই নেই। ওর হৃদয়ে একজন লেখকের জন্যে ছোট্ট একটু জায়গা ছিল৷ অথচ সে জায়গা জুড়ে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। এতটা ভালোবেসেছিল যা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। তার হৃদয়ের বাকি অংশ সে তার স্বামীর জন্যে রেখে দিয়েছিল৷ সে তার স্বামীকে ওই লেখকের জন্যে রাখা ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া বাকি সবটা দিয়ে ভালোবাসবে৷ তাহলে জানি সেই ভালোবাসাটা কতোটা বিস্তৃত হবে৷ কতোখানি ভালোবাসবে সে তার স্বামীকে। আমার লোভ বাড়ে আরো৷ আমি তাত ভালোবাসা পাবার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠি। তারপর একদিন মাকে বলে হুট করেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেই মায়াবিনীরর বাড়িতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো?
মায়াবিনী তখনও আমাকে ঠিক চিনতে পারেনি। এমনকি আমাকে যে সেদিন চড় মেরেছিল সেটাও মায়াবিনী ভুলে গিয়েছে। কী অদ্ভুত তাই না? এটা কীভাবে সম্ভব? মেয়েটা আমাকে চিনলই না? কী জানি! হয়তো রেস্টুরেন্টের ওই ব্যাপারটা তার জন্যে কমন ছিল৷ তাই হয়তো মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। তবে জানো, আমি আজোও মায়াবিনীর চোখ দেখে কিছু বলে দিতে পারিনি। কারন ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখা মিলে অজস্র ভালোবাসার। আমার জন্যে। শুধু আমার জন্যে ভালোবাসা। আমি শুধু ওর মুখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারি সে কী চাচ্ছে। এই বলে আমি থামি৷ রূপার দিকে দেখি একবার৷ সে প্রবল আগ্রহে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলি,
-জানো? মায়াবিনী এখনও জানে না যে, যে লেখকে সে ভালোবেসেছে সে লেখকই তার স্বামী হয়েছে। জানলে যে কতটা খুশি হবে তা ঠিক আমি ঠাউরে উঠতে পারছি না। এই বলে আমি রুপার দিকে তাকাই আবার দেখলাম সে আমার দিকে চেয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে দোলনার সামনে। অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে।হুট করেই বলে ফেলল,
:মায়াবিনীর নামটা কী যেন? আমি কিছু সময় ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মৃদু স্বরে বললাম,
:রূপা!
রূপা হুট করে বসে পড়ল দোলনায়। দোলনাটা কেঁচ কেঁচ শব্দ করে উঠল। আমি কিছু বললাম না। দ্রুতু হেঁটে গিয়ে লুকিয়ে রাখা নীল রঙের ডায়েরিটা নিয়ে এলাম। রূপার সামনে তা মেলে ধরলাম। রূপা তা দেখেই চট করে আমার থেকে সেটা কেড়ে নিল। একজন মা যেমন তার হারিয়ে পাওয়া সন্তান কে ফিরে পেলে যেভাবে আঁকড়ে ধরে রূপা ঠিক সেভাবেই ডায়েরিটাকে আঁকড়ে ধরল। কান্না ভাসিয়ে দিল নিজের দুচোখ কে। আমি বললাম,
:আমিই সেই, যাকে তুমি প্রথম দেখায় চড় মেরেছিল। তুমিই সেই যে আমার গল্পের মায়াবিনী। যে মায়াবিনীর মাঝে তুমি নিজেকে কল্পনা করতে। অথচ তুমি জানতে না যে তুমিই সেই মায়াবিনী। তুমিই সেই অপরিচিতা। তোমার স্বপ্নের কেউ ভাগ বসায়নি রূপা। তোমার স্বামির উপর কেউ ভাগ বসায়নি। যে বসিয়েছে সে তুমি নিজেই। তোমার স্বপ্ন তোমারই আছে, থাকবে আজিবন। ও আস্তে করে ডায়েরিটা নিজের পাশে রাখে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে।সেদিনের সেই রাগত চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসে। এই চড় মারবে বলে। আমি কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। রূপা ভেজা কন্ঠে বলল,
:কিভাবে পারলে তুমি এটা? কেন আমাকে আগে বলনি যে তুমিই আমার প্রথম ভালোবাসা। তুমিই আমার ভালোবাসার লেখক। বিয়ের পরে বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত! জানো আমি আজও একতরপা সেই লেখকেই ভালোবেসে এসেছি। কেন বলনি বল? বল কেন বলনি?
:এমনিই।কেন জানি আনন্দ পাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে দু’ভাবে ভালোবাস এটা ভাবতেই আমার কেমন জানি আনন্দ লাগে। আর তাছাড়া আমি তোমার ডায়েরি পড়েছি লুকিয়ে লুকিয়ে। এটা একটা অন্যায়৷ আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার ডায়েরিটা একদিন গোপনে পড়ে ফেলো৷ অন্যায়টা দু’পক্ষের হোক। তখন নাগয় নির্ভয়ে বলা যাবে। আমি সেদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। কখন আসবে সে দিন। আসলেই চট করে সব বলে দিতাম। এই বলে আমি আস্তে করে মাথা তুললাম।দেখলাম রূপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন পড়ছে। এই আমাকে গিলে খাবে বলে।আমি চট করেই চোখ নামিয়ে নিলাম। ওর এমন রাগত চোখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।আমি চুপ করে থাকলাম। রূপাও। কিছু সময় পর রুপা বলল,
:সেদিন তো খুব বলেছিলে আমার রাগত দুই চোখ নাকি তোমার ভালো লাগে। ওটা কি মিথ্যা ছিল? আমি চট করেই ওর দিকে তাকালাম। ওর চেহারার তুমুল পরিবর্তন হয়েছে। রাগ সেখানে ঠাই পাচ্ছে না। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আসছে। ভালোবাসা ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বললাম,
:সত্যিই বলছি আজো তোমার সেই দুচোখ আমার খুব ভালো লাগে। খুব ভালো। ঘোর লাগানো ভালো লাগা কাজ করে। ও একটু অভিমানি স্বরে বলল,
:তাহলে এখন তাকিয়ে থাকছ না কেন? পুরোন হয়ে গেছি তাই না?
:এই না! একদম না।তোমাকে আমি প্রতিদিন নতুন করে ভালোবাসি। নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি। তোমার ওই মিষ্টি মাখা দু’ঠোঁট যখনই আমার কপাল স্পর্শ করে তখনই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। অন্য রকম ভালোবাসাও।
:তাহলে? এখন কি হল? তাকিয়ে থাকছ না কেন?
:এই যে তাকিয়ে থাকলাম।
তারপর? আমি তাকিয়ে থাকি তার চোখ বরাবর। আমার চোখে ঘোর ধরে৷ ঘোর ধরে মস্তিষ্কে। আমি হুট করেই যেন ওর দু’চোখের ভেতর দিয়ে হৃদয়ের পথে রওনা হই। কী অদ্ভুত! এই তো সেদিন এলাম। তখন এমন ছিল না। এখন যেমন দেখাচ্ছে। আজকে আর ট্রাফিক বাধা দিচ্ছে না। আস্তে আস্তে চুরি করে ঢুকতে হচ্ছে না। লালবাগিছা বিছানো আছে।আমি সেখানে পা রাখতেই সবাই আমার দিকে চাইল। তারপর সাদরে আমাকে গ্রহন করল। আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই নিজেকে দেখতে পাই। নিজের ছবি তার হৃদয় মহলের প্রতিটা দেয়ালে টাঙানো। প্রতিটা দরজার খোলা।সবাই আমাকে ঢাকছে।”এখান দিয়ে আসেন জনাব।”এখানে দিয়ে আসেন।” আমি ঘুরে ঘুরে সবটা দেখলাম। আস্তে করে টুপ করে বেরিয়ে গেলাম। বের হতেই দেখা মিলল সেই মায়াবিনীর দু চোখের। মধু মাখা মুখটা কেমন উচ্ছ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বলল,
:কি দেখলে গো?
:আমাকে দেখলাম। আচ্ছা এত ভালোবাস কিভাবে বলতো?
:তুমি মনে হয় কম ভাসো। তুমি এত ভালোবাস কেন হুম। কেন?
:আমি ঠিক জানি না। তুমি জানো?
:না! আমিও জানি না। তবে একটা জিনিস জানি।
:কি?
:আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।
:আমিও।
:কি আমিও?
:ভালোবাসি!
:কাকে?
:মায়াবিনী কে?
রুপা একটু লজ্জা পায়। মাথা নামিয়ে নেয়৷ তার মুখটা অন্য রকম উজ্জ্বল হয়৷ মুখ ভর্তি বিজয়ের হাসি৷ কিছু না পাওয়া জিনিস চট করেই পেয়ে গেলে যেমন খুশি হয় মেয়েটা ঠিক তেমন খুশি হয়েছে৷ তার চেহারা তেমনই উজ্জ্বল হয়ে আছে৷ তাকে অদ্ভুত সুন্দরী লাগছে৷ মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে কেবল একটিই সুন্দরী নারী আছে। সেই নারীটির নাম হলো রূপা চৌধুরী। এখন এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ একটু পর আমার বুকের উপর আছড়ে পড়বে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত