আজ ডাক্তারের থেকে রিপোর্ট গুলো পেয়ে খুব খুশি খুশি লাগছে। আনন্দে হাসবো নাকি কষ্টে হাসবো বুঝতেই পারছি না। যাই হোক, নিলয় কে দেখলাম অনলাইনে আছে। রিপোর্ট এর কিছু পিক তুলে নিলয় কেই প্রথমে পাঠালাম। ও হ্যা নিলয় আমার সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষ, যাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। নিলয় রিপোর্ট গুলো দেখলো কিন্তু কোনো রিপ্লাই দিল না। কেন দিলো না জানি না। দেখানো টা কি ভুল হয়ে গেলো আমার?
.
কিছুক্ষণ পর নিলয় কল দিলো। দিয়েই ইচ্ছেমত বকা। কি সব দেখালাম আমি তাকে, সে বিশ্বাসই করতে পারছে না আমার যে ব্লাড ক্যান্সার। ফোনে কথা বলার সময় নিলয় প্রচুর ঝাড়ছে আমায়। আর বলছে এই সব ভুয়া। একদম বিশ্বাস করতে না। তিন তিন বার পরীক্ষা করানোর পর দেখলাম একই রেজাল্ট। কি করে নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি । একজন কে ব্লাড দিতে যেয়ে ধরা পরেছে আমার ক্যান্সার। বাসায় এই কথা কেউ জানে না। জানলে একটা অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হবে। যা হতে দিতে চাচ্ছি না। তাছাড়া অনেক আগেই ভিতর থেকে মরে আছি। হয়তো কদিন পর প্রাণ টাই না হয় হারাবো। দরজা লাগিয়ে ঘরের এক কোনে বসে আছি। মা সেই কখন থেকে দরজা বারি দিচ্ছে, আর ডেকেই যাচ্ছে। হঠাৎ করে মনোযোগ আসলো মা ডাকছে। ধীরে ধীরে উঠে গেলাম। দরজা
খুলতেই মা বলল,
—কিরে ঘরের একি অবস্থা করে রেখেছিস। বিছানাও আজ গুছালি না। হয়েছি কি তোর?
—কিছু তো হয় নি মা। কি বলবা তা বলে যাও। আমি ঘুমাবো একটু।
–সারারাত কি করেছিস? এখন এই সময়ে কেউ ঘুমায়? আজ কলেজে যাবি না?.
—না। ভালো লাগছে না।
—সামনে তো পরীক্ষা। যাবি না কেন?
—যাও তো তুমি। বললাম তো ভালো লাগছে না।
কখনো এই ভাবে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলি নি। আজ বলেছি। দিন টা ঘুমিয়ে পার করে দিলাম। উঠে দেখি নিলয়ের ৭২ টা কল আর ১৫ টা মেসেজ। ঘুম ঘুম চোখে ফোন হাতে নিয়ে কল দিলাম। এই রকম ঘুম আর ঘুমাই নি। সারারাত জেগে ছিলাম। নিলয় অনেক চিন্তায় পরে গেছে। ফোন দিতেই কতগুলো
আবার ঝাড়ি দিল। কেন আমি ফোন ধরলাম না। হয়েছে টা কি। বার বার বলছে দেখা করার জন্য। কিন্তু একদম এখন আর ইচ্ছে করে না। খুব ভালোবাসি নিলয় কে। নিলয় তা বোঝে। কিন্তু সে প্রকাশ করে না। আমি জানি আমি নিলয় কে না পেলে যত টা কষ্ট পাবো, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাবে
নিলয়। কারন আমি ছাড়া নিলয় কে এতো বেশি ভালো কেউ বাসবে না। ওর প্রতি সব টেক কেয়ার একমাত্র আমিই নিই। এখন আরও বেশি ভালোবাসতে মন চায়। অনেক বেশি। কদিন পর আর পারবো কিনা জানি না। বিকেলে খুব সুন্দর করে সেজেগুজে নিলয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে নিলয় এই ভাবে দেখে আমায় অবাক হয়ে গেছে। একটা সুন্দর শাড়ি, হাতে রেশমি চুড়ি,
খোলা চুল। পাশে যেয়ে বসতে নিলয় আমার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল। বলছিল, -রুমু, আজ এই ভাবে খুব সুন্দর লাগছে তোমায়। কথা টা শুনেই নিলয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এই কথা নিলয় এর আগে কখনো বলেছে কিনা আমার মনে পড়ছে না। ও কখনই কিছু বলে না। হাজার বার
ভালোবাসি বললেও বলে নি, রুমু ভালোবাসি তোমায়। বড্ড বেশি শুনতে মন চায়। খুব জোড়ালো ভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমায় কেনো বলো না। একটা মেয়ের মন চাইতেই পারে তার প্রিয় মানুষের থেকে শুনতে, খুব ভালোবাসি অন্তত এই কথাটি। উত্তরে বলেছিল, যদি আশানুরূপ কিছুই না হয়
শুধু শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে কি লাভ। আমি তো লাভ লস খুঁজে ভালোবাসি নি। তবে আমায় বলতে কেন লাভ লস এর কথা আসে। যাক গে, আর ভালো নাই বা বাসলে। আছিই বা কদিন। যে কদিন আছি সেকদিন আগের মত আমিই ভালোবেসে যাবো। দেখলাম চুপ করে বসেই আছে। আর কিছু বলছে না।
আমি বললাম, কি জন্য দেখা করতে বললে। বললো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। খুব জোড় করে হাত ধরে টেনেটুনে নিয়ে গেলো। আমি জানি রিপোর্ট ভুল আসবে না। আবার আমায় টেস্ট করালো। লাভ কি হল? সেই একই রিপোর্ট। নিলয় ডাক্তারের শার্টের কলার ধরেই মারা শুরু করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ পর নিলয় শান্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল। আমায় সেখানে বসে জড়িয়ে ধরে বলেই যাচ্ছে, এই
সব বিশ্বাস করবা না তুমি। সব মিথ্যে সব। এক পর্যায়ে বাচ্চাদের মত কান্না। পুরো হাসপাতাল যেন কান্নার আওয়াজে থমথম করছে। আমি একদম হাসিখুশির ভাব দেখাই। এই মুহূর্তে আমি নিজেই ভেঙ্গে পরলে নিলয় নিজেকে সামলে নিতে পারবে না। আজ আমার বেচে থাকাটা স্বার্থক। আজ প্রথম
অনুভব করতে পারছি সে আমায় কতটা ভালোবাসে। বুঝিয়ে শুনিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যার যার বাসায় চলে গেলাম। কিছুদিন পর, ঘুমোন্ত অবস্থায় চোখ মেলে দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায় শোয়া। পাশে মা আর বাবা বসে আছে। মা কেদেই যাচ্ছে। এক কোনে চোখ গেলো দেখলাম কাচের
জানালার বাইরে নিলয় দাঁড়িয়ে আছে। মা সব জানলো আজ, কে নিলয়। ধীরে ধীরে বললাম, কিছুক্ষনের জন্য নিলয় কে আসতে বলো, আর তোমরা একটু বাইরে যাও। আমি ওর সাথে কথা বলবো। মা নিলয় কে ডাক দিয়ে চলে গেলো। নিলয়ের দিকে তাকানো যায় না। চোখের নিচে কেমন যেন কালো দাগ হয়ে গেছে। মুখ শুকিয়ে গেছে। নিলয় আমার হাত ধরে বসে আছে। বললাম,
–একি অবস্থা তোমার। হয়েছে কি? কি নিয়ে এতো চিন্তা করো? আমার তো কিছুই হয় নি।
হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, –আর একটা আজেবাজে কথা বলবা না তুমি। —আরে কোথায় আমি আজেবাজে কথা বলছি। তুমি নিজেকে আয়নায় দেখেছো?
দাড়াও আমার কাছে আয়না আছে দেখাই তোমায়?
—রুমু, আর কত অভিনয় করে আমায় হাসাবে। নিজের সব টুকু দিয়ে ভালোবাসলে,, শুধু
স্বার্থপরের মত ভালোবাসা দুহাত ভরে নিয়েই গেলাম। দিতে তো পারলাম না। কথা গুলো বলছে আর কাঁদছে। আমি চুপ করে শুনছিলাম। ভাবছিলাম, আজ না চাইতেই আমি কত কথা শুনে ফেলেছি। আমায় কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে নিলয় বলেই যাচ্ছে, আমি ভালোবাসি খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার
কিছু হয়ে গেলে আমি বাচতে পারবো না। আমি পারছি না আর চুপ করে থাকতে। চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। কিন্তু আজ আর বললাম না, নিলয় আমিও খুব ভালোবাসি। কেমন যেন চোখ টা আবার ঘুমে ভরে গেলো। নিলয় কে বললাম, আমায় একটু ছাড়ো। খুব ঘুম পাচ্ছে, সে ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল, আমি নিশ্চিন্তে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল টা আর দেখবো কিনা জানা নেই। হয়তো ঘুম ভাঙ্গলে দেখতে পাবো, না হয় আর দেখা হবে না। আর নিলয় কে ভালোবাসি ভালোবাসি পাগলামি করা হবে না। বার বার কল দিয়ে আর জ্বালাতন করা হবে না। আমি চলে গেলে ওরে এই ভাবে কে ভালোবাসবে। আচ্ছা ও কি ভুলে যাবে আমায়? নাকি মনে রাখবে? আর একটু ও গলায় জোড় নেই, বলতেও পারছি না। নিলয় ঠিক মত খাবার টা খেয়ে নিও। সাবধানে ক্লাস করতে যেও। এলার্জির ওষুধ গুলো খেতে ভুলো না।