একটি প্রশ্ন

একটি প্রশ্ন
মৌমিতা বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।মা ফোন করে বললেন আমায়। আমি দোকানের মালামাল গোছানোয় ব্যস্ত তখন। দুদিন পর রমজানের ঈদ। কাজের খুব চাপ। দম নেয়ার ফুরসৎ নাই পর্যন্ত।এসির বাতাসেও কাজ হচ্ছে না।শরীর ঘেমে একসার হয়ে যায় বারবার। মসজিদ থেকে আসরের নামাজটা পড়ে এসে দোকানের বাইলে নতুন মাল সাজানো শুরু করলাম মাত্র,এর মাঝেই মা ফোন দিলেন।মার গলা ভেজা। কাঁদছেন। কেঁদে কেঁদে বলছেন,’মনসুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে রে বাপধন!’ আমি আতঙ্ক গ্রস্থ গলায় বললাম,’কী হইছে মা কী হইছে?’ মা তার কান্নার গলা আরো দ্বিগুন করে বললেন,’বৌমা পালাইয়া গেছে বাড়ি থাইকা।’ ‘কী বলছো এইসব!সে পালিয়ে কোথায় যাবে?’ ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে রে বাপধন সর্বনাশ হয়ে গেছে।নিতুর স্যারের সাথে পালিয়ে গেছে।’
শুনে আমার মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।হাত থেকে ফোনটা জমিনে পড়ে ডিসপ্লেতে শত ফাঁটল ধরলো। আমার মাথায় কিছু আসছে না। মনে হচ্ছে মালেক ফেরেশতা পাছায় লাথি মেরে দোযখের ভেতর ফেলে দিচ্ছে আমায় । কর্মচারীদের কাছে হিসেবের খাতাটা বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাসার পথ ধরলাম। দোকান থেকে আমাদের বাসাটা খুব দূরের পথ নয়, কিন্তু এটুকু পথ হাঁটতেই আমার পা কেমন অসাড় হয়ে আসছিলো। চোখে কেমন ধাঁধা দেখছিলাম। এমন ভাবে হাঁটছিলাম যেন কেউ আমায় না দেখতে পায়। ভাবছিলাম, যদি মানুষ জেনে যায় তবে কী হবে আমার? ওদের চোখের সামনে কী করে পরবো? ওদের কোন প্রশ্নগুলো কী করে সামলে নিবো আমি?
বাসায় এসে দরজায় ঠোকা দিতেই দৌড়ে এলেন মা, তার পিছু পিছু নিতু।মা আমায় জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।নিতুও কেঁদে উঠেছে ভে ভে করে। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। লজ্জা এবং ঘৃণায় নিঃশ্বব্দে কেঁদে উঠেছি। নিতু ছোট মানুষ। এবার ক্লাস থ্রিতে পড়ে। খুব চতুর আমার মেয়েটা। ঠিক ওর মার মতোই চতুর। কী মিষ্টি করে যে কথা বলতে পারে!নিতু কাঁদতে কাঁদতে আমার একটা হাত টেনে ধরে বললো,’ও বাবা,মা কোথায় গো?স্যারের সাথে কী আমার জন্য বই কিনে আনতে গেছে?দাদু তো সেই দুপুর থেকেই বলছে মা আসবে আসবে।কই,এখনো তো এলো না!’
মেয়েটার কথা শুনে আমার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার শব্দ শুনতে পাই। চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল নামে আমার। নিজেকে আর একটুও ধরে রাখতে পারি না। শব্দ করে কেঁদে উঠি।নিতু বলে,’ও বাবা বলো মা কখন আসবে?মা কখন আসবে?’ আমি মুহূর্তে কান্না থামায়। থামিয়ে বলি,’আসবে মা, তোমার মা আজ রাতেই আসবে।মা তার বন্ধুর বাসায় গিয়েছে তো তাই একটু দেরি হচ্ছে। তুমি এখন হাত মুখ ধুয়ে আসো তোমার দাদুর সাথে কেমন! আমি গিয়ে দোকান থেকে একটা আইসক্রিম নিয়ে আসি হুম!’
নিতু তার চোখ মুছতে মুছতে বলে,’মা আসার আগে আমি কিচ্ছু খাবো না বাবা।মা কে এক্ষুনি আসতে বলো।’
আমার ফোনটা বিকল হয়ে গেছে বলে এতোক্ষণ ফোন দিতে পারিনি মৌমিতাকে।অথবা ফোন দেয়ার কথা মনেও পড়েনি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল এটা কী করে করতে পারলো মৌমিতা?আট নয় বছরের একটা রাজকন্যা রেখে কী করে অন্যের হাত ধরে চলে গেলো সে? আমার জন্য নয়,সন্তানটার জন্য কী ওর একটুকুন মায়াও হলো না? আমাদের দীর্ঘ বারো বছরের সংসার। সংসারে কোনদিন কোন ঝগড়া ঝাটি নাই,মার সাথে তার কোন কিছু নিয়ে মতের মিল অমিল নিয়ে কথাও বাজেনি কোনদিন। ছুটির দিন গুলোতে তাকে নিয়ে আমি কত ঘুরেছি পার্কে পার্কে,খোলা রাস্তায়, সমুদ্রের ডাঙায় ডাঙায়!ওর সাথে কত হাজার সুখের স্মৃতি আমার মিশে আছে!
আমাদের সংসার পুরনো হয়ে গিয়েছিল ঠিক কিন্তু আমরা একে অপরের কাছে নতুনই ছিলাম। মাঝেমধ্যে মৌমিতা যখন সাজতো তখন তাকে লাগতো হুর পরীদের মতন।রোজ রোজ ওর প্রেমে পড়তাম আমি।রাত দুপুরে ওর ইচ্ছে হতো ছাদে যাবার। জোছনা দেখার প্রতি খুব দূর্বলতা ছিল ওর। আমি ঘুমিয়ে গেলেও আমায় ডেকে তুলতো মৌমিতা। আমি ভুলেও কোনদিন এতে রাগ করতাম না।হাসি মুখে চোখ কচলে কচলে ওর হাত ধরাধরি করে ছাদে উঠতাম আমি।ছাদে টবের গোলাপ বাগানের পাশে বসে ওর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতাম আমি। কোনদিন আমরা ঝগড়া করিনি এই বারো বছরে। আমার প্রতি ওর বিরাগ ভাব দেখিনি কখনো। তবুও কেন চলে গেল মৌমিতা? নিতুর স্যার এ বছর অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। আনন্দ মোহন কলেজে পড়ে।ও তো আমাদের থেকে অনেক অনেক ছোট। মৌমিতার চেয়েও ছোট। মৌমিতাকে দেখতাম ছেলেটাকে খুব আদর করতো। একদিন মৌমিতা বলেও ছিল,’আমার তো কোন ভাই নেই, ওকে আমি ভাই ডাকি?’ আমি হেসে বলেছিলাম,’ডাকো। ছেলেটাও তো অনেক ভালো। ঠান্ডা আছে।’
আমার কাছে এইসব ভালো ভালো কথা বলে গোপনে এই ভয়ংকর কান্ড টা কী করে করতে পারলো মৌমিতা?
ছিঃ! কিন্তু ছিঃ বলতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। আমার গলায় কিছু একটা আটকে আসছে। আমি কী মৌমিতাকে খুব বেশি ভালো বেসে ফেলেছিলাম? মার ফোনটা হাতে নিয়ে মৌমিতার নম্বরে কল দিলাম।বন্ধ। একবার, দুবার, বারবার দিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না ছেলেটাকেও ফোনে। অসহায় আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।নিতু কাঁদছে আবার।রাত বাড়ছে।নিতু না খেয়েই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল। আমি এখানে ওখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর মৌমিতাকে পেলাম না।
মেয়েটা আমার কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গায়ের রং খানিক ময়লা হয়ে গেছে। সারাদিন মার জন্য কাঁদে।ঘরে থাকা তার মার ছবিগুলো নিয়ে একটানা নেড়ে ছেড়ে দেখে। ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমু খায়। মাঝেমধ্যে গল্প করে।বলে,’মা ,ওমা, তুমি কোথায় গো এখন?’ ছবি কী আর কথা বলতে পারে! তবুও অবুঝ মেয়েটা আমার বারবার বলেই যেতে থাকে,ও মা, মাগো ফিরে আসো না তুমি। প্লিজ ফিরে আসো।তোমায় ছাড়া আর বাঁচবো না আমি।’
আমাদের ঘরের দখিন জানলাটা খুললেই রেল লাইন।রেল লাইন দিয়ে ঝকঝক করে রোজ কত ট্রেন যায়। ট্রেনের হুইসেল শোনলেই নিতু দৌড়ে গিয়ে জানলাটা খুলে তাকায়।হাত বাড়িয়ে ডাকে,’মা ওমা,মাগো।’ তার দাদু তখন বলেন,’আসবে দাদু আসবে। তোমার মা ঠিক একদিন আসবে।’ রাতে আজকাল মেয়েকে নিয়েই আমি ছাদে যাই।নিতুও কেমন তার মার মতো জোছনা প্রেমী হয়ে গেছে। জোছনা না দেখে তার ঘুমই হয় না। নিতু বড় হয়ে গেছে। এবার ক্লাস টেনে পড়ে সে। কিন্তু নিতুর মা আর এলো না। এলাকার কত মানুষ যে আমাদের নিয়ে পঁচা পঁচা কথা বলেছে তার কী কোন হিসেব আছে! তবুও সহ্য করে থেকেছি।মা বলতেন,’বিয়ে করে ফেল আরেকটা বাপধন।’
আমি হু হু করে হেসে বলতাম,’মাগো,এই রাজকন্যাকে আমি আর নতুন কোন রাক্ষসের মুখে তুলে দিতে চাই না।’
মা মারা গেছেন গত বছর হঠাৎ করে। এরপর থেকে আমি আর নিতুই ঘরের মালিক, বাড়ির মালিক।নিতু নিজের মতো করে সারাটা বাড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। আগে যে নিতু তার মার জন্য এভাবে রাতের পর রাত জেগে থেকে কাঁদতো,জানলা খুলে মা মা মা বলে ডাকতো এখন আর তা করে না। জোছনাকেও কেন জানি আর সে ভালোবাসে না।ঘরে থাকা তার মার সবগুলো ছবি একদিনে পুড়িয়ে দিয়েছে সে। আমি কোনদিন তার মার নাম নিলেও আমায় ধমকে উঠে নিতু।নিতু ভুলে গেছে ঠিক অথবা ভুলতে চাইছে তার মাকে , কিন্তু আমি যে মোটেও পারি না।পারি না এইজন্য যে আমার একটা উত্তর জানার বাকী আছে। আমি তাকে প্রশ্ন করতে চাই,’মৌমিতা, আমাদের ভুল টা কী ছিল বলবে? তুমি কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলে আমাদের?’
আমি অপেক্ষা করি তাকে একদিন হঠাৎ করে পাওয়ার জন্য। সুতীব্র অপেক্ষা আমার শুধু লম্বাই হতে থাকে কিন্তু তাকে আর নাগালে পাই না। সময় শুধু দৌড়ে যেতে থাকে আমার। ঢেউয়ের চেয়েও গতিতে সময় মিলিয়ে যায় আমার। নিতু এখন ভার্সিটিতে পড়ছে।ঢাকা ভার্সিটি। খুব বড় হয়ে গেছে মেয়েটা আমার। আগের মতো অবশ্য অত কথা বলে না এখন আর।অথবা চতুর ভাবটাও আর নাই তার মাঝে। আমি বুঝতে পারি তার ভেতরের চাপা দুঃখটা। এমন দুঃখ বুকে নিয়ে আসলে পৃথিবীর কেউই ভালো থাকতে পারে না।
ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম একদিন। বিজয় এক্সপ্রেস এর ট্রেনে করে। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। আখাউড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেনটা থামলো একবার। ট্রেন থামতেই কজন ফকির উঠে এলো আমার কামরায়।ফকিরদের সব কজনই মেয়ে। ওদের একজনকে দেখে আমার চোখের দৃষ্টি কেমন মুহূর্তে বিঁধে গেল ওর চোখে মুখে ।ওই ফকির মেয়েটিও আমার দিকে হা করে তাকালো। কিন্তু তা আর বেশিক্ষণ নয়।চোখ নামিয়ে চটজলদি দৌড়ে বগি থেকে লাফিয়ে নামলো। আমি বসা থেকে উঠে দৌড়ে ওকে ধরতে চাইলাম। জিজ্ঞেস করতে চাইলাম,’মৌমিতা, আমাদের অপরাধটা কী ছিল বলবে?’ কিন্তু ততক্ষণে হুঁইসেল বাজিয়ে ঝকঝক শব্দ তুলে ট্রেনটা ভোঁ ছোট দিল সামনের দিকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত