বেলা সাড়ে তিনটা মতো বাজে। আজ প্রথম শ্বশুরবাড়িতে রান্না করছি। শাশুড়ি আম্মা মাছ, মাংস, সবজি সব রান্নাঘরে দিয়ে গিয়েছেন এবং বলে গিয়েছেন কী-কী রান্না করতে হবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছি রান্নাগুলো ঠিকঠাকভাবে করার। তবে কোনোটাই ঠিকঠাক হচ্ছে না। পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ায় কখনোই সেভাবে রান্নাবান্না করার দরকার পড়েনি। কলেজে পড়ার সময়ে হোস্টেলে থাকাকালীনই যা একটু রান্না করতাম। এখন হঠাৎ এত মানুষের রান্না করতে এসে আমি কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। এখন মাংস রান্না করছি। শুকনা মরিচের গুড়া বেশি পড়েছে কিনা বুঝছি না। ঝোলটা বেশি লাল দেখাচ্ছে। তরকারিতে লবণ কোনোকালেই আমার ঠিক হতো না। কম হতো। আজও মনে হচ্ছে একই ঘটনা। রমজান মাস, রোজা আছি তাই লবণ বা মরিচ কেমন হলো তা খেয়ে দেখতেও পারছি না! হতাশ হয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম।
বাসায় রোজা রাখেনি আমার ভাসুরের মেয়েটা, ওর নাম শানু। কিন্তু বাড়ির সবাই ওকে ঝানু বলে ডাকে। ওকে পেলে লবণ হয়েছে কিনা টেস্ট করানো যেত। কিন্তু ওরও পাত্তা নেই। রুদ্র, আমি যাকে রদু বলে ডাকি ওর আর আমার লাভ ম্যারেজ ছিল। বিয়ের পর এই প্রথম আমাকে রুদ্র ওর বাড়িতে এনেছে। বিয়ের একবছর পর ও জব পেয়ে তবেই দুজনার বাড়িতে বিয়ের কথা জানিয়েছে। আমার মা-বাবা আর ওর মা-বাবা দুপক্ষই বিয়েটা মেনে নিয়েছে। পুরো পৃথিবীতে যখন করোনার প্রকোপ বেড়ে গেল তখনই আমার শ্বশুরমশাই কল করে বলল আমাকে নিয়ে গ্রামে চলে আসতে। তারপরই আমরা গ্রামে এসেছি। লকডাউনের শহরের চেয়ে এই গ্রামই অবশ্য আমার কাছে বেশি ভালো লাগছে। আরেক চুলায় চাল ধুয়ে বসিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। হঠাৎ দেখি বাবা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিছু না ভেবেই হুট করে বললাম,
-বাবা? মনে হচ্ছে মাংসে লবণ কম হয়েছে, একটু খেয়ে দেখবেন?” বাবা হেসে ফেললেন। বললেন,
-আমি তো রোজা রেখেছি মা। তুমি ভুলে গেছো?” বাবার কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পেলাম। মনেই ছিল না! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবা বললেন,
-দাঁড়াও। আমি ঝানু দাদুভাইকে ডেকে আনি।”
বাবা তখনই ঝানুকে খুঁজে আনলেন। ও তিনবার তরকারির ঝোল খেয়েও বুঝতে পারলো না যে লবণ বেশি নাকি কম হয়েছে। আমি আবার হতাশ বোধ করলাম। বাবা ভরসা দিয়ে বললেন,
-অত ভেবো না তো! যেমন হবার হবে।” আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সবজি কাটতে বসলাম। মাছ দিয়ে পটল রান্না করতে হবে। কিন্তু পটল কোন সাইজ করে কাটবো তা বুঝছি না। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। বাবা সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন। আমি চিন্তা করছি। হঠাৎ বাবা রান্নাঘরের দরজায় বসে বললেন,
-বটিটা আর পটল আমার কাছে এগিয়ে দাও। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।” আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললাম,
-না বাবা। তা কি হয়? আপনি সবজি কাটছেন দেখে আপনার ছেলে আর আমাদের মা রাগ করবে।” বাবা হাসিমুখে বটি টেনে নিয়ে পটল কাটা শিখিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের দরজায় টুল পেতে তার উপর শ্বাশুড়ি আম্মা বসে আছেন। হাতে তসবিহ। আমাকে রান্না শিখাচ্ছেন। কড়াইতে কোনটা আগে দিবো, কোনটা পরে দিবো তা উনি যত্ন করে শিখাচ্ছেন। আমিও ভয়ে-ভয়ে এটা সেটা জেনে নিচ্ছি। মনে একটা ভয় কাজ করছে। যদি সব তরকারি বিশ্রী হয়! সবাই তো ছিঃ ছিঃ করবে! একসময় আম্মা বললেন,
-শুনলে রুপু? একসময় আমিও রান্না পারতাম না। আমার শাশুড়ি কড়া মানুষ ছিলেন। যা বকাবকি করতেন! তবে তোমার শ্বশুর রান্না জানতো। উনি লুকিয়ে রান্নাঘরে এসে আমাকে এটা-ওটা শিখাতেন। রান্না হলো অভ্যাসের ব্যাপার। তুমিও রান্না করতে-করতে একদিন পাকা রাঁধুনী হয়ে যাবে। সেদিন তোমার এইসব দিনগুলো খুব মনে পড়বে। ভয় পেও না। মনে রাখবে প্রতিটি মানুষই সব কাজে তার সেরাটা উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। তুমিও করছো। তাই তরকারি কেমন হবে, কে কী বলবে এটা না ভেবে মন দিয়ে রান্না করো।” আম্মার কথাগুলো শুনে আমার চোখদুটো ভিজে উঠলো। মনে হলো এই মুহূর্তে আমার মাকেই অন্য রূপে দেখছি। হঠাৎ কী ভেবে বলে উঠলাম,
-আম্মা? আমার সাথে তুই করে কথা বলতে পারবেন?” আম্মা হেসে ফেললেন। হাসিমুখেই বললেন,
-তুই করে বললে কিন্তু তুমি মেয়ে হয়ে যাবে তখন অন্যায় করলে কান ধরে ঘুরাবো। রাজি তো?” আমি সব দুশ্চিন্তা ভুলে হেসে ফেললাম। আম্মা বললেন,
-তুই বড় সরল মেয়ে রুপু!” রুদ্র চুপিচুপি রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে বলছে,
-আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?” আমি বললাম,
-না রদু। তুমি রান্নাঘরে দাঁড়িও না। আগুনের খুব তাপ। ঘরে যাও।” রুদ্র হেসে বলল,
-এই তাপ বুঝি শুধু রুদ্রদের গায়েই লাগে! রূপকথাদের গায়ে লাগে না?”
আমি এর কোনো জবাব দিতে পারলাম না। দুচোখে অগাধ শ্রদ্ধা নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। ও হুট করে আমার শাড়ির আঁচল তুলে নিয়ে আমার ঘর্মাক্ত মুখটা যত্নের সাথে মুছিয়ে দিলো। রুদ্রকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘরে পাঠিয়েছি। রান্নাঘরের দরজায় ছোট দেবরকে উঁকি দিতে দেখলাম। ওর সাথে আমার ঠিকঠাক বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি। দুদিন এসেছি এই বাড়িতে। ও ছোট মানুষ, সারাদিন খেলাধুলা করে বেড়ায়। আমি ওকে দেখে বললাম,
-কিছু বলবে তামিম?” তামিম মুখটা গম্ভীর করে বলল,
-বাড়ির সবাই আমাকে তুই করে বলে, তুমি আমাকে তুমি করে কেন বলছো?” আমি হেসে বললাম,
-আচ্ছা। এখন থেকে তামিমকে তার ভাবী তুই করে বলবে। খুশি তো?” তামিম হেসে বললো,
-খুশি। আমি তোমাকে কোনো কাজ করে দিতে পারি?” আমি বললাম,
-তুমি তো ছোট। তাছাড়া রোজা আছো, তুমি বিশ্রাম করো। আমি একাই সব পারবো।” ও রাগ করে বলল,
-আমি ছোট না। সব পারি। আমি কি তোমাকে টিউবয়েল থেকে খাওয়ার পানি তুলে দিবো?” আমি হাসিমুখে বললাম,
-যা। একজগ পানি এনে রাখ।”
ননদ প্রেগনেন্ট। ও এসেছে রান্নাঘরে। এসে চুপিচুপি ওর ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বলেছে কোনো রেসিপি কীভাবে রান্না করবে না বুঝলে ইউটিউবে ঢুকে চুপিচুপি দেখে নিতে। আমি আবারও হেসেছি। আসরের আজান হয়ে গিয়েছে। আম্মা তার ঘর থেকে আমাকে ডাকছেন। নামাজ পড়ে নিতে বলছেন। আমি বললাম,
-আম্মা! চুলায় তরকারি। রান্নাটা শেষ হতে আর কয়েকমিনিট লাগবে। নামিয়ে রেখে আসছি।” আম্মাকে বলতে শুনলাম উনি বাবাকে বলছেন,
-রুপুর কাছে যাও তো! তরকারিটা দেখো, ও নামাজ পড়তে আসুক।” বাবা এসে আমাকে নামাজ পড়তে পাঠালেন। আমি আবারও তৃপ্তির হাসি হাসলাম। রাত। সবাই খেতে বসেছে। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খেতে দিয়েছি সকলকে। আম্মা বললেন,
-রুপু? তুই সকলকে তরকারি তুলে দে, আমি ভাত দিচ্ছি। এখন থেকেই সংসারে কার কী প্রয়োজন তা বুঝে নে। আর সেই সাথে নিজের প্লেটেও খাবার তুলে নে।” আমি ভেজা চোখে সবার প্লেটে তরকারি তুলে দিচ্ছি। আমার প্লেটে তরকারি তুলতে যেতেই আম্মা বলে উঠলেন,
-বড় দেখে মাছ নে। নাহলে সবগুলো তোর পাতে ঢেলে দিবো। এখন থেকে বেশি করে খেতে হবে।” আমি চোখদুটো মুছে নিয়ে খেতে শুরু করলাম। খেতে বসে সবার মুখের দিকে তাকালাম। সবাই আমার রান্নার যথেষ্ট প্রশংসা করছে। অথচ আমি খাবার খেতে গিয়ে বুঝলাম একটা তরকারিও প্রশংসা করার মতো অতটা ভালো হয়নি। আমার বুকের ভেতরটা ভরে উঠলো। নামাজ পড়ে বিছানায় এসে শুয়েছি। গায়ে জ্বর। হঠাৎ আম্মা এসে পাশে বসলেন। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসতে যেতেই উনি বললেন,
-শুয়ে থাক। তোর কী জ্বর এসেছে? চোখদুটো লাল দেখাচ্ছে?” আমি জবাব দেবার আগেই উনি কপালে হাত রাখলেন। জ্বর দেখে চুপচাপ কপাল টিপে দিতে শুরু করলেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তখনই রুদ্র আর বাবা নামাজ শেষ করে আম্মাকে খুঁজতে আমাদের ঘরে আসলেন। আমার জ্বর শুনে বাবা নিজের ঘরে গেলেন জ্বরের ওষুধ আনতে। রুদ্র গেল পানি আনতে। এবার আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করলো। আম্মা বিচলিত হয়ে বললেন,
-কী রে রুপু? তোর শরীর খুব খারাপ লাগছে নাকি?” বাবা আর রুদ্রও ফিরে এসেছে। সবাই চিন্তিত। অথচ ওরা কেউ জানে না। আজ আমাকে কোনো অসুস্থতা কাঁদাচ্ছে না, আজ আমাকে জীবনের এক অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্র সুখ কাঁদাচ্ছে। আমি সুখী।
গল্পের বিষয়:
গল্প