মৌমিতার ডায়েরী

মৌমিতার ডায়েরী
সম্ভবত প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম আমি আর সুহাস । সম্ভবত বললাম কারণ, বিয়ের ১১/১২ বছর পরে এসে বুঝতে পেরেছিলাম ওটা আসলে প্রেম ছিল না। আমরা দুইজন দুইজন এর সঙ্গ পছন্দ করতাম,ব্যাস। পাশাপাশি বসে গায়ে গা ঘেসে থাকতে আমাদের ভালো লাগত,রিক্সার হুড তুলে ঘনিষ্ট হতে,বা একে অপরের শরীরকে চিনে নেবার প্রক্রিয়াটাকেই আমরা ভালবাসা ভেবে নিয়েছিলাম। মন চেনার প্রক্রিয়াটা শুরুই হয় বিয়ের পরে।
বিয়ের পরেরদিন থেকেই বুঝতে শুরু করলাম আমরা একজন উত্তর মেরু আর অপরজন দক্ষিন মেরুর বাসিন্দা এক জীবনে দুইজনের কারো পক্ষেই এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব না। বিয়ের রাতে ও আমাকে খুব ভালোবেসে কিছু ডুজ এন্ড ডোন্টস বুঝিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল সবসময় ওগুলো মনে রাখতে। বলেছিল,তোমার আগের জীবন ভুলে যাও। চারুকলায় বসে আড্ডাবাজি,টিএসসি তে ছেলে বন্ধুদের সাথে চা খাওয়া,কেও ভালো আবৃত্তি করতে পারে বলে তার প্রেমে পড়ে যাওয়া,কেও ভালো গান গায় বলে তার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া এগুলো বন্ধ করে দাও। তোমার প্রায়োরিটি এখন তোমার সংসার। হাংকি পাংকির দিন শেষ।
আমি টুক করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। ওর কথাগুলো খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছিল সেদিন। তাই তো,আমার বিয়ে হয়েছে,সংসার হয়েছে,দুইদিন পর আমি মা হব। এগুলোই তো আমার প্রায়োরিটি। আমি বুঝিনি নিজের অজান্তেই আমার সত্ত্বা বিসর্জন দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেই রাতে। যে আমি,গান ভালোবাসি,কবিতা ভালোবাসি,প্রেমের গল্প পড়তে পড়তে যার চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়,বন্ধু ছাড়া যার একমুহুর্তও চলে না,যে একদিন সিনেমা বানিয়ে বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে বলে স্বপ্ন দেখে,সেই আমি মন দিয়ে সংসার করব বলে প্রতিজ্ঞা করে ঘুমিয়ে পড়লাম স্বামীর আলিঙ্গনে।
শুরু হলো “আমার আমি”কে বাদ দিয়ে আমার বিবাহিত জীবন আমি অবশ্য সুহাশকে পুরোপুরি দোষ দেই না। কারণ প্রত্যেকটা মানুষেরই জীবনকে দেখবার আলাদা দর্শন আছে। সুহাস তার নিজের মত। তার ভাবনার প্যাটার্ন আলাদা। তার কাছে তার কাজ এর পেছনে নিজস্ব লজিক আছে। আমি স্বীকার করি,ভুলের বেশি অংশটাই আমার। ভুল প্রেমিক নির্বাচন,ভুল জীবন সঙ্গী নির্বাচন। যখন আমাদের তথাকথিত প্রেম চলছিল,সেই সময় একদিন সকালবেলা লাল রং এর একটা তাতের শাড়ী পরে হোস্টেলের গেইটে সুহাসের অপেক্ষা করছিলাম আমি। আমাকে দেখেই সুহাসের চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল সেদিন রাগে,ক্ষোভে।বলেছিল
– এটা কি শাড়ি পড়েছ?? এই শাড়ির নিচ দিয়ে তোমার শরীর বোঝা যাচ্ছে। এই পোশাকে তোমাকে কোথাও নিয়ে যাবনা আমি । যাও,চেঞ্জ করে এস এক্ষুনি। আমি অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে দৌড়ে রুমে চলে গেছিলাম চেঞ্জ করতে। আয়নার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছি নিজেকে, মনে মনে বলেছি
-কই,কিছুই তো দেখা যায়না।
আমি বুঝিনি আমার তাকে বলা উচিত ছিল – আমি পোশাক পরব সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার ভালো না লাগলে তুমি চলে যেতে পার । আমার চোখে পানি এসেছিল,আমি চোখের পানি মুছে একটা সালোয়ার কামিজ গায়ে চাপিয়ে বের হয়েছিলাম অবশেষে । সেদিন বোধয় সুহাস একটু বেশি আদর করেছিল আমায়,বাধ্য মেয়ের মত ওর কথা শুনেছিলাম বলে। সুহাস তো কোনো আড়াল রাখেনি,বলেছিল আমার ছেলেদের সাথে কথা বলা নিষেধ,বলেছিল ঢোলা ঢালা কাপড় পরতে,বলেছিল পাতলা শাড়ী পরা বারণ। একবার তো অদ্ভুতভাবে আমার শাড়ির আচল নিজ হাতে পিন আপ করে দিয়েছিল যাতে সূর্যের আলোও আমার শরীর অব্দি পৌঁছুতে না পারে।
আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। এখন যখন ভাবি-কেন?হাস্যকর উত্তর পাই একটা । ওর চোখের পাপড়ি ভালো লাগত বলে,ওর হাসিটা ভালো লাগত বলে। ও হাসলে মনে হত মরে যাই । তাই বোধয়,এখন আমি প্রতিদিন সত্যিই একটু একটু করে মরি আমার অনেক রাগ হয়,অভিমান হয়,ক্ষোভ হয়। এইজন্য না যে আমি যেটাকে প্রেম ভেবেছি ওটা প্রেম নয়,এইজন্য না যে আমি একটা অলীক সোনার খাচায় বন্দী হয়ে থেকেছি, এইজন্য না যে সংসার সংসার করে আমি নিজের দিকে কোনদিন ভাল করে তাকাতেও পারিনি।
এইজন্য রাগ হয় যে আমি পুরো একটা জীবন বন্ধু বিহীন কাটিয়ে দিলাম। এমন একজন পুরুষের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে চাইলাম যে শুধুই আমার স্বামী হতে চেয়েছে,বন্ধু হতে চায়নি। আমার কত কথা,সব ওকেই বলতে চেয়েছি সারাজীবন। একটা খোলা বই হতে চেয়েছিলাম ওর সামনে যার প্রতিটা পাতা ওর মুখস্থ থাকবে। তাই মেলে ধরেছিলাম নিজেকে। ভেবেছিলাম,আমার শরীর যেমন ওর চেনা,তেমনি মনটাও চেনা থাকুক। আমি যেদিন হাসতে হাসতে জীবনের প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতার গল্প টা ওকে শোনালাম,দেখলাম ও ঠিক ধাতস্থ হতে পারলনা। ও শুনতে চাইতো গল্পগুলো,খুচিয়ে খুচিয়ে ডিটেইল বের করত,কিন্তু মানতে চাইতো না।
আমি ওর সিরিয়াসনেস উপেক্ষা করে বলতাম,সুহাস,এত রিএক্ট করছ কেন? যেন তুমি তখন ছিলে আমার লাইফ এ?
সব বলেছিলাম ওকে,এমনকি কৈশোরে ভাই এর বন্ধুর কাছে,রিলেটিভ এর কাছে এবিউজড হবার ঘটনা টাও। বলবনা কেন? আমি তো ওকে আমার বন্ধু বানাতে চেয়েছিলাম। আমি তো শুধু দুটো শরীর এক হোক চাই নি। আমি মন দিতে চেয়েছিলাম সুহাস কে ।সেই নির্ঘুম রাত গুলো মনে হলে এখনো আমার জ্বর আসে। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারনে তার রেগে যাওয়া, আমার সাথে কথা বন্ধ করে দেয়া বা কখনও বিনা কারনে প্রচণ্ড ওভার রিএ্যাক্ট করা।ইস কি কঠিন ছিল সেইসব দিন সেইসব রাত। আমি সুহাসের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে অনুনয় করতাম
– সুহাস,কি হয়েছে,তুমি কি নিয়ে রেগে আছ,প্লিজ কথা বল আমার সাথে,আমি কি কোনো ভুল করেছি? কি অপরাধে শাস্তি দেয়া হত আমাকে তাই বুঝতাম না। ভাবতাম আমি তো আজকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়েছি,বাজারে গেছি,রান্না করেছি,সুহাস অফিস থেকে ফেরার আগেই সব কাজ গুছিয়ে অপক্ষা করেছি। তাহলে ও কেন এত রেগে আছে? আমি নিজের অপরাধ না বুঝেই মাফ চাইতাম। কাদতে কাদতে বলতাম, মাফ করে দাও সুহাস । প্লিজ একটু ধর আমাকে,তুমি জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসেনা। আমি কাঁদতাম,সারারাত কাঁদতাম।
কোনো মানুষ যে পাথরের মত কঠিন হতে পারে ত়া সুহাসকে দেখেই জেনেছি। আরো জেনেছি যে আমার অতীত ও মানতে পারেনি,আমার প্রথম চুম্বন থেকে শুরু করে ওরই মত কোনো এক পুরুষ দ্বারা আমার সুন্দর কৈশোর নষ্ট হবার কাহিনীগুলো সে মানতে পারেনি কোনদিন। তার স্ত্রীর শরীরে অন্য পুরুর্শ স্পর্শ করেছিল ভাবলেই তার আর আমার প্রতি ভক্তি হত না। এটাকেই বলে বলে নিয়তি,যাকে বন্ধু ভেবে মনের অলিতে গলিতে লুকিয়ে থাকা কষ্ট গুলো জড়ো করে এনে তার সামনে রাখলাম একা সইতে পারিনা বলে,গোপনীয়তা চাই না বলে। দেখলাম,সে শুধুই একজন শুধুই একজন অযৌক্তিক অপ্রয়োজনীয় ইগো ওয়ালা স্বামী,একজন লিঙ্গ সর্বস্ব পুরুষ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত