বিশ্ব নন্দিত বিজয় –

তেরই ডিসেম্বর, উনিশ’শ একাত্তর। রক্তের সাগরে ভাসছে তখনও বাঙালীর স্বপ্ন সাধ ! যদিও ততদিনে অস্পষ্ট দুরত্বে মুক্তির তথা বিজয়ের আবহ, আশা জাগানিয়ার অনিশ্চিত সান্ত্বনা হিমালয়ের চূড়া থেকে ক্রমশঃ বিশ্বাসের অলিন্দে এসে দাঁড়াবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে লড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্ভেদ্য কুয়াশার দেয়াল ভেঙ্গে ভেঙ্গে একটি স্বপ্নময় সুন্দর সকালের দিকে নিয়ত এগিয়ে চলছে অকুতোভয় মুক্তিসেনার দল। ওরা মৃত্যুকে পরাজিত করে করেই পরাজয়কে জানিয়ে দিচ্ছে চুড়ান্ত অঙ্গীকারের দৃঢতার স্পষ্টতা। ওরা নির্ভীক মৃত্যুঞ্জয়ী ! সাফল্যের সম্ভাবনাকে পুঁজি করেই ওরা দুর্বার গতি প্রাপ্ত হয় নিত্য দিন। ঠিক তেমনি করেই সেদিনও শীতের তীব্রতাকে পাশ কাটিয়ে ঘুমকে বিছানায় রেখে উঠে পড়ে সানু। একান্ত সহচর এস, এল, আর টিকে যথাসম্ভব পরিচর্যা করে মাত্র সকালের সকল আবশ্যকতা সমাপ্ত করেছে। হয়তো সহসাই নাস্তার পর্বটা শুরু হবে এমন সময় জনৈক জৈষ্ঠ মুক্তিসেনার কন্ঠে মেথর পাড়ায় জনতার বিরুদ্ধে নকশালীদের জুলুম, নির্যাতন, হত্যাকান্ডের খবরে চোঁয়াল দু’টো শক্ত হয়ে গেল সানুর। বেমালুম ভূলে গেল নাস্তার কথা। নিজের অজান্তেই এস, এল, আর টা হাতে তুলে নিল সানু। শরীরের মাংসপেশী গুলো দারুন ভাবে শক্ত হয়ে গেল। মুহুর্ত্তে প্রস্তুত হয়ে গেল পাল্টা হামলার অভিপ্রায়ে । ওর সাথে সাথে বেড়িয়ে এলো এক ঝাঁক বাংলার বিচ্ছু। উদ্দেশ্য জনতার বিরুদ্ধে পরিচালিত ধ্বংস যজ্ঞে অংশ গ্রহণকারী পিশাচদের সমুচিত জবাব দেওয়া।
ইছামতি নদীটা দ্বীপচরের মত গ্রামগুলোকে পাবনা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সরু একটা নদী দু’পাড়ের মানুষকে শিক্ষা দীক্ষায় আচার আচরনে কেমন আলাদা করে ফেলেছে। একদিকে পাবনা শহরের মানুষ গুলো যেমন হানাদার বাহিনীর এবং তাদের দোসরদের অবিরত সন্ত্রাসের মুখে আতঙ্কিত ! মৃত্যু ভয়ে তটস্থ ! জীবন, সম্ভ্রম আর সম্পদ রক্ষার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত, দ্বীপচরের মত অন্যান্য গ্রামের মানুষ গুলো তখন প্রতিশোধের স্পৃহায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এক এক একটি দুর্ভেদ্য গণ দূর্গ। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গের প্রতিযোগিতায় মাতোয়ারা তেমনি এই সমস্ত গ্রামের মানুষ গুলোও অর্থ,খাদ্য, সহায় সম্পত্তি উৎসর্গের যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শণ করেছে তাও বিশ্বের ইতিহাসে সত্যই বিরল ! এমনই একটা ঘটনার আজও পূনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। সানুরা সম্পুর্ন যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে দ্বীপচরের জমির আইল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শহরাভিমুখে। পদতলে শীতের সকালে তৃণমূলে আশ্রিত শিশির বিন্দু গুলো যেন ভালবাসার ছোঁয়ায় জানাচ্ছে বিদায় সম্ভাষন।সারি সারি মুক্তিযোদ্ধাদের লম্বা লাইনের পিছনে উৎসুক জনতার উৎসাহ আর উদ্দীপনায় উজ্জিবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কঠিন চেহারাগুলো বিজয়ের আকাঙ্খায় দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে চলছে। আস্তে আস্তে জনতাকে পিছে ফেলে ওরা বীরদর্পে ঢুকে পড়ল শহরের আঙিনায়। ভকেশনালের সামনে পাবনা-নগরবাড়ী মহাসড়কের সীমানা আর ভকেশনালের সীমানার মাঝের দেয়ালের কোল ঘেঁষে সানুরা পজিশনে যেতে না যেতেই চকচকে নতুন একটা সাইকেলযোগে একজন নকশালপন্থী ওই এলাকা অতিক্রমকালে সানুরই এক সহযোদ্ধার গুলিতে লুটিয়ে পড়ল পিচঢালা রাজপথে। মুহুর্তে জনৈক শুভ্র কেশধারী ব্যক্তি গেট পেরিয়ে ছুটে যায় লাশের পাশে। লাশের পা ধরে একটানে রাস্তার ধারের ড্রেনের মধ্যে লাশটি ফেলে দিয়েই সাইকেলটি নিয়ে ভোঁ দৌড়। চোখের পলকে রাজপথটি আগের মত পরিষ্কার তবে জমাট বাঁধা রক্তই কেবল ঘটনার সাক্ষী হয়ে জানান দিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির কথা। কয়েক মুহুর্ত্ অতিক্রান্ত হতেই কয়েকজন পাকিস্তানী(বিহারী)বাজার পাহাড়াদার প্রাচীরের সামনে দিয়ে যাবার সময় চোখাচোখি হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। ওরা দেখেই বুঝে ফেলে মুক্তিযোদ্ধারা বসে আছে এ্যামবুশ পেতে। ভূত দেখার মত চমকে যায় আর সাথে সাথে বেড়ে যায় ওদের চলার গতি। পড়িমরি করে রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ল সামনের অবাঙ্গালী গাড়ীর ব্যবসায়ী খলিল সাহেবের বাড়ীর ভেতরে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নর পিশাচদের মত কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ার গুলো গর্জে না ওঠে বরং মার্জনার মহত্বই প্রকাশ করে যা কিন্তু মানবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত ও বটে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই শহরের দিক থেকে একটি বাস পূর্ব দিকে ছুটে যাবার মুহুর্ত্তে জামতলার সামনে অবস্থান রত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ্য থেকে ফায়ার ওপেন হওয়ার সাথে সাথে সানুর এস, এল, আর থেকে বেড়িয়ে যেতে থাকে বুলেটের ঝাঁক। ঠাস ! ঠুস ! ড্যা-ড্যা-ড্যা-ড্যা শব্দে সমস্ত পাবনা শহরে ছড়িয়ে পড়ল যুদ্ধের দামামা ! মার খাওয়া বাসটি সানুদের আর খলিল সাহেবের বাড়ীর মাঝামাঝি জাযগায় এসে থেমে গেল। গাড়ীর ছাদে ছিল কাপড়ের গাইটের আড়ালে পজিশনে থাকা হানাদার বাহিনীর দশ্যুরা, আর গাড়ীর ভেতরে তো ছিলই। গাড়ীটি থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী থেকে শত্রুরা অতি দ্রুত নেমে রাস্তার ড্রেনে অবস্থান নিয়ে বৃষ্টির মত বুলেট বর্ষণ শুরু করল। এই সুযোগে সেই সব পূর্ব পরিলক্ষিত পাকিস্তানী(বিহারী) বাজার পাহাড়া দাররাও খলিল সাহেবের দোতলা থেকে সানুদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। সেই গুলিরই একটা এসে সানুর পাশে থাকা সাত্তারের পিছনে ভকেশনালের বিল্ডিংয়ের দেয়ালে লেগে ফিরে এসে সাত্তরের উড়ুতে আঘাত হানে। সাত্তারের গুলি লাগার সাথে সাথে সানু দূর্ঘটনার খবরটি সবাইকে জানান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে নীলমনি ঘোষ ছুটে এসে সাত্তারকে কাঁধে তুলে নিয়ে ইছামতির দিকে ছুটতে থাকে। “হিট এ্যান্ড রান”রণ কৌশলে বিশ্বাসী মুক্তিযোদ্ধদের কমান্ডার ও ততক্ষণে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষনা করে দ্বীপচরে ফিরে যাবার নির্দেশ প্রদান করে । মুক্তিযোদ্ধারাও অবস্থান ত্যাগ করে যখন ভকেশনালের ভেতর চত্বরে প্রবেশ করল তখন হানাদার বাহিনীর পক্ষ থেকে লক্ষ কোটি বুলেট বর্ষণে সমস্ত পাবনা শহরে তৈরী হ’লো এক ভীতিকর অবস্থা। মনে হচ্ছিল, পাবনা শহরের যে সমস্ত এলাকায় হানাদার বাহিনীর অবস্থান ছিল সব জায়গা থেকেই অন্ধের মত বুলেট বৃষ্টির মাধ্যমে দশ্যুরা তাদের ভীত সন্ত্রস্ত মনের দুর্বলতাকেই সবার সামনে জানান দিয়ে দিল। কিন্তু সানুরা যখন ইছামতির পাড়ে এসে দাঁড়াল, মনে হচ্ছিল হানাদাররা যে কোন সময় গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বুঝি ভকেশনালে ঢুকে পড়বে। অজস্র গুলি ইছামতির পানিতে টুব টাব করে পড়ে পড়ে শান্ত পানিকে অশান্ত করে তুলল ! ঘাটে দাঁড়ানো একটি মাত্র ছোট্র নৌকা ! যুদ্ধাহত সাত্তারকে কাঁধে নিয়ে নীলমনি ঘোষ সবার উদ্দেশ্যে সাত্তারকে বাঁচাবার জন্য নৌকায় আর কাউকে না ওঠার জন্য অনুরোধ জানানোতে সানুরা সাত্তারের জীবন রক্ষার্থে বৃহত্তর ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকাটি সাত্তার আর নিলমনিকে নিয়ে ওপাড়ে পৌঁছে গেল। অথচ কী অবাক কান্ড ! নৌকাটি নিয়ে বাকী সবাইকে ওপাড় নিয়ে যাবার জন্যে কাউকেই আর ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসতে দেখা গেল না ! অথচ কী এক অস্থিরতার মধ্যে অপেক্ষা করতে থাকে সানুরা ! কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি না দেখে বরং সংগঠকদের পরামর্শেই সব মুক্তিযোদ্ধাগণ ঝাঁপিযে পড়ল ইছামতি নদীতে ! ওদের গায়ে গরম কাপড় চোপড় সহ ছিল বুলেটের থলে আর হাতিয়ার ! এসব নিয়ে শীতের সকালে সাঁতরিয়ে নদী পাড় হওয়া অতটা সহজ ছিল না। কিন্তু কিছু করার ও ছিল না। শেষ মেষ যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওরা প্রাণ পণ সাঁতরিয়ে পাড়ে ওঠার শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত ! তখনই ওপাড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢের মত দাঁড়িয়ে থাকা সংগঠক গণ সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচাবার তাগিদ দেওয়ায় অবশ্য কাজ হলো। সবাই জীবন বাঁচাতে সেই পন্থাই অনুসরণ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত কোন রকমে উলঙ্গ প্রায় অবস্থায় ওপাড়ে গিয়ে একে একে সবাই আছড়ে পড়তে থাকে। তখন তখনই সংগঠক এবং শুভাকাঙ্খি গ্রামবাসীগণ ধরাধরি করে তাদের অন্তত আধা মাইল ফাঁকে নিয়ে সেবা শুশ্রষা দিতে থাকে। একাত্তরের বাঙালী বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ উপাদানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে বিশ্বের বুকে চির সম্মানিত হয়ে থাকবে।
অনেকটা রাত অবধি শরীর টা ক্লান্ত থাকলেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সানু তা বুঝতেও পারেনি। তবে সকাল টা এসেছিল সুন্দর ঝলমলে সোনালী সূর্যালোকের স্বপ্ন নিয়ে। চারদিকে ততক্ষণে স্বাধীনতার গুঞ্জণে আনন্দমুখর পরিবেশ ! কিন্তু সানু কিছুতেই তার বিশ্বস্ত সহচর পরম আপন এস,এল,আর এর বিচ্ছেদ ব্যথাকে ভুলতে পারছে না। সে কারণেই দ্রুততার সাথে নাস্তা সেরে ইছামতির পাড়ে গিয়ে কী ভাবে গানটা উদ্ধার করা যায় সে চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে গেল।কিন্তু সানু দুঃখের চরম ধাক্কায় হতোদ্দম হয়ে গেল যখন শুনল যে, তাদেরই কয়েকজন সহযোদ্ধা নদীর তলানী সাপটে যা ছিল সব তুলে নিয়ে চলে গেছে ! এটাই ছিল বুঝি স্বাধীনতার ঊষা লগ্নের প্রথম অশনী সংকেত ! জাতির ভাগ্য রেখা সে দিনই ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের পূর্বাভাসের জানান দিয়েছিল ! যদিও সানুর জন্য হাতিয়ারের কোন অভাব হয়নি তবু ও প্রিয় এস, এল, আর এর বিরহে মনটা ছিল বেশ আবেগঘন। বাকী দু’টো দিন কেটেছিল অলস অপেক্ষায় ! শুধু একটি সুসংবাদ শোনার জন্য আকুপাকু করছিল সানুর মনটা। মনটা যেন আর তর সইছিল না। তারপর এলো সেই কাঙ্খিত সুবর্ণ ক্ষণ যার অপেক্ষায় গোটা জাতি একটু একটু করে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে স্রষ্টার চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সময় আর দুর্যোগময় আধাঁরকে ডিঙ্গিয়ে এসেছে। এ এমন এক অনুভূতি যা হাজার বছরের ইতিহাসেও মানুষের মনে অনুভূত হয় নাই এবং ভবিষ্যতেও হবে কিনা তাও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাই ভাল বলতে পারবেন। গ্রাম, গঞ্জ, শহর, নগর তথা সমগ্র বাংলাদেশ সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল। সবার হাতে হাতে মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা আর জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত বাংলাদেশ দেখে সানুর দু’চোখ গড়িয়ে আনন্দাশ্রু স্পর্শ করেছিল পবিত্র এই মাটি। যে বিজয় সানু দেখেছিল দু’চোখ ভরে সে বিজয় ছিল ক্ষণজন্মা, সে বিজয় ছিল শ্বাশ্বতঃ, সে বিজয় ছিল বিশ্ব নন্দিত !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত