দেয়ালে হেলান দিতেই মুখ বিকৃতি করে তাকালাম। দেয়াল ভিজে আছে। বাম হাত দিয়ে মশারি সরিয়ে ভেজা দেয়ালেই হেলান দিলাম আবার। জানালা দিয়ে একটা পাখি ভেতরে আসতে চাচ্ছে। ভেতরে আসার লোভ আমি না, টেবিলে রাখা কয়েকটা ধান। জানালার ঠিক সামনেই একটা টেবিল রাখা। টেবিলের ডান পাশে কিছু বই আর একটা খাতা। ঠিক মাঝখানে একটা ডায়েরি।
আমি এই ঘরটাতে উঠেছি ছয়দিন হলো। এর আগে এই ঘরের পাশের দুটো ঘর বাদে একটা বড় ঘড় আছে, সেখানে হাসানের সাথে থাকতাম। হাসানের অভ্যাস ভালোনা। মেসের মালিকের সামনে যেকোন সময় গাজা ধরিয়ে ফেলে, আর অনায়াসে টানতে থাকে। আমি প্রতিবারই বিরক্ত হয়ে তাকাতাম, এছাড়া আমার কিছু করার থাকত না। মেসে থাকার সম্পূর্ণ টাকা হাসান দিত, আমি শুধু মাসের পর মাস বিনামূল্যে কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে গাজার ধোঁয়া নিতাম আর তার গল্প শুনতাম। এইটুকুর বিনিময়ে যদি ফ্রি তে থাকতে পারা যায় তাহলে বিনামূল্যে গাজার ধোঁয়া নিতে অবশ্যই প্রস্তুত থাকব আমি।
সমস্যা দেখা দিল কয়েক মাস থাকার পর থেকে। হাসানের কাছ থেকে যে গল্প গুলো শুনতাম তার বেশিরভাগই ছিল ভূত বিষয়ক, কিন্তু রাত বেশি হলে ভূত বিষয়ক গল্প সে এড়িয়ে চলত। আমি চোখের সামনে বই রেখে আবছা আলোতে পড়তাম আর হাসানের গল্প শুনতাম, ভালোভাবে শুনতাম এমনও না। শুধু কানে নিতাম যাতে হুট করে প্রশ্ন করে বসলে উত্তর দিতে পারি। হাসান সিগারেটে জোরে টান দিয়ে বলত, “তাহলে বল তো মীর সিদ্দিকী কার প্রেমে পড়েছিল?” উত্তরটা আমার জানা, কিন্তু সঠিক উত্তর দিতে ইচ্ছা করল না রুচিতে লাগল। বললাম, “ওইযে মীরার। যে মেয়েটা সিদ্দিকীর বাড়িতে সন্ধ্যায় পানি আনতে গিয়েছিল তারপর বুকের ওড়না সরে যায়।”
“ধুরর এই জন্য তোকে গল্প বলতে চাইনা। মীরার প্রেমে পরতে যাবে কেন শুধু শুধু। মনে করে বল, এক মিনিট সময় দিলাম।”
“মীরার বড় ভাই রাহাতের?”
“ইয়েস, কারেক্ট মাই বয়। রাহাতের প্রেমে পরেছিল মীর সিদ্দিকী। হুয়াট আ লাভ!” বলতে বলতে হাসান আমার পিঠ চাপড়াতে শুরু করে।
ভূত বিষয়ক গল্প গুলো বাদে হাসানের বেশিরভাগ গল্পই এরকম ছিল। সবগুলো গল্পেই সমকামী তিনটা কি চারটা চরিত্র থাকত। এমনও না যে গল্প গুলো মিথ্যা, কিছু গল্প সত্যি ঘটনা থেকে একেবারে হুবহু তুলে ধরত হাসান। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে হাসানের কবিতা আবৃতি শুনতাম। অসাধারণ গলা। গলায় বিন্দুমাত্র বাড়তি কম্পন নেই, স্কেল যতটুক থাকার কথা একেবারে ততটুকই। মাঝে মাঝে বলতাম– তোর লেখালেখি বাদ দিয়ে গায়ক হওয়া দরকার। প্রচুর সুনাম হবে দেখিস। হাসান মুখ দিয়ে কুৎসিত ধরনের শব্দ বের করত। আমি মাথা না ঘামিয়ে পুনরায় বইয়ে চোখ রাখতাম। বিনামূল্যে একটা থাকার যায়গা পেয়েও কেন ছেড়ে দিলাম সেটা আমি বাদে কেউ জানেনা। হাসানের গল্পের চরিত্র গুলো বাস্তবে উঠে আসতে শুরু করছিল। প্রত্যেক মানুষেরই এক ধরনের শারীরিক চাহিদা থাকে, রাহাত সাধারণের থেকে একটু ভিন্ন। ওর চাহিদাও সাধারণের চেয়ে ভিন্ন।
কিন্তু আমি ভিন্নতার আশেপাশেও ছিলাম না। বড় মামা মারা যাবার পর যখন টাকা নিয়ে সমস্যায় পড়লাম তখন ছয়তলা থেকে সোজা মাটিতে নেমে এলাম। এত উপর থেকে নিচে আসার পর নিজেকে খুব ভারি লাগতে লাগল। নরম সোফা বাদ দিয়ে কাঠের চেয়ারে বসা লাগবে ভাবতেই শরীর শক্ত হয়ে আসল। মাসে ত্রিশ দিন এসির বাতাস খাওয়া আমি এখন ফ্যান ছাড়াও দিব্যি চালিয়ে দিতে পারি কয়েকদিন। টাকার এই বিশাল অভাবের সময়ে হাসান এসে সাহায্যের হাত বাড়ালো। টাকার অভাবে না থাকলে হাসানের গল্প শোনার মত ফালতু কাজ আমি কোনদিন করতাম না।
টাকা নেশার মত, যতক্ষণ আছে ততক্ষণ নিজেকে সবথেকে সুখী মানুষ মনে হয়। না থাকলেই আমি সন্ধ্যা বেলার কালো পাখি, যা দেখতে কাক হলেও আসলে কাক না। যার দিকে মানুষ তাকায়, আগ্রহ প্রকাশ করে অথচ কাছে গিয়ে সময় অপচয় করেনা। এই ঘরটায় একটা টেবিল আর খাট বাদে শুধুমাত্র একটা জুতার সেল্ফ আর প্লাস্টিকের চেয়ার আছে। চেয়ারটার রঙ কি বুঝতে পারছিনা। তিনদিন আগে ভেবেছিলাম এটা নীল রং, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গোলাপি আর ছাই রঙের মিশ্রণ হবে হয়ত। রঙ বিষয়ে আমি অসম্ভব রকমের বোকা। ছোট বেলায় একবার সুতা কেনার জন্য টাকা দিয়েছিল। হাতে কয়েকটা কাপড় দিয়েছিল আর দুটো মুখে বলে দিয়েছিল।
আমি সুতা কিনে আনলাম, কিন্তু লালের বদলে গোলাপি এনেছিলাম। আবার বুঝিয়ে পাঠানো হলো, জোরে জোরে বলে দিল– তোর সোয়েটারের রঙ। যেটা পড়ে আছিস ওই কালারের আনবি, লাল রঙ। আমি নিজের মত সময় নিয়ে ধির পায়ে হেঁটে গেলাম। ফিরে এলাম হলুদ রঙের সুতা নিয়ে। লাল রঙ কোনটা তখনও বোঝা হয়ে ঠেনি আমার, এখনো হয়নি। রঙ নিয়ে চিন্তা করছি কারণ নিলীমার নীল রঙ পছন্দ। নীল রঙের কিছু একটা পরে বের হতে বলল। নিলীমার প্রিয় রঙ আগে সবুজ ছিল, ছোটবেলায় যখন বুঝতে পারল তার নামের সাথে নীল রঙ ভাল মানায় তখনই সবুজ থেকে লাফ দিয়ে নীলে চলে গেলো। নীল রঙের টি-শার্ট পড়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই নিলীমার মুখোমুখি হলাম। আমাকে দেখার সাথে সাথে সে ফিক করে হেসে দিল– এ কি অবস্থা তোমার?
“কেন কি হয়েছে?”
“আয়না দেখে আসোনি?”
“না।”
“আরে বোকাটা, তোমার নাকে টিপ লেগে আছে। মেয়েদের টিপ।”
আমি ঘাবড়ে গেলাম। তারাহুরো করে বোঝাতে গেলাম যে টিপটা তারই। সুজোগ বুঝে একদিন নিয়ে নিয়েছিলাম। আজ নাকে কিভাবে লেগে আছে জানিনা। বোঝানোর আগেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জানি, ওটা আমারই টিপ। সন্দেহ করিনা, এখন চলেন।” আমি ঘার চুলকোতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে পার্কের পেছন দিকের বট গাছ তলায় এসে বসলাম দুজনে। নিলীমা হাত ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। বিষয়টাকে সাধারণ ভাবে নিলাম। মাঝে মাঝেই ওর থেকে সিগারেট উপহার পাই এখন, অথচ অন্য প্রেমিকারা সিগারেটের জন্য বিচ্ছেদ টানে। আমি একটা সিগারেট নিতেই নিলীমাও একটা নিল। ইশারা দিয়ে বলল জ্বালিয়ে দিতে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
“কই জ্বালিয়ে দিচ্ছোনা কেন?”
“তুমি সিগারেট খাবে? গোল্ডলিফ কিন্তু, গলায় ধরবে।”
“ধরুক, দাও তো তুমি।”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা ধরো আমি আর তুমি একই সিগারেট খেলাম আজকে। আমি প্রথম টান দিয়ে তোমাকে দিতাম আর তুলি লিপস্টিক লাগানো ফিল্টারে টান দিতা। সুন্দর না?”
“হ্যা, কিন্তু এর পর আমি আর কোনদিন সিগারেট ধরতে পারতাম না।” নিলু অবাক হয়ে বলল, “কেন?” “মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম শেষ সিগারেট তোমার সাথে ভাগ করে খাব। তারপর বাদ! তুমি মনের কথা বুঝে গেছো।”
নিলু সিগারেট আগের মত রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ আনমনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আমি নিশ্চুপ, পাখিরা সেই কতক্ষণ থেকে প্রেমময় পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। বাতাসে চুল গুলো সরে যাচ্ছে বারবার। আমার পাশে অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ে বসে আছে যাকে দেখলে উনিশ শতকের সুন্দরী নাইকাদের মত লাগছে। আমার উচিৎ একটু কাছে ঘেষে বসা। হিন্দি সিনেমার কিছু ডায়লগ মনে করে মেয়েটাকে হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা। কিন্তু আমি তার ধারে কাছেও গেলাম না। নিলুর হাতের উপর হাত রেখে শক্ত করে ধরে রাখলাম। আমরা দুজনেই জানি কিছুদিনের মধ্যে বিচ্ছেদের দাগ টানতে হবে। সিনেমার মত সবকিছু না হলেও, ঠিকই নিলুর বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে। ছেলে তেমন বিশাল কিছু করেনা, একটা কসমেটিকস এর দোকান চালায় আর তিনটা অটো আছে যেগুলো ভাড়া দিয়ে ভালোভাবেই চলে যায়।
এই ধরনের ছেলেদের থেকে মেয়ে তুলে আনা তেমন কষ্টের কিছুনা। কিন্তু পায়ের মাটিটা যদি টাকা হয়, তাহলে আমার পায়ের নিচ এখন শূন্য। কোনভাবেই গুছিয়ে নিতে পারব না এই অল্প কয়েকদিনের ভেতর। নিলু টেবিলে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সকালের পাখি দুটোর মধ্যে একটা এখনো আছে। কাঁঠের সারক আর টিনের চালের মাঝে সুরক্ষিত যায়গা পেয়ে বাসা বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিলু পেছনে না তাকিয়েই খাটে এসে বসল। শরীর ছেড়ে দিয়ে বসার কারণে খাটের কোনা গুলো যেন ককিয়ে উঠে ‘ক্যাচত’ করে শব্দ করে উঠল। এই শব্দটার সাথে কম বেশ সবাই পরিচিত। নিলুর চোখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকালাম। হিরের মত চকচক করছে– এমনটা অনায়াসে বলা যাবে। যদিও আমি কোনদিন হিরে দেখিনি। নিলু পাখিটার দিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমিও ওই পাখিটার মত হয়ে যাও।”
“কিভাবে?”
“আমার জন্য থাকার যায়গা করবা। আমার জন্য না হলেও অন্য কারো জন্য। তারপর একসাথে দুইজন। প্রতিদিন দুপুর বেলা তোমার প্রিয় “একদিন বৃষ্টিতে” গানটা শুনব। ভালো হবেনা?”
“কিন্তু ওরা তো ব্যর্থ চেষ্টা করছে, আমার মত।”
“কিসের কি!”
“একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হবে। যেখানে বাসা তৈরি করছে সেখান দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পরে।”
“তাহলে সরিয়ে দেই গিয়ে বাসাটা, অন্য পাশে রাখি।”
“নাহ থাকুক, ব্যর্থতা থেকে শিখুক আর না শিখুক একটা নতুন গল্প হবে ওদের। তিনটা ছানাকে এই গল্পটা শোনাবে আর অন্য একটা ছানা ঘুমাবে। হায় সংসার!”
“তুমি হাসান ভাইয়ের মত হয়ে যাচ্ছ। কিসব ঘুরানো প্যাঁচানো কথা।” আমি হাই তুলে শুয়ে পরলাম বিছানায়। দুটো পা মেঝে স্পর্শ করছে। মাথার উপর ফ্যান জমে বরফ হয়ে আছে তিনদিন হলো। এভাবে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে ঘামে বিছানা ভিজে যাবে। বিছানা ছেঁড়ে উঁঠতে যাব তখনই নিলু শুয়ে পড়ল আমার পাশে। এখান থেকে পাখি গুলোকে দেখতে একটু কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে বাইরে বৃষ্টি হবে। আকাশে মেঘ করছে। অন্য পাখিটি কোত্থেকে যেন উড়ে আসল। বাইরের দুটো পাখি বাসা বানানো বন্ধ করে দিয়ে মেঘজমা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আর ঘরের ভেতরের আমরা দুটো পাখি! নিলু সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখল। আমি উঠে বসলাম।
“ব্যাপার কি?”
“কিসের ব্যাপার! জ্বালিয়ে দাও, খাব আমি।”
“অন্য কিছু খেয়ে ফেলছ নাকি! গাজা খায়িয়ে দেয়নি তো হাসান?”
“ধুরর কি যে বলো, হাসান ভাইয়ের সাথে তো অনেকদিন হলো দেখা হয়না।”
“ওহ।”
“জ্বালিয়ে দাও না!”
“আচ্ছা দিব। আগে বলো, এটাই কি আমাদের শেষ দেখা?”
“জানিনা।”
“জানিনা কেমন কথা। বিয়ের তো চারদিন বাকি, এর পর তো আর বের হতে দিবেনা তোমাকে।”
“হুম, তুমি জ্বালিয়ে দিবেনা?”
নিলুর ঠোঁট থেকে সিগারেট নিয়ে জ্বালিয়ে আবার দিয়ে দিলাম। একটা টান দিয়েই কাশতে কাশতে উঠে বসে পরল নিলু। প্রথমে ভাবলাম এবার ছুড়ে ফেলে দেবে। আমার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে আনাড়ির মত আরো কয়েকটা টান দিয়ে কাশতে লাগল।
আমি উঠে গিয়ে নিলুর সামনে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলাম নিলু কান্না করছে। নিঃশব্দে কান্না করছে, থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। আমি বোকার মত নিলুর গালে হাত দিলাম। প্রেমিকার কান্না থামানোর কোন উপায় আমার জানা নেই। ইতিহাসের সবথেকে বোকা প্রেমিক বোধহয় আমি। কিভাবে প্রেম ধরে রাখতে হয়, কিভাবে দুটো কথা বলেই হাসাতে হয়, কিভাবে কান্না থামাতে হয় আমি কিচ্ছু জানিনা। শুধু ভালবাসতে জানি। ভালবাসতে জানলেই প্রেম হয়! উত্তর আমার বোকা মস্তিষ্কের জানা নেই। নিলু কান্না করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। ক্ষমতা থাকলে এখনই ড্রয়ার খুলে সিঁদুরের কৌটা বের করে নিলুকে পড়িয়ে দিতাম। দুদিন পর যে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে তাকে এভাবে আটকে ফেলার ক্ষমতা আমার নেই।
নিলুর চোখের জল মুছে দিতেই ওর ফোন বেজে উঠল। বাসা থেকে ফোন আসছে। ফোন সাইলেন্ট করে ব্যাগে রেখে দিয়েই আমাকে জাপটে ধরল। এর মানে আমি জানি। এখন হয়ত বলবে ভাল থেকো, অথবা অন্যকিছু যা শুনে আমি কোনদিনই ভাল থাকতে পারব না। আমাকে অবাক করে দিয়ে নিলু বলল– “বাবা-মা কে কষ্ট দিতে কতটা সাহস লাগে এখন জানি। কিন্তু ভালবাসি তো! ছেড়ে যাব না কোনদিন।” ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিলু বাইরে চলে গেল। আমি তখনো বিশাল ঘোরে আটকে আছি। সারাদিনের মন খারাপ, বিষন্নতা এ কিভাবে শেষ হচ্ছে! আমি কাগজ খুলে দেখলাম একটা বড় কোম্পানিতে ডিজাইনার হিসেবে জয়েনিং এর লেটার। পোর্টফলিও সহ এপ্লাই করেছিলাম প্রায় এক মাস আগে। এতদিনে হয়নি তাই এখনো হবেনা ভেবে টিউশনি করিয়ে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
এখন হয়ত সাহস করে ওই ছেলেকে সরিয়ে নায়কের মত বিয়েটা করতে পারব। নাহয় নিলুর বাবার অনুমতি নিয়ে ভালোভাবেই বিয়েটা করতে পারব। তবুও আমার মন এখন অন্যকিছু বলছে। তারাতাড়ি ড্রয়ার খুলে সিঁদুরের কৌটা বের করে বাইরে যেতে লাগলাম। বাইরে বের হতেই হাসানের সাথে ধাক্কা লাগল। “এত তাড়া কেন? কোথায় যাচ্ছিস?” “আমি গল্প শোনানোর মানুষ পেয়ে গেছি বেটা। শুধু মিথ্যা গল্প না, আমার জীবনের গল্প গুলাও তাকে শোনাতে পারব এখন।” “বাহহ, ভালোই।” “ভালো মানে! একেবারে পরী। রূপকথার গল্পের মত, যেমনটা চাইতাম ওইরকমই মেয়েটা। কাল দেখা করিয়ে দিবো আসিস, তোর ভাবী রান্নাও পারে ভালো।”
হাসান-কে এর আগে এত খুশি দেখিনি কখনো। আজ বোধহয় প্রেমের দিন। এই হাসানকে কি ভাবত মেসের সবাই! আমিও কি ভেবে ঘর পাল্টে নিলাম। আজ দেখি সে প্রেমে পরেছে, কোন ছেলের না এক মেয়ের প্রেমেই পড়েছে।
হাসানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে প্রায় দৌঁড়ে নিলুর কাছে গেলাম। বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। নিলুর একেবারে কাছে এসে চোখের দিকে তাকাতেই সম্মতির ইশারা পেলাম। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও নিলুর নিঃশ্বাস স্পষ্ট আমার কানে আসছে। হৃৎস্পন্দন বেড়েই চলেছে, এভাবে আর কিছুক্ষণ এই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে গোটা কয়েক বার হার্ট এট্যাক করা লাগবে। কৌটা থেকে যতটুক পারা যায় সিঁদুর নিয়ে নিলাম। বাকিটুক বৃষ্টির সাথে মিসে গেল। নিলুর সিঁথীতে সিঁদুর ছোয়াতেই কেঁপে উঠল সে। আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম আমার সামনে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকা দেবীটির দিকে যার মুখ বেয়ে সিঁদুর পরছে। এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারব জানিনা, হয়ত কিছুক্ষণ আবার হয়তো মহাকাল!
অনিচ্ছায় আমার হাত নিলুর কোমড়ে চলে গেল। প্রকৃতি এখন চাচ্ছে ঠোঁটে চুম্বন দিয়েই নতুন শুরু হোক। আর আমি? আমি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার সাহস করলাম না। নিলুর ঠোট স্পর্শ করতেই সে দ্বিতীয় বারের মত কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই ভালোবাসায় ডুব দিল সেও। পায়ের নিচ শূন্য রেখেও শেষ পর্যন্ত থাকার চেষ্টা করেছি, প্রকৃতি আমার শূন্যতা সরিয়ে নিয়েছে আমি শুধু প্রকৃতির একটা ইচ্ছায় সায় দিলাম। অপরাধ হবেনা নিশ্চিত!
গল্পের বিষয়:
গল্প