আমার এক রোখা স্বভাবের বাবার সামনে আমি আর বলতেই পারলাম না যে, আমি বিয়েটা আসলেই করতে চাইনা। মা’কে অনেকবার বলেছি। মায়ের একই কথা, ‘তোর কোনো পছন্দও নেই, পড়াশোনাও শেষ, চাকুরিও করছিস। এখন আর বিয়ে না করার মত কোনো বাহানাও নেই। সুতরাং এখন আর কোনো কথা বলবি না।’
মা’কে কোনোভাবে বোঝাতেই পারলাম না যে, আমি আসলে বিয়ে বিষয়টা নিয়ে এখনও মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। একটা জিনিস ধুম করে বললেই তো করা যায় না, সবকিছুর একটা প্রস্তুতি আছে৷ কিন্তু কে বোঝায় মা’কে এই কথাটা। অবশ্য মা’কে বলেছিলাম। তিনি উত্তরে কর্কশ কন্ঠে বললেন, ‘বিয়ের জন্য আবার প্রস্তুতি কি! আমার তো ঊনিশ বছরে তোর বাবার সাথে একদিন হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যায়। কই আমার তো কোনো প্রস্তুতি লাগে নি! আমি কি মরে গেছি? খারাপ আছি? তোদের দুই ভাইবোন, তোর দাদা দাদি, তোর বাবাকে নিয়ে খুব ভালো আছি।’ যখন বললাম, ‘তাহলে তুমি মাঝে মাঝে কেন সব ছেড়ে ছুঁড়ে বাবা বাড়ি চলে যেতে চাও?’
মা ভীষণ চটে গিয়ে বললেন, ‘ওটা কি আমি মন থেকে বলি! ওটা তো রাগ করে বলি। সংসারে তো রাগারাগি হবেই।’
মা এক নাগাড়ে বলেই চললেন, ‘ তুই এইসব বাহানা রাখ। বয়স কত হয়েছে দেখেছিস? চেহারার দিকে তাকালে তো বুঝবিনা। জন্ম সনদ দেখিস। পাড়াপ্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনদের কথা তো আমাদেরকেই শুনতে হয়। মেয়ে ঘরে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে বিয়ে দিচ্ছি না কেন! নানান কথা নানান লোকে বলে। কতদিন শোনা যায়! এতদিন তবুও পড়ালেখা, চাকুরি এসব বাহানা দেখিয়ে লোকজনের কথা হজম করেছি। এখন তুই চাকুরিও পেয়ে গেছিস এখন আর কোনো কারন নেই বিয়ে না করার। তোর এই নানান বাহানায় সময় কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ভালো ছেলেই পাচ্ছিলাম না এতদিন। কয়েকদিন পর তো খারাপ কোনো ছেলেও পাবো না খুঁজে। ভাগ্যিস তোর জলিল মামা সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছিল।’ শান্ত স্বরে বললাম, ‘ভালো সম্বন্ধ পাচ্ছিলে না? তাহলে গত দুই বছর ধরে যে ছেলেগুলোর ছবি আমাকে দেখাতে তাঁরা কি আসলেই ভালো ছিল না মা?’
আমার কথায় মা আরও রেগে আগুন হয়ে গেলেন। বড় বড় চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। এবার আসলেই রক্ষা নেই। এতবছর মা’ই বাবাকে বুঝিয়ে থামিয়ে রেখেছেন। এখন মা নিজেই উঠেপড়ে লেগেছে। বিয়েটা করতেই হবে আমার। বাবা আর ছোট ভাই ছাড়া আমি কোনো ছেলেকে ভালো চোখে দেখতে পারিনা। ছোট বেলায় একবার স্কুলে এক ছেলে আমার মাথায় ক্রিকেট বল ফেলে মাথা ফাটিয়ে দিল। দুইটা সেলাই লাগলো। তারপর থেকে স্কুল জীবনে আমি ছেলেদের থেকেই দূরে ছিলাম। মাধ্যমিকে একদিন এক ছেলে বার্ষিক পরিক্ষার সময় নকল করে সেই কাগজ ফেলে দিলো আমার পায়ের কাছে। শিক্ষকরা এসে আমাকে ইচ্ছেমত বকাঝকা করে খাতাটা নিয়ে গেল। সেবার রোল এক’র জায়গায় হলো দুই।
প্রথমবার আমার রোল এক’র নিচে নামলো। তারপর থেকে মাধ্যমিকেও ছেলেদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতাম। কলেজে ওঠার পর একদিন দেখি আমার বান্ধবী খুব কান্না করছে। জিজ্ঞেস করলে বললো ক্লাসের একটা ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক অনেকদিনের। কিন্তু কয়েকদিন ধরে ওকে এড়িয়ে চলছে। আজ জানতে পেরেছে ছেলেটা নাকি অন্য কারো সাথে সম্পর্ক শুরু করে। তারপর থেকে তো ছেলেদের প্রতি এক ধরনের রাগ চলে এলো। এরপর যখন দেখতাম রাস্তায় ছেলেরা দাঁড়িয়ে মেয়েদের বিরক্ত করে। তখন থেকে তো ছেলেদের প্রতি শুধু রাগ না ঘৃনাও যোগ হলো। পরবর্তীতে কোনো ছেলেকে ভুল করেও আমার কাছে ঘেঁষতে দেইনি কখনও। ভার্সিটি জীবনে শিক্ষক ছাড়া কখনও কোনো ছেলের দিকে তাকিয়েছি বলে মনে পড়ে না। ছেলেদের নেতিবাচক দিকগুলো সবসময় চোখে পড়তে পড়তে এত বিরক্তি চলে এলো যে তাঁদের ইতিবাচক দিকগুলো আমার চোখেই পড়ে না।
‘জুলিয়া?’
‘জ্বী মা বলো।’
‘তোর জলিল মামা কল করেছিলো। কাল ছেলেপক্ষ বাসায় আসবে তোকে দেখতে।’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে দেখার কি আছে মা?’ আরও অবাক হয়ে মা বললো, ‘কি বলে এই মেয়ে! তোকে তাঁরা তাদের ঘরে তুলবে, দেখেশুনে তুলবে না? তুই তোর কাজিনদের বিয়ে দেখিস নি কিভাবে হয়েছে!’ ‘তার মানে আমাকেও হেঁটে দেখাতে হবে? সুরা পড়ে শুনাতে হবে?’ মা বললেন, ‘লাগতেও পারে। তুই প্রস্তুতি নিয়ে থাক। তোর তো প্রস্তুতি ছাড়া নাকি হয় না।’ মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছি। কাল কি হবে জানা নেই। একটাই উপায় আছে, ছেলের সাথে ব্যক্তিগত কথা বলার বাহানায় একা পেয়ে তাঁকে অনুরোধ করে বলবো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে। নাটক সিনেমায় দেখেছি এমনটা। কাজও হয়। আমারও হবে।
অতঃপর ছেলের পক্ষ এলো কিন্তু ছেলে এলো না। ছেলে নাকি বলেছে তাঁর বাবা মায়ের পছন্দ হলেই চলবে। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করে যাচ্ছি যাতে তাঁদের পছন্দ না হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার। ছেলের বাবা মা আলহামদুলিল্লাহ বলে বিয়ের প্রসঙ্গ টানা শুরু করলেন। বিয়েটা কি তাহলে হয়েই যাবে! আঁটকানো কি কোনোভাবেই সম্ভব নয়! যে করে হোক ছেলেকে এখানে আনতেই হবে। মা’কে ফিসফিস করে ডাকলাম। ‘মা?’ মা ফিসফিস করে বলছে, ‘কি হয়েছে?’ ‘ছেলের বাবা মায়ের আমাকে পছন্দ হলেই বিয়ে ঠিক হবে কেন? তোমাদেরও তো অধিকার আছে ছেলে দেখে বিয়ে ঠিক করার। তাই না?’ আমার কথাটা সত্যিই মায়ের মাথায় ঢুকেছে। বাবাকে বলে অবশেষে ছেলের মা-বাবাকে দিয়ে ছেলেকে আনালেন বাসায়।
কিন্তু আরও দুর্ভাগ্য যে ছেলে এসে সালাম দিয়ে বসতেই আমার মা বাবা আলহামদুলিল্লাহ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। এবং আমাদেরকে কোনোরকমের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওই আসরেই বাগদান সম্পন্ন করে ফেললেন। আমি কটমট দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ছেলে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো সামনের মাসের তেইশ তারিখ। উপায় না পেয়ে মা’কে বললাম আমার ছেলে পছন্দ হয়নি। মা এক রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেটা কি সুন্দর। যে কারো পছন্দ হবে। তোর হলো না কেন? কি সমস্যা?’ ‘মা ছেলেটা অনেক বেশি সুন্দর এটাই তো সবচেয়ে বড় সমস্যা। ‘ ‘এটা আবার কি সমস্যা?’ ‘এই ছেলে এত সুন্দর। নিশ্চয়ই অনেক প্রেম করেছে, কত মেয়ের মন ভেঙেছে খবর নেই। মা বিয়ের পর যে আমাকে ছেড়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কি?’
আমার কথা শুনে মা খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভাবলাম, এই বুঝি কাজ হলো। খুশি খুশি মনে তাকাতেই মা কঠিন স্বরে বললেন, ‘তোর বিয়ে করার ইচ্ছে কোনোদিনও হবে না। ভাবলাম এই সুন্দর ছেলেটাকে দেখে হয়তো তোর মনে বিয়ের ইচ্ছে হবে। কিন্তু আমি ভুল ভাবছি।’ মা এখানেই থেমে রইলেন না। তিনি বাবাকে বলে বিয়ের তারিখ সামনের মাস থেকে সামনের সপ্তাহে আনলেন। আমি নিরুপায় হয়ে চুপ করে রইলাম। বিয়ের আয়োজন চলছে বাড়ি জুড়ে। বিয়ের দিনটা অবশেষে চলেই এলো। কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধে টেকা খুব মুশকিল। সাজার আগেই অবশ্য এক প্লেট খেয়ে নিয়েছি কিন্তু এখন আবার খিদে লেগেছে।
কনে বিদায়কালে মা আমাকে ধরে খুব কাঁদলেন, বাবাও কাঁদলেন। ছোট ভাই কাঁদে নি। কারন ও আমার সঙ্গে ওই বাড়িতে যাবে। আমার কান্না পায়নি। লোকজন খারাপ বলবে, না কান্না করলে। এটা ভেবে অনেক চেষ্টা করে চলছি কান্না করার কিন্তু হচ্ছে না। তারপর যখন মনে পড়লো আমার বিয়ে হয়ে গেছে তারমানে এখন থেকে একটা ছেলের কথামত আমার চলতে হবে, তাঁর সাথে জীবনযাপন করতে হবে এটা ভাবতেই কষ্টে কান্না করে দিলাম। মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘থাক কাঁদিস না মা আমাদের জন্য। আমরা ভালো থাকবো। তুইও ভালো থাকিস। ‘
হাসি হাসি মুখ করে নাজিম সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো। নাজিম আমার স্বামীর নাম। আজই জানতে পেরেছি।
অতঃপর আমি গোমড়া মুখে বেজায় খিদে নিয়ে বাসর ঘরে বসে আছি। নাজিম রুমে ঢোকার সাথে সাথে তাঁর ভাবিও এলো। আমাদেরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে তিনি বিদায় হলেন। খুব রাগ হলো ভাবির উপর। আমার খিদে পেয়েছে কাচ্চি বিরিয়ানির আর তিনি একটা মিষ্টি খাইয়ে চলে গেলেন। রুমে এখন আমি আর নাজিম। আমার ভীষণ অসস্তি হচ্ছে। মাথার উপরে ফুল স্পীডে ফ্যান ঘুরছে কিন্তু আমি ঘেমে যাচ্ছি। বুঝে উঠতে পারছিনা এমন কেন হচ্ছে। হয়তো খিদের জন্য। নাজিম কিছু একটা বলতে চাচ্ছে এমন সময় আমি বললাম, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। ভীষন কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। আপনার বাসায় কি কাচ্চি রান্না হয়েছে? তাহলে আমার জন্য এক প্লেট কাচ্চি নিয়ে আসেন দয়া করে।’ আমার কথা শুনে একটু অবাক হলো নিশ্চয়ই নাজিম। বাসর ঘরে প্রথম কথা খিদে নিয়েও হতে পারে এটা হয়তো তাঁর ধারনা ছিল না। সে চুপচাপ উঠে চলে গেল। তাঁর ভাব ভঙ্গি দেখে আমি আন্দাজ করতে পারছি না সে আসলেই কাচ্চি আনতে গিয়েছে নাকি সবার কাছে নালিশ করতে গিয়েছে।
যাই হোক কিছু তো একটা হবেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে কাপড় বদলে নিলাম। সব গহনাদি রেখে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরই মধ্যে নাজিম এক প্লেট কাচ্চি নিয়ে হাজির হলো রুমে। আমাকে বউ সাজ রেখে এরকম সাদামাটা অবস্থায় দেখে তাকিয়ে রইলো নাজিম। তাঁর তাকানো দেখে মনে হলো আমি খুব বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে খেতে বসলাম। নাজিম চুপচাপ বসে আমার খাওয়া দেখছে। ‘আমার খাওয়ার সময় কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি খেতে পারিনা।’ কথাটা বলতেই নাজিম চুপটি করে উঠে চলে গেল ওয়াশরুমে। সারাদিনে একটা কথাও বলেনি নাজিম আমার সঙ্গে। তাহলে কি নাজিমের এই বিয়েতে মত ছিলো না? ভাবতেই বেশ খুশি লাগছে। এমন সময় হঠাৎ হেঁচকি উঠে গেল। নাজিম পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলো খেয়ে নিতে। আমি চুপ করে খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষ হতেই মনে হলো, নাজিম খেয়েছে কিনা একবার জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। মনে মনে কি ভাবছে আমায়! রাক্ষস ভাবে নি তো!
‘আচ্ছা আপনি খেয়েছেন?’ নাজিমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। নাজিম চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর বললো, ‘তোমাদের বাড়ি অনেক খাবার খেয়ে এসেছি। এখনও হজম হয়নি। তাই খাবো না রাতে।’ এমন সময় মায়ের কল এলো। ‘হ্যালো মা? কেমন আছো?”আমরা ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? মন খারাপ করিস না আমাদের জন্য। জামাই কোথায়?’ ‘আছে আমার কাছেই।’ ‘শোন জামাইয়ের কথা শুনবি। বাড়ির সবার খেয়াল রাখবি। একদম উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। আমাদের কানে যেন কোনো ধরনের কথা না আসে।’ ‘আচ্ছা মা’ বলে ফোনটা রেখে দিলাম। খুব ভয় হতে লাগলো। নাজিমের একটা কথাও তো আমি শুনবো না। সে যদি নালিশ করে দেয় বাবা মা’র কাছে, তবে তো আমার খবর আছে।
আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু আমি এখানে ঘুমানোটা নিরাপদ মনে করছি না। কেমন যেন একটা ভয় লাগছে। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে নাজিম বললো, ‘তুমি চাইলে শুয়ে পড়তে পারো।’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আমি একা ঘুমাতে অভ্যস্ত।’ ‘এখন থেকে তোমাকে আমার সঙ্গে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। আমি নাটক সিনেমার মত সোফায় বা নিচে বিছানা করে ঘুমোতে পারবো না। এতটা মহান আমাকে ভাবলে ভুল করবে। কিন্তু হ্যাঁ, সমস্যা নেই তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো। তোমার থেকে আমি দূরত্ব বজায় রেখেই থাকবো। মহান না হলেও খারাপ না আমি।’ কথাগুলো মাথার ভিতরে তীরের মত গেঁথে গেল। চুপ করে রইলাম। নাজিম আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমাকে শাড়ী গহনার থেকে সাদামাটা সেলোয়ার কামিজে বেশি সুন্দর লাগছে।’
আমি চুপ করে শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। সকালে রত্নার ফোনকলে ঘুম ভাঙলো। রত্না হলো আমার বান্ধবী। ‘কি রে জুলিয়া? কেমন কাটলো তোর বাসর রাত?’ ‘এত সকালে কেউ ঘুম ভাঙিয়ে এসব জিজ্ঞেস করে?’ ‘এত সকাল কই? দশটা বাজে।’ ‘কি বলিস দশটা বেজে গেছে?’ ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি আসলেই দশটা বেজে গেছে। ‘তুই ফোন রাখ। পরে কথা হবে।’ বলেই তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম বিছানা ছেড়ে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা কোলবালিশ রাখা, তার পাশে বালিশটা ফাঁকা। তাড়াতাড়ি উঠে বিছানাটা গোছাতেই নাজিম রুমে এলো।
‘শুভ সকাল’ একগাল হাসি নিয়ে বললো নাজিম। ‘শুভ সকাল’ ‘তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। টেবিলে মা নাস্তা দিয়েছে খেতে বসবো তারপর।’ ‘আপনি খান নি?’ ‘না। তোমার জাগার অপেক্ষায় ছিলাম।’ আমি ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসলাম। বাড়ির সবাই খুব যত্নশীল আমার খাবারের বিষয়ে। নাজিম আমার কাছে ঘেঁষে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কি এখানে খেতে অসুবিধা হচ্ছে? তাহলে রুমে গিয়ে খেতে পারো।’ আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, ‘না’ দুই বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমার আর নাজিমের ছুটিও শেষ হয়ে গেলো। নাজিমের চাকুরি চট্টগ্রামে। খুলনা থেকে চট্টগ্রাম বেশ দূরত্ব। আমার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও বাবা আর মা জোড় করে আমায় ট্রান্সফার করাতে বাধ্য করিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে নাজিমের সাথে চট্টগ্রাম পাড়ি জমাতে হলো।
খুব মন খারাপ হয়েছিল আমার। নাজিমের সাথে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ভেতরে নেই৷ আমি তাঁর থেকে যত দূরে থাকতে পারি ততই আমি স্বাচ্ছন্দ্যেবোধ করি। আমার অবস্থাটা হয়তো কিছুটা আন্দাজ করেছিল নাজিম।
আমার গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি আমার সাথে নিশ্চিন্তে যেতে পারো। কথা দিলাম, তোমার অনুমতি ছাড়া আমি তোমার নেইল কাঁটারটাও ছুঁয়ে দেখবো না।’ চট্টগ্রামে এই প্রথমবার আসা আমার। নাজিম আমাকে মোটামুটি একটা ধারনা দিল এই শহর সম্পর্কে। দিন কাটছিলো একইরকম। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে যে যার মত অফিসে চলে যাওয়া তারপর যার সময় মত সে বাসায় ফেরা। বাসায় ফিরে বুয়ার রান্না করা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। সারাদিনে নাজিমের খবর আমি না নিলেও নাজিম নানা কৌশলে আমার খবরটা জেনে নেয়। মনের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যায় সবসময়, ‘আমার এমন দূরত্ব বজায় রেখে চলার কারন নিয়ে নাজিমের কেনো কোনো প্রশ্ন নেই? তাহলে কি সেও চায় আমি এমনটাই করি?’
একদিন বুয়া আসেনি। রান্নাঘরে রান্নার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তরকারি কাঁটার সময় হাত কেটে ফেলেছিলাম। ‘উহ্’ করে চিল্লানি দিতেই নাজিম এসে হাজির। যতটুকু কেটেছিলো তার থেকে অনেক বেশি যত্ন ছিল নাজিমের৷ এরপর কখনও রান্নাঘরে গেলে নাজিম আমাকে সাহায্য করে। রাতে ঘুমোলে আমার গায়ে কম্বল থাকে না। ঘুমের মধ্যে আমি ওটাকে সরিয়ে দেই। আর পরে ঠান্ডা লেগে গিয়ে খুব খারাপ অবস্থা হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সবসময় আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছি আমার গায়ে ঠিকঠাক কম্বল আছে। বুঝতে কষ্ট হয়নি যে এটা নাজিমের কাজ।
সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে খুব জ্বর হলো। ছুটি নিতে হলো। নাজিমও ছুটি নিয়ে নিল। আমি অসুস্থ থাকলে মায়ের খুব প্রয়োজনবোধ করি। এই প্রথমবার আমি মায়ের অভাব অনুভব করিনি, মনে হয়নি মা নেই আমার কাছে। মাথার পাশে সারারাত বসে ছিল নাজিম। আমার খাওয়া দাওয়া, ঔষধ, ঘুম সবকিছুর বিষয়ে নাজিম খুব সচেতন ছিল।
আস্তে আস্তে নাজিমের প্রতি আমি একধরনের আস্থা তৈরি হলো। তারপর সেটা ভালো লাগায় রূপ নিল। আবিষ্কার করলাম এই প্রথম আমি কোনো ছেলের প্রতি এরকম অনুভূতি অনুভব করছি। নাজিমকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা চালালাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। একদিন সন্ধ্যায় বললাম আইসক্রিম খেতে বাহিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। নাজিম স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘আচ্ছা তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও। তারপর বের হবো।’ বিয়ের পর আমি এই প্রথমবার শাড়ি পড়লাম। হালকা সাজগোছ করে নিলাম। নাজিমের সামনে এসে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো লাগছে তো?’
নাজিম মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘হুম’ পাশাপাশি রিকশায় বসা আমি আর নাজিম। রিকশা থেকে নেমে রাস্তার ওপাশে আইসক্রিমের দোকানের উদ্যশ্যে যখন পা বাড়ালাম, নাজিম পাশ থেকে হাতটা শক্ত করে ধরলো। রাস্তা পারাপার শেষ হলে নাজিম হাতটা ছেড়ে দিলেও আমার সারাদিনই মনে হলো নাজিম আমার হাতটা এখনও শক্ত করেই ধরে রেখেছে। নিজেকে আমি প্রতিদিন নতুনভাবে আবিষ্কার করি এখন। ছেলে বিদ্বেষী আমিই বর্তমানে একটা ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার এখন নাজিমের সঙ্গ খুব ভালো লাগে, কারনে অকারণে নাজিমের সাথে কথা বলার চেষ্টা চালাই, বাহানা খুঁজি নাজিমের মনোযোগ আকর্ষণের। একদিন খুব সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম , ‘আচ্ছা আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?’
শান্ত স্বরে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, বাসি’ খুব মন খারাপ হলো সেদিন। একটা ছেলে অন্য কাউকে ভালোবাসে এই কথাটা আমাকে মন খারাপ করাবে আমি কখনও ভাবিও নি। আমার এই পরিবর্তনগুলো আমি ভিষণ টের পেতে থাকি। আগে মন খারাপ হত নাজিমের কাছাকাছি থাকতে হবে বলে, আর এখন মন খারাপ হয় নাজিম আমার কাছে থেকেও দূরে আছে বলে। দিন কেটে যেতে লাগলো, আমার প্রতি নাজিম তাঁর সব দায়িত্ব পালন করে যায়। নাজিম তাহলে কি চায়, আমি নিজ থেকে তাঁকে ছেড়ে দেই? নাকি তাঁর সময় হলে সে’ই আমাকে ছেড়ে দিবে? অনেক প্রশ্নরা ভীড় করে মনে। আমি উত্তর খুঁজি কিন্তু পাইনা। আমার দূর্বলতা বেড়ে যেতেই লাগলো। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছি কিন্তু কেন যেন পারছি না। তবুও চেষ্টা করে চলছি।
মাঝে মাঝে নাজিম আমার দিকে এমনভাবে তাকায়, আমার মনে হয় আমি তাঁর চোখের ভেতর ডুব দেই। একটা শক্ত মায়ার টান অনুভব করি। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সে চাহনিতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে আমার দেখার ভুল, নাজিম তো অন্যকাউকে ভালোবাসে। এই কষ্টটা বোঝানোর মত নয়। কাউকে ভালোবেসে না পাওয়ার কষ্ট, ভীষণ পোড়ায়। আমাকেও ভেতরে ভেতরে পোড়াতে লাগলো। সন্ধ্যে বেলায় খুব ঝড় শুরু হয়। সাথে ভীষণ বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতও শুরু হলো। তার সাথে লোডশেডিং। বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতের শব্দে আমি খুব ভয় পাই। নাজিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আমি চুপচাপ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। পাশ ফিরে তাকিয়ে নাজিম জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু বলবে?’ আমি মাথা নেড়ে না সূচক ইঙ্গিত দিলাম। আমি বজ্রপাত আর বিদ্যুৎ চমকানো ভয় পাই এই কথাটা বলা যাবে না কোনোভাবে। একটা মানসম্মানের বিষয় আছে তো।
কিন্তু অবাক করে দিয়ে নাজিম জিজ্ঞেস করলো, ‘বজ্রপাত আর বিদ্যুৎ চমকানো ছাড়া আর কি কি ভয় পাও তুমি?’
নিজেকে সংবরণ করে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলাম, ‘আমি বজ্রপাত বা বিদ্যবিদ্যুৎ চমকানো কোনোটাই ভয় পাইনা৷’
‘ওহ্ তাই নাকি! আমি ভাবলাম তুমি হয়তো এসবে ভয় পাও তাই বারান্দায় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছো।’
নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলাম, ‘নাহ্ এমন কিছু না। এমনিই এসেছি।’ এমন সময় বিদ্যুৎ চমকে সারাবাড়ি আলো করে দিয়ে ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হলো। আমি সাথে সাথে চিৎকার মেরে নাজিমকে জাপটে ধরলাম। বেশ কিছুক্ষন বিদ্যুৎ চমকানো শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি নিজেকে নাজিমের থেকে সরিয়ে নিয়ে চলে যাব এমন সময় নাজিম আমার হাতটা চেপে ধরলো।
আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘আমি দুঃখিত। আমি আসলেই বজ্রপাত আর বিদ্যুৎ চমকানো ভয় পাই। আমি ইচ্ছে করে করিনি।’ নাজিম আমার হাতটা হেঁচকা টান মেরে তাঁর কাছে নিয়ে গেল। নরম স্বরে বললো, ‘আমি জানি তুমি কিসে ভয় পাও, আর কিসে খুশি হও।’ আমি দু’চোখ ভরা বিষ্ময় নিয়ে নাজিমের দিকে তাকিয়ে আছি। নাজিম শান্তস্বরে বললো, ‘এখানে বসো তোমার সাথে আমার কথা আছে কিছু।’ আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। জানিনা কি বলতে চলছে নাজিম। নিঃশ্বাস চলছে তবুও মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস যেন আঁটকে আছে৷ আমি নাজিমের চোখের দিকে তাকালাম। মোমবাতির লালচে আলোয় মুখটা লালচে লাগছে।
‘জুলিয়া আমি তোমার ভার্সিটির সিনিয়র ছিলাম। তোমাকে একদিন আইসক্রিম খেতে দেখেছিলাম ক্যান্টিনে। আমরা তখন বন্ধুরা মিলে চা খাচ্ছিলাম তোমার পাশেই। নিষ্পাপ একটা মায়া মুখ, তোমায় ভালো লেগেছিলো ভীষণ। তারপর থেকে তোমাকে অনুসরণ করতাম। কিন্তু ভুল করেও তোমাকে কখনও তাকাতেই দেখিনি আমার দিকে। তোমার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তুমি ছেলে বিদ্বেষী। হতাশ হলাম। কিন্তু এটা নিশ্চিত ছিলাম তুমি কখনও প্রেম করোনি আর করছোও না। আমার প্রেমেও পড়বে না এটাও নিশ্চিত হয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমার দিকে নজর রাখতাম। পড়াশোনা শেষ করে চাকুরি পেয়ে ভাবলাম তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। কিন্তু তখন জানলাম তুমি তোমার চাকুরী না পাওয়ার বাহানায় সব সম্বন্ধ ভেস্তে দিচ্ছো।’
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নাজিম বলেই চললো, ‘আমি অপেক্ষায় ছিলাম তোমার চাকুরি পাওয়ার। আর যেদিন তুমি চাকুরি পেলে তার এক সপ্তাহ পরেই তোমার জলিল মামার সাথে যোগাযোগ করে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। দেখ জুলিয়া সব ছেলে খারাপ নয়। আবার সব মেয়েও ভালো নয়। ভালো খারাপ মিলিয়ে আমরা মানুষ। আমি চাইলে তোমাকে এত বছরে অনেক বিরক্ত করতে পারতাম, তারপর তুমি নাকচ করে দিলে খারাপ মানুষের মত আমি তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু আমি কিছুই করিনি, করার মত মানসিকতা নেই আমার। আমি অপেক্ষা করেছি, আমি দূর থেকে তোমার খেয়াল রেখেছি। বিয়ের পর আমি তোমার সাথে জোর করে আমার অধিকার আদায় করতে পারতাম। কিন্তু আমি করিনি। আমি চাইতাম আগে তুমি আমাকে চেনো, বোঝো, জানো, বিশ্বাস করো। তারপর একদিন নিজেই ধরা দাও।
এইজন্যই তোমাকে আমি আমার কাছে রাখার চেষ্টা করেছি। কারন তুমি কারও কাছে না পৌঁছালো, তাঁর ভেতরটা জানতে পারবে না৷ ভেতর জানতে হলে, কাছে তোমাকে যেতেই হবে। দেখ জুলিয়া সবাই খারাপ না। তুমি ছোট বেলা থেকে ছেলেদের ভুলগুলোই প্রাধান্য দিয়ে দেখেছো, ছেলেদের ভালোগুলো তাই তোমার চোখে পড়ার সুযোগ পায়নি।’ আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে, আমার মত ছেলে বিদ্বেষী একটা মেয়েকে কোনো ছেলে এতটাও ভালোবাসতে পারে। নাটক সিনেমার মত আমার বিয়েটা ভাঙ্গে নি ঠিক, কিন্তু নাটক সিনেমার মত আমার ভালোবাসাটা হয়ে গেল। নাজিম আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। নাজিম কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে। আমি নাজিমের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হাতটা ধরো তো আবার৷’
আমার কথা শুনে নাজিমের মুখ জড়িয়ে হাসি জেগে উঠলো। নাজিম আমার হাতটা চেপে ধরলো শক্ত করে। আমি নাজিমের চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘জড়িয়ে ধরা যায় না? সব কি আমার বলে দিতে হবে?’ নাজিম উপচে পড়া হাসি নিয়ে আমাকে ওর বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমো খেল। আমি ফিসফিস করে নাজিমের কানে বললাম, ‘একটা কথা তোমাকে বলা হয় নি?’ নাজিম ফিসফিস করে উত্তর দিল, ‘কি কথা?’ আমি হাসি মিশিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘ছেলে বিদ্বেষী মেয়েটা তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে অনেকদিন ধরে।’ নাজিম আমায় আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে আর আমার ভেতরে ছেলেদের প্রতি যত বিদ্বেষ সব ধুয়েমুছে যাচ্ছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প