প্রকৃতির প্রতিশোধ

প্রকৃতির প্রতিশোধ
আজ আমার স্বামী সিয়ার বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে এসেছে।সিয়া হলো আমাদের একমাত্র আদরের মেয়ে।সেই মেয়ে যাকে মশা কামড়ালেও শাহিদ (আমার স্বামী) বাড়ি মাথায় করত।মেয়েটাও ঠিক তেমনি হয়েছে।ছোটবেলা থেকেই বাবার নেওটা।বাবাকে ছাড়া একমূর্হুত থাকতে পারেনা।আজকের এই অপমানটা শাহিদ মানতে পারেনি।সিয়ার বাড়ি থেকে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে রয়েছে।আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।তারপর সিয়া ফোন করে সব বলল।প্রচুর কাদছিল ও।বুঝতে পারলাম শাহিদকে অপমানিত করায় যতটা কষ্ট পেয়েছে তার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে মেয়ের চোখে জল দেখে।কথায় আছে,”মাটিতে নামায় না পিপড়ে কামড়াবে,মাথায় রাখে না উকুন কামড়াবে বলে”।এমন করে সিয়াকে বড় করেছে শাহিদ।
এসব ভাবতে ভাবতে বিকেল হয়ে গেল। আসরের নামাজ পড়ে বেলকনিতে দাড়ালাম। মনে পড়ে গেল ত্রিশ বছর আগের কথা।আমি তখন কারো বউ,কারো মা ছিলাম।ছিলাম বাবার আদরের মেয়ে। না নিম্নবিত্ত বাবার আদরের মেয়ে।ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বিয়ে হয়ে গেল।যৌথ পরিবার তাদের। ওরা ছিল উচ্চবিত্ত। তাই বাবা ভেবেছিল, এখানে ভালো থাকব।কিন্তু টাকা থাকলে ভালো মনের হওয়া যায়না।এই জিনিসটা শাহিদও বোঝেনি। এতো বড় বাড়িতে কয় হাড়ি ভাত হবে,কয় পিস মাছ রান্না হবে।এসব বুঝতে পারতাম না।তাই নিয়ে সবাই কথা শোনাতো।রোজাতে একদিন মা,বাবা এসেছিল দাওয়াত খেতে আর উপহারসামগ্রী দিতে।সবাই কাপড় দেখে ভেংচি কাটে।
আমার ননদ তো বলে দেয়,এই কাপড় তাদের বাড়ির কাজেরলোক ও পড়েনা।বাড়িতে কয়েক পদের খাবার রানৃনা হয়েছিল।কিন্তু বাবাকে শুধু ভাত আর শাক দেওয়া হল।একই টেবিলে বসে ওরা রেস্তোরা থেকে আনা খাবার খেলো।আর বাবা শাক দিয়ে ভাত চিবুচ্ছিল।আমার শাশুড়ী বলল,বেয়ান আপনি তো এইসব খাবার কখনো খাননি,তাই আপনার জন্য শাক ভাতের ব্যবস্থা।বাবা শুধু একটা শুকনো হাসি দিয়েছিল।যাওয়ার সময় হাতে পায়ে ধরে বলেছিলাম,আমাকে সুখী দেখতে চাইলে আর এখানে এসো না।মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।নিজের বাবার এই অপমান সহ্য করতে পারিনি।মাকে ফোন করে কাদতাম।মা বলতো,মেয়েদের সহ্য করতে হয়।তারপর আর কোনদিন বাবা এইবাড়িতে আসেনি।মৃত্যুর সময় তাকে দেখতে পারিনি। কারণ ওখানে গেলে আমার শুশুর বাড়ির সবার মাথা নিচু হয়ে যাবে।
মা কাদতে কাদতে বলেছিল,আমার আসতে হবেনা।তার বছর দুয়েক পর মাও চলে যায়।তাকেও দেখতে পারিনি আমার মেয়েকে কখনো বলতে পারিনি তার নানুবাড়ি আছে।নানা আছে,নানু আছে। হঠাৎ করে কলিংবেলের আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়লো।এখন তো কেউ আসার নেই।এসব ভাবতে ভাবতে গেট খুললাম।দেখি সিয়া দাড়িয়ে আছে।গেট খুলতে দেরী কিন্তু ওর শাহিদের রুমের দিকে দৌড়াতে দেরী হলো না।আমি ওর লাগেজ ঘরে রেখে ব্যাপারটা কি তা দেখার জন্য ওদিকে যেতেই হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ পেলাম।তাই আর ভিতরে ডুকলামনা।কাদুক ওরা।নিজেদের হাল্কা করুক।কাদতে কাদতে সিয়া অজ্ঞান হয়ে গেল।ডাক্তার এসে বলল,রোজা রেখে অতিরিক্ত কান্নার ফলে অজ্ঞান হয়ে গেছে।ওর জ্ঞান ফিরতেই জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?জামাই কোথায়?ও বললো,খুব ক্ষিদে পেয়েছে।আগে খাবে।খাওয়া শেষ করে ও ঘুমোলো। রাতে খাবার টেবিলে—
সিয়া: মা,বাবা আমি ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছি।আর এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আমি জানি পাপ্পা তুমি আমাকে কিছু বলবেনা।আর মা,আমি এমন বাড়িতে যাবনা যেখানে আমার পাপ্পাকে সম্মান করা হয়না।ওই বাড়িতে আমি জলস্পর্শ করবনা। এই বলে সিয়া চলে গেল।আমরাও যে যার মতো ঘুমাতে গেলাম।
শাহিদঃ আফরোজা আমি সিয়াকে আবার ভালো বাড়িতে বিয়ে দেব। তুমি ওকে আর ফিরে যাওয়ার কথা বলোনা। আমি শাহিদের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বললাম,প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয়না।মনে আছে ত্রিশবছর আগের কথা,আমার বাবা,মাকেও এভাবে অপমান করা হয়েছিল।আমি তাদের লাশ ও দেখতে পাইনি।জানো শাহিদ যেদিন আমাদের মেয়ে হয়েছিল আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।কারণ প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেওয়ার উপায় খুজে পেয়েছে।
তুমি ও তোমার মেয়ের বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে এসেছ।কিন্তু খারাপ লাগছে সিয়াকে নিয়ে।ওর তো কোনো দোষ নেই।ওতো শুধু ওর বাবা,দাদীদের করা ভুলের শাস্তি পাচ্ছে।আজ এতোদিন আমি এইদিনের অপেক্ষায় ছিলাম।আজ আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারব।কথা বলা শেষ করে দেখলাম শাহিদ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে।আমি বিছানায় শুয়ে পড়লামআর ভাবছি,আমি যা করার সাহস পাইনি তা আমার মেয়ে করে দেখিয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত