অন্ধকার রাত। চারপাশ অন্ধকারের কালো কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে। যতদূর চোখ যায় শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার।
নয়জি বয়েস। মেসের নাম। মেসটা ছিল লোকালয় ছেড়ে প্রায় উত্তর পশ্চিম সীমান্তে। মেস থেকে কয়েক কদম হাটলেই চন্ডি পাড়া শুরু হয়। কালীমন্দিরের সামনে দিয়ে মেসের রাস্তা চলে গেছে। কালীমন্দিরের দিকে আমি অন্তঃনয়ন দিয়ে যতই না তাঁকাতে চাই তবুও দৃষ্টি চলে যায়। যৌবন সত্যিই লাজ-লজ্জাহীন। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। তবে, ভুলেও কখনো আঙ্গুল তুলে প্রতিমার দিকে তাকাই নাই। হিন্দুধর্মের মাঝে নাকি একটা ট্যাবু আছে, যারা আঙুল তুলে প্রতিমাকে দিকে দেখায় তাদের নাকি মাঝরাত্রিতে কালীদেবী দেখা দেয়। কালীদেবীর দেখা পাওয়া মানে তার নিশ্চিৎ মৃত্যু !
কালীমন্দির ফেলে কয়েক কদম এগুলে উত্তর পাশে নারায়ণ গুচ্চুর ফাঁকা ভিটে। একটা বনের বেড়া আর টিনের চালার ঘর।সেখানে তেমন কেউ থাকত না।মাঝে মাঝে গুচ্চুর ছেলে পাঁচন থাকতেন । বছর পাঁচেক আগে তাকে তিনিও নাকি ঘরের ভিতর মারা যান। পাঁচন বাবুর মৃত লাশে অনেক আঁচড় পাওয়া যায়। দক্ষিন দিকে ঝোঁপ-ঝাঁড় ঘেঁষে একটা মেটে রাস্তা চলে গেছে সোজা পুষ্কুনির পাশ দিয়ে।
চাঁনপুকুর। পুকুরের নাম চাঁনপুকুর হলেও এ যাবৎকালে কাউকে সেখানে স্নান করতে দেখা যায়নি। ওই রাস্তার সাথেই ছিল গফুর মুন্সির আখের (ক্ষেত)বাগান, আর বাগানের ধার ঘেঁষেই চাঁনপুকুর। করচা আর আখের বাগানের অর্ধেকই পুকুরে নেমে এসেছে। লোকমুখে শোনা যায়,ওই পুকুরের পানি কোনদিন শুকাতো না। সুন্দর ঘাঁট করা পুকুর । সবুজাভ কালো রঙের পানি। পুকুরের পানিতে একটু পর-পরই খাবি খাওয়ার শব্দ শোনা যায়। অনেক মাছ হবে বোধহয়। পরিত্যক্ত পুকুর বলে কথা !
মেসে আমরা বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় দশ-বারো জন ছিলাম।সবাই হোমড়া-চোমড়া স্বাস্থ্যের অধিকারী। কেবল আমিই বোধহয় একটু জোরে হাওয়া দিলে হেলে পড়তাম। আমার অবশ্য এতে কোন আক্ষেপ ছিল না। সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা আর রাতে মনোযোগ দিয়ে পড়া। বেশ কেটে যাচ্ছিলো।
বাড়িটায় আমরাই ছিলাম সর্বেসর্বা। বাড়িওয়ালা বিশেষত এ বাড়িতে থাকতেননা। মাস শেষে এসে শুধু ভাড়াটা নিয়ে চলে যান। লেখাপড়া করার জন্য শহরে এসেছি কিন্তু থাকার জন্য যে এমন গ্রাম্য এলাকা পাওয়া যাবে ভেবেই অবাক লাগছে। ভাড়া স্বল্প। বাড়ির অবস্থাও বেশ ভালো ছিল। সব মিলিয়ে একটা সুপার প্যাকেজ!
আমার একটা আলাদা বদঅভ্যেস ছিল। দিনের চেয়ে রাত জেগে পড়ার প্রতি বেশি ঝোঁক । দেখা যেত কোন কোন দিন পড়তে পড়তে রাত তিনটে চারটে বেজে যেত। আমি যতক্ষন জেগে থাকতাম,ততক্ষন আর কেউ জেগে থাকত না। সবাই তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো । রাসেল ভাই আর সম্ভু ভাই মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠতেন তবে সবদিন না হঠাৎ হঠাৎ !
রাত জাগার সুবাদে প্রায়দিনই আমি এক অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিষের দর্শন পেতাম। ঘরের চারকোনায় অদৃশ্য নুপুরের আওয়াজ। কেউ শুনতো কিনা জানিনা তবে আমি শুনতাম। অতি মোহনীয় তার রিনিঝিনি নুপুরের শব্দ। প্রায়সময়ই লেখাপড়ার চেয়ে শব্দটা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। কিন্তু, কখনো দুঃসাহস করে ঘর থেকে দু’পা ফেলে দেখা হয়ে উঠতোনা অচেনা জিনিষটাইবা কি?
শুক্রবারের রাত। আকাশ পুরো অন্ধকার। বাইরে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ঘরের বাইরের জানালাটা ভেজিয়ে দেওয়া । ভিতরের দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে পড়ছি। সম্ভু ভাইয়ের কড়া নির্দেশ হাজারো গরম কিংবা শব্দ হলেও দরজা-জানালা খোলা যাবেনা। আমার ঘরটা ছিলো দক্ষিন পাশের সরু রাস্তাটার সাথে। যে রাস্তাটা পুষ্কুনির পাঁশ দিয়ে দূরের একটা লোকালয়ে চলে গেছে। আমার ঘরের একটা জানালাও সেদিকে ছিল। অত্যাধিক গরমে অসহ্য হয়ে, বাইরের হাওয়া ঘরে প্রবেশ করানোর জন্য কয়েকটা জানালা খুলে দিয়েছি। পরীক্ষার আগের রাত যেন খুব তাড়াতাড়িই গভীর হয়ে যায়। বন্ধুদের অনেকেই দশটা না বাজতে আজ শুয়ে পড়েছে। কিন্তু, প্রতিদিনের অভ্যেস বশত ঘুমাতে অনেক দেরি হয় বই পড়ছি।পড়তে পড়তে কেবলই তন্দ্রা মত এসেছি,ওমনি জানালায় মৃদু টোকার শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। একবার নয় দু..দু’বার !
চোখের পাতা থেকে ঘুম শব্দটা উবে গেল। ছ্যাৎ করে চমকে উঠলাম। টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ০২.৩৯ বাজে। ভাবলাম,এত রাতে কে টোকা দিল! তারপর মনে হলো, হয়ত আশেপাশের কোন লোক রাস্তা দিয়ে যেতেই হাতের টোকা লেগেছে।তাই তেমন গুরুত্ব দিলাম না। আর রাত যেহেতু অনেক হয়েছে তাই দেরি না করে ঘুমাবো বলে লাইট অফ করে দিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে চোখ ভার করে ঘুম চলে এসেছে প্রায়, এমন সময় আবার দু’টো টোকা। এবারের টোকা গুলো আগের গুলোর চেয়ে জোড়ে হলো। বুকে হপারের মত শব্দ হচ্ছিলো। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। ধরফর করে বিছানা ছেঁড়ে উঠে বসে পড়লাম।জোড়ে করে বললাম, “কে? “কোন সাড়া পেলাম না।
হাতের কাছের বেড সুইচ টা দিয়ে আলো জ্বালালাম। আলো জ্বালানোর সাথে সাথে জানালার পাশ থেকে কে যেন পুকুরের দিকে প্রথমে আস্তে পরে জোড়ে হেটে চলে গেলো। নিঝুম রাত্তিরে স্পষ্ট পায়ের শব্দ পেলাম”’ না কিন্তু সুর তোলা নুপুরের আওয়াজ বলে দিল সব। ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। কিন্তু কই? কেউ নেই তো। ঘরের টিউবলাইটের সাদা আলো জানালার ফাঁক গলে রাস্তার উপর পড়েছে। সেখানে অন্ধকার কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নেই।
কি আর করা,জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। মনে মনে নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজেই লজ্জা পেলাম। সকালে উঠে কাউকেই কিছু বললাম না। শেষে সবাই এ নিয়ে হাসাহাসি করে! মনকে বুঝালাম,
দূর, ভূত টুত কিছু না। সব মনের বিভ্রম!
দ্বিতীয়দিন। সেদিনও পড়ালেখা শেষ করে সাড়ে দেড়টা নাগাদ বিছানায় শুলাম।মেসের অন্যরা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার চোখে তখনো ঘুম আসেনি। আমি পুরোপুরি সজাগ। হঠাৎ আবারো জানালায় জোড়ে জোড়ে দু’টো টোকা পড়লো। আকষ্মিক এ শব্দে আমার বুক ধরফর ধরফর করে উঠলো। স্পষ্ট জানালায় টোকা দেয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। বুকে একটু সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে? কে ওখানে? “কেউ কোন কথা বলল না, শুধু একটা মেয়েলি হাসি শুনার শব্দ পাওয়া গেল।তারপর কেউ নুপুর পায়ে দৌড়ে গেলে যেমন শব্দ হয়,তেমন একটা শব্দ। গা ছম ছম করে উঠলো। ওটা কে হতে পারে! জানালার ছোট্ট ফোঁকড় দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। অদূরে একজন রমণী তার তানপুরার মত নিতম্বকে বাঁকিয়ে হেটে যাচ্ছে। কিছুটা সন্দেহ হল।কিন্তু বাইরে বেড়িয়ে দেখার মত সাহস হলোনা।
কৌতুহূলী মন মানছেনা। নূপুরধ্বনির শব্দটা আবার শোনা গেল। শব্দের উৎপত্তিটা মনে হল একদম শিয়রের পাশ থেকে আসছে। সব সন্দেহ ঝেড়ে ফেলে, ভেজানো দরজাটা আস্তে করে খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম। কেউ জেগে নেই। সবাই গভীর ঘুমে মত্ত। টিনের চালার ওপর গাছের কালো কালো ডাল ঝুলে রয়েছে। কয়েকটা ডাল চালা থেকে নেমে উপুড় হয়ে মাটির দিকে তাঁকানো, সেখানে কয়েকটা কেঁচো তখন গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত। চোখের মতন পাতারা বাতাসে বারকতক পিটপিট সেরে একটানা ও দৃশ্য দেখায় নিমগ্ন খুব। লম্বা আর নিজের মধ্যে অনবরত প্যাঁচ খাওয়া প্রাণিগুলো অন্ধকারে প্রবেশ করার সময় তাদের অজান্তেই খোড়নের নমুনা ওপরে রেখে যায়। ঝুলে পড়া গাছটার পাশেই শিরা উপশিরার মতো রাতের পুরো আকাশ দখল করে নেয়া বড় গাছের বিরাট বিরাট ডালপালা। ছোট গাছটা মনে হচ্ছে ঘুমে ঝিমুচ্ছে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ছোট গাছটার সাথে ধাক্কা খেয়ে গাছটা একটু নড়ে উঠলো। তার মাথার উপরের ডালপালায় হঠাৎ নাড়া খাওয়ার শব্দ। ঝটপট ঝটপট শব্দ করে বিশাল এক ঝাঁক বাদুড় নামলো। এত বাদুড়ের একসাথে নামার শব্দে একটু চমকে উঠলাম। পায়ের তলায় চাপা খায় কেঁচোর খুঁড়ে যাওয়া দানাদার গোল মাটি। উপরের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। আলোর ঝিটে-ফোঁটা বলে কিছু নেই। ঘরের চাল, চালের উপর ঝুঁকে থাকা গাছ, তার উপরে, তারও উপরে এবং তার তারও উপরে শত সহস্র লক্ষ লক্ষ বাদুড় দুলছে। তখন মাথার উপর পুরো আকাশটাই ডানে বাঁয়ে দুলতে থাকে। মনে হচ্ছে যেন কয়েক লক্ষ চোখ আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে আর অন্ধকারের মধ্যে সবাই আমাকে দেখছে উল্টো করে। আতংকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। মাটি হাতড়ে একদলা মাটি নিলাম। ঢিলের মত বানিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে ও দিকে ছুঁড়ে দিলাম। কালো পাখায় তখন চারিধার এমনভাবে ছাওয়া যে সে জানে, যে কোন একদিকে ঢিল ছুঁড়লে অন্তত ঐ দিকের অন্ধকারটা একটু পাতলা হয়ে যাবে। ঢিলটা কোথায় পড়লো বোঝা গেল না কিন্তু বাদুড়েরা নাড়া খেয়ে সরসর সরসর করে উড়তে লাগলো। একজোড়া দুই জোড়া বাদুড় নয়, একসঙ্গে আবার সেই শত সহস্র লক্ষ বাদুড় ঝটপট ঝটপট করতে লাগলো।
দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা একদিকে যেতে লাগলো। বাঁদুড়গুলোর ছায়া থেকে মাটিতে চোখ নামিয়ে দেখলাম, অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি জনশূণ্য পথ ধরে হেঁটে চলছে।
শাড়ি পরহিত। অন্ধকারের কারণে বলতে পারছিনা শাড়ির রঙটা কি ! নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ হচ্ছে। মেয়েটার পথ চলার মোহনীয় সৌন্দর্য আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। চোখে ঘোর লেগে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি এখন মেয়েটার কাছে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। মেয়েটা যেদিকে হেঁটে চলেছে আমি হাওয়ায় ভেসে শুধু তাকে অনুসরন করছি। সৃষ্টির কি অপার সৌন্দর্য !
হাঁটছি না দৌড়াচ্ছি বুঝে উঠতে পারছিনা। অন্ধকারের কারণে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবে মেয়েটার নূপুরধ্বনি অন্ধকারের তীব্রতা ভেদ করে আমাকে পথ চিনিয়ে নিচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ নূপুরগুঞ্জন থেমে যায়। আমারও ঘোর হঠাৎ করেই কেটে যায়। ভাবছি, এ আমি কোথায় এলাম !
আশপাশে পশুর গর্জনের মত গড়গড় শব্দ শোনা যাচ্ছে। অজানা ভয়ংকর আশঙ্কায় আমার মন কুহু ডেকে উঠলো। দু’হাত হাঁতড়ে দেখলাম আখ আর করচা বাগানের ভিতরে এসে পৌঁছেছি। সামনে এক কদম এগিয়ে দেখলাম জলার পানির শব্দে ব্যাঙ ডাকছে। কোথাও অপেক্ষা করছে ভয়ানক সংকট তাই দিক-বেদ্বিক শূণ্য ভেবে দৌড়াতে লাগলাম আখ, করচার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।
হৃদপিন্ডটাতে হপারের ন্যায় শব্দ হচ্ছে। প্রচন্ড শব্দে মনে হচ্ছে হৃদপিন্ডটা বোধহয় খাঁচা ছেড়ে এখনই বেরিয়ে আসবে।
আকাশে কোন চাঁদ নেই। কৃষ্ঞপক্ষ। অন্ধকারে আমার চোখের অবলাল সংবেদী এখন কাজ করছে। দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থাকায় আশে-পাশের অবস্থা কিছুটা দেখতে পাচ্ছি। আখবাগানের ফাঁক দিয়ে অন্ধকারের অল্প কালো আলো তির্যকভাবে মাটিতে পড়ছে কিন্তু মাটি তখন এত কালো যে সামান্য ঐ আলো শুষে খেয়ে নিচ্ছে মুহূর্তেই। তাই অন্ধকারের মধ্যে মাটি ও আকাশ পার্থক্য করার মতো তেমন কিছু ফুটে উঠলো না। একটা ব্যাঙ দূরে কঁকিয়ে ওঠে, কোন সাপের মুখে পড়ে সে ত্রাহি চিৎকার দিচ্ছে। একদল ঝিঁ ঝিঁ পোকাও ক্রমাগত ডেকে ডেকে থেমে যায়। যেই ঝিঁ ঝিঁর ডাক থামে বাগানটি হয়ে পড়ে আরও নীরব, দৌড়ানো বাদ দিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াই । এই বাগানে কখনও আসা হয়নি, ডানে বাঁয়ে এদিক সেদিক চেয়ে কোন একটা পথ খুঁজতে থাকি। মাইলের পর মাইল অতিক্রম করার পর এই প্রথম নির্দিষ্ট কোন পথের আশায় কেটে ছিড়ে যাওয়া হাত লতাগুল্ম সরিয়ে এগিয়ে যাই। কুশুলের বাগানের যেখান দিয়ে আমি দৌড়ে যাই, ভেজা মাটিতে সেখান দিয়েই তৈরি হয় পথ। চলতে চলতে একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ি। মনে হয়, কিছু দূরে একজন লোক কোন কিছু ঠেলতে ঠেলতে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। প্রথমবার ভাবি যে তাকে ডাক দিয়ে থামতে বলা প্রয়োজন, তারপর কিছু না বলে লোকটির দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকি।
অচেনা লোকটি প্রায় আট-নয় ফুট লম্বা, দুই হাত দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একটা পাথর টানা বিশাল ট্রলি। ট্রলি ঠেলবার সময় সাধারণত মানুষ সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। কিন্তু সে ঐ বিশাল ট্রলিটা নিয়ে চলছে কোনরকম না ঝুঁকেই। ট্রলিটার দিকে ভালভাবে তাকিয়ে দেখলাম ওতে রয়েছে অনেক ওজনের বেশ বড়মাপের অনেক পাথর। কিন্তু এত ওজনের পাথর লোকটি এমনভাবে ঠেলছে যেন ওগুলো পাথর নয়, শিমুল গাছ থেকে সংগ্রহ করা সাদা সাদা তুলোর বল। অপেক্ষা করছিলাম লোকটি কিছু জিজ্ঞেস করবে, কেননা এই রাতবিরেতে জঙ্গলের মাঝখানে হঠাৎ কোন মানুষের উদয় হওয়া নিশ্চয়ই কোন সাধারণ ব্যাপার নয়, কিন্তু পাথর ঠেলা লোকটি কিছুই জিজ্ঞেস করে না। আনমনে নিজের কাজ করতে থাকে। আমার কৌতুহূল মন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরি নিজ থেকেই সে কে, এই পাথর কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসব প্রশ্ন করবো। কিন্তু লোকটি এমনভাবে চলছে যে সে প্রশ্ন করলে উত্তর পাবে, এমন আশা হয় না। পাশাপাশি হাঁটার কারণে লোকটির চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। তবে মাঝেমাঝে চেষ্টা করছি দুই পা এগিয়ে লোকটির মুখোমুখি তাকাতে-যাতে কাল দিনের আলোয় তার সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করতে পারি। যতবারই চেষ্টা করে দুই পা এগোতে যাই, অচেনা লোকটি ততবারই ভারি পাথরের ট্রলিসহ সব সময় সমান্তরালেই রয়ে যায়। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা ধরে প্রথমবারের মতো দূরের একটা লোকালয়ে এসে পড়ি। ট্রলি ঠেলা লোকটি সেই লোকালয়ের দিকে চলতে থাকে। লোকটার চলনভঙ্গি দেখে এবার শিওড়ে উঠলাম। একি! লোকটা মাটিতে পা ফেলে হাঁটতে পাচ্ছেনা কেন ?
অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লোকটার গাঁয়ে এতক্ষণ যেটা পায়জামা-পাঞ্জাবি বলে ভাবছিলাম সেটা আসলে আস্ত কাফনের কাপড়। ধবধবে কালো। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিলোনা। তবে, শার্ট-প্যান্ট ও কাফনের কাপড়ের মাঝে পার্থক্য বুঝে উঠা যায়। তবে এত ভারী পাথর নিয়ে অচেনা লোকটা কি করছে, এইসব নিয়ে যখন ভাবতে থাকি তখন দেখতে পাই সেই লোকটি তার ট্রলি থেকে একটা সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো মাংসের স্তূপ তুলে তরতর করে উঠে যাচ্ছে একটা পোড়ো-বাড়ির ছাদে। নারায়ণ গুচ্চুর ভিটের পুরোনো ঘরে।আমার মনে হচ্ছে আমি সে সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এবং সেই গভীর ঘুমের ভেতর অনুভব করছি এ যেন চেপে বসা দুঃস্বপ্ন। অচেনা লোকটা থেকে দু’কদম পেছনে চলে যাই। কিন্তু, কাঁধের উপর হালকা গরম নিঃশ্বাস টের পাই। পেছনে মুরে কোন অতিপ্রাকৃত জিনিষ দেখার সাহস হয়না। নুপুরের ধ্বনিটা কাছেই কোথাও শোনা যায়। চোখের সামনে কোমড়ের অর্ধাংশবিহীন মানুষ দেখার দূর্ভাগ্য নিঃশ্চয় হয়নি। অতিপ্রাকৃত জিনিষ তখনো কোমড়টা তানপুরার সুরের মত করে একেঁবেকে দুলিয়ে চলেছে। পাঁয়ের নুপুরগুলোও সেই দুলুনিতে রিনিঝিনি শব্দে বেঁজে চলেছে। আমার মেরুদন্ড বেঁয়ে শীতল বাতাস নেমে গেল। কাঁধের পিছনে যা দেখলাম তা দেখে স্থির থাকা আর সম্ভব হলোনা। স্যাঁতসেঁতে কিছু আঁশটে তরল আমার কাঁধের উপর চ্যাঁটচ্যাঁট করছে। মুখমন্ডলটা একটু উপরের দিকেই ঘুরিয়ে দেখলাম বিকৃত চেহেরার একজন আমার দিকে তাঁকিয়ে ভয়ংকরভাবে হাঁসছে।
বুকে টের পেলাম বাড়তি এক গাঢ় চাপ। দ্রুত গতিতে নিঃশ্বাস ওঠানামা করে, বুকের ঘাম গড়িয়ে নাভির কালো গর্তে জমা হয়। শরীরে অজানা এক অস্বস্তি, এপাশ থেকে ওপাশ করতে করতে উদ্বিগ্ন মন পালাবার জন্য তাড়া দিতে থাকে। এসবের পর লম্বা অচেনা লোকটি ধীরে ধীরে চলে যায় অন্যদিকে, নুপুরের শব্দ করা প্রাণীটা কোথাও যায়না। আমি আমার দেহে প্রবল এক শিহড়নের অনুভব করতে থাকি। উল্টো ঘুরে ভো-দৌড়। কিন্তু আলো না ফোটা পর্যন্ত দৌড়ে এতদূর এসে বাড়ি যেতে পারছি না, আসলে এখনও বুঝতেই পারছি না আদৌ আমি এখন কোথাই। তাই না থেমে পুনরায় দৌড়ানো শুরু করি। আকাশে অন্ধকার হালকা হয়ে আসছে, হয়তো ভোর আসন্ন, হয়তোবা এতক্ষণ আঁধারে থাকতে থাকতে অন্ধকার সয়ে নিয়েছে চোখ। কান পেতে শুনতে পাই বাতাসে ভেসে আসছে স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি। ভালোভাবে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, তিরতির করে কোন এক জায়গা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পানি। শব্দ লক্ষ্য করে ক্রমাগত দৌড়াতে থাকলে বুঝতে পারি কুলকুল ধ্বনি তীব্রতর হচ্ছে। পিছনে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। পায়ের নিচে মাটির বদলে এখন বালি, এখানে সেখানে ছোট ছোট নুড়ি। ছলছল স্রোতে চারপাশ মুখরিত, এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বুক জুড়িয়ে দেয়। সে তীর ধরে দৌড়তে দৌড়তে দেখতে পাই অদূরে অনেকগুলো মানুষ স্রোতের ধার ঘেঁষে কি যেন খোঁজাখুঁজি করছে। অচেনা মোহনীয় রূপের পেছনে ছুটে আমি এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। শরীরকে তবুও টেনে টেনে, ঠেলে ঠেলে চলতে থাকি অবিরাম। চোখের আলো ক্রমশ ঝাঁপসা হয় কিন্তু চলার জন্য তখন চোখের প্রয়োজন নেই, অতীন্দ্রিয় কোন অনুভব চালিয়ে নিচ্ছে। এক জায়গায় এসে দেখলাম পথটি দ্বিখণ্ডিত।সেই দ্বিধাবিভক্ত রাস্তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে পড়ি, দুটি রাস্তাই ক্রমশ উঁচু হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে। জ্ঞানশূণ্য হয়ে একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। অদূরের মানুষগুলো কাঁদামাটি মাখা শরীরে আমার দিকে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। আখ ক্ষেতের সর্বশেষে চলে এসেছি। এখান থেকে নতুন লোকালয় শুরু! আখক্ষেতের শেষপ্রান্তে এসেই বাঁতাসের ভয়ানক শব্দটা নুপুরের রিনিঝিনি শব্দে রূপ নিয়েছে। তার সাথে আরো একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে, দূর আকাশের পরিষ্কার নির্মল বাতাসে ফজরের আযানের মিষ্টি শব্দ ও চাষাদের হৈ-হুল্লোড়!