এক.
বড় চাচার ঘরে আমরা ভাই বোন রা খুব একটা যাই না। যাই না বললে ভুল হবে বিশেষ কারন ব্যাতীত তাঁর ঘরে যাওয়া নিষেধ, আর গেলেও অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। অসম্ভব রাগী এই মানুষটাকে কৈশোরে যেমন দেখে আসছি এখনও ঠিক আগেরই মত। রাগ যেমন তেমনি তাঁর ভালবাসা ও। চাচা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা খান, তারপর একটু হাটাহাটি করেন নিজের তৈরি বাগানের চারপাশে। মন চাইলে বাগানের পরিচর্যা ও করে থাকেন আর সিগারেট টানতে টানতে বাগানে নতুন ফুলের আগমন প্রত্যক্ষ করেন। বাগানের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরলে নাকি মনের পাষাণ খন্ড টা ক্ষয় হয়। একথাটা প্রায় বলতেন আমাকে আর ছোট বোন কে। চাচার আদেশ সকালে তাঁর সাথে বাগানের চক্রাকার ঘুরাতে আমাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। ছোট বোন টি প্রথম প্রথম ঘুম থেকে উঠতে ই চাইত না। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেছে। মা -বাবা এ নিয়ে কারও কোন অভিযোগ ছিলো না। চাচাকে সবাই খুবই সম্মান করে, ভয় ও পায় একই রকম। একদিন বড় বোনের মেয়ে টি তাঁর ঘরে ঢুকে তাঁর বইয়ের তাক পানি দিয়ে ভাসিয়ে দিল , নারিকেল – মালায় কাদা মাটি মাখিয়ে সংসার -সংসার খেলছে আপন মনে। নারিকেল -মালা আর কাদা মাটিতে মিশে গেছে বইগুলোর সুন্দর প্রচ্ছদে ও। তাই নিয়ে সবার কি যে উতকন্ঠায় কেটেছিল সেদিন। রানু আপা ত তার মেয়েকে মারতে শুরু করল। দুপুরে চাচা কোথা থেকে এসেই দরজা লাগিয়ে দিলেন। পরক্ষনে দরজা খুলেই আমাকে ডাক দিলেন -বদিউল শুনে যা ত !
গম্ভীর ডাক শুনে ভয় পেতে পেতে তাঁর ঘরের সামনে গেলাম। -কিরে এসব কি আমার ঘরে? -চাচা রানু আপার মেয়ে ….. আপা জান্নাত কে মেরেছে আর যাতে না আসে এখানে। -মেরেছে কেন? (রাগত সুরে ) -আমি নিশ্চুপ। -যা রানুকে বল তার মেয়েসহ এখানে আসতে ! -আর শুন থানার ঝামেলার কি করলি? -চাচা ও.সি সাহেব আপনাকে একবার ফোন করতে বলেছেন আর কিছুই বলেনি। -যা এখান থেকে। আমি চলে এলাম। এমন বদমেজাজি চাচা সেদিন রানুকে ধমক দিয়েছেন কড়া করে শুধুমাত্র তাঁর মেয়ে টিকে মারার জন্য আর বলেছেন -দেখ রানু দুধের বাচ্চাদের জন্য আমার ঘর নিষিদ্ধ না। আমি একা মানুষ একটু পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি তাই বলে তুই তাকে মারধর করতে পারিস না, এটা অন্যায় (তুচ্ছ করার মত অন্যায় না)। -বড় চাচা আর এরকম হবেনা। -ঠিক আছে যা, আর শুন জান্নাত ঘুম থেকে উঠলেই আমার ঘরে পাঠিয়ে দে! দিনের বেলা বেশি ঘুমাতে নেই। তুই আমার জন্য একটা আদা -চা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি করে। সেদিনের পর থেকেই বড় চাচার বিধি -নিষেধ কিছুটা কমে গেছে। এই পরিবারের সুশাসন আর পরিচালনার অভিভাবক বড় চাচাই আমাদের আগলে রেখেছেন ত্রিশ বছর ধরে। তার সুশৃঙ্খল আর পরিপাটি পদচিহ্ন আমাদের জীবন কে দিয়েছে অনেক কিন্তু এই মানুষ টিই ক্যান্সারে আক্রান্ত সাত মাস ধরে! কি যে কষ্ট আর ভোগান্তি তাঁর আজ। যার গড়া বাগানে আমরা সপ্ন # দেখে বড় হয়েছি, সে বাগানের মালিক আজ মৃত্যুর দুয়ারে। কেন জানি চাচা বিয়ে করেন নি ;যা অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। এইচএসসি পাশের পর তাঁর এক বন্ধু মহসিন তাকে সুইডেন নিয়ে যায়। ওখানে দিনরাত পরিশ্রমের ফসল আজকের এই আমাদের অবস্থান। দুই টাকার জন্য যেন কারো কাছে হাত পাতা না লাগে সেই ব্যবস্থা করে গেছেন।
দুই.
মহসিন আংকেল যাকে বিয়ে করেন তাকেই নাকি বড় চাচা ভালবেসে ছিলেন। এলাকায় তার বন্ধু জয়নালের কাছ থেকেই এসব তথ্য পেলাম কিছুদিন হল। আরও অজানা অনেক কিছুই। সেদিনটা ছিল 10 অক্টোবর। শারমিন উল্লা, মহসিন আংকেলের স্ত্রী সহ আমাদের বাড়িতে আসার কথা ছিল। বড় চাচা 10 অক্টোবর জমকালো জন্মদিনের আয়োজন করেছিলেন। এলাকার সকলকে এই দিনে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলেন এবং চাচাকে ও ঐ দিনের মত আনন্দে থাকতে দেখিনি কোনদিন। তাঁর উতফুল্ল ভাব দেখে কে বলবে -তিনি ক্যান্সার নামক মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। দুপুরের দিকে চাচাকে সাহস করে বলেই ফেললাম -চাচা আপনার স্পেশাল গেস্ট ত দেখি এখনো এলোনা? -আরে বোকা আসবে, অবশ্যই আসবে। কথা দিয়েছে আসবে। -2 টা বেজে গেল, একবার ফোন করে দেখবেন? -আমি ট্রাই করেছি কয়েকবার। হয়তো বিমানে আছে ফোন ত বন্ধ ! এমনি করে সন্ধ্যা হল, যাকে ঘিরে সব আয়োজন সে আসেনি। চাচা সেদিন মনে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁর মুখে হাসি দেখিনি কতদিন!
তিন.
রাত 12 টা। বড় চাচা এবং আমি হাসনাহেনা গাছটির নিচের পাকা বেঞ্চিতে বসে আছি। তিনি একটার পর একটা সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন কিন্তু কিছু বলার মত দুঃসাহস ছিল না আমার। চুপচাপ দুজনেই। আমার কাধে হাত রেখে চাচাই প্রথম কথা বললেন। -কিরে তুর অনার্স শেষ হবে কবে? -এক বছর বাকি। -ও আচ্ছা, অনার্স শেষ হওয়া মাত্র আমার ন্যাংটা কালের দোস্ত হারুন সলিট তার নাম। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। আমার ডায়েরিতে তার সেল নাম্বারসহ ঠিকানা লেখা আছে। তাকে বলে দেখিস তোকে একটা ভালো চাকরি দিয়ে দিবে। -ঠিক আছে চাচা। -তুর মেধার কারনেই তুই চাকরি পাবি, কিন্তু হারুন একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। -আর এই নে মোটরসাইকেলের চাবি,এই মুহুর্ত থেকে এটা তুর। আমাকে ভালবাসতেন বেশি তাই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যংক -একাউন্ট, তাঁর জমি-জামা, ঘর-বাড়ি আমাকে উপহার দিয়ে যান। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। -আর এই যে হাস্নাহেনা (মাথা উচিয়ে দেখিয়ে) গাছটির নিচেই আমাকে কবর দিবি ! বড় চাচাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। তিনি কাঁদছে আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি আর কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি। বড় চাচাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন -একদম চিন্তা করবি না বদিউল কেমন ! আমি মরে গেলেও তোরা নিরাপদ থাকবি, বিধাতা আমাকে অনেক দিয়েছেন। কিছু দিন পরেই বড় চাচা মারা গেলেন। সবই আছে আগের মত কিন্তু একটি শুন্যতা আমাদের চারপাশ ঘিরে। যার বৃত্তের মাঝে আমাদের পথচলা ছিল সে রাগী মানুষটির জন্য পরিবারের সবার মত আমারও মনে কেঁদে উঠে এখনো !
চার.
সেদিন রাতে কড়া জোসনা ছিল। আমি বড় চাচার ঘরে (যেটা এখন আমার ঘর) পড়ছিলাম। গেইটের কাছে পাজেরো গাড়ির হর্ন বাজছে। আমি দারোয়ান কে ডেকে বললাম গেইট খুলে দিতে। গাড়ি ভেতর ঢুকতেই এক সুন্দরী রমনী একটি ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন। চোখে সবুজ ফ্রেমের কালো চশমা। আমার আর চিনতে অসুবিধা হয়নি।
এইযে শারমিন উল্লা। বড় চাচার ডায়েরি পড়ে সব জানতে পেরেছি এবং তাঁর কয়েকটি বাধাই করা ছবি ও দেখেছি। -আসসালামু আলাইকুম আন্টি! -অলাইকুম আস সালাম। -আন্টি ভিতরে আসেন। -হ্যাঁ বাবা, আহসানের ঘরটা দেখিয়ে দাও। -আসেন আন্টি। এই বলেই আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। ঘরের চারপাশে তিনি কি যেন খুজছেন। আলতো করে বড় চাচার বিছানায় বসলেন। মনে হচ্ছে কাঁদছিলেন কিন্তু চশমার জন্য বুঝা যায়নি। চাচার মৃত্যুর কথা শুনে সেই সুইডেন থেকে সোজা আমাদের বাড়ি। -বদিউল আমাকে তাঁর কবরের কাছে নিয়ে চল ! -আন্টি ফ্রেশ হয়ে নিন, অনেক দুর থেকে জার্নি করে এসেছেন? -না, ফ্রেশ হওয়া লাগবে না তুমি নিয়ে চল। -ঠিক আছে আন্টি।
বড় চাচার কবরের সামনে শারমিন আন্টি, তার মেয়ে এবং আমি দাড়িয়ে আছি। তিনি কাঁদছে আর বলছে -তুমিই জয়ী হলে আরেকবার, জান তোমার রাগটাকেই বেশি ভালবাসি আমি। তাঁর ছোট্ট মেয়েটি তার মাকে বলছে -আম্মু, বড় বাবা এখন কোথায়? তা শুনে আন্টি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। চশমা খুলে আমার দিকে একবার তাকালো -তাঁর চোখ অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। পরক্ষনেই তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা -মেয়ে একসঙ্গে কয়েক গুচ্ছ গোলাপ বড় চাচার কবরে রাখলেন ! কবরকে খানিকটা ছুঁয়ে ও দিলেন।
তাঁর মেয়ের মুখে বড় বাবা কথাটাই বলে দেয় তাদের ভালবাসা কতটা খাদ হীন !
আস্তে আস্তে জোসনার আলো কমতে থাকে।