১।
মুখ ফুটে কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না আশা। কোথায় যেন বেধে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে এতক্ষণ বসে ছিল ও। রাজিবের ডাকে মাথা তোলে অবশেষে। চোখে চোখ রাখে। অস্ফুট স্বরে কথাটা গুছিয়ে নেয় একটু। নাহ! পারফেক্ট হচ্ছে না। বিরক্ত হয় আশা। সেই সাথে রাজিব। ধমকে ওঠে রাজিব। গাধা কোথাকার। একটা কথা বলতে এত ভণিতা লাগে। বাদ দে তোর জরুরি কথা। চল ওঠা যাক বলে আশার হাত ধরে উঠে দাড়ায় রাজিব।
2।
রাজিব ভেবেই পায় না আশা এমন কি বলতে চায় ওকে। যার জন্য এত ছ্যাবলামি। আশা তো এমন ছ্যাবলা টাইপের মেয়ে নয়। আচ্ছা ব্যাপারখানা কি। প্রেম ট্রেমের বিষয় নয় তো? আশা মেয়েটা দেখতে শুনতে খারাপ নয় মোটেও। বরং লিজার থোকে একটু ফর্সা। আশাকে যে কারোরই ভাল লাগতে পারে। ভালোলাগার মতো যথেষ্ট গ্লামার আছে মেয়েটার। রাজিবও অবশ্য ব্যতিক্রম নয়। তবে কাজিন এই যা। চাচাতো বোনের সাথে প্রেম। ধ্যাত! তাই আর এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না রাজিব। বিরক্ত হয় নিজেই। কি উল্টা পাল্টা ভাবছে ও। তারচেয়ে বরং লিজার কথা ভাবা যাক। হাজার হোক মেয়েটা তাকে ভালবাসার কথা বলেছে। প্রত্যাখ্যান করার মতো কোন কারণ নেই। অতএব রাজিব সম্মতি ও দিয়েছে।
৩।
তীব্র অস্থিতে দুলছে আশা। রাজিব ভাইকে কথাটা কিভাবে যে বলা যায় ভেবেই পায় না ও। আর ও শালাও একটা গাধা। কিচ্ছু বোঝেনা। এত করে বোঝানোর চেষ্টা করেও বোঝানো গেল না যে আশা ওকে ভালবাসে। প্রোক্ষণেই মনে সন্দেহ দেখা দিল আশার মনে। নাহ ! রাজিব হয়তো ঠিকই বুঝতে পারে, কিন্তু কথাটা আশার মুখ থেকে শুনতে চায়। নয়তো একটা মেয়ে আর একটা ছেলে পার্কের নির্জন পরিবেশে শুধু শুধু হাওয়া খেতে যায় না। দুজনের মধ্যে একটা প্রেম প্রেম ভাব থাকতেই হয়। এই সহজ কথাটা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স নিশ্চয়ই হয়েছে ওর।
৪।
কলেজের গেটে আসতেই বুকটা ধক করে উঠল আশার। সেই সাথে একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেল মনে। খানিকটা অবাক ও হল আশা ফুল হাতে রাজিবকে দেখে। আরে! ও এখানে কি করছে। আশার জন্য অপেক্ষা করছে নাকি? নাকি অন্য কারো জন্যে। ধাঁধায় পড়ে গেল আশা। আচ্ছা দেখা যাক ও কি করে। আশা সোজা হন হন করে হেটে যাচ্ছিল নিচের দিকে চেয়ে। রাজিব ওকে ডাকল, এই আশা শোন। আশা না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছিল। রাজিব আবার ডাকল। এই আশা, আশা। শোন! এবার দাঁড়াল আশা। অবাক হওয়ার ভান করল ও। কি ব্যাপার তুমি এখানে রাজিব ভাইয়া। হ্যাঁ আমি। এই একটু কাজে এলাম আর কি? আমতা আমতা করে জবাব দিল রাজিব। গার্লস কলেজের গেটে তোমার আবার কি কাজ? অ্যা? চালাকির আর জায়গা পাও না। না মানে এই এমনি আর কি। তুই আমার একটা উপকার করবি আশা, বলে রাজিব। মনে মনে প্রমাদ গুনল আশা। আগে বলো তো দেখি। আচ্ছা বলছি শোন। তোদের সেকশনে লিজা আছে না? ওকে এই চিরকুটটা দিবি বলে পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করল রাজিব। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল আশার। কম্পিত হাতে কাগজটা নিল আশা। কেমন কান্না পাচ্ছিল ওর। কান্না আড়াল করতে দ্রুত পদক্ষেপে গেটের ভিতর ঢুকল আশা।
৫।
আশা ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে ও। চিরকুটটা কি লিজাকে দেবে? নাকি ছিঁড়ে ফেলে দেবে কাগজটা। উহ! কি অসহ্য! নিজের উপর বিরক্তি চরমে উঠল ওর। কি গাধী মেয়ে। ভাললাগে অথচ মুখ ফুটে বলতে পারবা না। কি আর করা। এখন ম্যাসেঞ্জারী কর। না আশা হেরে যাবে না। কিছুতেই হারবে না সে। রাজিবের ভালোবাসা তার চাই ই চাই। আশা কিছুতেই এ কাগজটা লিজাকে দেবেনা। কিছুতেই দেবেনা। কিছুতেই না। টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দেবে।
৬।
ক্লাসে মন বসছে না লিজার। কেমন একটা অস্থির ভাব। আনমনে উদাসী ভঙ্গি। স্যার কি পড়াচ্ছেন তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না লিজা। বোঝার কথাও নয়। মনোযোগ না থাকলে কার সাধ্য বুঝাতে পারে। লিজার সমস্ত মনোযোগ এখন গেটের দিকে। জানালার পাশে বসেছে লিজা। এখান থোকে গেটটা পুরোপুরি নজরে আসে লিজার। কথা ছিল সাড়ে নয়টায় কলেজের সামনে রাজিব আসবে। গেট থেকেই দুজন রিক্সায় চাপবে। কলেজে আর ঢুকবে না লিজা। অপেক্ষা করতে করতে দশটা বেজে গেল। লিজার বিরক্তি ধরে গেছে ততক্ষণে। ক্লাস শুরু হবে দশটা পাঁচে। ক্লাস টিচার আনিস আহমেদ এর মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল লিজার। আর যায় কোথায়। কিরে লিজা এখনো ক্লাসে যাও নি? এখানে দাড়িয়ে আছ কেন? এসো। লিজা আর কি করে। অগত্যা স্যারের পিছু পিছু ক্লাসে ঢুকতে হল তাকে। লিজার দু মিনিট পরেই হাঁপতে হাঁপাতে ক্লাসে ঢুকল আশা। কেমন একটা মলিন চেহারা। লিজা দেখল আশাকে। কি ব্যাপার ওর আবার কি হল ? মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আশার সাথে লিজার সম্পর্কটা ভালই। খুব ক্লোজ না হলেও বেশ মিল দুজনের মধ্যে। আচ্ছা ক্লাস শেষ হলে জিজ্ঞেস করে দেখবে লিজা, কি হয়েছে ওর?
৭।
ক্লাসে ঢুকেই আশার মনটা আরো বেশি খারাপ হেয়ে গেল। ওই বাঁদরই মেয়েটা ঠিক জানালার পাশেই বসেছে। ইস আবার ঘন ঘন তাকাচ্ছে গেটের দিকে। ওই হাঁদারামটা আবার গেটের মধ্যে ঢুকবে নাকি। তাহলে তো সর্বনাশ! নাহ। ও হয়তো এতটা সাহস করবে না। কারণ বর্তমানে দেশে ইভ টিজিং নিয়ে যে হইচই পড়েছে তাতে গার্লস কলেজের ভিতরে ঢোকার সাহস করবে না নিশ্চয়ই। কাগজটা তো আশা বাথরুমেই ছিঁড়ে ফেলে এসেছে। দুজনার দেখা না হলেই হয়। রাজিব বাসায় ফিরে গেলেই হয়। পরে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে লিজা ক্লাসে আসেনি। কিন্তু লিজা তো ক্লাসে এসেছে। রাজিব জানতে পারলে কি ভাববে ওকে। ইস! বড় স্বার্থপর ভাববে আশাকে। যা ইচ্ছা তাই ভাবুক। তাতে আশার কিচ্ছু যায় আসে না। আশা কিছুতেই মেনে নেবে না লিজার সাথে রাজিবের প্রেম হোক। কিন্তু আশাকে বড় চিন্তিত হতে হল। যদি ইতোমধ্যেই ওদের সম্পর্কটা পাকা হয়ে যায়। তখন কি হবে। আর ভাবতে পারছে না আশা।
৮।
নাহ! বড় দেরি হয়ে গেছে। নিজের উপর বিরক্ত হল রাজিব। ও মেয়েটাও দেখছি বোকার হদ্দ, ক্লাস করতে ঢুকল নাকি ? না বাড়ি থেকেই বের হয়নি। শালার মেয়েদের বিশ্বাস নেই। এদের উড়ু উড়ু মন কখন কি ভাবে, কখন কি করে বোঝা মুশকিল। মেজাজই খারাপ হয়ে গেল রাজিবের, একটু দেরি হতেই পারে। রাজিবের হয়তো একটু দেরিই হয়েছে। তাই তুমি মেয়ে দেড় ঘণ্টায় ও খোজ থাকবে না। এটা কেমন কথা। নাহ ! এসব গবেট মেয়ের সাথে প্রেম চলে না। জরুরি সমস্যা থাকলে ফোন করে বলতেই পারে। রাজিব যে ফোন করবে তার উপায় নেই। লিজার ফোন বন্ধ। তার মানে গাধী মেয়েটা ক্লাসেই ঢুকেছে। যাহ! শালা। এবার বাসায় ফিরতে হবে। কলেজ কামাই গেল একদিন। সেদিনকার মতো বাসায় ফিরল রাজিব।
৯।
বিছানায় শুয়েও অনেকক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারল না আশা। এক অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় কাতর আশা। অস্থির চিত্তে ভাবছে আশা। রাজিবের সামনে কথাটা কিভাবে তোলা যায়। ও যদি প্রত্যাখ্যান করে। রাজিব তো সত্যি সত্যি লিজাকে ভালবাসে। সেখানে আশার উপস্থিতি কেমন দেখাবে। যেমন দেখায় দেখাক। তাতে আশার কি। রাজিবকে তার ভাল লাগতেই পারে। কি এমন রূপ আছে ওই মেয়েটার! ক্লাসেও আশার থেকে ভাল নয়। লিজা! লিজা! লিজা। লিজা রাজিবের মাথাটাই নষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু আশা কি করবে এখন। লিজার কাছে হেরে যাবে। নাহ! এ অসম্ভব। আশাকে জিততেই হবে। প্রয়োজনে আশা আরো কঠোর হবে। যেভাবেই হোক রাজিবকে তার পেতেই হবে। এমনি সব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা নিজেও টের পেল না আশা। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল আটটা। সেলিনা বেগম দু বার ডেকে গিয়েছেন মেয়েকে। তাতে কাজ হয়নি। আড়মোড়া দিয়ে আবার ঘুমিয়েছে আশা। বিরক্ত হলেন তিনি। তৃতীয় বারের মতো যখন ডাকতে এলেন তখন সবেমাত্র বাথরুমে ঢুকেছে ও। যাক! স্বস্তি পেলেন সেলিনা বেগম। দশ মিনিটের মাথায় নাস্তার টেবিলে এসে বসল আশা। সেলিনা বেগম মেয়েকে লক্ষ্য করলেন। চোখে মুখে রাত জাগার চিহ্ন স্পষ্ট। কেমন একটা চিন্তিত মুখাবয়ব। কি ব্যাপার রাত্রে ঘুম হয়নি? মায়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে চমকে উঠল আশা। নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। ঘুমিয়েছি প্রায় দেড়টার দিকে। কেন ? এত রাত জাগার দরকার কি? সেলিনা বেগমের প্রশ্ন। দরকার আছে বলেই তো জেগেছি, আশার কন্ঠে ক্ষোভ। আমার পরীক্ষার মাত্র দুমাস বাকি। সেটা আমি ভাল করেই জানি। সন্ধ্যায় পড়তে বসার নাম নেই আর উনি দেড়টা বাজাবেন ঘুমাতে। না এসব চলবে না । আজ থেকে সন্ধ্যায় টিভি দেখা বন্ধ। সন্ধ্যা থেকে দশটা পর্যন্ত একটানা পড়ে খেয়ে ঘুমাতে যাবে। চেহারার কি অবস্থা করেছো দেখেছ? থামলেন সেলিনা বেগম। আশা চুপ মেরে গেল। হৃদয় এতক্ষণ চুপচাপ আপুর সাথে মায়ের কথাবার্তা শুনছিল। এক্ষণে বেশ খুশি হল হৃদয়। কি মজা আপুর টিভি দেখা বন্ধ। এবার ইচ্ছেমত কার্টুন দেখতে পারব। হৃদয়কে কড়া ধমক লাগালেন সেলিনা বেগম। উৎসাহে ভাটা পড়ল হৃদয়ের। খাওয়া শেষ করে উঠল আশা। আজ আর কলেজে যাওয়া হচ্ছে না, দেরি করে ঘুম থেকে ওটা এর কারণ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়ার টেবিলে বসতে হল আশাকে।
১০।
এতক্ষণ চেষ্টা করেও রাজিবের লাইন পাওয়া গেল না। বিরক্ত হল লিজা। ধ্যাত মোবাইল বন্ধ করে রাখার দরকার কি? রাজিবকে খুশির খবরটা না জানালে হবে কি করে। এত বড় একটা আনন্দের খবর শুনে রাজিব নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে। ইস! এমন ভাগ্য কজনার আছে। ভাগ্যিস লিজা খান সাহেবের ঘরে জন্মেছিল। নয়তো বস্তিতে জন্মালে আমেরিকা যাওয়া তো দুরের কথা এই বয়সে পুরো সংসারী হয়ে চুলায় লাকড়ি ঠেলতে হতো। লিজার বাবা ডঃ আমানউল্লাহ খান ডিভি ২০১০ অ্যাপ্লাই করেছিলেন। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে সময় লাগেনি। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার ভিসাটা পেয়ে গেলেন তিনি। ব্যস আর যায় কোথায় ? স্বপ্নের আমেরিকা যাওয়ার সুযোগটা এখন লিজার হাতের নাগালে। নিজেকে বেশ সুখী সুখী লাগছিল লিজার। প্রোক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে গেল লিজার রাজিবের কথা ভেবে। কিন্তু রাজিব? রাজিবের কি হবে? এতদিনের প্রেম আজ হঠাৎ থমকে দাঁড়াবে। হায়! লিজার এতদিনের স্বপ্ন সাধনা সব ভেঙ্গে যাবে নিমেষে। কিন্তু লিজা কি পারবে রাজিবকে ভুলে যেতে। ভালবাসাকে ভুলতে। আহা ভুলতে হবে কেন? ভোলার দরকারটা কি। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত ঘটনাই তো ঘটে। কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কারো সাথে সম্পর্কটা গভীরও হতে পারে। তাই বলে এটা মনে করে কষ্ট পাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কাউকে ভাল লাগতেই পারে। আর সব ভালোলাগার পরিণতি যে বিয়েতে গড়াবে এমন ধারনা করা নিতান্তই ভুল। যেখানে সারাজীবনের নিশ্চয়তা, উন্নত জীবন যাপনের হাতছানি, তার পথে সামান্য ভালোলাগা, ক্ষুদ্র তুচ্ছ ভালবাসা বাধা হতে পারে না। নাহ ! এটা কোন ব্যাপারই না লিজার পক্ষে রাজিবকে ভুলে যাওয়া। লিজা পারবে তার সামান্য ভালবাসাকে খুন করতে। লিজাকে যে পারতে হবে। এতটা বোকা মেয়ে সে নিশ্চয়ই নয় যে, রাজিবের মত একটা ছোকরা যার কোন ভবিষ্যৎ নাই তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে। সুখ আর আরাম আয়েশের হাতছানিকে উপেক্ষা করবে? নাহ ! এতটা বোকামি লিজা নিশ্চয়ই করবে না ।
১১।
রাজিবের মন বড়ই খারাপ আজ। লিজাকে এত তাড়াতাড়ি হারাতে হবে ভাবতেও পারেনি ও। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। কঠিন বাস্তবতা লিজাকে কেড়ে নিয়েছে। রাজিব কে করেছে একা। কিন্তু লিজার কি কিছুই করার ছিল না। রাজিবের মনে প্রশ্ন জাগে লিজা কি পারত না। —-নাহ আর ভাবতে পারছে না রাজিব। প্রেম ভালবাসা, আবেগ অনুভূতি এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে লিজা একটা মেয়ে। আর একটা মেয়ের কাছে প্রেম ভালবাসার চেয়ে অর্থ -বিত্ত-বৈভব কোন অংশে কম গুরুত্ব বহন করে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রেম ভালবাসাকে বিত্ত-বৈভবের সাথে এক পাল্লায় উঠাতেও তারা পিছপা হয় না। সান্ত্বনা খোজে রাজিব। লিজার সাথে সম্পর্কটা খুব বেশী দিনের নয়।
মাত্র তিন মাসের জানাশোনা। যেখানে স্বার্থের প্রশ্নে কয়েক যুগের সম্পর্ক নষ্ট হয়। সেখানে মাত্র তিনমাসের প্রেম কোথায় উড়ে যাবে। এ আর অসম্ভব কি। তবুও সান্ত্বনা এই যে, লিজা যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে ই রাজিবকে বাস্তবতাকে বুঝাতে চেয়েছে। কোন ধরনের ভণিতা করেনি। রাজিব ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেছে। বাস্তবকে মেনে নিয়েছে রাজিব।
১২।
লিজার আমেরিকা যাওয়ার খবরটা শুনে খুশিই হল আশা। যাক আপদটা বিদেয় হচ্ছে তাহলে। এবার রাজিবকে পেতে আর কোন বাধাই থাকল না। তবুও একটু মন খারাপ হলো আশার। ইস রাজিব নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। প্রেমিকা চলে যাচ্ছে ওকে ফাকি দিয়ে। কষ্ট তো পাওয়ারই কথা। কিন্তু বাছাধন তোমার জন্য অন্য একজন যে এত কষ্ট সহ্য করেছে তাতো তুমি বুঝতেও পারছ না। এবার বোঝ কেমন মজা। আচ্ছা এখন দেখা যাক রাজিব কি করে। একবার ফোন করলে কেমন হয়। ভাবল আশা। রাজিবের মোবাইলে রিং করল ও। প্রথম বার রিং বাজতেই রাজিবের কণ্ঠ শোনা গেল। হ্যালো আশা কেমন আছিস? জিজ্ঞেস করে রাজিব। ভালো তোমার খবর বল। তুমি কেমন আছ? পাল্টা প্রশ্ন করে আশা। এই তো আছি। আমার আর থাকা। কেন? তোমার তো ভাল থাকার কথা। বেশ তো চলছে! মন্দ কী। আশার কন্ঠে কৌতুক। আহ! ফাজলামো করিস না। মন ভাল নেই আমার। কেন পাখি উড়াল দিছে। তুমি বসে আছ কেন ? পাখির ডানা ধরছ না কেন? তুই থামতো আশা। আমার ভাল লাগছে না। তোর আর কোন কথা আছে? থাকলে বল। না আমার কথা ভাল লাগবে কেন ? ভাল লাগবে তো লিজার কথা। তা কি বলল তোমার পরান পাখি। বলেতো শুনি। তুই তো আমার মনটাই খারাপ করে দিলি। প্লিজ এখন থাম আমার ভাল লাগছেনা। তোর সাথে পরে কথা হবে চেঁচিয়ে বলে রাজিব। না আমার কথা শেষ হয়নি। আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। খুব তো দহরম মহরম চলছিল। এত সহজে ভেস্তে গেল কেন ? ইস! আশা আমার একটা উপকার করবি। খুব তো দরদ উথলে উঠছিল লিজার জন্য। কই এখন তো পরান পাখি ফিরেও চাইছে না। ব্যাঙ্গাঙ্গতক স্বরে কথাগুলো বলল আশা। উহ! অসহ্য, আশা তুই কেন বুঝতে পারছিস না তোর এমন রসালো কথাবার্তা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমার মনটা এমনিতেই ভাল না। তার উপর তোর এমন সব কথা আমার খুব খারাপ লাগছে। ইস খারাপ লাগছে। আমার বুঝি মোটেই খারাপ লাগেনি। আমিতো পাথরের তৈরি। তাই না। ঝাঁঝালো কণ্ঠ আশার। কি বলতে চাস তুই? তোর কি এমন ক্ষতি করলাম আমি। তোর খারাপ লাগবে কেন? জিজ্ঞেস করে রাজিব। খারাপ লাগবে কেন? তুমি যেন দুধের শিশু। ফিডার খাও। কিছুই বুঝতে পারছনা। ন্যাকামো করার আর যায়গা পাওনা। আশার কন্ঠে ক্ষোভ। চমকে উঠে রাজিব। সেই সাথে কিছুটা অবাকও হয়। আচ্ছা তুই কি বলতে চাস বলতো? মাথা গরম করিস না। আস্তে আস্তে বল। বলে রাজিব। তুমি বুঝতে পারনা। না বললে বুঝব কি করে পাল্টা প্রশ্ন করে রাজিব। না বললেও বোঝা যায়। এমন অনেক কথা আছে যা মুখে না বললেও বুঝে নিতে হয়। দেখ। অমি এসব ব্যাপার একটু কম বুঝি। তোর কোন কথা থাকলে বলে ফেল। সময়ক্ষেপণ করছিস কেন ?বলে রাজিব। হ্যাঁ আমি বলতে চাই আমার কথা। বিকালে লেকের পাড়ে আসতে পারবে? প্রশ্ন করে আশা। একটু সময় নিয়ে উত্তর দেয় রাজিব। হ্যাঁ পারব চারটের সময়। আচ্ছা ঠিক আছে এসো, বলে ফোন রেখে দেয় আশা।
১৩।
রাজিব আশার ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। আশা কি বলতে চায়। মেয়েরা সাধারণত চাপা স্বভাবের। কথায় আছে বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। তাই হয়তো আশা এতদিন চুপ করে ছিল। চাপা আক্রোশে তির্যক মন্তব্য করেছে লিজার ব্যাপারে। লিজার প্রসঙ্গে কোন কথা জিজ্ঞেস করলেই মুখটা অন্যরকম হয়ে যেত আশার। কেন লিজার কথায় ও অমন বিমর্ষ হয়ে যেত রাজিবের কাছে এখন তা পরিষ্কার। ধ্যাত কি বোকা মেয়ে! একটু মুখ ফুটে বললেই তো হতো। তাহলে তো আজ আর এতো কষ্ট পেতে হতনা রাজিবকে। আশা যদি রাজিবকে একটু টাচ দিতো তবে আর লিজার দিকে এগুতো না ও। আশাই হয়ে উঠত রাজিবের ধ্যান-জ্ঞান ও একমাত্র আরাধ্য। আচ্ছা রাজিব কি মোটেই ভুল করেনি। রাজিবের কি উচিত ছিল না আশার মনোভাবটা জানা। রাজিব এতদিন ভাবত আশা হয়তো তার স্বভাব সুলভ চপলতা ও স্বাভাবিক দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়েই রাজিবের সাথে মিশেছে। রাজিব ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে আশা রাজিবকে পছন্দ করে। রাজিবের প্রতি ওর ভালোলাগার মাত্রাটা অন্য সবার থেকে আলাদা। আজ বুঝতে পারছে রাজিব। আশা নিশ্চিত ওকে ভালবাসে। ইস বড় আফসোস হল রাজিবের। আশা এতদিন কি কষ্টেই না ছিল। রাজিবকে এতদিন ধ্যান-জ্ঞান করে এসেছে। অথচ ওর দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি সে। ইস বড় অন্যায় হয়ে গেছে রাজিবের। পায়ের কাছে ছড়ানো ফুল রেখে এতদিন সে আলেয়ার পিছু পিছু ছুটেছে। কুহকিনী, মায়াবিনী লিজা রাজিবের সমগ্র স্বত্বটায় ঝেঁকে বসেছে এতদিন। যার জন্য আশাকে মনেও পড়েনি তার। আশার অব্যক্ত মনের কথাটা বোঝার চেষ্টাও করেনি রাজিব। নাহ! এবার আশার কথাটা শুনতে চাইবে রাজিব। আশাকেই সে বাকী জীবনের সঙ্গী করে নেবে। আশার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে সে। না! না! আর নয় মরীচিকার পেছনে ছোটা। এবার বাস্তবে ফিরে আসবে রাজিব। আশাকেই ভালবাসবে সে, মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় রাজিব।