অদ্ভুত মেয়ে

অদ্ভুত মেয়ে
বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার এক পর্যায়ে মেয়েটি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, “জানেন, আমার না বিয়ে হচ্ছে না।”
আমি খানিকটা হকচকিয়ে উঠলাম। বুঝেও আরেকবার ক্লিয়ারলি শোনার জন্য বললাম,
– স্যরি, বুঝতে পারিনি।
– আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেলেও কোনো একটা কারণে বিয়ে হচ্ছে না। বলা যায় বিয়ে করতে পারছি না।
– কেন বলুন তো?
– আমি যেরকম ছেলে বিয়ে করতে চাই, আমার ফ্যামিলি সেরকম ছেলেকে কখনো মেনে নিবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। তাই বিয়েটা হচ্ছে না।
– কেমন ছেলে বিয়ে করতে চান?
– একদম কুচকুচে কালো একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। টাকা পয়সাও বেশি থাকা যাবে না তার।
আমি অবাক হয়ে আবার বললাম,
– কেন বলুন তো?
উনি আর কোনো উত্তর দিলেন না। রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন। মেয়েটি উচ্চবিত্ত ফ্যামিলির একটা মেয়ে। দেখতেও অসম্ভব সুন্দর। এমন একটি মেয়ে যদি এমন অদ্ভুত টাইপ কথা বলে! শুনে অবাকই হতে হয়।
মেয়েটার নাম এশা। এশার সাথে আমার পরিচয়টাও অদ্ভুত ভাবে হয়েছিল। আমি একদিন একটা মেডিকেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাত তখন প্রায় ১১ টা। মেয়েটা হঠাত করেই পথ আটকিয়ে আমাকে ডেকে বলল, “আপনার রক্তের গ্রুপ কি?” এত রাতে যদি একটা মেয়ে কোনো ছেলেকে রাস্তায় থামিয়ে তার রক্তের গ্রুপ জানতে চায়, রক্তের গ্রুপটা বলতেও তখন খানিকটা দ্বিধায় পড়তে হয়। দ্বিধায় পড়েছিলাম আমিও।
তার মা ছিল ইমারজেন্সি অপারেশনে। রক্তের জরুরী প্রয়োজন ছিল। রক্ত কোথাও না পেয়ে মেয়েটি প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। তার ইমারজেন্সি অসুস্থ্য মায়ের সাথে আমার রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় সেই রাতেই তাকে রক্ত দিতে হয়েছিল। সেই থেকে তাদের পরিবারটার সাথে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায় আমার। এশার মা আমাকে সন্তানের মত দেখতে শুরু করেন। তার সাথে প্রায়ই ফোনে কথা হয়। কথা হয় এশার সাথেও। অল্প দিনেই এশার সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমার। যদিও বন্ধুত্ব টা ‘আপনি’তেই সীমাবদ্ধ। বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতেও যাওয়া হয়েছিল আমার। বাড়ির সবার এত এত আদর যত্ন আর ভালোবাসায় আমি আচ্ছন্ন ছিলাম। সম্পর্ক গুলো কি রকম অদ্ভুত….একদম অপরিচিত থেকেও কতটা পরিচিত হয়ে যায় এক বৃষ্টির রাতে আমি বেলকনীতে বসে আছি। ঘুম পাচ্ছিল না কেনজানি। আমার ফোনের রিং বেজে উঠলো। এশা কল দিয়েছে,
– হ্যালো
– কোন দিকে হেলবো? ডানে নাকি বায়ে?
– উফফ…আপনি না আচ্ছা শোনেন, আপনাকে আজ সেই কথাটা বলব
– কোন কথাটা যেন?
– এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?
– একটু মনে করিয়ে দিন তো?
– আরে ওইযে, আমি কালো ছেলে বিয়ে করবো যে কারণে।
– ওহ আচ্ছা বলেন।
– বলব, কিন্তু একটা শর্তে।
– কি শর্ত?
– আমার আব্বু, আম্মু কে একটু বুঝাবেন। হিহিহি।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– ওকে এখন বলছি। আমি একদম কালো একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু তার মনটা হতে হবে সাদা সেই সাথে অল্প টাকা পয়সাওয়ালা। কারণ বেশি টাকা সাদা মনকে অটোমেটিকলি কালো করে দেয়। এশা একটু থামলো। তারপর আবার বলা শুরু করলো…
– এরকম একটা ছেলেকে আমার জীবন সঙ্গী করতে পারলে আমি সারাজীবন তার থেকে অনেক বেশি ভালোবাসা পাবো। সে অন্যকোন মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হবে না। সব সময় আমাকে নিয়েই ভাববে। আমিও তাকে অনেক ভালোবাসবো। সব সময় এটা ওটা আবদার করবো, তবে ছোট খাটো। মাঝ রাতে আইস্ক্রীম খেতে চাইবো, আমার চুল বেণী করে দিতে বলব, অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য ফুল নিয়ে না আসলে গাল ফুলাবো… বেচারা কালো মানুষটা আমার এত বেশি ভালোবাসা পেয়ে নিশ্চয়ই মনে মনে আহ্লাদে গদগদ হবে। হিহিহি…আমার মজা লাগবে খুব।
আমি মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার কথা গুলো শুনছিলাম। প্রতিটা কথাতেই অদ্ভুত ভালোবাসা আর সরলতার কি ছোঁয়াই না ছিল মাঝখানে বেশকিছু দিন কেটে গেল। এশার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার। আমিও ব্যস্ত ছিলাম নিজের যান্ত্রিক জীবন নিয়ে। একদিন হুট করেই খবর পেলাম এশার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এশার মা ফোন করে আমাকে বিয়ের দাওয়াত দিলেন এবং আরও বললেন আমি না গেলে উনি মনে কষ্ট পাবেন খুব। এশা আর তার বর পাশাপাশি বসে আছে। পাশের কালো মানুষটিকে যতটা না সুখী মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশি সুখী মনে হচ্ছে এশাকে। লাল বেনারসি তে কি সুন্দরই না লাগছে মেয়েটিকে..লাজুক মুখে কিছুক্ষণ পর পর সে মাথা তুলছে, চারিদিক থেকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ গুলোও জ্বলে উঠছে বিদ্যুৎ চমকানোর মত করে। এশার পাশে বসা পৃথিবীর অন্যতম সৌভাগ্যবান মানুষটির কালো মুখটাও জ্বল জ্বল করে উঠছে ক্যামেরার আলোয়। কি মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য… কতশত বিচিত্র মানুষই না আছে আমাদের চারপাশে..আছে বিচিত্র সব ভালোবাসাও।
বিয়ে বাড়ির সব কোলাহল প্রায় শেষ। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার ছোট্ট বেলকনীওয়ালা রুমটাতে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজ রাতেও হয়তো বৃষ্টি নামবে। আজ রাতেও আমার ঘুম আসবে না। বেলকনীতে বসে বসে বৃষ্টি দেখবো। বিচিত্র এক ভালোবাসা পাগল মেয়েটিকে নিয়ে হয়তো ভাববোও কিছুক্ষণ। ভাবতে ভাবতে মনটা ভালো হয়ে যাবে আমার। হয়তো খানিক বাদে মনটা খারাপও হবে। আজ যে আকাশেরও মন খারাপ!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত