অপ্রিয়

অপ্রিয়
টেবিলে বসে একমনে বই পড়ছিলাম।কারো গলার আওয়াজ শুনে মনটা নড়েচড়ে উঠল।পাব্লিক ভার্সিটির এই এক বিশাল সমস্যা। কোনো কিছুতে ভাল ভাবে মন দেওয়া যায় না।সেটা বই হউক আর মেয়ে।মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তি এসে পড়বেই।তাকিয়ে দেখলাম চশমা পড়া মেয়েটা ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম,
– আপনি নিশ্চয়ই মেহেক? মেয়েটার চোখের চাহনির প্রশ্নটা স্পষ্ট।যেখানে বলা হচ্ছে,
– আপনি জানেন কিভাবে?
– আন্দাজ করলাম আরকি!
মনে মনে একটু খুশি হলাম।সত্যি বলতে বেশ খুশি হলাম।মানুষকে বোকা বানানোর কাজটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস।কয়েকবার উপরের ক্লাসের স্টুডেন্টদের কাছে মারও খেয়েছিলাম। কিন্তু স্বভাবটা ছাড়তে পারি নি।এই অভ্যাস ছাড়াও আমার আরো অনেক ভাল অভ্যাস আছে।যেগুলো অন্য মানুষজনেরা সহ্য করতে পারে না।বাট হু কেয়ারস? ভার্সিটিতে প্রথম দিন।ক্লাসে আসার আগে অফিসে গিয়ে দেখে আসছিলাম আমাদের ইউনিটে কে কে আছে।তখন মেয়েটার ছবি দেখে ছিলাম সাথে ডিটেইলস।ভাগ্যিস নামটা মনে ছিল বিধায়। তার মুখেতে আকস্মিকতার ভাব সরে গিয়ে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠেছে।কেন তা জানি না।বলল,
– আমাকে কি বসতে দিবেন? আমি সরে গিয়ে তাকে বসার জায়গা দিলাম।মেয়েটা আমার পাশে ধপাশ করে বসে পড়ল।তার চোখের চশমাটা দু’ইঞ্চি লাফ দিয়ে আবার জায়গায় বসে পড়ল।যেন সে অনেক ক্লান্ত।আমি আবার কথা বাড়ালাম,
– স্যালাইন লাগবে আপনার?
– কেন?
– পেট খারাপ মনে হয় আপনার।
– কি আজে বাজে বলছেন?
– আপনার চেহারা দেখলেই বুঝা যায় সকাল থেকে আসা-যাওয়ার মাঝে আছেন।
মেয়েটা এবার ফিক করে হেসে দিল।সুন্দর মেয়েগুলার হাসিটা অত একটা সুন্দর হয় না।এই মেয়ের ক্ষেত্রেও একই।তবে ওর আঁকা বাকা দাতের সাথে হাসিটা মিলে গেল।যা অনেক সুন্দর একটা দৃশ্যের জন্ম দিল।সে বলল,
– আপনি তো অনেক মজার মানুষ।
এবার আমি নিজে কনফিউশনে পড়ে গেলাম।এমনটা তো আজ অবধি কেউ বলেনি।অবশ্য আজ অবধি আমার আর ক’জন মানুষের সাথেই বা কথা হয়েছে।তাকে ‘থ্যাংক্স’ জানালাম। তারপর টুকটাক কথাবার্তায় আপনি থেকে তুমি পর্যন্তই আসতে পেরেছি।আজকাল মেয়ে পটানো এত্ত সহজ কাজ না।বাইক,তাও আবার কেটিএম তারপর ডিএসএলআর আর সাথে সুন্দর একখান চেহারা।আজকাল এগুলা ছাড়া মেয়ে পটানো যায় না।আর এসবের কোনো কিছুই আমার নাই। প্রথম দেখার ভালবাসাটা সেই ১৯ শতকেই রয়ে গেছে।২০ শতক পর্যন্ত আসতে পারে নি।তাই আমার মত সিঙ্গেল মানুষদের আজকাল গরীব বলা হয়।যাকগে,এসব দুঃখের কথা বলে লাভ নেই।
ক্লাস শেষে নবনীতার কলেজের দিকে হাটা ধরলাম।ভীষন রোদ সাথে পেটে ক্ষুদা।যায় যায় অবস্থা আমার।তবুও ওর সাথে আজ দেখা করতে হবে।নাহলে মরে গেলে পোকা মাকড়ও আমার দেহ খেতে আসবে না। হোস্টেলে আজ সকাল থেকেই আমার খাবার বন্ধ।বন্ধ হওয়ার কথা ছিল আরো দু’দিন আগে।হোস্টেল মাস্টার ভাল আছে বিধায় আরো দু’দিন খাওয়ালো।তিনমাস থেকে হোস্টেলের বেতন বাকি। এটাও আমার একটা ভাল অভ্যাস।হোস্টেলের বেতন না দেয়া বা কারো কাছ থেকে টাকা ধার নিলে তা ফেরত না দেয়া।যা মানুষজন সহ্য করতে পারে না।বাট হু কেয়ারস? নবনীতাকে সাদা ড্রেসে অনেক সুন্দর দেখায়।তবে সেভাবে কখনো দেখা হয়নি।চাইলেও দেখা হবে না।ওদের স্ট্যাটাস আর আমাদের স্ট্যাটাসে অনেক পার্থক্য।যে সমাজে সাম্যের গান গাওয়ার মত নজরুল নেই সেই সমাজেই আমাদের বসবাস। নবনীতার কথায় আমার ঘোর কাটল।ও খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বলল,
– দেখা করতে বললেন কেন?
– আগে আমারে কিছু খাওয়াও নাহলে মরে যাব।
নবনীতা হেসে দিল।এই হাসি দেখার কোনো মানে নেই। চোখের সামনে অলরেডি তারা ভেসে উঠতে লাগল।পাক্কা ৭ প্লেট ভেলপুরি খাওয়ার পর আমার হুশ ফিরল।মনে হলো যেন এখনো অনেক দিন বাচার বাকি।নবনীতার দিকে তাকিয়ে শক খেলাম।চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে।উচু গলায় বলল,
– এত খায় মানুষ?
– বুঝবে না,অনেকদিন ধরে না খেয়ে আছি।
– তো হোস্টেলের টাকা দিয়ে দিলেই পারেন।
– টাকা তো থাকতে হবে।
– বিড়ি সিগারেট না খেলেই টাকা থাকে। ও ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভেল্পুরিওয়ালাকে দিল।আমার দিকে আবার দেখল।বলল,
– কত মাসের বাকি?
– তিন মাসের। নবনীতা ব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– এই সহ প্রায় ৫০ হাজার। আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম।যার অর্থ ‘আমি তো কাউকে টাকা ফেরত দিই না’।ও হাসি ফেরত দিল।যার অর্থ ‘আমি জানি’।বলল,
– আজকে পড়াতে আসবেন না?
– না,আজকে একটু ভাল মন্দ খেয়ে ঘুমাব।
– যাই খান খাবেন,কিন্তু সিগারেট না। নবনীতার গাড়ি এসে পড়ল।ও ব্যাগটা গাড়ির ভিতর ছুড়ে দিয়ে বলল,
– আপনাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে আসব?
– না,আমার রোদে হাটতে ভালই লাগে।
– আজব মানুষ একটা।
নবনীতার মুখে ক্লান্তি আর বিরক্তি ভাবটা স্পষ্ট।ও গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ি শুন্যে মিলে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম।’এ্যালন’ কোম্পানির গাড়ি।গত জন্মদিনে নবনীতার বাবা ওকে গিফট করেছিল।বড়লোকদের কত শখ-আহ্লাদ।আমার যখন বয়স ৬ কি ৭।তখন একবার জন্মদিন পালন করেছিলাম।বাবা আমাকে একটা খেলনার গাড়ি গিফট করেছিল।ওইটাও হয়ত ‘এ্যালন’ কোম্পানির হবে। রোদের তাপ বেড়ে যেতে লাগল।আনমনে হোস্টেলের দিকে হাটা ধরলাম।এক মাসের টাকা দিয়ে খাবার চালু করতে হবে। আর বাকি ৭ হাজার টাকা দিয়ে কয়েক দিন ভাল মন্দ খাওয়া যাবে। মেহেককেও একটা ট্রিট দিতে হবে।সুন্দরি আমার একটা এসাইনমেন্ট তৈরি করে দিয়েছিল। এই রঙ্গিন বাতির রেস্টুরেন্টে আমি আরো এসেছিলাম। নবনীতার সাথে এসেছিলাম।আজ মেহেককে নিয়ে আসলাম। রঙ্গিন বাতির মাঝে মানুষের চেহারাটা কেমন জানি বদলে যায়।একটা আভিজাত্য ভাব ফুটে উঠে চেহারায়।কাউকে তো আর সাদামাটা হোটেলে নিয়ে ট্রিট দেয়া যায় না।আর সুন্দরি মেয়ে হলে তো নিজের প্রেস্টিজে গিয়ে লাগে।ওকে বললাম,
– কি খাবে?
– যা খাওয়াবে।
– তাহলে পানি খাই,কি বলো?
– কাউকে যে পানিও ট্রিট দেয়া যায় আমার জানা ছিল না।
আমি হেসে দিলাম।এই হাসির কোনো অর্থ নেই।পাস্তা অর্ডার করলাম সাথে কোল্ড কফি।এখানের পাস্তাটা সেই লেভেলের। নবনীতা খাইয়ে ছিল।নাহলে আর আমার সাধ্য কই এমন রেস্টুরেন্টে বসার।হোস্টেলের সামনের ভাঙ্গাচুরা টিনের হোটেলের সিঙ্গারা খেয়ে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিই।আর পাশের মামার টঙ দোকানের চায়ের তো কোনো তুলনা হয় না সাথে একটা গোল্ডলিফ।আহ হা!জীবনটা যেন সুখের। মেহেকের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল।বলল,
– তোমার কোল্ড কফি গরম হতে চলেছে। মেয়েটাও কিছুটা ফানি টাইপের আছে।প্রথম দেখায় গম্ভীর টাইপের ভাবছিলাম।স্বাভাবিক বাঙ্গালী মেয়েরা যেমন হয় আর কি! বললাম,
– উত্তরার দশ নংয়ের মসৃণ মার্বেল পাথরের বাসায় কবে নিয়ে যাবে?
– তুমি জানলে কিভাবে আমার বাসা ওখানে?
– আন্দাজ করলাম আরকি।
– তোমার একটু ভুল হয়েছে।সেখানে মার্বেল পাথরের কোনো বাসা নেই আমাদের।আর আমরা ভাড়ায় থাকি।বাট তোমার আন্দাজ এত্ত সঠিক হয় কিভাবে? আমি আবারো বেশ খুশি হলাম।মেয়েটাকে আবারো বোকা বানানো গেছে।আরেকটা ডিল ছুড়া যাক,
– তোমার হাতের বিরিয়ানি তো সেই লেভেলের।ট্রাই করাবে না? মেয়েটার অবাক চাহনি নেই।কথাটা স্বাভাবিক লাগল ওর কাছে।মনে হয় ধরা খেয়ে গেছি।বলল,
– ফেইসবুক প্রোফাইলে ঘুরাঘুরি না করে রিকুয়েষ্ট দিলে আরো অনেক কিছুই জানতে পারবে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম,একটু বড়লোক হলে কি ক্ষতি হত। কাল রাতে বন্ধুর আইডি থেকে ওর প্রোফাইলটা চেক করেছিলাম।আমার যে ভাঙ্গাচুরা মোবাইল আছে সেটাতে কেবল কল আসে আর যায়।অন্য কিছু ভাবা দুষ্কর।আমি আর কথা বাড়ালাম না।বিলটা পরিশোধ করলাম।ওকে ভার্সিটিতে নামিয়ে হোস্টেলের দিকে হাটা ধরলাম।আজকে ক্লাস করার ইচ্ছে নেই।হোস্টেলে গিয়ে জন্মের ঘুম দিতে হবে। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিকেল ৪ টা।আজকে নবনীতাকে পড়াতে যেতে হবে।অনেকদিন হয়ে গেছে যাই না।ফ্রেশ হয়ে ওর বাসার দিকে হাটা ধরলাম।বিকেল ঘনিয়ে এলো তবুও রোদ কমে না।একটা গাড়ি থাকলে তো এসির বাতাস খেতে খেতে যেতে পারতাম।কপাল আর কি! বাসার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।দারোয়ান আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো যেন আমি ভিনগ্রহী।এই দারোয়ানরে আমার একটুও পছন্দ না।যেদিন প্রথম নবনীতাকে পড়াতে এলাম, বেটা আমাকে ঢুকতেই দিল না।সেদিন টানা দশ মিনিট আমার চেহারা দেখে কি ভেবে যেন বাড়ির ভিতর কল করে কাদো কাদো গলায় বলল,
– স্যার,আমার কি দোষ বলেন? আমি থাকতে নতুন দারোয়ান কে চাকরি দিলেন কিভাবে? সেদিন মাথা চরম লেভেলের গরম হয়ে গেছিলো।পরে ভাবলাম,বেচারার আর কি দোষ!চেহারাটাই হয়ত এমন।আর গায়ের পাঞ্জাবিটা কত বছরের পুরনো,সেটা তো আমার নিজেরো মনে নেই।পরে নবনীতা এসে আমাকে নিয়ে গেছিলো। কিন্তু আমার সাথে এমন ঘটনায় নবনীতা বেশ লজ্জা পেল।আমার আর কি!আমরা গরীব পরিবারের ছেলে গুলো বুঝ হওয়ার পরেই লজ্জা-শরম কবর দিয়ে দিই। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম নবনীতাকে কল দিতে।এই বেটা এমনিতে ঢুকতে দিবে না।মোবাইল বের করতেই বলল,
– আরে আপনি তো ছোট ম্যাডামের স্যার। আমি অর্ধমৃত ফোনটার দিকে তাকালাম।এটাই তাহলে আমার পরিচয়। মনের অজান্তে ফোনটায় একটা চুমু দিলাম।যাক,মান সম্মানটা আজকের মত বেচে গেছে।নাহলে নবনীতা আবার কি ভাবত,কে জানে! নবনীতা আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বলল,
– আজকেও কি ঢুকতে দিচ্ছিল না? তাহলে মান সম্মান আর রক্ষা পেল না।ও নিশ্চয়ই বারান্দা থেকে দেখেছে।বললাম,
– আমাকে অপমান হতে দেখতে কি তোমার ভাল লাগে?
– আরে কি যে বলেন!আসলে আপনি দারোয়ানের সামনে যে লুক নিয়ে দাড়ান আমার সেটা দেখতে ভাল লাগে।
– কথা বাড়িও না।বই নিয়ে এসে পড়ো।
আমি নবনীতার ম্যাথ টিচার।আপনি হয়ত ভাবছেন,এত উচ্চ পরিবারে আমি প্রাইভেট টিউটর হলাম কিভাবে?সেটা আরেক ঘটনা: সেদিনও আমি রোদ্র বিলাস করতে করতে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছিলাম।হঠাত একটা গাড়ি আমার সামনে এসে দাড়াল আর ভিতরে ঢুকতে বলল।তার আগে আমার গাড়িতে চড়ার কোনো এক্সপেরিয়েন্স ছিল না বলে কৌতুহল বশত গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়িটা একটা প্রাইভেট কোম্পানির সামনে এসে দাড়াল।একটা লোক আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল।সেদিন মোটা ভুড়িওয়ালা লোকটাকে দেখে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম।উনি কোনো মতে নড়েচড়ে কঠোর স্বরে বলল,
– তুমি তাহলে আদ্রতার ম্যাথ টিচার।আমি ভয়ে আদ্রতাটা কে ভুলেই গেছিলাম।টেবিলের উপর পত্রিকায় তাকিয়ে দেখলাম আদ্রতা নামের কে জানি ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে।ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বললাম,
– বিশ্বাস করেন স্যার।আমি এ ঘটনার সাথে জড়িত না।কে কে ছিল সেটাও জানি না। লোকটা পত্রিকার দিকে তাকাল।তারপর হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল,
– মাই বয়,আমি তো আসাদ সাহেবের মেয়ের কথা বলছি।
পরক্ষনে আমার মনে পড়ল।আদ্রতা তো আমার স্টুডেন্ট।ক্লাস টেনে পড়ে।ওকে আমি ম্যাথ পড়াই।পুরাই ম্যাথে গোল্লা টাইপের স্টুডেন্ট।আমার সান্নিধ্যে উন্নতি হয়েছে।এতটা উন্নতি হয়েছে যে,সেবার টেষ্টে টপ ক্লাস মার্ক পেয়েছে। এসব মনে পড়তে আমি নিজেই হেসে দিলাম।বললাম,
– জ্বী স্যার,মনে পড়ছে।
– আমি চাই যে,তুমি আমার মেয়েটাকে একটু পড়াও।ম্যাথে ওর অবস্থা ভাল না।
– ওকে স্যার।
– আঙ্কেল বলবে আমাকে।ওকে?
– জ্বী স্যার,সরি আঙ্কেল।
তারপর বের হতে হতে ভাবতে লাগলাম, দিনে কত লক্ষ লক্ষ টাকার হিসেব করে এই লোক হয়ত সেও জানে না।অথচ তার মেয়ে অঙ্কে গোল্লা।সময় অসময়ে বড়লোক মানুষ গুলারো গরীব মানুষদের স্মরন করতে হয়।এই দুনিয়া বড়ই অদ্ভুত!বড়ই!কাউকে এক বিন্দুও ছাড় দেয় না। নবনীতা এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।কিন্তু দেখতে অতটা বড় হয়নি এখনো।ক্লাস টেনের টেস্ট এক্সামের পর থেকেই আমি ওকে ম্যাথ পড়াই।ওর বাবা যতটা বলেছিল ও ঠিক ততটাও খারাপ স্টুডেন্ট না।ও বই নিয়ে এসে বসল।আমি বইটা খুলতে খুলতে ও অভিমানি কন্ঠে বলল,
– আমার টাকা দিয়ে অন্য মেয়েদের খাওয়ানো হয় অথচ আমাকে একবারো খাওয়ানো যায় না।
– তুমি জানলে কি করে?
– আন্দাজ করলাম।
এ বলে ও হেসে দিল।আমিও হেসে দিলাম।কিন্তু ওর হাসির পিছনে কোনো একটা অনুভুতি যেন চাপা পড়ল।ও জানে না, এসব অনুভূতি বড্ড খারাপ।এসব জন্ম দিতে নেই।বাস্তবতা এসব অনুভূতি মানতে চায় না।তারা জাত খুজে।তারা মেয়ের সুখ বুঝে না।অন্য কাউকে বিয়ের পর এসব অনুভূতি যখন পচে গলে যায় তখন সেখান থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়।যার গন্ধ তাদের নাকে যায় না।মেয়েটা ছাড়া কেউই সে গন্ধ পায় না।তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাও পায় না যে লাল নীল আভিজাত্য বাতির নীচের তুলতুলে নরম বেডে শুয়ে তুলতুলে বুকটায় সুখ খুজে।সে বুঝে না এই বুকটার গহীনে মন জিনিশ টা আজ পচে গেছে।যেখানে অন্য কেউ একজন ছিল।আমি মনের অজান্তে বলে উঠলাম,
– বাস্তবতা অনেক কঠিন নবনীতা,তুমি বুঝবে না! নবনীতার রুমে কেউ একজন ঢুকল।বেশ হ্যান্ডসাম।গায়ে ট্যাটু,চুল স্পাইক,কানে হেডফোন,গায়ে ইয়ো ইয়ো স্টাইলের সব জামা কাপড়।দেখে আমি হেসে উঠলাম।নবনীতার কানের কাছে গিয়ে বললাম,
– মালডা ক্যাডা?
– মুখ সামলে কথা বলেন।
আমি চুপ হয়ে গেছি।নবনীতার চোখে রাগ আর মুখে বিরক্তির চাপ।নবনীতা ছেলেটাকে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।ওর দুঃসম্পর্কের মামাতো ভাই।নাম জন।জয়নুল থেকে জন। আভিজাত্যপূর্ণ নাম।আমি মনে মনে হেসে উঠলাম।জনও কোনো এক বড়লোক বাবার সন্তান।
কিন্তু তার বাবাকে আভিজাত্যটা ভালভাবে হয়ত ছুতে পারেনি।আমি আমার মা বাবার কথা ভাবতে লাগলাম।তারা তো আভিজাত্যপূর্ণ ছিল না।তাহলে আমার নামটা এত আভিজাত্যপূর্ণ কেন? এসবের উত্তর আমার অজানা। জিজ্ঞেস করার জন্য আমি মা বাবাকে খুব একটা সময় কাছেও পাই নি। জনের সাথে টুকটাক কথা হলো।কথায় ইংলিশ আর ফ্রেঞ্চের সংমিশ্রণ।ম্যানার বলতে ওর কাছে পশ্চিমা কালচারটাই প্রিয়।বাংলা ভাষা আর কালচারটাকে ক্ষ্যাত ছাড়া হয়ত ও অন্য কিছু ভাবে না।কিন্তু ও  জানে না,এই ক্ষ্যাত ভাষা আর কালচার টাকে আকড়ে ধরে প্রাণ দিয়েছিল ত্রিশ লক্ষ মানুষ।নাহ, আমাদের পোষাকে হয়ত আভিজাত্য ভাবটা আছে কিন্তু মনের দিক থেকে আমরা বড় হলাম কই! সন্ধ্যা ৬ টা।আরো আগে বের হওয়া উচিত ছিল নবনীতাদের বাসা থেকে।মামার অফিসে একটু যেতে হবে।মামা ডেকেছেন। হোস্টেল ফি আর হাত খরচ দিবে হয়ত।মা বাবার মরার পরে মামার পরিবারেই সুখ দুঃখের মাঝে বড় হওয়া। মামার অফিসের নরম গদির চেয়ারটা আমার সবসময়ের প্রিয়। বসলেই ঘুম ঘুম ভাব আসে।মামা দু’কাপ চা দিতে বললেন কাউকে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– এত কালো হয়ে গেলি কেন?
– রোদে হাটতে হাটতে মামা হাসতে হাসতে বললেন,
– তোর এই স্বভাব যায়নি এখনো? আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনি।আজকে কেন জানি নরম গদির চেয়ারটা ভাল লাগছে না।বসতেও ইচ্ছে করছে না খুব।বললাম,
– মামা,আমার এই নাম রাখলো কে?
– তোর মা,অনেক আদর করে রাখছে।
– এমন নাম কেন? উচু সমাজের নাম!
মামা কিছু বলল না।একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকাল।মামা ভাবছে নামে আবার উচু নিচু কি।মামা জানে না,এই সমাজে সব ভাগ করা।নাহলে জয়নুল থেকে জন নাম রাখার কি খুব দরকার।আমি টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোস্টেলের সামনের মামার টঙ দোকানে এক কাপ চা আর গোল্ডলিফ নিয়ে চিন্তায় আমি মগ্ন।চিন্তায় কতরাত কাটিয়েছে মা। ছেড়া শার্ট আর স্যান্ডেলের পিছনে লুকিয়ে থাকা বাবার স্বপ্ন। হয়ত ছেলেটা একদিন বড় হবে।ওনেক বড়।তাইতো মনের কোণে কষ্ট চাপা দিয়ে উচু সমাজের নাম রাখা।এটাই কারণ।
আমাকে বড় হতে হবে।অনেক বড়।চোখের কোণের পানি কণাগুলো মুছে উঠে দাড়ালাম।মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।খুব তাড়াতাড়ি চলে গেছেন তারা।খুব! নবনীতার বিয়ের খবর আসল।কার্ডটা টেবিলের উপর রাখা। জনের নামটা সোনালি রঙে জ্বলজ্বল করছে।নবনীতা খুশি থাকলেই হয়।ও তো আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল।আমার বিপদে সাথে ছিল অনেক।তবুও আমরা অনেক আলাদা।ওর দেয়া চিঠিটা শার্টের বুক পকেটে ঘর্মাক্ত অবস্থায় বন্দী।এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না।পরে পড়ব। ভার্সিটি শেষ।এখন জীবনের দৌড়ে নিজেকে প্রমান করা। এভাবেই চলে দুনিয়া।এভাবেই সৃষ্টি হয় সমাজ। আর মেহেক।সেটাও হয়ত আমার জীবনে একটা নিষিদ্ধ অধ্যায়। চলতে চলতে ভালবাসা হয়েই যায়।না চাইলেও হয়ে যায়। মেহেকের জন্য গড়ে উঠা অনুভূতিগুলো চাপা দেয়া থাক। ভালবাসা কেউ বুঝে না।এই জগত সংসারে কেউ কারো নয়।যে যাকে লুপে নিতে পারে।নিজ যোগ্যতায় বড় হতে পারলে হয়ত আমিও একদিন মেহেককে লুপে নিবো।ততদিনে কি সে আমার অপেক্ষায় থাকবে?
নবনীতার বিয়ের রাত।যাওয়া হবে না।জনের পাশে ওকে আমি ঠিক মেনে নিতে পারব না।আমার কাছে বাঙ্গালী কালচারটা যেমন প্রিয় তেমনি এই কালচারকে ভালবাসা মানুষগুলোও।জন এর বিপরীত।চিঠিটা পড়তে হবে।খুললাম, ‘অপ্রিয়, প্রিয় করতে চেয়েছিলাম খুব করে।কিন্তু সেদিন আপনার mচোখের গভীরে আমি ডুব দিতে পেরেছিলাম।হয়ত প্রথম বারের মত।সেখানে হয়ত আমি নেই।হয়ত আমার থাকার কথাও ছিল না।কিন্তু আপনি এটা জানেন না যে,ভালবাসা জাত খুজে না।সমাজ বুঝে না।ভালবাসা হয়ে যায়।আমার বিয়েতে আসবেন না প্লিজ। নিজেকে হয়ত রুখতে পারব না।প্রযত্নে বেচে থাকবেন আমার হ্নদয়ের গহীনে। নবনীতা’ আমার চোখে পানি জমে উঠল।মনে মনে বললাম,
– আজো তুমি বাস্তবতা বুঝলে না নবনীতা। গভীর রাত।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ত আমি।তবে সব শুনতে পাচ্ছি।বৃষ্টির টপটপ শব্দটাও আমি মিস করছি না।কোথাও বিড়াল ম্যাও ম্যাও করছে।দরজার ওপাশ থেকে কারো আওয়াজ ভেসে আসছে।
– ইভান…..ইভান কার কন্ঠ।অনেক চেনা চেনা।মেহেকের।এত রাতে ও এখানে কি করে? না,মনের ভুল হয়ত।কিন্তু আওয়াজ থামছে না। তবে কি বাস্তব? নাহ,আমি উঠব না।আমি অনেক ক্লান্ত।আমার ঘুমের প্রয়োজন।মেহেক কি বুঝবে? আমি ওর কাছেও অপ্রিয় হয়ে থেকে যেতে চাই।আওয়াজটা মিলে গেল ধীরে ধীরে।বাস্তবতা যে বড় কঠিন!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত