মা

মা
নিরানব্বই সালের মে মাসে আমার বিয়ে হয় আসাদগেটের মিডনাইটসান চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। বিদায়ের সময় আমার ছোট ছোট কাজিনরা গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিল তাদের নাজা’পুকে কারা নিয়ে যাচ্ছে, আমিও সেই দৃশ্য দেখে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছি।
বধূবরণ করে নিলেন আমার শাশুড়ি একটা সোনার মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে। নিজের নতুন ঘরে ঢুকে থিতু হতেই বর বললেন নাজু, এই যে ছবিটা মানিব্যাগে দেখছো এটা বড়’পা। মায়ের পরেই তিনি। তাকে সেই শ্রদ্ধাটা দিবে। আর আমার বাবা নেই মা’ই আমার দুনিয়া। জানালার বাইরে একটা গাছ দেখিয়ে বললেন এই নারিকেল গাছটাকে আম্মা যদি বেল গাছ বলেন তুমিও তাই বলবে। কারণ তিনি অসুস্থ। তার কথার বাইরে আমরা যাইনা, তিনি যা বলেন আমরা তাই বলি। আমি ছোট করি বলি – আচ্ছা।
বিয়ের তিন বছর পর রাজশাহী চলে আসি ঢাকায় আমার চেনা দুনিয়া ছেড়ে একেবারেই অপরিচিত এক শহরে। শাশুড়ি মা এতটাই ভালোবাসা দিয়েছিলেন যে ঢাকার মায়া আস্তে আস্তে ভুলে যেতে শুরু করি। আমার সন্তান জন্মের পর যথারিতী তাকে স্কুলে ভর্তি করি, তখন বাচ্চা খুব ছোট বলে স্কুলে বসতে হতো। আমার ডানে বামে সব ভাবীরা তাদের বাড়ীর গল্প করতেন, শাশুড়ী আর ননদদের ভয়াবহ গল্প। আমি চুপ করে বসে থাকতাম কারন এই গল্পের সাথে আমার গল্প মিলবেনা। একসময়ে সেই মানুষগুলোর সাথে আমার বন্ধুত্ব হলে তারা আমার বাসায় আসা শুরু করলেন এবং বলতে লাগলেন “ ভাবী আপনারা বউ শাশুড়ী দুজনেই অসম্ভব ভালো। তালির জন্য দুটো হাত লাগে এক হাতে তালি বাজেনা” ।
ঈদ এলে আমার হাতে একহাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলতেন যাও তোমার জুতো কিনে নিয়ে এসো। বলতাম জুতো তো আছে মা। বলতেন তারপরও কেনো। এক হাজারে এক জোড়াই কিনবে। পাঁচশ পাঁচশ করে দুই জোড়া নিওনা যেন। বলতাম আচ্ছা। আমি দুইজোড়া কিনতাম দুই হাজারে এক জোড়া তার আর আরেক জোড়া আমার।
আমার জীবনে এমন কোনদিন হয়নি যে আমি বাজারে গিয়ে শুধু নিজের জন্য কিনেছি। যাই কিনেছি দুই জোড়া। তার আর আমার। জীবনে আমার বর আমি বাইরে কোনদিন একটা আইসক্রীম খাইনি মা’কে ফেলে। যা খেতাম বাসায় এনে সবাই মিলে। কিছু না বললেও ভেতরে তিনি খুশি হতেন, সেটা আমি বুঝতাম। একটা সময়ে তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন নিজের ছেলেকেও মাঝে মাঝে চিনতেননা তবে আমাকে ঠিক চিনতেন। হাত ধরে বলতেন নাজু চলো বাড়ী যাবো।
: এটাই তো বাড়ী মা।
: না এটা আমার বাড়ীনা। আমার বাড়ী আরও সুন্দর।
: মা দেখেন রাস্তায় কোন রিক্সা আছে ?
: না
: গাড়ী আছে ?
: না
: তাহলে আমরা কাল যাবো আচ্ছা ?
: আচ্ছা।
দশ মিনিট পর আবারো হাত ধরে টানতেন চলো নাজু বাড়ী যাবো। তিনি জমিদারের মেয়ে ছিলেন। সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের সময় বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় আসেন। বিনিময় করেছিলেন শরৎবাবুর সাথে। সেই শরৎবাবু – গানের শরৎবাবু। খোলা চিঠি দিলাম তোমার হাতে। তিনি আলঝেইমারসহ নানা রোগে ভুগছিলেন বর্তমান ভুলে গিয়ে পেছনের সবকিছু দেখতে পেতেন, শৈশব কৈশরের সেই প্রাসোদপম বাড়ী, তিনি সেই বাড়ীতে যেতে চাইতেন।
আমার ক্ষুদ্র জীবনে মায়ের সেবা করে এরকম মানুষ জীবনে দেখিনি। আমার বর তার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে মায়ের সেবা করে গেছেন। চোখে দেখেছি টানা আট বছর টরিক তার মাকে ভাত খাইয়ে দিতেন কি অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে, এটা সেটা বলে অনেক কায়দা করে তাকে খাওয়াতে হতো। সারারাত তিনি ঘুমাতেননা, আমি আমার বর সারারাত এঘর ও ঘর তার পেছন পেছন হাটছি কারো কোন ক্লান্তি নেই। দীর্ঘ চৌদ্দবছর আমরা একসাথে গলাগলি জড়াজড়ি করে থাকার পর এক সন্ধ্যায় তিনি আমার কোলের উপর থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর আমার আমার সাত বছরের ছেলে তার দাদীর কবর জেয়ারত করে এসে বললেন মাম্মি দাদু আমাকে একটা কথা বলেছে।
: কি বলেছে আব্বা ?
: বলেছে দাদু নাজুকে নিয়ে এলেনা ?
: তুমি কি বলেছো ?
: বলেছি দাদু মাম্মি খুব কাঁদবে তাই আনিনি।
শাশুড়িকে মা বলে ডাকতাম। মা, আপনি কোথায় আছেন কেমন আছেন জানিনা নিশ্চয়ই ভালো আছেন কারণ আপনার মতো দয়াবতী আমার চোখে যে পড়েনা। আমার একটি মাত্র ছেলে। যদি বেঁচে থাকি তবে আপনার মত শাশুড়ি হতে চাই মা। যে একদিন এমন করে চোখ মুছতে মুছতে কোন এক জায়গায় তার শাশুড়ীর গল্প লিখবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত