আজ ২৬ বছর ধরে শশুর বাড়ির লোকজনদের জন্য ইফতার বানাচ্ছে রেহানা । অনেক বড় পরিবারের বউ সে । অনেক দ্বায়িত্ব । ইফতার বানাতে বানাতে প্রতিদিন রান্নাঘরে থাকতে থাকতেই আজান দিয়ে দেয় । সেটাই এই বাড়ির নিয়ম । যদি কোনদিন দু’চার মিনিট আগে ভাঁজা শেষ হয়ে যায় তো শশুর সাহেব খুব রাগ করেন । ভাঁজাপোড়া জিনিস গরম গরম ছাড়া উনারা খেতে পারেন না । অবশ্য, ইফতার সার্ভ করার দ্বায়িত্ব কোন কালেই ছিলো না তার । তাই রান্নাঘরে আজান দিলেও খুব একটা অসুবিধা হয়না তার । সে দ্বায়িত্ব নেওয়ার লোকের অভাব কোনদিনই ছিলো না । আগে শাশুড়ী ননদ শশুর উনারা প্লেট রেডি করতেন আর এখন তার ছেলে মেয়ে আর দেবরের ছেলে মেয়েরা মিলে প্লেট রেডি করে । শশুর শাশুড়ী বসে বসে নাতি নাতনিদের বলে বলে দেন ।
যখন ওর বিয়ে হয়ে আসে মাত্র ১৮ বছরের একটা মেয়ে । শাশুড়ী ননদ ইফতার বেড়ে দিতেন । ওর পাতে সব প্রকার ইফতার দেওয়া হতো না । পরিবারের সদস্যদের মর্জাদার ভিত্তিতে একেক ক্যাটাগরিতে ইফতারের প্লেট রেডি করা হতো । কাজের বুয়া আর ওর ছিলো সেম ক্যাটাগরি । অনেক আফসোস আর দুক্ষ হতো তখন । বুয়ার সাথে সেম ক্যাটাগরির খাবারের জন্যে না । এত্তকিছু বুঝার মতো বুদ্ধি তখন সেই ছোট্ট মাথায় ছিলো না । দুক্ষ হতো উনি নিজের হাতে কত কি রান্না করতেন অথচ একটু চেখে দেখার সুজোগটাও পেতো না সেজন্যে । তখন অবশ্য দুই একদিন একটা আলুরচপ বা বেগুনী ভাঁজার সময় চুলার নিচে লুকিয়ে রেখে দিতো । অনেক সময় শাশুড়ীর চোখের আড়াল করে সেটা আর খাওয়া হয়ে উঠতো না । পরের দিন ময়লার ঝুড়িতে লুকিয়ে ফেলে দিতে হতো ।
কালের বিবর্তনে এখন উনার ছেলেমেয়েরা ইফতার সার্ভ করে । এখনো ওর ক্যাটাগরির ভিন্ন । এখন চাইলেই অনেককিছু খেতে পারে সে । কিন্তু শরীরে নানা সমস্যার জন্য এখন আর খাওয়া হয়না । আগের দিনগুলোর কথা মনে হলে হাসি পায় । আহারে কিন্তু, দিন কি সত্যি বদলেছে? এইতো মাত্র দু’দিন আগে । কি যে হলো সেদিন । ইফতার ভাজতে ভাজতে হঠাৎ আজান দিয়ে দিলো । এখনো বেগুনি আর পেঁয়াজু ভাঁজার বাকি । ছেলেমেয়েরা প্লেট সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো । সাথে জোগ দিলেন উনার স্বামী ও দেবর । রেহানা আর ওর জা পরিমরি করে ভাঁজতে থাকলেন । চাইলেই তো আর সব একবারে ভাঁজা সম্ভব না । দুই চুলায় যতটুকু সম্ভব ভেঁজে সবাইকে অল্প অল্প করে দিয়ে আবার ভাঁজতে লাগলো দুজন মিলে । সবাই ইফতারি নিয়ে বসে গেলো ।
রেহানার বর ও দেবর পরে গেলো বিপদে । স্ত্রীদের রেখে খেতে বসতে সংকোচ হচ্ছিলো । অথচ আজান হয়েছে অনেকক্ষণ হয়ে গেসে । বাপমায়ের ভয়ে ডাকতেও পারছে না । শরবত খেয়ে চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো রেহানার বর । বেশ উপভোগ করছিল রেহানা । তাই ইচ্ছে করেই আরো দেরি করছিলো সে । ব্যাপারটা বেশি জমলো না । শশুরের ধমক খেয়ে খেতে বসে গেলো । আহারে বেচারা । আরো একটা জিনিস আজ তার মন খারাপ করে দিলো । শশুড়ী মা সবাইকে ইফতার করানোর জন্য বারবার করে বলছিলেন । ব্যস্ত হলেন । কিন্তু একবারের জন্যেও ওকে বা ওর জাকে ডাকলেন না । একটা কাজের লোকের জন্য ও মানুষের মন খারাপ হয় । আমি কি এটুকুর যোগ্য ও নই । ভাবে সে । হায়রে জীবন । মেয়ে মানুষের সারাটা জীবন কেবল ভেবেই যেতে হয় ।
শশুর সাহেব কি খেতে পছন্দ করেন সেমতে রান্না । শাশুড়ী ঝাল খেতে পারেন না । উনার জন্যে আলাদা তরকারি । আলাদা নরম ভাত । শশুড়ী মাকে গোসল করানো । উনাদের ফ্লাস্কের জন্য গরম পানি করে দেয়া সহ আরো কত কি চাইবার আগে রেডি করে দিতে বাধ্য উনি । প্রতিবেলায় খাবারে কতজনের কত রকমের চাহিদা । সন্ধ্যায় কারো দুধ চা চিনিছাড়া কারো চিনি সহ । কেউ রংচা চিনি ছাড়া, কেউ চিনি সহ । কেউ আবার কফি । কতজনের কত রকমের চাহিদা । এসব কিছু ওদেরকে পূরন করতে হয় । বিনিময়ে সামান্য একটু মায়া কারো কাছ থেকে আশা করতে পারেনা সে ।
গল্পের বিষয়:
গল্প