একজন

একজন
বাসে উঠে একটা সীটে বসলাম। খুব গরম লাগল। আমার কাছে একটা বোবা ছেলে এসে বসল। খুব অবাক হলাম। হাতে খাতা কলম। আমি ছেলেটা কে কিছু বললাম না। আমি বললে তো সে বুঝবে না। আর সে বললেও আমি বুঝব না। তাই একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলাম। সে বারবার মেয়েটার দিকে থাকাচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম কেন?
খাতায় কি যেন লিখল। মেয়েদের পাশে দুই তিন টা ছেলেও ছিল। ছেলেদের হাতে একটা চিরকুট দিল। ছেলেরা বোবা ছেলে কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। চিরকুট টা এক অপরিচিত মহিলার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আমি চিরকুট টা হাতে নিয়ে পড়লাম। চিরকুটে লেখা ছিল ” নারীদের সম্মান করুন। অন্য নারী তোমাকে জন্ম দিয়েছে। আমি লিখাটা পড়ে একটা মুচকি হাসি দিলাম। খুব সুন্দর লিখা। সত্যি বোবা ছেলেটার প্রতি আমার খুব মায়া হলো। আমি ছেলেটা কে দাঁড় করলাম। ছেলেদের কাছে গিয়ে বললাম ” চিরকুট টা পড়। তারা পড়ল। তারা আমাকে বলল ” তাতে তোর কি? ” আমি বললাম ” তোর বোনের নাম কাজল না? ” ছেলে টা বলল ” হ্যাঁ। ” একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম ” মেয়ে টা তো প্রতিদিন কলেজে যায় না কেন যানস? তোদের জন্য। বখাটেদের জন্য। ” ছেলেটা রাগি রাগি ভাব নিয়ে বলল ” তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে দিব। “
হাতে ধরে বললাম ” তাইলে তুই অন্যর বোন কে ডিস্টার্ব করিস কিসের জন্য? তাইলে তোর বোন কে ডিস্টার্ব করলে তোর জ্বলে কেন? ” ছেলেটা বুঝতে পারল। হয়তো তার অন্যায় হয়েছে তাই চুপ করে বসে থাকল। পাশের মেয়েরা বোবা ছেলেটার দিকে চেয়ে খুশিতে হাসি দিয়ে চিরকৃতজ্ঞতা জানাল। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। অন্যের বিপদে এগিয়ে যাব। সীটে বসে একটু পানি খেতে ছিলাম। অতিথি কল দিল। অতিথি বলল ” তোমার আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে? আমি পানি খেয়ে বললাম ” দশ মিনিট। আজ আমাদের দুই টাকার ভোজন মেলা। অনেকদিন পর এটার আয়োজন করল। আমাদের প্রানের শহর। অনেকের খুব বেশি জ্বলে। কেন? আমরা তো গরীবদের পাশে আছি। তারা এসব কিছু সহ্য করতে পারে না।
তাদের কাজ হলো ঢাকা থেকে সিলেট মোটরবাইক প্রতিযোগিতা। পিছনের সীটে মেয়ে বসিয়ে অনেক স্পীডে মোটরবাইক চালানো। আমরা তো তাদের কাজে বিরক্ত করি না। তারা আমাদের কে দেখে হিংসা করে কেন? তুমি তোমার মতো চলো। আমরা আমাদের মতো চলব। কাজ ভালো হলে মুরুব্বিরা আমাদের সম্মান করবে। মায়া করবে। নিজেকে সমাজের সেবার কাজে নিয়োজিত রাখব। আল্লাহ্ খুশি হবেন। নামাজ পড়ে মেসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মেসের ভিতর যেতেই আবির ভাই মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। আমি চিমটি দিয়ে বললাম ” ভাই আপনি কি পাগল মানুষ হয়ে গেছেন? এই রকম করে হাসেন কেন ? ভাই আমাকে হাতে ধরে চেয়ারে বসিয়ে বলেন ” আমাদের পরিবারের একটা গাড়ি ছিল। বাবা মা মারা যাওয়ার পর সেটা আমার হয়ে যায়। কিন্তু আমার চাচা আমাকে ভয় দেখিয়ে নিজের নামে করে নেয়। আমিও খুব অসহায় ছিলাম। আমি আল্লাহ্ কাছে বিচার দিয়েছিলাম। আজ শুনলাম গাড়ি টা নাকি আগুন লেগে একদম পুড়ে গেছে। “
আমি বললাম ” ভাই আল্লাহ্ কাছে অন্যায়কারীরা ছাড় পাবে না। তারা শাস্তি পাবে। ভাই ব্যাগ থেকে একটা শার্ট বের করে বলেন ” এটা তোর ভাবি দিয়েছে। আমার জন্য কিনেছিল? সুন্দর তো? ” আমি শার্ট টা হাতিয়ে বললাম ” ভাই খুব সুন্দর। খুব দামী।  ভাই হাসি দিয়ে বললেন ” আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। ” তারপর দু’জন ভাত খেতে রান্নাঘরে চলে গেলাম। ভালো লাগছিল না তাই একটু ঘুরতে বের হলাম। আবির ভাইয়ের বোন কে দেখতে পেলাম। চাচাতো বোন। কি যেন কিনার জন্য একটা দোকানে ঢুকলেন। আমি চুপচাপ না দেখার ভাণ করে চলে গেলাম। এরা খুব স্বার্থপর। একটা টাকাও দান করে না। অতিথি কল দিয়ে বলল ” চত্বর আসতে। আমি সেখানে গেলাম। অতিথি চুপ করে বসে আছে। কোনো কথা বলছে না। আমি বললাম ” মন খারাপ কেন? ” অতিথি বলল ” আমার একটা কথা আছে। আমি তোমার সাথে রিলেশনশিপ রাখতে পারব না। “
আমার মুখ টা একদম কালো হয়ে গেল। কেন জানতে চাই নি। নিজে কে একটু শক্ত করে বললাম। তুমি যে রকম ছেলে চাও হয়তো আমি সে রকম ছেলে না। তাই আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও না। আমি তোমাকে জোর করব না। আমি তোমার জন্য দোয়া করলাম তুমি যেন তোমার মনের মতো একটা ভালো ছেলে পাও। ” চলে আসলাম। চোখ থেকে পানি পড়ছে। তবুও নিজে কে বললাম ” চোখের মধ্যে বালু পড়ছে তাই চোখ থেকে পানি পড়ছে।  খুব অসহায় লাগছে। কি করব কিছুই ভালো লাগছে না। একটু ভাবলাম। মেয়েটা হয়তো আমার জন্য ছিল না তাই চলে গেছে। তাই মনে মনে ঠিক করলাম লেখাপড়া ভালো মতো করব। আজ তিন বছর হলো। কোনো রিলেশনশিপ অন্য কারো সাথে করে নি। লেখাপড়া শেষ করলাম। একটা জব করি। রাস্তায় একটা পরিচিতি মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম। মেয়েটার মুখ টা দেখে চিনতে পারলাম। মেয়েটা আর কেউ না। অতিথি।
আমি অতিথি বলে একটা ডাক দিলাম। অতিথি এমন ভাব করল আমি যেমন অপরিচিত মানুষ। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অতিথি আমার দিকে চেয়ে নিজের ঠোঁট টা হালকা ভেঙ্গে দিল। বুঝতে পারছি অতিথি আমাকে দেখে লজ্জা পাইছে। লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমি বললাম ” তিন বছর পর দেখা হলো। কেমন আছো? ” অতিথি কি রকম অস্থিরতা অনুভব করল। আমি বুঝতে পারলাম। হয়তো আমাকে সহ্য করতে পারতাছে না। তাই চলে আসতে লাগলাম। অতিথি ডাক দিয়ে বলল ” তুমি এতো শরল সোজা কেন? আমার প্রতি তোমার কোনো ঘৃণা নাই? তুমি আসলেই একটা নির্লজ্জ মানুষ। আমি মাটির দিকে চেয়ে একটা হালকা হাসি দিয়ে বললাম ” ভালোবাসার মানুষের প্রতি কোনো ঘৃণা নাই। অতিথি একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। আমি বসলাম। অতিথির কোলে একটা বাচ্চা শিশু। আমি বললাম ” বাবু টা কি তোমার বাচ্চা? ” অতিথি বাবুটার দিকে চেয়ে বলল ” হয়। ৮ মাস হয়েছে। “
আমার কোলে আসার জন্য চটপট করতে লাগল। অতিথি হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমি বললাম ” বাবু টা আমার কোলে আসতে চায়। অতিথি চুপ হয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। বাবুটাও আমাকে দেখছে। আমি বললাম ” বাবু টার বাবা কোথায়? ” অতিথি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ” অন্য মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার করে। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। তাই আবার বললাম ” আমি কিছু বুঝতে পারে নি? ” অতিথি বাবু টার হাত ধরে বলল ” ইমন একটা ব্যবসা করত। একটু বেশি টাকার। সাগরের মাঝে দিয়ে মাল সরবরাহ করত। কিন্তু একদিন জাহাজ টা ডুবে যায়। অনেক লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়। আমাদের পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আমার উপর অত্যাচার করতে শুরু করে।
আমাকে সময়ে অসময়ে মারত। তখন আমার কোলে বাবু আসে। এরপরও আমাকে মারত। তারপর ইমন আরেক টা বিয়ে করে। সে মেয়ে ইমন কে অনেক টাকা দেয়। তারপর ইমন আবার ব্যবসা শুরু করে। আমাকে ডিবোর্স দিয়ে দেয়। ” আমি কিছু বললাম না চুপ করে বসে থাকলাম। অতিথি বলল ” আমি তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই হয়তো আমিও কষ্ট পেয়েছি। তোমাকে একা করে রেখে চলে গেলাম। স্বার্থপর মেয়ের মতো করে। তুমি বিয়ে করো নি? ” চোখ টা বন্ধ করে আবার চোখ টা মেলে বললাম ” মা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতাছেন।  অতিথি অবাক হয়ে বলল ” রিলেশনশিপ করো নি? ” আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম ” তোমাকে তো ভুলতেই পারি নি। তাইলে অন্য একটা মেয়ে কে মনের মধ্যে কি করে জায়গা দিব। ” অতিথি মায়াবী চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকল। চুপ করে আছি দু’জন।
একজন রোগীকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। অপারেশন হয়েছে। আমার বন্ধুর মা। হাসপাতালের খরচ ও চিকিৎসার খরচ এসেছে ৫ লক্ষ টাকার মতো। বন্ধু টা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এতো টাকা সে পাবে কোথায়। আমাদের কাছে একজন নার্স একটা চিরকুট দিয়ে গেল। আমরা খুব অবাক হলাম। চিরকুট কিসের? চিরকুট টা খুলে দেখলাম। ম্যাডাম আমি আপনার ফাজি ছাত্র টা আজ বড় ডাক্তার। চাচিম্মা চিরকুট টা পড়লেন। চাচিম্মা একজন শিক্ষিকা ছিলেন। চিরকুটে লেখা ছিল আপনি যে আমাকে শয়তানি জন্য মারতেন তারজন্য আপনার পেট কেটে দিলাম। তারপর সেলাই করলাম। এখন বুঝবেন মজা। প্রতিশোধ নিলাম। আমার জন্য দোয়া করবেন।
আপনার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। হয়তো কোনদিনও হবে না। ভালো থাকবেন। আপনার ফাজি ছাত্র।  চাচিম্মা অনেক কান্না করলেন। মানুষ কে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসতে পারে। একটা গাছের দিকে চেয়ে আছি। গাছ টা আমার খুব পরিচিত গাছ। গাছের গায়ে কি কি আছে তা বলে দিতে পারব। প্রতিদিন এখানে এসে অতিথির জন্য অপেক্ষা করতাম। আজ অন্য একজন মানুষ অপেক্ষা করতাছে। আসলে আমরা শুধু অপেক্ষা করি। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা না করে তাকতে পারবে না হয়তো এটাই নিয়ম। আমরা তো অবুঝ তাই বলতে পারব না। জানার ইচ্ছাও আর জাগে না। একটা রিক্সায় উঠে মামা কে বললাম ” চত্বর যান। “
রিক্সার সামনে অতিথি একটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বুঝতে পারছি আমার সাথে কথা বলবে। রিক্সা থেকে নেমে আসলাম। অতিথি গাড়ির ভিতর থেকে বলল ” গাড়িতে উঠো। ” রিক্সা মামা কে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম। চুপ করে বসে থাকলাম। এখন খুব কম কথা বলি। মায়া জিনিষ মন থেকে একেবারে দূর করে দিয়েছি। মনের মধ্যে মায়া থাকতে নেই। মায়া নামক শব্দ টা অনেক কাঁদায়। একটা শপিং মহলে ঢুকলাম। অতিথি আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সব কাপড়চোপড় কিনল। জানতে চাই নি কেন এসব কিনতে চায়। অতিথি আগ থেকে অনেক খুশি কিন্তু কেন তাও জানি না।
অতিথি বলল ” তোমার এসব পছন্দ হয়েছে? ” আমি কোনো উত্তর দিলাম না। অতিথি কে বিদায় জানিয়ে হাঁটতে লাগলাম। মা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করেছেন। মা যার সাথে বিয়ে দিবেন থাকে বিয়ে করব। মা অতিথির কথা আমাকে জিজ্ঞাস করছিলেন। আমি বললাম ” অতিথি সব ঘটনার কথা। ” মা কিসের জন্য খুশি হয়েছিলেন সঠিক করে বলতে পারব না। মায়ের মুখে একটু হাসির ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। আমার কোনো ইচ্ছে নাই। আমার আশা নাই। স্বপ্ন নাই।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত