বিয়েটা হবে না।’ আসিফ বললো। শুধু এটুকু নয়, সাথে আরেকটা কথাও বললো।’কালো মেয়েকে কোনদিন আমি বিয়ে করবো না।মরে গেলেও না। আমার বাপ টাকার লোভে এটা করতে চেয়েছিল।সরি, আপনার কাছে মাপ চাইছি আমি।কষ্ট নিবেন না মনে।বাই।’
তারপর আমি কোন টু শব্দ করার আগেই কুট করে ও পাশ থেকে লাইনটা কেটে দিলো আসিফ। আমি কোন কথা বলার সুযোগ পেলাম না। আমার মাথা প্রচন্ড রকম খারাপ হয়ে গেল। পায়ের নিচের মাটি কেমন সরে যেতে লাগলো দূরে। হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনিতে আমার হাত পর্যন্ত কেঁপে উঠলো।হাত থেকে ঝট করে মোবাইল টা ছিটকে পড়লো ফ্লোরে। তখনও আমার হাতে আংটি আছে। জানলার ফাঁক গলে ভোর সকালের আলো পড়ে সেই হেম রঙা আংটি চিকচিক করে জ্বলছে।ফ্লোরে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনের দিকে না তাকিয়ে আমি তাকালাম আংটিখানার দিকে। এই আংটিখানা ওরা দিয়ে গিয়েছিল গত সপ্তাহে।মহা সমারোহে বাড়িতে আয়োজন করে দশজন মেহমানকে খাওয়ানো হলো। তারপর আমার হবু শশুর বিয়ে ঠিক করে গেলেন। শাশুড়ি আমার হাতে এই আংটিখানা পড়িয়ে দিয়ে বললেন,’লক্ষ্মী মেয়ে আমার!’
আসিফের সাথেও সেদিন কথা হয়েছিলো আমার। বাড়ির মুরুব্বিরা পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলেন আমাদের কথা বলার জন্য। আমরা ছাদে গিয়ে কথা বলেছিলাম। আসিফকে আমার পছন্দ হয়েছিল।ও দেখতে ভালো।কর্মও ভালো। কিন্তু আমার গায়ের রং যে কালো! আমি বলেছিলাম,’আপনি একটু ভালো করে ভাবুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন।’ আসিফ গাঢ় হেসে বলেছিলো,’বাবা মার উপর আমার আর কোনো কথা নেই। তাদের পছন্দই আমার সই।’ সেদিন এসব বলে আজ যখন বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিকঠাক, আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী সকলকে দাওয়াত করা হয়ে গেলো তখন এমন একটা সংবাদ কেন দিলো আসিফ? হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। দম কেমন আটকে যেতে লাগলো। আম্মা উঠোনে মরিচ শুকোতে দিয়েছেন। আব্বা বারান্দায় বসে রবিনকে অংক পড়াচ্ছেন। আমি কী এখন এই কথাটা তাদের কাছে বলবো?
বলতে পারলাম না আমি। এমন কথা যে খুব লজ্জার হয়! লজ্জা এবং ঘৃণায় চোখ ফেটে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো আমার গালের উপর। আমি সেই জল আটকাতে পারলাম না কিছুতেই। বিছানার উপর বসে চাপা স্বরে কাঁদতে থাকলাম শুধু। ঠিক তখন হঠাৎ করে মনে হলো, আচ্ছা,আমি শুধু শুধু এমন করছি কেন? আসিফ আমার সাথে মজাও তো করতে পারে! আমি ফ্লোর থেকে ফোনটা উঠিয়ে কল করলাম আসিফকে। এবার আর আসিফ ফোন ধরলো না।ফোন ধরলো তার মা।বললো,’মাগো, ভুল হয়ে গেছে আমাদের। আমাদের ছেলে তোমাকে পছন্দ করেনি।
তাছাড়া আমরাও সেদিন তোমায় খুব ভালো করে দেখতে পারিনি। তুমি আরেকটু ফর্সা হলেও ভাবা যেতো। আমাদের ক্ষমা করো মা।’ এবার আর ওপাশ থেকে কেউ ফোনকল কাটলো না। কাটলাম আমি নিজেই। ততক্ষণে আমার কান্নার গলা অনেকটাই বেড়ে গেছে। আব্বা এবং আম্মা এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন আমার। আম্মা বললেন,’কী হয়ছে বৃষ্টি,কী হয়ছে মা,কী হয়ছে তোমার?’ আব্বাও এসে বসেছেন পাশে।জানতে চেয়েছেন তিনিও। আমি কথা বলতে পারি না কান্নার দাপটে। লজ্জায় কেমন মরে যেতে ইচ্ছে হয় হঠাৎ। আম্মার হাতে ফোনটা তুলে দেই আমি। আম্মা কল করেন আসিফদের বাড়ি।আব্বাও কথা বলেন।গালাগালি হয়ে যায় একছুট দু পাশ থেকেই। কিন্তু তাতে কী? বিয়ে তো আর হবেই না এটা। প্রায় হয়ে যাওয়া একটি বিয়ে হুট করেই ভেঙে গেল।
এইসব খবর চাপা থাকে না। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে যায় মুহূর্তে। আমার এই অপমানের খবরটাও ছড়িয়ে যেতে দেরি হয়নি। মানুষের মুখে মুখে তখন শুধু আমার নামই খৈয়ের মতন ফুটতে থাকে।তারা একে অপরের কানে বাড়িয়েও কত কথা বলে! ওইসব কথা আবার আমার কানেও আসে। তখন প্রচন্ড মন খারাপ লাগে আমার।দুনিয়াটা কেমন দোযখ মনে হয়। স্বচ্ছ আয়নার ভেতর তাকাই আমি। তাকিয়ে আমার এই বিকৃত চেহারা এবং গায়ের রংটাকে খুব ভালো করে পরখ করে দেখি। তারপর বড় উপহাস করতে থাকি নিজেকে নিয়ে।মরে যেতে ইচ্ছে করে হঠাৎ আমার। কিন্তু মরে যাইনি আমি। আম্মা কাছে এসে সান্ত্বনা দেন। বলেন ধৈর্য ধরতে। ধৈর্যের ফল নাকি শুভ হয়।ধৈর্য্যই ধরেছিলাম আমি। ধৈর্যের ফল আমার খারাপ হয়নি। গাঁয়ের মানুষ ভেবেছিলো গায়ের রং আর ওই অপমানের জন্য আব্বা- আম্মা আমায় আর বিয়ে দিতে পারবেন না কখনো।
কিন্তু কপালে ভালো কিছু থাকলে তা কী করে কেউ ফেরাতে পারবে? এবার আমার বিয়ে হয়ে গেলো আসিফের চেয়েও সুন্দর এবং যোগ্যবান ছেলের সাথে। যদিও আমি সুন্দর কোন ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু আদনান নামের ওই ছেলেটা আমার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। কেন লেগেছিল আমি তখন জানতাম না। কিন্তু বিয়ের পর জেনেছি সে নাকি মানুষের কাছে আমার গুণের কথা শুনেছিলো।গুণ বলতে এটুকুই আমি ভালো গান জানি। মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে পারি ভৌতিক গল্প বলে। তার নাকি ঠিক এমন মেয়েই চায়। রাতভর তাকে গান শুনাবে এবং ভৌতিক গল্প বলে ভয় পাইয়ে দিবে এমন! আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মানুষ বড় অবাক হয়ে গেল। কিন্তু আমি খুব একটা অবাক হইনি এতে। আমি বিশ্বাস করতাম বাস্তবতার চেয়েও বেশি কপালের লিখনিখে।তাই অবাক হয়ে যাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনি আমি।
আদনানের সাথে খুব ভালো সময়ই কাটছিলো আমার। অসম্ভব ভালো মনের মানুষ সে।গান গেয়ে কতবার তাকে মুগ্ধ করেছি আমি আর কতরাতে যে ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি ভৌতিক গল্প বলে তার কী আর হিসেব আছে! এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল আমাদের। একদিন হঠাৎ করে আদনানকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম ওর এক অসুস্থ খালাকে দেখতে। খালার অপারেশন হয়েছিল।হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসার সময় হাসপিটালের গেটে হঠাৎ একটা মুখ দেখে থমকে দাঁড়ালাম আমি। লোকটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি।ওর কোলে একটা দু’তিন বছরের বাচ্চা।মেয়ে বাচ্চা। গায়ের রং কালো। আমার চেয়েও কালো।বাচ্চাটা কার আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা আসিফকে ডেকে উঠলো,’পাপ্পা,পাপ্পা।’
ততক্ষণে আমি খুব ভালো করে বুঝে গেছি এই মেয়ে আসিফেরই। আমার খুব কষ্ট লাগলো হঠাৎ এই ভেবে যে আসিফের এই কালো মেয়েটাও কী আমার মতো এমন পরিস্থিতির শিকার হবে না একদিন? তারও কী কোনদিন এই গায়ের কালো রঙটার জন্য বিয়ে ভেঙে যেতে পারে না? আচ্ছা তখন কী আসিফের একটুও কষ্ট হবে না? আসিফের কী মনে পড়বে না সেও এমন করে শুধু গায়ের রংটার জন্যই একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলো? অপমান করেছিল?তার কী সেদিন খুব অপমান হবে না? ভাবলাম আমি। ভাবলাম, গায়ের রং ছেড়ে কখন মানুষ মানুষের ভেতর টুকু দেখতে শুরু করবে। কখন পৃথিবীর সব মানুষেরা আসিফ থেকে আদনান হয়ে উঠবে!
গল্পের বিষয়:
গল্প