বেগুনিতে আর বুটে লবন কম হওয়ায় ইফতারি নিচে ছুড়ে ফেলে দিলেন আফতাব সাহেব।তার ১১বছরের মেয়েটি চোখে হাজারো আত্নঘাতি প্রশ্ন আর ভয় নিয়ে মায়ের কাপড়ের আচঁল টা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে নেয়।তারপর আফতাব সাহেব উঠে দাড়িয়ে তার স্ত্রীকে আংগুল তুলে বললেন বাইরে সব কিছু বন্ধ না হলে তোরে আজকে দেখাইতাম।সারাদিন কি কাজ টা ঠিকমত করিস যে খাবারের দিকে ঠিকমত খেয়াল থাকেনা।এতবছর রান্না করেও কি রান্নার প্রতি আইডিয়া নাই।বাজে মেয়ে ছেলে কোথাকার।জীবনটা বরবাদ হয়ে গেলো তোকে বিয়ে করে।একবার সব ঠিক হোক তারপর এই বাড়ির ভাত তোর কপাল থেকে উঠে যাবে। উক্ত কথা গুলি বলে আফতাব সাহেব বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।সম্ভবত নামায পড়তে অন্যরুমে গিয়েছে।
ফ্লোর থেকে ফেলে দেওয়া ইফতারি গুলি তুলে, ধুয়ে মুছে সব পরিষ্কার করলেন রুবিনা আক্তার।নামায টা সেরে আবারো ইফতারি হাতে স্বামীর কাছে গিয়ে অনুনয়ের সুরে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন।কাল থেকে সব ঠিক মত করবো।দয়া করে খেয়ে নিন।সারাদিন উপোস ছিলেন। কিছুক্ষন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খেয়ে নিলেন।কিন্তু তার অন্তরালে তার স্ত্রীর আর ইফতার করা হলোনা। সামনের রুমে আফতাব সাহেব টিভিতে খবর দেখছিলেন।এটো বাসন গুলি কিচেনে পরিষ্কার করছিলেন রুবিনা আক্তার।তার মেয়ে তারপাশে এসে দাড়ালো।কিছুক্ষন চুপ থেকে সে তার মাকে বললো মা , তুমি কিছু খাবেনা?তুমিও তো রোজা ছিলে।সারাদিন কত কাজ করেছিলে,খেয়ে নাও।
নিজের মধ্যে চেপে রাখা সব অভিমান যেনো কলিজা ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে রুবিনা আক্তারের।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ ভাবে কাদঁতে লাগলেন।আওয়াজ তো করা যাবেনা।লোকে কি ভাববে। রাতে খাবার বেড়ে দিয়ে টেবিলের পাশেই রুবিনা আক্তার দাড়িয়ে আছে স্বামির মুখের দিকে তাকিয়ে। কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই বলে উঠলেন এর চেয়ে তো না খেয়ে থাকাই ভালো।হাতে কি রস কস নেই নাকি।স্বাদ এমন কেনো তরকারির।তুমি কি ইচ্ছে করেই এমন নাটক করছো নাকি আমার সাথে।আমি যদি এইভাবে আরো কয়েক মাস ঘরেই থাকি তাহলে তো মনে হয় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে।
এই বলে উঠে চলে গেলেন।রুবিনা আক্তারের রাগ হয়না কারন গত ১৫বছরের সংসার।অভ্যাস হয়ে গেছে এখন।তবে সবার ই সহ্যের একটা সীমা থাকে। এভাবেই রোজ চলতে থাকে টুকটাক ঝামেলা আর কথা বাড়াবাড়ি। দেশের নামকরা ব্যাংকে মোটা অংকের বেতনে চাকরি করেন আফতাব সাহেব।নাম,পতিপত্তি সব ই আছে উনার।এস এস সি পাশ করার পরেই রুবিনার বাবা ওর বিয়ে দিয়ে দেয়।শুধু মেয়ের হাতে হাত রেখে বলেছিলেন আমার মুখে কখনো চুনকালি মাখিস না।কোন দিন যেনো তোর জন্য (শালিস)বিচার নিয়ে যেতে না হয়। সেই থেকেই চুপ সে।আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল সম্মান আর অঘাত শ্রদ্ধা তার স্বামীর প্রতি।
ঘরমোছা থেকে শুরু করে প্রতিটা কাজের খুত ধরতে শুরু করেন আফতান সাহেব।উনি কেনো এমন করছেন উনি নিজেই জানেন না।মাঝে মাঝেই অনুশোচনা হয় ওনার।কিন্তু স্ত্রীকে সর্যি বললে নিজের মান ক্ষুন্ন হবে বিধায় বলা হয়ে উঠেনি। এক দিন ২দিন করে ৫টা রোজা চলে গেলো। আজও একই অভিযোগ তার খাবারে স্বাদ আসেনি।খাবার ছুড়ে ফেলার আগেই তার ১১বছরের মেয়েটি তার হাত ধরে ফেলে। হঠাত মেয়ের এমন আচরনে রুবিনা আক্তার ও অবাক হয়ে যায়।আর মেয়েকে টেনে নিজের কাছে আনতে চায়।কিন্তু মেয়ে তার বাবার মতই রক্তবর্ন চোখ নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে রান্নার ব্যাপারে যখন তোমার এতই অভিযোগ তাহলে কাল থেকে রান্না তুমি করবে।শুধু রান্না নয় তোমার যতগুলি কাজে অভিযোগ থাকবে ততগুলি কাজই তুমি করবে।এই পুরো লক ডাউনে তুমি আমাকে আর মাকে শিখাবে কিভাবে কাজ করতে হয়।আমি মেয়ে হয়েও আমার ঘৃন্না ধরে গেছে এসব শুনতে শুনতে জানিনা মায়ের কেমন লাগে।রমজানের মানে এটা নয় তুমি একাই উপাস রয়েছো।মাও রোজা রাখে। তাহলে খাবারের নুন কিভাবে সে পরিমান মত দিবে।আর হ্যা লক ডাউনে আসার ক’দিন আগেই না তোমার বস তোমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে ঠিকমত কাজ না করলে চাকরি চলে যাবে বলে।তুমিও তো আজ ১৮বছর ধরে চাকরি করছো তাহলে তোমার কেনো ভুল হয়।আর হ্যা মা আমার কসম দিলাম যদি তুমি ঘরের একটা কাজে হাত লাগাও।কি ভেবেছো তুমি লকডাউন চলছে তায় না।এই লক ডাউনেই আমি মাকে নিয়ে চলে যাবো নানুর বাড়িতে।থাকো তুমি তোমার ধাম্বিকতা নিয়ে।
মেয়ে চলে যাওয়ার পরেও আফতাব সাহেবের কানে তার মেয়ের কথা গুলিই বাজতে লাগলো।রুবিনা আক্তার তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও ছোট মানুষ। কিইবা আর বুঝে।ওকে মাফ করে দিন। রুবিনা আক্তার মেয়ের কাছে চলে গেলেন। মুহুর্তেই যেনো আফতাব সাহেবের ধাম্বিকতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।নিজেকে নিজের অপরাধী মনে হতে লাগলো।চুপচাপ টেবিলে রাখা বাকি খাবার গুলি খেয়ে নিলেন,,কি মনে করে যেনো নিজের এটো প্লেট টাও নিজেই ধুয়ে ফেললেন। পরের দিন সকালে উঠে আফতাব সাহেব ঘর ঝাড়ু দিলেন,ঘর মুছলেন,কাপড়-ছোপড় গুছিয়ে রাখলেন।স্ত্রী আর মেয়ে উঠার আগেই উনি সব কাজ শেষ করে ফেললেন।
স্ত্রী আর মেয়ে উঠতেই তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো আজ কি রান্না করবে।তার প্রশ্ন শুনে আর ঘরের সব কাজ করা দেখে মা আর মেয়ে দুজনেই অবাক হয়ে যায়।মেয়েটা ঝাপটে ধরে তার বাবাকে আর বলে, পারফেক্ট পাপ্পা।লাভ ইউ। থাক!থাক! আমি ও দেখিয়ে দিবো আমি সব কাজ পারি।আপনারা চলে গেলে আমি একাই রান্না করতে পারবো। তায় ঠিক আছে আজ ই তোমার পরিক্ষা। আফতাব সাহেব যোহরের নামায পড়ে রান্না ঘরে ডুকে। রুবিনা আক্তার ডুকতে চাইলেও উনি ডুকতে দেয়নি।
নাকের পানি চোখের পানি এক করে তিনি সব রান্না শেষ করলেন। ইফতারির সময় রুবিনা বেগম আর তার মেয়ে চুপচাপ খেতে লাগলেন।মুখে কিছু না বললেও আফতাব সাহেবের চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।তারা কিছু বলছেনা দেখে নিজেই খাবার মুখে তুললেন।বেগুনিতে খুবই ঝাল,তারউপর বেগুনি ফুলেনি,বেসন ঠিক মত গুলা হয়নি তার বেগুনে মেশেনি ভালো করে যার জন্য বেগুন বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিলো।পেয়াজু তেলে দিতেই সব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো,,বাটা হয় নি ঠিক মত,তায় এমন হয়েছে,,বুট গুলি সিদ্ধই হয়নি।এতই শক্ত যে খাওয়া কষ্ট সাধ্য। বেচারা নিজেই চুপ হয়ে গেছে।রুবিনা আক্তার কিছু না বললেও, তার মেয়ে ঠিক ই হোহো করে হেসে উঠলো।রাতে রান্নার ও একই অবস্থা।আফতাব সাহেব উপলব্ধি করলেন উনি ভাবতেন তার স্ত্রীর কাজ অত্যান্ত সহজ।এগুলা কোন কাজের আওতায় ই পড়েনা তার কাজের কাছে।কিন্তু আজ তার মেয়ে তাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দিলো।তিনি নিজেকে বদলাতে প্রস্তুত হলেন।
রাতে মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে তারাও শুয়ে পড়লো।মাঝরাত,মোয়াজ্জেম মসজিদ থেকে বার বার সেহেরি খাওয়ার জন্য ডাকতে লাগলেন।প্রতিদিন রুবিনা আক্তার ডাকলেও আজ সে ডাকছেনা দেখে আফতাব সাহেব নিজেই তাকে ডাকতে লাগলেন।তবুও তার সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিতেই অনুভব করলেন শরীর ঠান্ডা।কয়েকবার ঝাঁকানি দেওয়া সত্ত্বেও তার কোন চেতন হয়নি। এক অজানা ভয় আফতাব সাহেব কে ঘিরে ধরলো।নাকের সামনে হাত দিয়েও সে কিছুই বুঝতে পারলোনা।এক মুহুর্তের জন্য তার জ্ঞান -বুদ্ধি লোপ পায়।সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে কিছু বলতে পারেনা।কিছুক্ষন পরেই তার চিতকারে তার মেয়ে তাদের রুমে আসে। আফতাব সাহেব তার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে মামনি তোর আম্মু উঠছেনা কেনো।তোর আম্মুকে ডাক।সেহেরির সময় হয়ে গেছে।
মেয়ে পাশে এসে ডাকার পরেও রুবিনা বেগমের কোন সাড়া শব্দ নেই।দুজনেই বুঝতে পারে রুবিনা বেগম আর নেই।আফতাব সাহেব চিতকার করে কাদঁতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন উঠো রুবিনা,আমার যে তোমার কাছে মাফ চাওয়া বাকি আছে।আমায় মাফ করো।উঠো তুমি,আমি আর কখনো তোমাদের কষ্ট দিবোনা।আমার ভুল হয়ে গেছে উঠো।তুমি এত বড় বেইমানি করতে পারোনা আমার সাথে। আফতাব সাহেব পুরো ঘরের দিকে তাকিয়ে বললো তোমাকে ছাড়া এই ঘর অপুর্ন উঠো তুমি।আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবোনা।উঠো তুমি,,,,,,,উঠো আফতাব সাহেব হকচকিয়ে উঠে গেলেন।পাশেই তার স্ত্রী রুবিনা তাকে ডাকছে।মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জেম সেহেরির জন্য ডাকছে।উনি বুঝতে পারলেন উনি স্বপ্ন দেখছিলেন।স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেই কাদঁতে লাগলেন।স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হলেন। পরেরদিন আফতাব সাহেব তার মেয়ে আর রুবিনা বেগম তিনজন একসাথে ঘরের সব কাজ শেষ করলেন।
আমরা এমন পরিবারের ই প্রত্যাশি।যেখানে থাকবে ভালোবাসায় ঘিরা স্পর্শময়ী ছোয়া।রোজা মানেই উপাস থাকা নয়।দেহের সাথে সাথে মনের আত্নশুদ্ধি ও প্রয়োজন। আমাদের নিজেদের ছোট ছোট বদঅভ্যাস গুলি পরিবর্তন করা উচিত।নিজেদের প্রকৃত মুসলমান করে গড়ে তোলা উচিত।রমজানুল মুবারাক সবাইকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প