পরিণাম

পরিণাম
অভি ইদানীং প্রায়ই মধ্যরাত করে বাসায় ফেরে। বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত তাঁকে ফোনেও পাওয়া যায় না তেমন। ‘অফিসে কাজের অনেক চাপ যাচ্ছে তাই ব্যস্ত ছিলাম’ বাসায় ফেরার পরে এটাই তাঁর নিয়মিত অজুহাত। আমি খুব ভালো করেই টের পাচ্ছি কিছু একটা ঠিক নেই। বাসায় অভি যতক্ষণ থাকে যদিও বোঝাই সম্ভব নয় ওর ভেতরে কিছু একটা চলছে।
আগে খাবার টেবিলে রাতের খাবার নিয়ে অভির ফেরার অপেক্ষা করতাম। অভি ফিরলে একসঙ্গে খেতে বসতাম। খাবার টেবিলে খেতে খেতে জমে উঠতো আমাদের গল্প, প্রেম, খুনসুটি আর ভালোবাসা। এখন আর অপেক্ষা করি না। অভির বারনেই আস্তে আস্তে বাদ দিয়েছি অপেক্ষা করা। খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে খাবার টেবিলেই ঘুমিয়ে যেতাম। অভি ফিরলে শুনতাম তাঁর খিদে নেই, খেয়ে এসেছে। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হত, পরে মনকে বুঝিয়েছি সময় সবসময় একরকম যায় না। অভ্যাস করে নিতে হবে সব। অভ্যাস করে নিয়েছি এখন একা খাওয়ার। সকালের নাস্তাটাও এখন তেমন একটা বাসায় করে না অভি। আর দুপুরের খাবার তো শুরু থেকেই বাহিরে খায়।
অভির সাথে বিয়ে হয়েছে সাড়ে তিন বছর হলো।
এই সাড়ে তিনবছরে ওর এরকম পরিবর্তন আমার চোখে পরে নি। আমি না চাইলেও আমার জন্য সময় বের করার জন্য যে মানুষটা পাগল ছিলো, আজ সেই মানুষটার কাছে আমি চেয়েও সময় পাইনা। এখন যতটুকু সময় অভি আমার সাথে থাকেও, আমার মনে হয় অভি আমার সাথে থেকেও কেন যেন আমার কাছে নেই। অন্য কোথায়ও ডুবে আছে৷ ওর উদাসীনতার জন্য অনেক প্রশ্ন করেছি কিন্তু কোনো যুক্তিযুক্ত উত্তর পাই নি। সেদিন অভির কাছে বসে ওর ডান হাতের আঙুলগুলোর মাঝে আমার আঙুল গুঁজে দিয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার দু’চোখ ভরা ভালোবাসা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছো তোমার অভি? সত্যি করে বলো। আমি একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি তোমার মাঝে৷ কিছু একটা হয়েছে। আমায় বলো দয়া করে কি হয়েছে?’ অভি বাঁকা হাসি হেসে আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। আর আমার নিরুত্তর প্রশ্নগুলো আরও শক্ত হলো।
আজও অভি মধ্যরাত করে বাসায় ফিরলো। খুব ক্লান্ত ছিলো যার কারনে বিছানায় গা এলাতেই ঘুমে তলিয়ে গেলো। অভির ঘুমন্ত মুখটা আমায় খুব টানে। মায়াময় মুখটা আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে দেখি। আলতো করে কখনও ছুঁয়ে দেই। ছোট্ট করে চুমো খাই কখনও গালে, কখনও ঠোঁটের কোণে। আগে ঘুমের মধ্যে স্পর্শ করলেই অভি বুঝতে পারতো। এক রাজ্যের দুষ্টুমি নিয়ে আমাকে জাপটে ধরতো, বিছানার সাথে চেপে ধরতো। পালানোর মিথ্যা অপচেষ্টা চালাতাম তাতে করে আদরগুলো আরও গাঢ় হত। ইদানীং অভি আমার ছোট্ট চুমোগুলোও টের পায় না, টের পায়না আমার দীর্ঘশ্বাস। অভির চুলের মধ্যে আমার আঙুলগুলো চিরুনি করে দিলাম। ওর চুলগুলোর ভেতরটা ভেজা ভেজা মনে হলো। কিন্তু এত রাতে চুল ভেজা থাকার প্রশ্নই আসে না। হয়তো আমার ভুল। আমি ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন টের পাইনি৷
অভির যখন ঘুম না আসে আমি তখন ওর চুলে আমার আঙুলগুলো চিরুনী করে দেই। এটা নাকি ওর ছোটবেলার ঘুম পাড়ানি গানের মত কাজ করে। ও ঘুমিয়ে গেলে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কখনও বুকের ভেতর মাথাটা গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে যাই। মাঝে মাঝে অভি বালিশ থেকে তুলে ওর বুকের উপরটাতে আমার মাথাটা রাখতো, কপালে আলতো করে দুই ঠোঁটের আদর দিত তারপর ঘুমিয়ে যেত। আমি টের পেতাম কিন্তু টের না পাওয়ার বাহানা করতাম। এখন এইসব ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসা আর আদরগুলো খুব মনে পড়ে, অভি যেন দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। বাচ্চা নিলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে এই ভরষায় বাচ্চা নেওয়ার কথা তুলেছিলাম অভির কাছে। কিন্তু অভি স্পষ্ট জানিয়ে দিলো এখন সে এসবের জন্য প্রস্তুত না৷ তাঁর সময় চাই আরও। মা ইদানীং ফোন করে বাচ্চা গাচ্চার কথা তুলছেন। এদিকে অভির বাবা-মাও আকার ইঙ্গিত দিচ্ছেন বাচ্চা নেওয়ার বিষয়ে৷ আজ ভাবছি অভি বাসায় ফিরলে আবার বলবো। একমাস তো হয়ে গেলো এখন বললে হয়তো রাজি হতে পারে। অভি বাসায় ফিরে ঘুমোতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময় ওর কাছে গিয়ে আদর মাখা গলায় বললাম, ‘এই শোনো না?’
‘বলো’ ‘তোমার মেজাজ ঠিকঠাক? ‘ শান্ত গলায় উত্তর দিলো, ‘হুম ঠিকঠাক। কি বলবে বলো, মেজাজের দরকার নাই।’ ‘শোনোনা সবাই বলছিলো যে আমাদের এখনই সিদ্ধান্তটা নেওয়া উচিৎ।’ অভি বিছানায় বসতে বসতে বললো, ‘কি সিদ্ধান্ত?’ আমি হাসি হাসি মুখ করে বললাম, ‘মা-বাবা হওয়ার সিদ্ধান্ত।’ অভি মুখটা মলিন করে বলে উঠলো, ‘তৃষ্ণা আমি তোমাকে বলেছি যে এখন এই বিষয় নিয়ে কথা না তুলতে। আমার সময় দরকার আরও। আমি এখন পারবো না নতুন একজনের দায়িত্ব নিতে।’ ‘কেন পারবেনা অভি? আমাদের কি টাকা পয়সার কমতি আছে? যা আছে তাতে দিব্যি চলে যাবে খেয়ে পড়ে সুন্দরভাবে। তাহলে সমস্যা কি? আর সাড়ে তিনবছর তো চলে গেলো। আর কত সময় চাই? আমাদের পরিবার আমাদের থেকে প্রত্যাশা করছে, এটা কি অপরাধ?’
‘দেখ আমি এখন পারবো না। সম্ভব নয় আমার দ্বারা। যখন সম্ভব হবে আমি তোমাকে নিজেই বলবো। আর মুরুব্বিরা এরকম বলবে, ছেলেমেয়ে বিয়ে দিলেই তাদের নাতি নাতনি চাই’ই।’ অভি কথাটা বলেই শুয়ে পড়লো। আমি ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘কিন্তু অভি আমারও যে মা হতে ইচ্ছে করে। সারাদিন একা থাকতে আমার ভালো লাগে না। সময় কাটে না৷ বাবা-মাও তো গ্রামে থাকেন। তাঁদেরকে এসে থাকতে বললেও তাঁরা থাকেন না। এসে চলে যান। এত বড় বাড়িতে আমার একা সময় কাটে কি করে বলো? তুমি তো অফিসেই ব্যস্ত থাকো। আমি তো চাকুরিও করি না। আমার সাথে বাসায় কাউকে আসলেই প্রয়োজন।’ বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে গেলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি অভি ঘুমে তলিয়ে। লাইট অফ করে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমিও৷
অভির ব্যস্ততায় সময় বেশ ভালো কাটছে। ইদানীং মাঝে মাঝে অফিসের কাজের চাপে বাসায়ও ফিরতে পারে না। আমার একলা সময় একা বাড়িটায় বন্ধি। অনেক ভেবে বুদ্ধি বের করলাম বাচ্চা নেওয়ার বিষয়ে অভিকে কিছু আগে থেকে জানাবো না। তারপর যখন ও শুনবে ও বাবা হতে চলছে তখন নিশ্চিত বেজায় খুশি হবে। আমি সেই খুশিটা দেখার জন্য হলেও অভিকে কিছুই জানাবো না। বাচ্চার জন্য তখন ঠিকই সময় বের করবে অভি৷ আমাকে দূরে দূরে রাখলেও নিজের সন্তানকে তো আর অনাদরে রাখতে পারবে না। সময় আগের যথা নিয়মে কাটলেও কয়েকদিন ধরে অভি বাসায় বেশ তাড়াতাড়িই ফিরছে। জিজ্ঞেস করলে বললো, ‘এখন কাজের চাপ কম, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই একবার দেশের বাহিরে যেতে হবে অফিসের কাজে এক সপ্তাহের জন্য।’
কথাটা শুনে বেশ মন খারাপ হয়ে গেলো। বিয়ের পর অভি আমাকে রেখে দুই দিনের বেশি দূরে কোথায়ও ছিলো না। সাতদিন কেন যেন আমার কাছে সাত মাস মনে হলো। অভির এই সাতদিন বাহিরে থাকার মধ্যেই আমি নিশ্চিত হতে পারলাম আমি মা হতে চলছি আর অভি বাবা হতে যাচ্ছে। খুশি আর ধরে না আমার। ইচ্ছে করছে এখনই কল করে বলে দেই অভিকে। খুশিটাকে দমিয়ে রাখলাম। অভি ফিরলেই খুশির খবরটা দিবো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে একবার খেয়াল করলাম। পেট টা আলতো করে হাত দিয়ে ধরলাম। ভেতরে একটা মানুষ বড় হবে এটা ভাবতেই কেমন আনন্দ জেগে উঠলো।
অভির সাথে আমার পরিচয় ভার্সিটি জীবনে। অভি আমার সিনিয়র ছিলো ভার্সিটিতে। ওখান থেকেই পরিচয়, বন্ধুত্ব, প্রেম ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসাটা বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে আসতে অনেক ভোগান্তি গেছে আমাদের। সবেমাত্র চাকুরিতে জয়েন করেছে অভি তখন, বাড়ি নেই গাড়ি নেই আমার পরিবার অভির কাছে আমাকে বিয়ে দিতে কোনোভাবেই রাজি নয়৷ একসময় বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে আমার। তারপর শুরু হয় টোনাটুনির সংসার। ভালোবাসায় ভালোবাসায় কাটতে থাকে প্রতি মুহুর্ত। আস্তে আস্তে উন্নতি হয় অভির। প্রথম দুইটা বছর হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে অভি। এই দুই বছরে আমাদের সবকিছুর পরিবর্তন হয় উন্নতিতে। এমনকি ভালোবাসাটাও বেড়ে যায়। আমাদের বাসাটা বড় হয়, দামী সব জিনিসপত্রে সেজে ওঠে বাসাটা, গাড়িও হয়। বাসার কাজের জন্য একজন মানুষও ঠিক করা হয়। আর এদিকে আমার পরিবারের সাথেও যোগাযোগ হতে থাকে।
একসময় সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। অভি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। আমার কষ্ট হবে বলে বিয়ের পরে আমার কনফার্ম হওয়া চাকুরিটাও করতে দেয়নি অভি, সারাদিন পরিশ্রম করে অফিস থেকে ফিরে আমাকে বাসার কাজে সাহায্য করায় তাঁর চেষ্টার কমতি ছিলো না। ছুটির দিনে রান্নাঘরে দু’জন মিলে নানান ধরনের রেসিপি দেখে দেখে রান্না করতাম। সন্ধ্যে হলে বাহিরে বের হতাম রাস্তায় সোডিয়ামের আলো দেখতে। রিকশায় ঘুরে ঘুরে প্রেম হতো বিয়ের পরেও। আমাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য নানা বাহানা দাঁড় করাতো, লজ্জায় লাল হয়ে আমি পালিয়ে যেতে চাইলেই শক্ত করে চেপে ধরতো, আমার নিঃশ্বাস গাঢ় হতো আর অভি কড়ায় গন্ডায় ওর ভালোবাসার হিসেব চুকিয়ে নিত। সাতদিন কেটে গেলো। অভি দেশে ফিরলো। কেমন যেন অচেনা লাগলো অভিকে। জমিয়ে রাখা টান টা কেন যেন টানছে না আর। হয়তো অনুপস্থিতিটা বেশি ছিলো তাই। একটা ভালো সময়ের অপেক্ষা করছি, ভালো খবরটা দেওয়ার জন্য।
অভি ঘুম থেকে জাগলে আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। অভির মাথায় হাত রাখতেই অভি জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু বলবে?’ কেন যেন বলতে মন চাইলো না। অভির প্রশ্নের মধ্যে আমি একটা বিরক্তি খুঁজে পেলাম। আগে এমন কখনও অনুভব হয়নি। এর আগে যতবারই এরকম ঘুম থেকে জাগার পরে মাথায় হাত রেখেছি ততবারই অভি হেঁচকা টানে আমাকে ওর বুকের উপর নিয়ে এসেছে। তারপর ওর পুরো শরীরটাকে আমার বিছানা বানিয়ে চোখের দিকে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতো, ‘বলো কি বলবে?’ আজ সেই ভালোবাসা, দুষ্টুমি, খুনসুটি সবকিছুই অনুপস্থিত। কিন্তু তারপরেও আমাকে বলতে হবে। ‘অভি’ ‘হ্যাঁ বলো। আমার বের হতে হবে এখনই।’ ‘তুমি বাবা হতে চলেছো। আর আমি মা।’ কথাটা শেষ করেই আমি অভির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি ওর চোখ ভর্তি খুশির ছটফটানি দেখার জন্য।
কিন্তু অভি আমাকে নিরাশ বানিয়ে অবাক করে বলে উঠলো, ‘তৃষ্ণা তোমাকে আমি নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম আমি এখন এসবে একদম প্রস্তুত না। তারপরেও তুমি কেন করলে? এখন অবশ্যই তুমি বলবে না যে তুমি জানতে না। তুমি খুকি নও, তুমি জেনে বুঝেই করেছো সব। কেন করেছো?’ অভির চিৎকারের আওয়াজে আমার মাথা নিচু হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে রইলাম। ভাবতেই পারছি না বাবা হওয়ার খবর শুনে এতটা চেঁচিয়ে উঠবে অভি। অভি হন্তদন্ত হয়ে উঠে অফিসের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হয়ে গেলো। আমি বসে পড়লাম ওখানটাতেই বিছানার উপর। আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। পেট টাতে হাত বুলালাম। ভেতরের প্রাণটাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।
সেদিন রাতে বাসায় ফেরেনি অভি। ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। পরেরদিন বিকেলে বাসায় ফিরলো, আমি চুপচাপ ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় ছিলে গতকাল রাতে? ফোন অফ ছিলো কেন?’
অভি শার্ট পরিবর্তন করতে করতে উত্তর দিলো, ‘অফিসে ছিলাম। কাজের চাপ ছিলো তাই ফোনে চার্জ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল টের পাইনি।’ ‘দুপুরে খেয়েছিলে?’ ‘না’ ‘খাবার দিবো টেবিলে?’ ‘হুম।’ অভির খাওয়া শেষ হলে আমি বেলকনিতে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরে অভিও পাশে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে বললো, ‘তৃষ্ণা আমি দুঃখিত। গতকাল ওভাবে রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলার জন্য।’ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘ব্যাপার না। মনে রাখিনি আমি।’
অভি আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমি আবার সেই ভালোবাসাময় দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। ওর স্পর্শ শিহরণ জাগালো বুকের বা পাশটাতে। হৃৎস্পন্দনের মাত্রাটা যেন বেড়ে গেলো। খুশির জলেরা ছলছল করে উঠলো ঠিক তখন অভি বললো, ‘যা হওয়ার হয়েছে, চলো বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলি। তাহলেই তো সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। এখনও তো সময় আছে তাইনা। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। তিনি আগামীকাল যেতে বলেছেন। কোনো সমস্যা হবে না। আমি থাকবো তোমার সাথে।’ অভির কথাগুলো কাঁটার মতে বিঁধতে লাগলো মস্তিষ্কে। হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম, হৃৎস্পন্দন কমতে লাগলো, বুকের বা পাশটাতে একটা সজোরে ধাক্কা খেলাম। আমি অভিকে ভুল অনুভব করলাম, খুশির জলের বদলে চোখে এবার যন্ত্রণার জলেরা টলমল করে উঠলো। ‘তুমি কি করে ভাবতে পারলে এমনটা? এটা একটা জীবন অভি! খেলনা পুতুল নয়! অভি আমি তোমার মত এতটা নিষ্ঠুর হতে পারবো না। একটা জীবনকে মেরে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর এটা আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন, আমি কেন এটা নষ্ট করবো? আমি পারবো না।’
অভি আমার এক রোখা কথায় রেগে গিয়ে বললো, ‘আমি কোনো চিহ্ন এখন চাই না। এটা তোমার যেমন সন্তান, তেমন আমারও। এর উপর আমার অধিকারও আছে। আমি একে পৃথিবীতে এখন আনতে চাই না। তুমি আগামীকাল আমার সাথে ডাক্তারের ওখানে যাচ্ছো, এটাই শেষ কথা।’ চোখ থেকে গড়গড় করে জল পড়ছে। আমি চোখের জল মুছে বললাম, ‘আমি পারবো না। আর তোমার অধিকার? লজ্জা করা উচিৎ ছিল কথাটা বলতে। মেরে ফেলার অধিকার পৃথিবীতে কাউকে দেয়নি সৃষ্টিকর্তা। তুমি অভিশপ্ত পিতা হতে পারো, আমি অভিশপ্ত মা হতে পারবো না।’ ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে অভি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো। আমি অভিকে এখন কোনোভাবেই বুঝতে পারিনা। কি হয়েছে ওর, ও কেন এমন করছে, কি চায় আসলে ও! যে মানুষটা আমার খুশির জন্য, আমাকে ভালো রাখার জন্য সব কিছু করতে রাজি ছিলো সেই মানুষটার কি এমন হলো!
অভি মধ্যরাত করে বাসায় ফেরে, কখনও ফেরেই না। কখনও বা অফিসের কাজে বেশ কয়েকদিন ঢাকার বাহিরে থাকে। যে মানুষটা কিছুক্ষণ পর পর ‘ভালোবাসি’ কথাটা শোনার জন্য শত কাজের মাঝেও সময় বের করে আমায় কল দিত, সেই মানুষটার সাথেই সারাদিনে আমার খুব জরুরি কথা ছাড়া কথাই হয় না এখন। একই ছাদের তলায়, এই বিছানায় থেকেও কত কত মাইল দূরে আমরা। রাত আড়াইটা বাজে। অভি বাসায় ফিরে শুয়ে পড়লো। ওর মুখ দেখে মনে হলো শরীর ভালো নেই। কপালে হাত দিলাম দেখলাম ঠিকঠাক। মাথার ভেতরে হাত দিতেই দেখি চুলগুলো ভেজা ভেজা। ঘেমে গেছে হয়তো। ফ্যানটা চালু করলাম।
ইদানীং খেয়াল করে দেখেছি অভি ফোনে খুব সময় ব্যয় করে। এতদিন এটাকে গুরুত্ব না দিলেও কেন যেন এখন বিষয়টা খুব গুরুত্বের মনে হচ্ছে। মধ্যরাত করে বাড়ি ফেরা অভিকে খুব সতেজ লাগে, এটাও এতদিন আমার চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। রাতে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে গেলে আমি ওর চুলে হাত দিয়ে প্রায়ই দেখি চুলের গোড়াগুলো ভেজা। এখানটাতেই আমার মনের ভেতরটা বারবার হকচকিয়ে ওঠে। অভির ফোনের কল লিস্ট চেক করে কয়েকটা নাম্বার খুঁজে পাই, কিন্তু কার নাম্বার এখনও জানা নেই। নাম্বারগুলো টুকে রাখি। এদিকে পেটের ভেতর ভবিষ্যৎ বড় হচ্ছে দিন দিন। সেদিন রাতে অভি বাসায় ফিরে ফোনের ডাটা অন করেই ওয়াশরুমে ঢুকে পরে। মেসেজের শব্দ শুনে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে, ‘বাসায় ফিরেছো?
সব ঠিকঠাক তো’ ফেসবুক একাউন্টের নামটা ছিলো জাবিয়া খান। ছবিটা বেশ চেনাচেনা লাগে আমার। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি জাবিয়া খান অভির অফিসের কলিগ। সেই সাথে বের হয়ে আসে অনেক অজানা রহস্য। জাবিয়ার সাথে অভির সম্পর্ক হয় বছর দেড়েক। অফিসের কাজের চাপের ব্যস্ততার অজুহাতে তাঁর বাসায়’ই অভি রাত যাপন করে, তাঁর বাসা থেকেই মধ্যে রাতে অভি ফ্রেশ হয়ে সুন্দর পরিপাটি ভাবে আমার কাছে ফেরে। জাবিয়াকে নিয়েই অভি দেশের বাহিরে, ঢাকার বাহিরে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়ায়। খবরগুলো আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ছিলো। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছিলো, গলা থেকে স্বর’ই বের হচ্ছিলো না। আমার পুরো পৃথিবীকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। অভির সাথে সরাসরি কথা হয় আমার এ বিষয়ে।
অভি আমাকে আরও অবাক করে জানালো, ‘সে আর জাবিয়া বিয়ে করেছে আরও অনেক আগেই এবং জাবিয়া মা হতে চলছে শীঘ্রই।’ মনে হলো, খুব কাছে এসে কেউ একজন বুকের মধ্যখানটাতে ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিলো। আমি এখন আমার বাবার বাড়িতেই আছি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে এখানটাতে থাকতে আমার কোনোরকমে অসুবিধে হচ্ছে না। অভি ভেবেছিলো হয়তো আমি তাঁর বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নিবো। সে অবশ্য এর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতও ছিলো। কিন্তু আমি তেমন কিছুই করিনি। শুধুমাত্র ডিভোর্স পেপারে সাক্ষর করে কাগজটা তাঁর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। খুব হতাশ হলেও নিজের ভবিষ্যৎ সদস্যের কথা চিন্তা করে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে চলছি। চাকুরির জন্য পড়াশোনা শুরু করি আবার, নিজের একটা পরিচয় থাকাটা খুব জরুরি। সেটা আমার জন্য না হলেও আমার সন্তানের জন্য খুব জরুরী।
সময় থেমে থাকার নয়, সময়ের গতিতে সময় চলে যাচ্ছে। আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করছি অনেক বছর হলো। বাবা মা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আমার মেয়ের নাম রিজওয়ানা আলভি। মেয়েটাও বড় হয়ে গেছে দেখতে দেখতে। মেয়েটার ভেতরটা আমার মত হলেও দেখতে একদমই আমার মত হয়নি। পুরোটা অভির মত হয়েছে। এটাই আমার বড় আফসোস। আলভি জানে ওর বাবা নেই মারা গেছে। অভির কোনো ছবিও আমি আলভিকে দেখাই নি। আলভি তাঁর বাবকে একদমই চেনে না। বাবা মা তোরজোর করলেও আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করার চিন্তা করিনি, আলভিকে নিয়েই বাকি জীবনটা স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেছি।
পড়াশোনায় ভীষণ ভালো আলভি। ছোট বেলা থেকে তাঁর ডাক্তার হওয়ার খুব ইচ্ছে। তাই আমারও ইচ্ছে ও ডাক্তার হোক। বাবার শরীরটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মাও বাবার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। আমারও চুল পাঁকা শুরু হয়েছে। চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতেই পাই না এখন আর। আলভিটা সারাদিন হাসপাতালে কাঁটায়। এখন আবার ব্যস্ততার আরও একটা উপায় যোগ হয়েছে, একটা বৃদ্ধাশ্রমে লোকেদের সেবা করে। সেটা খুবই ভালো কথা বিনামূল্যে এভাবে বৃদ্ধ অসহায় মানুষদের সেবা করা কিন্তু তাঁর বয়স বাড়ছে তো।
মেয়েটাকে বিয়ে দিতে হবে। আর সে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বিয়ের বিষয়ে তাঁর মাথা ব্যথাই নাই৷ কত ভালো সম্বন্ধ আসে, সে নতুন বাহানা দিয়েছে ছেলের নাকি ঘরজামাই থাকতে হবে৷ সে আমাদের রেখে কোথায়ও যাবে না। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না। লোকজন কি বলে! মেয়ে বড় হয়ে গেছে মায়ের খেয়াল নেই সেদিকে। বাবা থাকলে এমন হত না, বাবার বিষয়টাও অনেকে এই সুযোগে টেনে আনে। সন্ধ্যায় বেলকনিতে বসে চা খাচ্ছি। আলভি এসে বসলো পাশে। ‘জানো মা বৃদ্ধাশ্রমে একটা বয়স্কলোক আমার দিকে সবসময় কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। লোকটার কাছে গেলে আমারও খুব মায়া হয়। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, চোখ থেকে তখন পানি পড়তে থাকে তাঁর।’
নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাঁর ছেলে মেয়ে নেই?’ ‘আছে তো মা। তাঁর ছেলে নাকি বড় ব্যবসায়ী। তাঁর স্ত্রী নাকি সেই ছেলের সাথেই থাকে।’ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘তাহলে সে কেনো থাকেনা তাঁদের সাথে?’ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল আলভি, ‘তাঁদের নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে আরও অনেক আগে। ছেলেকে ব্যবসায়ী উনিই বানিয়েছেন। আর এখন তাঁর বাবার খবর সেই ছেলেই নেয় না।’ ডিভোর্সের কথা শুনে কেনো যেন মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। বুকের ভেতরটাতে পুরোনো সব কথা খাঁ খাঁ করে উঠলো। কষ্ট চাপা দিতে আমি আলভির মাথায় হাত বুলালাম। আলভি কাছে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
বাবার হৃদরোগের সমস্যাটা হঠাৎ আজ সকালে বেড়ে গেলো। আলভি গাড়ি পাঠিয়ে দিলো বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। ও ওখানটাতেই আছে। মা আর আমি বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম। বাবাকে ভর্তি করা হলো। আমি বাহিরে বসে আছি, কিছুক্ষণ পর পর চশমা খুলে চোখের পানিটা মুছে ফেলছি। আলভি এসে বললো বাবা নাকি এখন সুস্থ অনেকটা। এমন সময় পাশ থেকে এক ভদ্রমহিলা ও পঁচিশ-ত্রিশ বছরের একটা ছেলে এসে আলভির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন। আলভি কাছে এসে বসলো। ‘মা সেই ভদ্রলোককে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হয়তো বেশিদিন সময় নেই তাঁর হাতে। আমিই তাঁর চিকিৎসার সব খরচ বহন করার দায়িত্ব নিয়েছিলাম।’ ‘কোন ভদ্রলোক?’
‘ওই যে বৃদ্ধাশ্রমের ভদ্রলোক। এনারা হলেন ওনার একমাত্র ছেলে এবং ওনার প্রাক্তন স্ত্রী। দেখতে এসেছিলো। ওনার ছেলে চিকিৎসার খরচ বহন করতে চাচ্ছিলেন। তো আমি বললাম তার আর দরকার নেই। উনি বললেন কিছু প্রয়োজন হলে তাঁকে যেন জানানো হয়।’ মেয়েটার এই উদারতা দেখে মনটা ভরে যায়। মানুষের প্রতি ওর মায়া খুব বেশি। আমি ওকে এভাবেই দেখতে চেয়েছিলাম।
‘জানো মা লোকটার প্রতি কেমন যেন একটা টান অনুভব করি৷ অনেকদিন ধরে চিনি তো তাই একটা মায়া জন্মে গেছে। আর লোকটাও আমার দিকে মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেও না। ওনার ছেলে এসে তো হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। আমি সান্ত্বনা দিতে কাছে গেলাম উনি আমাকে বললেন, আপনি আমার বোনের মত কাজ করেছেন। আপনি এভাবে এগিয়ে না এলে আমরা তো জানতেও পারতাম না যে বাবা কোথায় আছে। কথা বলার সময় খুব আবেগি হয়ে গিয়েছিলেন। আর ওনার প্রাক্তন স্ত্রী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো কথাই বললেন না, চুপচাপ দেখে চলে গেলেন। মনে হলো অনেক অভিমান, অভিযোগ জমে আছে তাঁর ভেতরে।’
‘ভদ্রলোক কোনো কথা বলেন নি?’
‘তিনি তো কথা বলতে পারেন না। কথা বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। তবে বুঝতে পারে সব এবং শুনতেও পারেন। ব্রেইন কাজ করছে।’ মন খারাপ হলো আলভির বর্ননা শুনে। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘আল্লাহ ভরষা। চিন্তা করিস না মা।’ বাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরবো কি না ভাবছি। এমন সময় আলভিকে খুঁজে পাচ্ছি না৷ ফোন করলাম রিসিভও করলো না। মা আর আমি খুঁজতে সামনে এগোলাম। আলভিকে দেখা মাত্রই দাঁড়ালাম, ‘কোথায় ছিলি তুই?’ ‘মা ভদ্রলোকের অবস্থা খুব একটা ভালো না। সিনিয়র ডাক্তারদের সাথে আলাপ চলছে কি করা যায় ভাবছি।’
‘কোন রুমে চল তো একবার দেখে আসি। দেখা যাবে?’
‘হ্যাঁ এখন যাবে।’
আমি আর মা আলভির সাথে গেলাম। আলভি হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিলো। আমি তাকালাম। চেনা লাগলো মুখটা। খুব পরিচিত মুখ। তবে অনেক বেশি পরিবর্তন। দোটানায় পড়ে গেলাম! ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে আলভি আমাদেরকে ইঙ্গিত দেখিয়ে বললেন, ‘আমার মা আর আমার নানি আপু এসেছেন আপনাকে দেখতে।’
লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একজন নার্স এসে আলভিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ম্যাম রোগীর নাম কি?’ আলভি উত্তর দিলো, ‘অভি লিখলেই হবে’ বুকের ভেতরটায় একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পাশ থেকে মা আমার হাতটা চেপে ধরলেন। আমার কন্ঠ নালি আঁটকে আছে। শব্দ বের হচ্ছে না। বিছানায় শোয়া চিরচেনা লোকটা অপলক তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে এলাম। এত বছর পর এভাবে এখানে আমাদের দেখা হওয়াটা আমার কোনো বিষাক্ত নিঃশ্বাসেও ছিলো না। অনেক অভিযোগ ছিলো আমার কিন্তু অভিশাপ তো ছিলো না কখনও। পরিণামে এমন কেন হলো তাহলে?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত