প্রবাসী স্বামী

প্রবাসী স্বামী
কাল সারারাত আমার জামাই পা টিপে দিছেন ভাবী! পায়ের ব্যথায় ঘুমোতে পারছিলাম না।” – লিমার মা মিটমিটিয়ে হেসে বললেন। “আরে ভাবী আমি অসুস্থ থাকলে তো আমার জামাই ছায়া-ব্লাউজ পর্যন্ত ধুয়ে দেয়।” – রিয়ার মা আরো হেসে বললেন। শুধু হাসি নয়, একজন আরেকজনের গায়ে হেসে লুটিয়ে পড়ছেন। প্রতিদিন বিকেলে আমার সাত বছরের মেয়ে ‘তানহা’কে নিয়ে কোচিং এ আসার পর প্রত্যেক ভাবীদের এসব অসহ্যকর কথা শুনতে হয় আমাকে। আমি নীরব হয়ে তাদের অদ্ভুত কথাবার্তা শুনি। আজও তানহাকে কোচিং ক্লাশে দিয়ে শুনছিলাম। জুইয়ের আম্মু হঠাৎ পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলেন, “কী ব্যাপার তানহা’র মা, এতো চুপচাপ কেন? তুমিও কিছু বলো তোমার জামাইয়ের কথা!”
আমি এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কেননা, তিনি খুব ভালো করেই জানেন আমার স্বামী গত ছ’বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। এমন কোনো ঘটনা হুট করে চাইলেই আমি বলতে পারি না। তারপরও তার কথার প্রেক্ষিতে বললাম, “আমার তো বলার মতো কিছু নেই ভাবী, প্রতি দু’বছর কিংবা তিন বছর বাদে একবার দেখা পাই আমি তানহা’র আব্বুর। বাবা-মা যখন থেকে প্রবাসী স্বামীর সাথে বিয়ে দিয়েছেন, ‘তীর্থের কাকের’ মতো চেয়ে থাকি, কবে আবার তার দেখা পাবো?” জুইয়ের মা অশ্লীল ভঙ্গি করে বললেন, “তোমারই তো শান্তি, চাইলেই দেশে বসে আট দশ’টা প্রেম করতে পারো, জামাই টেরও পাবেন না। আমার জামাই তো খালি সন্দেহ করে আমাকে।” আমি অবাক হয়ে ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“কী বলেন ভাবী? জামাই থাকতে প্রেম কেনো করবো? তাছাড়া আমার বাচ্চা একটা মেয়ে আছে।” জুইয়ের মা বললেন, “এতো সুন্দর তুমি, বয়সও কম।ক্যামনে থাকো জামাই ছাড়া? নিজের রুপ-যৌবন এইভাবে নষ্ট করিও না। তোমার জামাই বিদেশে কতো জনের সাথে ঘুমায় তা কি তোমাকে বলে নাকি?” “না জেনে মন্তব্য করা কি ঠিক ভাবী? যদি তিনি পাপ করে তার কৈফত তিনি আল্লাহ্‌র কাছে দেবেন। আমি কেনো পাপের বোঝা মাথায় নেবো? তাছাড়া আমি তাকে বিশ্বাস করি সেই বিশ্বাস নিয়েই থাকতে চাই।” জুইয়ের মা বললেন, “শোন! এই পাপ-পূন্যের ভাত নেই আজকাল। শ্বশুর বাড়ির মানুষ কোনদিন আপন হয় না। নিজে ব্যাংক-ব্যালেন্স করো। জমি-জমা কেনো, নয়তো যখন শুনবা জামাই আরেকটা বিয়া করছে তখন আমার কথা মনে করে পস্তাবা।” আমি জুইয়ের মা’র কথায় কান দিলাম না।
তানহা’র বয়স যখন পাঁচ বছর তখন শেষবার এসেছিলেন তানহা’র আব্বু। এখন তানহা’র বয়স সাত বছর চলছে। বিয়ের পর থেকে ছ’বছরে তিনবার এসেছেন তিনি। তাও প্রত্যেকবার তিন/চার মাসের বেশী থাকেননি। প্রত্যেকবার যখন তিনি আসেন আমার মনে হয় আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে, খুব অচেনা লাগে মানুষটাকে। তবে তিনি মানুষ হিসেবে খারাপ তো নন। দেশে থাকলে অন্য ভাবীদের বরদের মতোই আমার খেয়াল রাখতো বলে ধারণা।
বিয়ের আগে যে আমি প্রেম করিনি তা কিন্তু নয়, সত্যি বলতে লজ্জা নেই। কলেজ লাইফে একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতাম, কিন্তু সমবয়সী সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা হয় আর কি! বিয়ে আর হয়নি আমাদের। আহারে! ছেলেটা আমার বিয়ের দিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে হাসপাতালে ছিলো, কিন্ত কিছুই করার ছিল না আমার। এখন মাঝে মাঝে স্কুল আর কলেজের সেই বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা ভাবি। স্মৃতিগুলো খুব আঘাত করে আমাকে, ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় ছেলেবেলায়!
‘তানহা’ আমার একমাত্র মেয়ে। তানহা’র আব্বুর এখন একটা ছেলের শখ। আমার জীবন অনেকটা রুপকথার রাজা-রানীর মতো, “অবশেষে তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো”- এরকম। তাই পরেরবার একটা ছেলে হলে বাচ্চা নেয়ার ঝামেলা থেকে বেঁচে যাই। কেনোনা অন্যান্য ভাবীদের মতো আমার অসুস্থ অবস্থায় খেয়াল নেয়ার মতো কেউ থাকে না। নিজের ঔষধ নিজের কিনে খেতে হয়, নিজের সংসারের রান্নার বাজার নিজের করতে হয়। তার উপরে শ্বাশুড়ি, ননদিনী কিংবা শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনদের মনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
বছর এর বছর এভাবেই সন্তান লালনপালন আর পরিবারের দেখাশুনা করেই কেটে যায় আমাদের মতো প্রবাসী স্বামীর স্ত্রীদের।
দিনশেষে ভালোবেসে ‘ভালোবাসি’ বলার মতো মানুষটা পাশে থাকে না। অন্যান্য ভাবীদের বরের মতো মুখে তুলে একবারের জন্যও কেউ খাইয়ে দেয় না। ঈদ-কুরবানীতে কেউ শপিংমলে নিয়ে গিয়ে বউয়ের পছন্দের শাড়ি-চুড়ি কিনে দেয় না। আমার তো সবার আগে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর ননদের জন্য কিনতে হয়। সবশেষে তানহা’র জন্য কেনাকাটা করে নিজের জন্য কিছু কেনার ইচ্ছেটা কেনো জানি মরে যায়। টাকা-পয়সার অভাব নেই আমার প্রবাসী স্বামীর। কিন্তু মাঝেমধ্যে এসবের মাঝে শান্তি খুঁজে পাই না আমি। এতো প্রতিক্ষার পর যখন একবার স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে আসেন তখন তিনি শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়-স্বজন নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে আমাকে আর সময় দিতে পারেন না।
যে কয়টা দিন দেশে থাকেন দিন শেষে রাত্রের সময়টুকু তাকে কাছে পাই, তখন মনে হয় আমার আর তার সম্পর্ক শুধু বিছানার মাঝেই সীমাবদ্ধ। তবে আমি তানহা’র বাবার দোষ দিচ্ছি না। তাকেও তো আত্নীয়-স্বজন এর মন জোগিয়ে চলতে হয়। না হলে গুরুজনদের কটু কথা শুনতে হবে, “এতোদিন পর দেশে এসে বউয়ের আঁচলের নিচেই রইলো।” ননদ আর ভাশুরের ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত থাকে তাদের মামা কিংবা চাচা বিদেশ থেকে কী এনেছেন তাই নিয়ে।কোনটা আনতে বলার পরও আনা হলো না, কে কোনটা পায়নি? সেই অভিযোগ নিয়ে! মাঝে মাঝে অনেক অভিযোগের বোঝা আমার মাথায়ও আসে। আমি নাকি বিদেশি জিনিস বাপের বাড়ি নিয়ে যাই! বিয়ের আগে তিনি নাকি এমন ছিলেন না। তবে আমি তো জানি আমার আর তার সম্পর্ক কতোটা ফরমাল।
শেষবার যখন তানহা’র আব্বু এসেছিলেন সামান্য কিছু বিদেশি চকলেট আমার বোনের ছেলেমেয়েদের দেয়ায় আমার শ্বাশুড়ি আমাকে অকথ্য ভাষায় অপমান করেন।সেদিন খুব কেঁদেছিলাম আমি। মুখ বুঝে সংসার টিকিয়ে রাখতে সবকিছু সহ্য করতে হয় আমাদের মতো নারীর। আমাদের মতো বিবেকবান মেয়েরা আর যাই পারুক সংসার ভাঙতে পারে না। আমার উচ্চস্বরে হাসতে নেই আবার পরপুরুষের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে নেই। তাহলেই যে মানুষ কথা তুলবে তানহার মা’র স্বামী বিদেশে থাকে আর সে অন্য পুরুষের সাথে হাসাহাসি করে। এইসব অপবাদ যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক বুঝি আমি। আমাদের মতো প্রবাসী স্বামীর স্ত্রী’দের কান্না শুধু রাতের বালিশের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।
ভাবতে ভাবতে তানহা’র কোচিং ছুটি হয়ে যায়। এখন বাসায় ফেরার পথে বাজার আর শ্বাশুড়ির ঔষধ নিতে হবে। রাতের রান্না করে তানহা’কে নিয়ে পড়তে বসতে হবে। তারপর বাসার প্রয়োজন বুঝিয়ে দিয়ে একবার যদি তানহা’র আব্বুর ফোন পাই! এরপর আবার সকালে ফজরের নামাজের পর সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে তানহা’কে নিয়ে স্কুলে আসবো। আবার বিকেলে কোচিং-এ এসে ভাবীদের গল্প শুনব! তারপর আবার রাত হবে, চোখের অশ্রু ও ফুরিয়ে যাবে।একদিন বুড়ি হয়ে যাব, কিন্তু আমার গল্প সবার অজানাই থেকে যাবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত