আটটার সংবাদ

আটটার সংবাদ
একাত্তরের রাত আটটার সংবাদ আমার বাধ্য হয়ে দেখতে হয়, কারণ সংবাদটা আমার একমাত্র বউ পড়ে। দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে এটা জানার জন্য দেখি না। নিজের বউ পড়ছে বলেও দেখি না। কারণ অন্য কিছু। বিকেল পর্যন্ত সে বাসাতেই থাকে। গোধূলির সময় রওনা দেয় চ্যানেলের উদ্দেশে। তখন আমার অফিস ছুটি হয়। বাসায় এসে আর তাঁকে পাই না। এজন্য কী পরে গেছে তা দেখা হয় না। খবর পড়া শেষ করে যখন ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, “ আজকে আমাকে কেমন লাগছিলো টিভিতে? তখন আমার উত্তর দিতে হয়। খুব সুন্দর একটা উত্তর দিতে হয়। তাঁর সাথে যত কিছুই করি না কেনো, কিছু মনে রাখবে না। কিন্তু এই প্রশ্ন করার পরে যদি আমি উত্তম উত্তর না দিতে পারি। তাহলে সে রাতে যুদ্ধ লেগে যায়। থালাবাসন ভাঙ্গাভাঙ্গি হয়। আমি এসব চাই না।
কয়েক লাইনে তাঁর প্রশংসা করে ফেলি। সে খুশি হয়ে যায়। সেই কয়েক লাইনে খুশি করার জন্য আমার আটটার সংবাদ দেখতে হয়। কোন রঙের শাড়ি পড়ে গেছে এটা দেখার জন্য। অনেকবার এমন হয়েছে সে নীল রঙের শাড়ি পড়ে গেছে। আর আমি বলেছি, “ লাল শাড়িতে তোমাকে যা লাগছিলো না! কমলালেবুর মতো। তারপর বাসায় এসেই ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। নাক মুখ না ফাটানোর আগে থামবে না! আজকে হলো কী, খুবই ক্লান্ত ছিলাম। অন্যদিন গাড়ির এসির বাতাসে ক্লান্তিটা দূর হয়ে যেতো। আজকে হঠাৎ করেই এসিটা খারাপ হয়ে গেছে। যথারীতি জ্যামে পড়ে অবস্থা এমনই খারাপ হলো যে। বাসায় ঢুকেই শোবার রুমে গা ছেড়ে শুয়ে পড়েছি। ক্লান্ত থাকায় চোখে ঘুম আসতেও সময় লাগল না। এর মাঝে আবার ইরিনার ফোন।
“ হ্যালো, কে? “
“ কে মানে? আমার নাম্বার তোমার ফোনে সেভ করা নেই? “
“ হ্যাঁ বলো, কতক্ষণ লাগবে আসতে? “
“ তোমার গলা এমন লাগছে কেনো? ঘুমিয়ে পড়ছো নাকি? “
“ আর বলো না, গাড়ির এসিটা খারাপ হয়ে গেছে তাই গরমের ঠেলায় বাসায় এসি ছেড়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। ”
“ ওহ, আচ্ছা আমাকে কেমন লাগছিলো টিভিতে? আমি উঠে বসলাম কথাটা শুনে। আজকে তো আটটার খবর দেখা হয়নি! হায় হায় এখন কী করি?
“ কী হলো? কথা বলছো না কেনো? ”
“ আটটার সময় তো আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই আর খবর দেখা হয়নি! “
ইরিনা সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দিলো। আজকে আমারই খবর করে ছাড়বে খবর না দেখার কারণে! এই মুহূর্তে আমার ঘুম বেশি প্রয়োজন মনে হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর টাই টেনে আমাকে নিচে নামিয়ে আনলো কেউ।
“ গাড়ির এসি ঠিক আছে দেখলাম। তো তোমার গরমটা লাগলো কীভাবে? সত্যি করে বলো কোন মেয়ের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছো? “
“ ঠিক হয়ে গেছে বোধহয়। মাঝেমধ্যে এমন হয়। “
“ কাকে কী বুঝাচ্ছো তুমি? আমি কি কচি খুকি?”
তাঁকে কোনোভাবেই বুঝানো যাবে না আজকে। চেষ্টাও করলাম না। ওয়াশরুমে চলে গেলাম। সে ইতিমধ্যে থালাবাসন ভাঙ্গা শুরু করে দিয়েছে! মেঝেতে কাচের জিনিসপত্রগুলো ফেলছে আর বলছে, “ এই ছিলো বুঝি কপালে আমার? কার সাথে বিয়ে দিয়েছে বাবা? বলেছিলাম আমি, দেখতে সুন্দর ছেলেরা মিচকা শয়তান হয়। কেউ শুনেনি আমার কথা! মজার ব্যাপার হচ্ছে রাগ করে থালাবাসন যা ভাঙ্গে সব তাঁর নিজের টাকায় কেনা! আমার টাকায় কেনা এমন কিছু ভাঙ্গলে যদি খোঁচা দেই! এই ধরনের মেয়েদের বলে জাতে মাতাল, তালে ঠিক! ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বললাম,, “ থালাবাসনের উপর অত্যাচার শেষ হলে গোসল করে নাও। খিদে পেয়েছে খুব।
“ খিদে পেয়েছে তো আমি কী করবো? রান্না করা আছে খেয়ে নিলেই তো হয়। “
“ ইরি, আমি তোমাকে ছাড়া খাই না! তুমি জানো না? “
আমার মা বাবাও খুব চালাক। আমাদের ঝগড়ার সময় দরজা খুলে দেখবে না। জানে সকাল হওয়ার আগে এমনিই সব ঠিক হয়ে যাবে। মেঝেতে একটা কাচের টুকরাও পাওয়া যাবে না সকালে। কিন্তু আজকে মা দরজা খুলে বের হলো। বেশ অবাক করার মতো ব্যাপার! ইরিনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ ইরি, তোর জন্য একটা খুশির সংবাদ। কালকে তোর বাপে এসে তোকে নিয়ে যাবে। বলেছে আর এখানে আসতে দিবে না। আমাদের কাছে তুই নাকি খুব অসুখী আছিস। ইরিনা চুপ হয়ে গেলো! কথাটার অর্থ সে বুঝতে পেরেছে।
“ বের হয়ে গেলেন তো নিজের ছেলের সাফাই গাইতে? আমি চলে গেলে আপনারা সবাই খুশি। আরেকটা মেয়েকে বউ করে আনবেন। “ উনি তো এক কথার মানুষ। কথা ফিরিয়ে নিবে বলে মনে হচ্ছে না। যত পারিস আজকে ভেঙ্গেচুরে নে। বলে আবার মা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। আমি কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বললাম, “ গোসল করবে না? বাদ দাও, সকালেই করো। এখন চলো খাই। “ নাহ, আমার খিদে নেই! “
আমি তাই করলাম। একা একাই খেয়ে নিলাম। স্বার্থপর ভাববে ভাবুক। যার পেট সে বুঝে। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো খাওয়ার সময়। মনে হচ্ছিলো আরেকবার সাধলেই খেয়ে নিবে। আমি সাধিনি! চুপ করে এসে শুয়ে পড়লাম। আমার শ্বশুর মশাই খুবই ত্যাড়া লোক। কথা একবার বলে দিয়েছে তো বলে দিয়েছে! তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। উনার জেদের উপরে কারো কোনো কথা চলে না! উনার সম্পর্কে আমার চেয়ে ইরিনাই ভালো জানে। নিজের বাবা বলে কথা। ঘুম আসছে না। মেয়েটা ভাঙ্গা কাচের টুকরোগুলো উঠিয়ে নিচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। গোসলও করে নিয়েছে। গোসল করার পরে ওর চুলের ঘ্রাণেই বুঝতে পারি। একা একা খেয়েও নিয়েছে। বিছানার একপাশে শুয়ে আছি আমি। বলতে গেলে পুরো জায়গাই খালি পড়ে আছে। খালি জায়গায় না শুয়ে আমার উপরেই সে পড়েছে! গলাটা একদম নরম হয়ে গেছে।
“ তুমি কি মানুষ? আম্মা কি বলে গেলো শুনলে না? “
“ আমি মানুষ কিনা জানি না। তুমি আমার সাথে অসুখী। আমাকে বিশ্বাস করো না। এটা জানি। তোমার বাবা জেনে ফেলেছে। তাই তোমাকে নিয়ে যাবে, এখানে আমার কী করার আছে? “
“ আমার চোখের সামনে, আমাকে রেখে তুমি খেয়েছো। এখন আবার শক্ত শক্ত কথা বলছো? “
“ গাড়ির এসি ঠিক ছিলো না তখন। তুমি এটা বিশ্বাস করলেই পারতে। কিছু না হতেই মাঝখানে অন্য মেয়েকে টেনে আনো! “
“ আমার কিন্তু কান্না পাচ্ছে এখন! ” আর কিছু বললাম না। জড়িয়ে শুয়ে থাকলাম। কিন্তু সকালে সত্যিই শ্বশুরের আগমন! সব মেয়েই তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নিজের বাবার আগমনে খুশি হয়। কিন্তু ইরিনা একদম খুশি হতে পারেনি! ভদ্রলোক ভারি কণ্ঠে বললেন, “ ইরিনা, ব্যাগ গুছিয়ে নাও। সময় পাঁচ মিনিট! ” ইরিনা আমাকে নিয়ে শোবার রুমে এসেছে।
“ তুমি বাবাকে বলো না, আমি যাবো না আজকে! “
“ পাগল নাকি? আমার অত মার খাওয়ার শখ নেই! “
“ আমাকে এখন নিয়ে গেলে জানো কি করবে? অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন কী করবে? “
ভদ্রলোক আবার ডাকলেন। ইরিনা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তিনি বললেন, “ আমার মেয়ের সাথে কেউ যেন যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। ” কেউ কোনো কথা বাড়ালো না। চলে গেলেন ইরিনাকে নিয়ে! রাত আটটার খবরে তাঁর দেখা মিললো। খবর পড়ার এক পর্যায়ে সে বলছে, “ বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে ফোন ব্যবহার করতেও দিচ্ছে না। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ! ভালো লাগছে না কিছু! ” সঙ্গে থাকা ভদ্রলোক ইরিনাকে থামিয়ে বললেন, “ কী করছো ইরিনা? আমরা লাইভে!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত