বাসর রাতে স্ত্রীর কাছে যাবো সেটারও অনুমতি নেই! বিশ মিনিট ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি বিছানা থেকে তিন ফুট দূরে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবার বিরক্ত হয়ে স্ত্রী তানহাকে উদ্দেশ্য করে বললাম;
– আচ্ছা, পুরুষ জাতির প্রতি কি আপনার কোন ক্ষোভ আছে যার প্রতিশোধ আমার উপর নিচ্ছেন? তানহা বললো,
– না, তা থাকবে কেন। আপনি যতক্ষণ না আমার মোহরানা পরিশোধ করবেন ততক্ষণ আমি আপনাকে গ্রহণ করবো না অর্থাৎ, আপনাকে আমায় স্পর্শও করতে দিবো না। জানিনা মা আমার জন্য এই অদ্ভুত প্রাণীটাকে কিভাবে পুত্রবধূ হিসেবে নির্বাচন করলেন। ভাবতে লাগলাম; যে মেয়ে এই কি না কি এক মোহরানার জন্য আমাকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে বাকি সাংসারিক জীবনে আরো কতো কি করবে কে জানে! বললাম,
– দেখুন, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। আসুন আমরা বসে একটি শান্তিচুক্তি করি। বালিশগুলো বিছানার মাঝখানে দিন। আপনি একপাশে আর আমি অন্য পাশে বসি। আমাকে গ্রহণ করবেন নাকি করবেন না সেটা পরেও দেখা যাবে। আমরা তো আলোচনা করে দেখতেই পারি যে কোন সমাধানে পৌঁছুতে পারি কি না তাইনা? আমার কথাগুলো শুনে তানহা হেসে উঠলো। বললো,
– আচ্ছা ঠিক আছে। বসুন তাহলে। এতক্ষণ পরে বসতে পেরে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! বললাম,
– প্রথমেই বলি এসব মোহরানা সম্বন্ধে আমার তেমন কোন ধারণা নেই। এটা কি এমন বিষয় যে যার কারণে আপনি আমাকে গ্রহণ করছেন না। তানহা বিস্ময়ের স্বরে বললো,
– আপনার মোহরানার সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই মানে! কি বলছেন এসব? আমি,
– হ্যা, ঠিকই বলছি। এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? তানহা,
– প্রতিটি পুরুষ মানুষের জন্যেই অবশ্য কর্তব্য হলো মোহরানার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা রাখা।
বিবাহের ক্ষেত্রে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পাশাপাশি এটি নিজেদের অধিকার বিধায় প্রতিটি নারীর জন্যেও এবিষয়ে জানা থাকা আবশ্যক। তানহার কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম; আমি কি বাসর ঘরে আছি নাকি কোন ইসলামি সভা-সমাবেশে আছি নাকি ক্লাসে আছি যেখানে নিজের বউ শিক্ষিকা আর আমি তার ছাত্র! মনে মনে বিরক্তিবোধ করলেও সেটার বহিঃপ্রকাশ করছিলাম না। বললাম,
– এবার তাহলে বলে ফেলুন মোহরানা এটি আসলে ঠিক কি? তানহা,
– মোহর হলো স্বামীর কাছে স্ত্রীর হক তথা অধিকার। এটি আদায় না করে আপনি আমাকে স্পর্শ করলেও আপনার পাপ হবে। মেলামেশা করলে সেটাও। আর সেই মেলামেশায় যদি সন্তানও জন্ম হয় তবে সেও হবে অবৈধ! কারণ, ‘যে স্বামীর মনে স্ত্রীর মোহর আদায়ের ইচ্ছাটুকুও নেই হাদীস শরীফে তাকে বলা হয়েছে ‘ব্যাভিচারী’। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩) বুঝলেন? তানহার মুখে এসব কথা শুনে আমার গলার পানি শুকিয়ে গেলো। মনে মনে বললাম, ‘কি করলাম জীবনে? এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মোহরানা আর এটি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না!’ এবার তানহাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
– আরো বিস্তারিত বলুন তো এটি সম্বন্ধে। তানহা,
– “পাঁচটি কারণে ইসলামী শরিয়ত নারীকে মোহরানা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
১. মোহরানা স্ত্রীর প্রতি সম্মান ও অনুরাগ প্রকাশের একটি মাধ্যম। স্ত্রী তাঁর মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়- স্বজন ত্যাগ করে স্বামীর ঘরে আসেন। এই কঠিনতম ত্যাগ স্বীকার করে তিনি আসেন অতিথির বেশে। তাই ইসলামী শরিয়ত মোহরানা ও বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে এই অতিথিকে বরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। এই মোহরানা যে এক ধরনের উপঢৌকন এবং সেটা সন্তুষ্টচিত্তে দিতে হয়, সে বিষয়টি কোরআনের ভাষায়, ‘আর তোমরা নারীদের তাদের মোহরানা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করো…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪)
২. মোহরানা নারীর সৌন্দর্য, মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে। কেননা অর্থকড়ি পার্থিব জীবনের শোভা ও সৌন্দর্যের পরিচায়ক। ইরশাদ হয়েছে, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্তুতি পার্থিব জীবনের শোভা…।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৪৬)
৩. ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি চুক্তি। ইসলাম এই চুক্তির শর্ত হিসেবে অর্থ দেওয়ার কথা বলেছে। কেননা অর্থবিনিময় চুক্তিকে সুদৃঢ় করে। কিন্তু ইসলামে স্ত্রীর কাছ থেকে উপকৃত হওয়ার বিষয়টিকে এই চুক্তির ভিত্তি হিসেবে স্থির করা হয়নি। তাই বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর স্ত্রীর কাছ থেকে দৈহিকভাবে উপকৃত না হয়েও যদি কেউ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন, তবু মোহরানার অধিকার বলবৎ থাকে। কেননা পুরুষ সেই চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। তবে পুরুষ যেন সবদিক থেকে বঞ্চিত না হন, সে কথা বিবেচনা করে ইসলাম চুক্তিকৃত মোহরানার অর্ধেক পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যদি তাদের স্পর্শ করার আগে তালাক দাও অথচ মোহরানা ধার্য করে থাক, তাহলে যা তোমরা ধার্য করেছ, তার অর্ধেক (আদায় করবে)…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৭)
৪. ইসলাম পরিবার ও পারিবারিক জীবনকে একটি প্রতিষ্ঠান কল্পনা করে। দুটি কারণে ইসলাম সেই প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পণ করেছে। এক. পুরুষ নারীর অর্থ ব্যয় করে থাকেন, যদিও নারী বিত্তবান হন। দুই. বুদ্ধিমত্তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা ও দৈহিক শক্তিমত্তা।
এই দুটি বিষয় বিবেচনা করে ইসলাম পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব স্বামী তথা পুরুষের ওপর অর্পণ করেছে। এ বিষয়ে কোরআনের ভাষ্য এমন : ‘পুরুষ নারীদের ওপর দায়িত্বশীল। কেননা আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর (সৃষ্টিগতভাবে) শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে পুরুষ তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৪) কিন্তু ইসলাম একদিকে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টিকে সামনে এনে পুরুষের ওপর পরিবারের মূল দায়িত্ব অর্পণ করেছে, অন্যদিকে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানে মর্যাদায় ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে নারীর জন্য একটি বিশাল অ্যামাউন্ট বরাদ্দ করে নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেছে। ইসলামের ভাষায় এটাকে মোহরানা বলা হয়।
৫. ইসলামী শরিয়তে মানুষের প্রতিটি অঙ্গের একটি আর্থিক মূল্য আছে, যদিও মানব অঙ্গ-প্রতঙ্গ অমূল্য সম্পদ। তথাপি জাগতিক নিয়মে কেউ কারো অঙ্গহানি করলে এর বিনিময় প্রদান জরুরি। আর বিবাহের মাধ্যমে যেহেতু পুরুষের মাধ্যমে নারীর এক ধরনের অঙ্গহানি হয়, তাই ইসলামী শরিয়ত এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোহরানা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘…সুতরাং তাদের অভিভাবকের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করবে এবং ন্যায়সংগতভাবে তাদের প্রতিমূল্য (মোহরানা) আদায় করবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৫)” তা এখন কি বুঝতে পেরেছেন জনাব? আমি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সম্ভব হলে বাইরে গিয়ে মাকে সালাম করে আসতাম এমন একজনকে আমার স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করার জন্য। এই ভাবনাটি এখন মনে কাজ করছে অথচ আগে এর উল্টো ভেবেছি। নিচুস্বরে তানহাকে বললাম,
– আমাদের বিয়েতে মোহরানা যেন কত ধার্য করা হয়েছে? তানহা,
– একলক্ষ বিশ হাজার টাকা। কেন, আপনি কি সবকিছু না জেনেই এত টাকা মোহর দিতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন? আমি,
– বিষয়টি ঠিক তা নয় আবার তাইও। কারণ, আমি এতদিন এবিষয়ে শুধুমাত্র মানুষের মুখে এটা সেটা শুনেছি। কোনদিন কারোর থেকে এভাবে বিষয়টি শুনিনি এখন যেভাবে আপনি বললেন। কথাগুলো বলে এবার আমি উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে পুরো একলক্ষ বিশ হাজার টাকা এনেই ওর হাতে দিয়ে বললাম,
– এবিষয়ে আরো যা যা জানার বাকি আছে আমার সব আপনার থেকে জেনে নিবো। অন্যান্য বিষয়েও যা না জানি সব জানবো। এবার বলুন মোহরানা আদায় করা হলো কিনা! তানহা একগাল হেসে বললো,
– হ্যা, আদায় হয়েছে। মোহরানা আদায়ের মধ্য দিয়ে আমাদের শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হলো এবং বিছানার মাঝখানে বাঁধার প্রাচীর হিসেবে দেয়া বালিশগুলোও তানহা সরিয়ে নিলো। বুঝতে পারলাম, আমি তো অন্ধকারে ছিলাম। আজ যদি আমার স্ত্রীও এই মোহরানার বিষয়ে আমার মতোই কিছু না জানতো তাহলে কত বড় ক্ষতিই না আমাদের হয়ে যেতো! এমন একজন স্ত্রী পেয়ে মনটা যেন রবের কুদরতি পায়ে লুটিয়ে পড়লো আমার। বলে উঠলাম, আলহামদুলিল্লাহ্।
গল্পের বিষয়:
গল্প