ক্লাসের এককোণে মন খারাপ করে বসে আছে মিলি। এই তো একটু আগে এসেম্বলিতে যাবারকালে নিজের হাতে ব্যাগে বইখাতা, কলমের পাশে টিফিনের বাটিটি রেখেছিল। এসেম্বলি থেকে ফিরে এসে ব্যাগের চেইন খুলতেই মিলি চোখ কপালে তুলে চিন্তা করতে থাকে।
ব্যাগে বইখাতা কলম ঠিকই আছে। শুধু টিফিনবাক্সটি খোলা পড়ে আছে।
মিলি ঝটপট করে টিফিনবাক্সটি হাতে নিয়ে লক্ষ্য করে। বাটিতে আম্মুর দেয়া তিন পিচ কেকের মধ্যে এক পিচ নেই। আবার দুটো কলার মধ্যে একটি নেই।
স্কুলে এসে ব্যাগটা ক্লাসে রেখে এসেম্বলিতে যাওয়া। আর কয়েক মুহূর্ত পর ক্লাসে ফিরে আসা। এই সামান্য সময়ের ব্যবধানে টিফিনবাক্স থেকে এক পিচ কেক ও একটি কলা উধাও! এ কী করে সম্ভব! তাছাড়া বই খাতা কলম টাকা ইত্যাদি চুরি হতে পারে। কিন্তু টিফিন কি করে চুরি হতে পারে? ইত্যাদি আনমনে ভাবছে মিলি।
পাশ থেকে জ্যোতি বলে উঠলো,
কিরে মিলি! এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?
মন খারাপ করবো না তো কী করবো? দেখ না জ্যোতি, আজ সকালেই আম্মু আমার চোখের সামনে টিফিন দিয়েছেন। স্কুলে এসে ব্যাগটা রেখে শুধু এসেম্বলিতে গিয়েছি। ফিরে এসে ব্যাগ খুলতেই দেখি আমার টিফিনের আংশিক উধাও হয়ে গেছে।
আমার ভাবতেই খারাপ লাগছে। মানুষ কি টিফিনও চুরি করে!
মন খারাপ করিসনে, বন্ধু। আজ তোর টিফিন চুরি হয়েছে। গতকাল আমারও চুরি হয়েছিল। কিন্তু কাউকে বলিনি। আজ কয়েকদিন ধরে দেখছি টিফিন চুরির বিষয়টি নিয়ে সবাই বলাবলি করছে।প্রতিদিন দুই/তিন জনের টিফিন চুরি হচ্ছে। এ যাবৎ কেউ সাহস করে ক্লাসটিচারের কাছে নালিশও দিইনি। এখন যা মনে হচ্ছে নালিশ করতেই হবে। অন্যথায় টিফিন চোর আরও আশকারা পেয়ে যাবে। চল, আমরা ক্লাসটিচারের কাছে নালিশ দিই।
মিলি ইতস্তত করে বলল,
না, থাক। আজ যেহেতু প্রথমবারের মতো আমার টিফিন চুরি হলো। আজ কোন নালিশ করবো না। আবার কোনদিন চুরি হলে নালিশ করবো।
আচ্ছা ঠিক আছে।
এরিমধ্যে ক্লাসের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। রেজা উচ্চশব্দে বলে উঠলো,
আমার টিফিন কে নিয়েছে? ব্যাগেই তো ছিল।
মিলি ও জ্যোতি এগিয়ে এসে কৌতূহলী হয়ে বলল,
তোমারও কি টিফিন চুরি হয়েছে?
রেজা কাঁদো গলায় বলল,
হ্যাঁ, আমার ব্যাগে পিঠা, একটি ডিম ও এক প্যাকেট পটেটো চিপস ছিল। এখন শুধু ডিমটাই পড়ে আছে।
জ্যোতি রেজার আরো কাছে এসে বলল,
তুমি একদম মন খারাপ করো না। যা হবার তা হয়ে গেছে।
আমি সেজন্য মন খারাপ করিনি। প্রতিদিন আম্মু নতুন নতুন আইটেম বানিয়ে দেন। পিঠা নিয়েছে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু চিপস কেন নিলো? টিফিনে আমি মূলত চিপসই খায়।
ওহ! আচ্ছা। আজ আমার টিফিন চুরি হয়নি। তুমি চাইলে আমার কাছ থেকে নিতে পারো।
এই কথা বলে জ্যোতি নিজের ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট চিপস এনে রেজার হাতে দিল।
এরিমধ্যে ক্লাসটিচারের আগমনে সবাই মনোযোগী হয়ে ক্লাস করতে লাগলো।
এভাবে আরও কিছুদিন কেটে গেল। প্রতিদিনই কারো না কারোর টিফিন চুরি হচ্ছে। টিফিন চুরির বিষয় এখন ক্লাসের সবার মুখেমুখে। কিন্তু কে বা কারা টিফিন চুরি করছে তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
একদিন রেজা, জ্যোতি ও মিলি স্কুল ছুটির পর একান্তে বসে টিফিন চোরকে ধরবার জন্য পরিকল্পনা করলো।
পরদিন আগে আগে ওরা স্কুলে আসে। নিজের ব্যাগগুলো সুন্দরভাবে রেখে ক্লাস সংলগ্ন মাঠের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ওদিকে ওদের ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীরাও তাদের ব্যাগ ক্লাসে রেখে এসেম্বলিতে যোগ দিচ্ছে। এসেম্বলি শুরু হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। সবার পরে সুজন ক্লাসে প্রবেশ করে। সে কাঁধ থেকে তার ব্যাগটা নামিয়ে এদিক ওদিক লক্ষ্য করে। তার চারদিকে চাহনি মিলিদের মনে সন্দেহ জাগায়। তারা আরও মনোযোগী হয়ে তাকে লক্ষ্য করতে থাকে। সুজন তড়িঘড়ি করে তিনটি ব্যাগের চেইন খুলে একটু একটু করে টিফিন বের করে নেয়। এরপর সুজন তার নিজের ব্যাগে তা রাখতে যাবে এমন সময় ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে রেজা, জ্যোতি ও মিলি “চোর! টিফিন চোর!” বলে জোরে জোরে চিৎকার করতে করতে ক্লাসের দিকে ছুটে আসে। তাদের এভাবে ছুটে আসতে দেখে সুজন হতভম্ব হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মিলি ও জ্যোতি টিফিনসহ তাকে হাতেনাতে ধরে রাখে। আর রেজা স্কুল ভবনের নিচতলায় দায়িত্ব পালনকারী আইয়ান স্যারকে বিস্তারিত বলে ক্লাসের দিকে নিয়ে আসে।
আইয়ান স্যারকে দেখে সুজন লজ্জায় মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আইয়ান স্যার সুজনের আরও কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
তোমার হাতের এসব কার কার ব্যাগ থেকে নিয়েছো?
সুজন ভয়ে কোন কথা বলতে পারে না। দুচোখের জল ছেড়ে দিয়ে কেঁদে ওঠে।
আইয়ান স্যার রাগত স্বরে বললেন,
তোমার রোল নং কত?
সুজন ক্ষীণকন্ঠে বলল,
-স্যার, ৭।
এরপর একটি ছোট নোটবুকে সুজনের নাম, ক্লাস, রোল লিখে নিয়ে আইয়ান স্যার উপস্থিত সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মাঠের এসেম্বলিতে যোগ দেন।
এসেম্বলি শেষে শিক্ষার্থীরা যে যার ক্লাসের দিকে আর শিক্ষকরা শিক্ষক মিলনায়তনের দিকে চলে যায়।
ঘড়িতে নয়টা বাজতেই ঘন্টা বাজলো। সব স্যারের মতো আইয়ান স্যারও শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতা হাতে নিয়ে ক্লাসের দিকে হাঁটছেন।
স্যারকে ক্লাসে আসতে দেখে সুজন ভয়ে মাথানিচু করে থাকে।
আইয়ান স্যার ক্লাসে প্রবেশ করার সাথে সাথে প্রায় সবাই সমস্বরে বলে ওঠে- স্যার, টিফিন চোরকে স্কুল থেকে বের করে দিন। আমরা একজন চোরের সাথে মিশবো না।
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আইয়ান স্যার সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। এরপর সুজনকে তাঁর কাছে ডাকলেন। সুজন কাঁপা-কাঁপা পায়ে এসে স্যারের সামনে হাত দুটো এক করে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আইয়ান স্যার তাকে ঘৃণার স্বরে বললেন,
কবে থেকে টিফিন চুরি শুরু করেছো? আর কেনই বা টিফিন চুরি করছো? চুরি করতে লজ্জা লাগে না?
সুজন দুচোখের জল ছেড়ে নির্বাক কাঁদতে থাকে।
আইয়ান স্যার আবার বললেন,
কি হলো? এখনও জবাব দিচ্ছো না কেন? তাড়াতাড়ি সত্য কথা বলো।
এটি স্কুল। এখানে কোন চোরের জায়গা নেই। তোমার কিছু বলবার থাকলে এখন আমায় বলতে পারো। নইলে প্রধানশিক্ষকের কাছে নিয়ে গিয়ে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেবো, বুঝলে?
এবার সুজন কাঁদো গলায় বলতে লাগলো,
স্যার, আমায় ক্ষমা করুন। আমি আর কোনদিন কারো টিফিন চুরি করবো না। প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবো।
না খেয়ে থাকবে কেন? তোমার বাসা থেকে কী কোন টিফিন দেয় না?
সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
স্যার, আমার জন্মের পরপর আমার মা মারা যায়। আমার বাবা একটি হোটেলে কাজ করেন। শুনেছি আমাকে বাঁচাতে বাবা আমার জন্য ঘরে নতুন মা আনেন। সেই মা আমাকে প্রথম প্রথম খুব আদর করতেন। কিন্তু আমার সেই মায়ের নিজের সন্তান হওয়ার পর থেকে আমার সব আবদার মায়ের কাছে অন্যায় বলে মনে হতো। মা আমাকে কারণে অকারণে মারতেন। বাবা প্রথম প্রথম এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও মায়ের আচরণে এখন নীরব থাকেন। আমার বাবা খুব ভালো মানুষ। প্রতিদিন কাজ শেষে বাবা বাসায় এলে আগে আমার সাথে কথা বলেন। আমাকে নিয়মিত পড়াশোনা করতে বলেন। আমার নিজেরও পড়াশোনা করতে ভালো লাগে। মা আমাকে আগে টুকিটাকি টিফিন দিতেন। কিন্তু গত মাস থেকে আমায় কোন টিফিন দেন না। বললে বকা দেন। একদিন বাবাকে জানালে বাবা মাকে বেশ বকাবকি করেন। কিছুক্ষণ পর বাবা কাজে চলে গেলে মা আমাকে বেধড়ক মারেন। সেই থেকে আর কোনদিন মা’র কাছে টিফিন চাইনি। বাবার কাছে কোন অভিযোগও করিনি। প্রথম প্রথম আমি টিফিনের সময় ক্লাসের এককোণে বসে থাকতাম। সবাই টিফিন খেতো আর আমি তাদের খাওয়া দেখে দেখে সময় কাটাতাম। আমি যে না খেয়ে আছি তা কখনো কাউকে বুঝতে দিতাম না।
একদিন আমার খুব খিদে পেয়েছিল। আমি কোন উপায় না পেয়ে একজনের ব্যাগ খুলে একটি রুটি আরেকজনের ব্যাগ খুলে একটি কলা নিয়ে আমার ব্যাগে রেখে দিই। টিফিন টাইমে আমি সবার সাথে সেগুলো খায়। কেউ কিছু বলেনি। আমার খিদেও মিটে যায়। সেই থেকে আমি নিয়মিতভাবে টিফিন চুরি করি। স্যার, আমাকে মারেন কাটেন যায় করেন এই স্কুল থেকে বের করে দিয়েন না। আমি কথা দিচ্ছি ক্ষিধায় মরে গেলেও আর কোনদিন কারো টিফিনে হাত দেবো না।
এই কথা বলে সুজন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সুজনের কান্না দেখে আইমান স্যারও কাঁদছেন। ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীরাও কাঁদছে। এরপর আইমান স্যার সুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
এই সুজন, আজ থেকে কারো টিফিন ধরবে না। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, চুরি করা মহাপাপ। এতে মানসম্মান কিছুই থাকেনা। স্রষ্টাও তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর আজকের পর থেকে তোমার নতুন মায়ের কাছে টিফিন চেয়ো না। আগামীকাল থেকে তোমার টিফিনের দায়িত্ব আমার। টিফিন টাইমে একজন পিয়ন এসে তোমাকে টিফিন দিয়ে যাবে।
এরিমধ্যে মিলি, জ্যোতি ও রেজা সামনে এসে হাতজোড় করে সুজনের কাছে ক্ষমা চায়। আর সুজন নিজের সহপাঠীদের মুখের দিকে কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে থাকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প