ভালবাসার খাম

ভালবাসার খাম
ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষজন,ব্যস্ত সব রাস্তাঘাট।যেখানে কেও কাউকে দেখার নেই,নেই কারও পাশে এসে দাড়ানোর মত একজন।সবাই যার যার মত ব্যস্ত। কিন্তু আমার কোন ব্যস্ততা নেই।ফুটপাতের রাস্তায় বেশ আয়েশ করেই হাটছি আমি।এখানে কেও কাউকে কিছু বলার নেই,কারও করার ও নেই।আমি একটু এগিয়ে গিয়ে আবারও শার্টের পকেটে হাত দিলাম।এক হাজার টাকার দুইটা চকচকে নোট উকি দিচ্ছে আমার দিকে।এই টাকা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে আবার শেখাচ্ছে।আমি টাকাটা বের করলাম না। হাতে রাখা খামটা প্যান্টের পকেটে রেখে রাস্তার ওপাশে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম।
দুই হাজার টাকার ভাজে একটা একশো টাকার নোটও দেখতে পেলাম।এটা দিয়ে এসময় বিরিয়ানি খেলে মন্দ হয় না।হয়তো একটু কম খাওয়া হবে কিন্তু খারাপ হবে না।এই রাস্তাটা সবসময় ফাকা থাকলেও আজ বেশ গাড়ি দেখা যাচ্ছে।শো শো শব্দে একে অপরকে পেছনে ফেলে চলে যাওয়ার এক নেশায় নেমেছে তারা।কোনভাবেই ওদিকটায় যাওয়া যাচ্ছে না।কিন্তু যেভাবেই হোক যেতে আমাকে হবেই।ওভারব্রিজের গুরুত্বটা এখন এখানে একটু বেশি হলেও সেটা এখানে নেই।অবশ্য সবসময় এরকম গাড়ি দেখাও যায় না।
আমি আরও একটু এগুতেই কারও ধাক্কায় পিচ ঢাকা রাস্তার সাইডে পড়ে গেলাম।ভেবেছিলাম কেও হয়তো ধাক্কা দিয়েছে কিন্তু সবাই যখন এগিয়ে এসে আমাকে ধরে তুললো তখন বুঝলাম একটা প্রায়ভেট কারের ধাক্কায় আমি পড়ে গেছি।হয়তো একদম কোনার দিকে ধাক্কা লেগেছে তাই কিছু হয়নি।তবে উঠে দাঁড়াতে একটু কষ্টই হচ্ছিলো। পায়ের ব্যথার সাথে হাতে বেশ খানিকটা ছিলে গেছে।কিন্তু আমার ওদিকে কোন খেয়াল নেই।
আমি গাড়িটার দিকে তাকাতেই গ্লাস নামিয়ে ভেতর থেকে কেও একজন তাকালো আমার দিকে।লোকটাকে বেশ চেনা চেনা লাগলেও উনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেন নি।আবার চিনেও না চেনার ভান ও ধরতে পারেন বলা যায় না।আশেপাশের লোকজন যখন তার উপর ক্ষেপে গেলো তখন আমি তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম।আমার এমন আচরনে লোকজন অবাক হলেও আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসলাম। অবশ্য আমার এরকম আচরনে অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।এখানে আমি না হয়ে অন্য কেও হলে এতক্ষনে গাড়িটার সাথে মালিকেরও খবর করে দিত।কিন্তু আমি হাতের কাছে পেয়েও ছেড়ে দিলাম।এর অবশ্য একটা কারন আছে।
ফুল হাতা শার্টটার কনুইয়ের দিকে বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে।কালো বলে শার্টে হালকা রক্ত লাগলেও সেটা বোঝা যাচ্ছে না।এতক্ষন হাটতে ভাল লাগলেও এখন সেই ভাললাগাটা পাচ্ছি না।পায়ে প্রচন্ড ব্যথা।হাতের ছিলে যাওয়া অংশেও বেশ জ্বলছে।জায়গাটা পরিষ্কার করা বেশ জরুরী।অবশ্য সামনেই একটা ক্লিনিক আছে।আমার উদ্দেশ্য এখন সেখানে গিয়ে আর যাই হোক ছিলে যাওয়া জায়গাটা পরিষ্কার করতে হবে।আমি দাঁড়ালাম না,একটু জোরেই হাটার চেষ্টা করলাম।দ্রুত পৌছাতে হবে।
আমি যখন ক্লিনিকে ঢুকলাম তখন প্রায় দু টা বেজে গেছে।এসময় সবাই দুপুরের খাবারের জন্যে আধঘন্টা বিরতিতে থাকে।সেই হিসেবে আমার চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিলো কেও হয়তো আসবে আমার কাছে, হ্যা সেটাই হলো। সাদা এপ্রোন পড়া মেয়েটা ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।তবে ডক্টর হিসেবে তার মুখে হাসি লেগে থাকার কথা থাকলেও আমি সেটা দেখতে পেলাম না।মেয়েটা আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বললো,
-কতবার ফোন দিয়েছি,ধরোনি কেন?আবার বন্ধ করেও রেখেছো। মেয়েটার কথায় আমি একটু চুপ করেই রইলাম।আসলে এসময় এসব নিয়ে কথা বলার কোন ইচ্ছেই আমার নেই।আমি একটু দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে ছিলে যাওয়া হাতটা এগিয়ে দিলাম।কিন্তু কিছু বললাম না।অবশ্য উনি এতক্ষনে বুঝতে পেরেছেন যে আমি কেন এখানে এসেছি।
মানহার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের বললে ভুল হবে।বলতে হবে ভালবাসার।অবশ্য ও আমার বেশ কয়েক বছরের জুনিয়র হবে।মানহার যেদিন মেডিকেলের রেজাল্ট দিল সেদিন মেয়েটা আমাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরেছিল।আমি অপেক্ষায় ছিলাম ওর খুশির মাত্রাটা যেন আরও বেড়ে যায়।এতে করে খুশিতে চুমুও দিয়ে দিতে পারে।কিন্তু মেয়েটা সেটা না করে ওর খুশির দিনে আমার মন খারাপ করে দিয়েছিল। কেটে যাওয়া জায়গাটা দেখে মানহার রাগি মুখটা একদম মলিন হয়ে গেলো।হুট করেই মেয়েটার চোখটা ভিজে উঠলেও সেটা সে বেশ ভালভাবেই কন্ট্রোল করে নিল।তবে এ অবস্থায় আমাকে কিছু বললো না।ওর চেম্বারে নিয়ে আমাকে বসিয়ে দিয়ে যখন কাটা জায়গাটায় হাত দিল তখন আমি আস্তে করে বললাম,
-ওই গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিলাম।তেমন কিছু হয়নি।
-যদি হতো?
মানহার কথায় আমি আবারও চুপ করে রইলাম।কথাটা খারাপ বলেনি।যদি হাতে না লেগে মাথায় লাগতো তাহলে হয়তো আজ অন্যকিছুও হয়ে যেতে পারতো।মানহা একটু চুপ থেকে বললো,
-দেখে চলতে পারো না।যদি বড় কিছু হয়ে যেতো?
-হালকা একটু লেগেছে।
-গাড়িটাকে ধরতে পেরেছিলে নাকি চলে গিয়েছিল?
-আমিই ছেড়ে দিয়েছি। আমার কথায় রাস্তার লোকগুলোর মত মানহাও অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
-ছেড়ে দিয়েছো মানে?
-ওই, লোকটা পরিচিত ছিল।তাই কিছু বলিনি।
-কে?
-আবির।
-আবির!তোমার ক্লাসমেট ছিল যে ওই আবির?
-হ্যা।
-ও কিছু করেনি,তোমাকে তো ওরই এখানে আনার কথা।
-হ্যা,কিন্তু ছেলেটা চিনতে পারেনি আমাকে। আমার কথায় মানহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-মনে আছে তোমার টিউশনির টাকা দিয়ে যখন ওকে ফ্রম ফিলাপ করে দিয়েছিলে,শুধুমাত্র ও টাকার জন্যে এক্সাম দিতে পারবে না বলে?
-ওসব যার মনে রাখার কথা ছিল সেই তো রাখেনি,আমার মনে রেখে কি লাভ।
আমার কথায় মানহা আর কিছু বললো না।এতক্ষনে কেটে যাওয়া জায়গাটাতে ব্যান্ডেজ করা হয়ে হয়ে গেছে।অবশ্য ব্যথাটা এখনও কমেনি। কিছুটা নীরবতা থাকলেও সেটা আর নীরব হতে দিলাম না।আমি পকেটে থাকা দু হাজার টাকা মানহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-গতকালের টাকাটা খরচ করা হয়নি।এটা বরং রেখে দাও। আমার কথায় মানহা আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত চোখে বললো,
-আজ তোমার একটা জব থাকলে ছেলেটা এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারতো না।আসলে এই রঙিন পৃথিবীতে কেও কাউকে মনে রাখে না।যার আছে তাকে সবাই পছন্দ করে কিন্তু যার নেই তাকে পিপড়াগুলাও এড়িয়ে চলে।
-এটা স্বাভাবিক।টাকাগুলা রেখে দাও।লাগবে না আমার। আমার কথায় মানহা কিছু না বলে ওর ব্যগ থেকে আরও কিছু টাকা বের করে দিয়ে বললো,
-রেখে দাও,চাকরি পেলে ফেরত দিয়ে দিও। আমি মানহার হাতে টাকাগুলা দিয়ে আস্তে করে বললাম,
-আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।
-তোমার টাকা না নেওয়ার এই মিথ্যেটা আমি অনেকবার শুনেছি।
আমি এবার মানহাকে আর কিছু বললাম না।পকেট থেকে খামটা বের করে মানহার হাতে দিলাম।যেটা আজ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পিয়ন এসে দিয়ে গিয়েছিল।অবশ্য আমি একবার খুলেছিলাম আবার সেভাবেই রেখে দিয়েছি। মানহার এতক্ষন পানিতে টলমল করা চোখটা এবার পুরোটাই ভিজে উঠে মেয়েটার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।আমি মানহার কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকাতেই মেয়েটা আমাকে বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো।মনে হচ্ছে এতদিন বেকার ও নিজেই ছিল।আজ চাকরি পেয়ে একটু বেশিই খুশি হয়েছে। মানহাকে যখন আমি চেয়ারে বসিয়ে দিলাম ততক্ষনে মেয়েটা চোখ বেশ লাল হয়ে গেছে।আমি ওর চোখের পানি মুছে দিতেই মানহা বললো,
-এবার বাবা আর না করতে পারবে না।
-কিন্তু তোমার বাবার তো ডাক্তার ছেলে পছন্দ।
-আমার এই হাত কাটা ছেলেকেই পছন্দ।
মানহার কথায় আমি কিছু বললাম না।তবে এটুকু বুঝলাম এই মেয়েটাকে আর কাঁদানো যাবে না।কোন ভাবেই না,কোন মতেই না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত