প্রজন্মদোষ

প্রজন্মদোষ

আজ রেজাল্ট হয়েছে এসএসসির। আরিফ অনেকের মতো রেজাল্ট জানতে গেছে স্কুলে। যাওয়ার সময় বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সব সাবজেক্টে এ প্লাস থাকবে তো?”

বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আরিফ বলেছিল, “অবশ্যই থাকবে, থাকতেই হবে!” এরপর সে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। গন্তব্য স্কুল। বাবা বারবার বলে দিয়েছে, রিকশা করে যাবি। আর মা আরও কিছু টাকা দিয়ে বলেছে, রেজাল্ট ভালোই যখন হবে, তখন দু’কেজি মিষ্টিও নিয়ে আসিস।

রিকশা পড়েছিল এক বিশাল জ্যামে। রেজাল্ট দিবে বেলা সাড়ে ১১টায়। আরিফ গিয়ে পৌছায় ১২টায়। স্কুলে ঢুকতেই দ্রাম দ্রাম ড্রাম পেটানোর আওয়াজ পায়। সবার হাসি মুখ দেখে নিজের ভালো রেজাল্ট হবেই- তা যেন একরকম নিশ্চিতই হয়ে নেয় ও। আরিফ বরাবরই প্রথম সারির ছাত্র। রোল সবসময় ১ থেকে ৪ এর মধ্যে থাকে। বেশ বুদ্ধিও রাখে ও।

যাই হোক, হেডমাস্টার স্যারের রুমের সামনে রেজাল্ট টাঙানো। সেদিকে এগোয় আরিফ। নোটিশবোর্ডের আশপাশে কেউ নেই। স্বভাবসুলভ উপরের দিকে নিজের নাম খোঁজে সে। পায় না। কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হয়। আশাহত না হয়ে মাঝামাঝিতে নিজেকে খোঁজে। এবারও পায় না। ডান দিকের ফেল করাদের তালিকায় সহসাই চোখ যায় ওর। আর হাজার ভোল্টের শক খাওয়ার মতো অবস্থা হয়। ফেলদের তালিকায় আরিফের নাম দুই নম্বরে আছে! আরিফ সেখানেই ফিট।

অনেক কষ্টে ওর জ্ঞান ফেরানো হয়। বাড়িতে খবর যায়। ছুটে আসেন তার বাবা-মা। রেজাল্ট শুনে তাঁদের অবস্থাও প্রায় আরিফের মতো হয়ে যায়। আরিফ ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথ, সমাজ, ধর্ম, কেমিস্ট্রি – এই পাঁচ পাঁচটা সাবজেক্টে ফেল করেছে! অবিশ্বাস্য এ ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যায় ড্রামের শব্দ। সবাই ঘিরে থাকে আরিফদের। হেডস্যার একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দেন, আরিফের মতো ছেলেদের জন্যই নাকি তাঁর প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারছে না!

অথচ আরিফ বাস্তবে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজে অনেক ত্যাগ শিকার করেছে। আজ দশ বছর এ প্রতিষ্ঠানে আছে আরিফ। প্রতিটা মুহূর্ত স্কুল নিয়ে ভেবেছে, কাজ করেছে। শেষে তাকে এই সম্মান পেতে হল!

বাসায় কীভাবে সেদিন আরিফ আর ওর পরিবার ফিরেছিল, তা ওরাই ভালো বলতে পারবে। ছোট্ট মফস্বলটার সর্বত্র শিক্ষার্থীরা তাদের উজ্জ্বল মুখ দেখাতে বেরিয়ে পড়েছে…আর আরিফ…

বাসায় ঢুকে আরিফ আবার বেরিয়ে যায়। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে না, সে কোথায় যাচ্ছে। কেউ তাকে ডাকে না। তার মা-বাবার ধারণা এর মতো ছেলেকে রেখে কী হবে? লজ্জা আর ধিক্কার ছাড়া এ আর কী আনবে তাদের জন্য। আরিফের বাবা কাঁদতে কাঁদতে আরিফের মাকে বলেন, “দেখলা, ছেলেটা আমাদের কষ্টের কী মূল্যায়ন করল! সারা জীবন ওর জন্য ব্যয় করলাম, আর ওই হতভাগা আমারে ডুবাইল। আমি আর বাঁচতে চাইনা গো, রাহেলা। আমারে বিষ দাও- খায়ে মরে যাই…”
রাহেলা, আরিফের মা শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।
আরিফ সোজা চলে যায় বাড়ি থেকে বেশ দূরে অবস্থিত সবুজ টিলার ওপারে। সবুজ দীঘির পাড়ে। আর ভাবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। এমন কেন হল? খোদা তার প্রতি এমন অবিচার করল কেন? কী অন্যায় ছিল তার? ইচ্ছে হচ্ছে পুকুরে ডুবে মরতে। না, তাহলে যে হেরে যাবে আরিফ! প্রমাণ করতে হবে না, ও ঠিক জায়গায় আছে!

মোটামুটি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাড়ির পথ ধরে আরিফ। মোড়ের দোকানের সামনে তার এক বখে যাওয়া বন্ধুর সাথে দেখা, “কীরে আরিফ। ফেল করসস নাকি হুনলাম?”
“কে বলল?”

“কইসে, কওয়ার মাইনশের অভাব আছে?”, বলেই ভুস ভুস করে সিগারেটের ধোঁয়া আরিফের মুখের ওপর ছাড়ে।

আরিফ কিচ্ছুটি বলে না। বাড়ি আসে। ওর বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। মা রান্নাঘরে। অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছেন। এদিকে চুলায় কিছু একটা পুড়ছে!
“মা, মা, সব পুড়ে গেল তো!”
ধীরে সুস্থে চুলা বন্ধ করেন রাহেলা। তারপর আগের মতই উদাস তাকিয়ে থাকেন দূরে। জানালা দিয়ে যদ্দূর চোখ যায়। বলেন, “পুড়ুক রে, পুড়ুক। পুইড়া যদি তাও কিছু যন্ত্রণা কমে…

প্রজন্মদোষ

কথাটা শুনে খারাপ লাগে আরিফের। নিজের ঘরে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর বাবা জেগে ওঠেন। ওর রুমে এসেই শুরু করেন চিৎকার, “জানোয়ার, তোকে এই পড়াশোনা শিখাইসি? পাঁচ সাবজেক্টে ফেল করো? বেয়াদ্দপ! পাশের বাড়ির ইব্রাহিম দোকান চালাইসে আর পড়সে। গোল্ডেন এ প্লাস পাইসে। আর তুই? সারাদিন আমরা দুইডা মানুষ খাইট্টা মরলেও তোরে কাজে ডাকি না। সেই তুই আজ পাঁচ সাবজেক্টে ফেল মারলি! তোর দ্বারা আর কী হইব? যা যা, মর গিয়া…”
এরকমই আরও কিছু কথা।

আরিফ তখনই তার কী করা উচিত তা ঠিক করে ফেলে। এই সময় আবার বাবা চেঁচিয়ে ওঠেন, “অই হারামি, এতক্ষণ কই আছিলি? গাঞ্জা-সিগারেট টাইনা ঘরে আইসস? বেতমিজ! অসভ্য কোথাকার!”

সব মুখ বুজে সহ্য করে নেয় আরিফ। বাবার কথাগুলো মনে গভীর দাগ টানে তার। বারবার কানে বাজে, ‘যা যা, মর গিয়া’ শব্দ চারটা। বাবা কত কষ্ট পেয়েই না কথাগুলো বলেছেন।

ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়া একটা লাইন মনে পড়ল, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে খোদার সন্তুষ্টি; পিতার অসন্তুষ্টিতে খোদার অসন্তুষ্টি।’ কিন্তু লাইনটা হাদিসের নাকি কুরআনের তা মনে পড়ছে না ওর। তবে লাইনটা নিয়ে সে আরও কিছু সময় ভাবে। ভাবে, যে জীবনের প্রতি বাবা, খোদা সবাই অসন্তুষ্ট, সে জীবন রেখে লাভ কী? এরচেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। সে রাতেই আরিফ জীবনের শেষ খাওয়া খেয়ে নেয়। রাত ১২টা বাজলে পরে সে নিজের ঘরে রাখা ইঁদুর মারার ওষুধ খেয়ে নেয় পাঁচ-সাত ঢোক। এরপরই লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে।

এভাবেই একটি ‘আরিফ’ অধায়ের শেষ হয়। আরিফ সেদিন আবার নতুন জীবনে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা তাকে আবার দূরে ঠেলে দেয়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। এই প্রজন্মের মানুষ যেন একটু বেশিই আবেগী। কিছু হলেই আত্মহত্যা। তার ওপর আছে পারিবারিক লাঞ্ছনা। একজন কিশোর আর কয়দিক সামাল দিয়ে ঠিক থাকতে পারে? হয়তো বাবা-মার কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পেলে আরিফ আবার নতুন জীবন শুরু করার পথ বেছে নিত। কিন্তু তা আর হল কই? সমাজের কাছে, ধর্মের কাছে নিজে অপরাধী হল তো হল বাবা-মাকেও ফাঁসাল।

কদিন পর দেখা যায়, আরিফের রেজাল্ট ছিল স্কুলের সবচেয়ে ভালো। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল সে। তাহলে আত্মাহুতি দিয়ে লাভ হল কী? আমাদের সমাজের বর্তমান প্রজন্মের একটা বদভ্যাসের ব্যাপার হল আত্মহত্যা। এ যেন এক প্রজন্মদোষ! সমাজকে মেধাশূন্য করার হাতিয়ার!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত