আঁধারটা এখনো ঘন হয়নি। উঠানে দুটো গলার আওয়াজ শোনা গেল। একটা রাজু তা বোঝা গেল। আরেকটা যে এবাদের গলা তা বুঝতে কিছুটা সময় গেল রাকিবের। এবাদটা আবার এলো কখন। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই এবাদ খুব মেধাবী ছেলে। রাকিবের চেয়ে তিন ক্লাস উপরে হলেও ছোটবেলা থেকে এক জায়গায় বড় হওয়াতে খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ওরা। মনে মনে ঘর ছেড়ে না বেরুবার সংকল্প থাকলেও এবাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে আর পারেনি রাকিব। এতোদিন ঘর থেকে বের না হওয়ায় নানারকম মিথ্যে অযুহাত দেখাতে হয় রাকিবের। অবশেষে বালুর মাঠে গিয়ে বসল ওরা তিনজন।
এবাদ ঢাকার একটি নামি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। রাজু আর রাকিব এবার এস এস সি পাশ করেছে। বয়সে আর ক্লাসে ব্যবধান হলেও বাল্য বন্ধু হিসেবে ওদের আন্তরিকতা কানায় কানায় পূর্ণ।
রাকিবের কাছে আসার আগেই রাজু এবাদকে বলেছিল রাকিবের মন খারাপের কথা। হয়েছে কি, ওদের স্কুলে এবার এস এস সি পরীক্ষায় ১৭৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ১৩৭ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। সমস্ত উপজেলায় ওদের স্কুলের রেজাল্ট হয়েছে সেরা। জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সংবর্ধনার আয়োজন হল বিশাল স্কুল মাঠে। দাওয়াত করা হল সকল অভিভাবকদের। সেই সাথে ছিল এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ছিল সাংবাদিকবৃন্দ। সমস্ত মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। আনন্দে ভাসছে চারিদিক।
অনুষ্ঠানে যথারীতি আলোচনা পর্ব চলছে। পেছনের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে এবারই স্কুলটি সম্মানের উচ্চাসন গ্রহণ করেছে। বক্তাদের মুখে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষকদের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ছে। ১৩৭ জন জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীর জন্য সবার সামনে মুখ করে মঞ্চের পাশে আলাদা আসন করা হয়েছে যেন ওদের সোনামুখগুলো সবার চোখে পড়ে।
আলোচনা শেষে জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হল। অনুষ্ঠানে বাকি কেবল দোয়া ও মোনাজাত। এমন সময় এক সাংবাদিক এগিয়ে গেল জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে, সাথে গেল ক্যামেরা। উচ্চ রেজাল্টধারীদের তখনকার উচ্ছাস দেখার মতো। ক্যামেরার আলোয় তাদের উজ্জ্বল চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু সাংবাদিক মহোদয় করল কি! পানিডালের মধ্যে ঢেলে দিয়েছে আরো এক বালতি পানি। “এমন সুন্দর রেজাল্টের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী ছিল” ধরণের প্রচলিত প্রশ্ন না করে তিনি এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, বলত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতার নাম কি? সদ্য জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্র উত্তর দিল, কাজী নজরুল ইসলাম। শুনে সমস্ত অনুষ্ঠান একেবারে ভেস্তে গেল। এরপর এগিয়ে গেলেন আরেক জনের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, বলত বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধ কোথায় অবস্থতি? উত্তর এলো- জানি না। পরের প্রশ্ন আরেক জনকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস কোন তারিখে? উত্তর এলো- ১৬ই ডিসেম্বর। আবার প্রশ্ন, বিজয় দিবস কবে? উত্তর, ২৬শে ডিসেম্বর। সায়েন্স এর ছাত্রকে জিজ্ঞেস করা হল, পিথোগেরাস কি ছিলেন? জবাব এলো, ঔপন্যাসিক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম কি? জানি না।
সাংবাদিকের এহেন কর্মকাণ্ডে শিক্ষক, অভিভাবক আর দর্শকবৃন্দ হতভম্ব। তারা এখন হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শেষমেশ সমাপ্তি অনুষ্ঠান পণ্ড হল। অনেকেই সাংবাদিককে মারতে উদ্ধত হলে পুলিশ এসে ঘটনাস্থল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
এই জিপিএ ৫ প্রাপ্ত উত্তরদাতাদের দলে রাকিবও ছিল। আর সেই অনুষ্ঠানের পর থেকে রাকিবসহ অন্যান্যরা একেবারে যেন উধাও হয়েছে। রাস্তাঘাটে তাদেরকে আর দেখা যায় না। এই সহজের সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর এসএসসি’র সর্বোচ্চ রেজাল্ট করা স্টুডেন্টরা পারবে না তা যেন ঐ সাংবাদিক ছাড়া আর কারোরই জানা ছিল না। এরপর এলাকায় নিন্দার ঝড় উঠেছে।
সবশুনে এবাদ ওদের দু’জনকে বলল, লজ্জায় তোমরা ঘরের বাইরে বেরুবে না ঠিক আছে। কিন্তু তোমরা এই যে অতি সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলে না এর জন্য দায়ী কি তোমরা? মোটেই না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থা এমন নিচে নেমে গেছে যে এখন ৯৯% পাশ করছে। আসলেই কি এটা সঠিক রেজাল্ট? মোটেই না। আমরা মাত্র কয়েকটা বছর পেছনে তাকাই। তখন একেকটা বোর্ডে ২০টা স্ট্যান্ড করত। এই ২০জনের সবাই কিন্তু ৮০% মার্কস পেত না। আর এখন ৮০% মার্কস প্রাপ্তদের সংখ্যা সারা দেশে কত হাজার বলতে পার? হঠাৎ করে এতো মেধা কি আকাশ থেকে ঝরে পড়ল?
এবাদের কথায় রাকিব অথৈ সাগরে একটু হলেও যেন কূলের সন্ধান খুঁজে পেয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প