বাস্তবতার উপলব্ধি

বাস্তবতার উপলব্ধি
যখন আমার প্রথমবার বিয়ে হয় তখন আমার বয়স মাত্র পনেরো বছর । কৈশোর ছেড়ে সদ্য যৌবনে পা রেখেছি । চেহারা মাশাল্লাহ । আশে পাশের সবার নজর আমার দিকে ঝোঁকানো। না বদ নজরের কথা বলছি না । বলছি ঘটকদের আনাগোনার কথা । এই একজন আসে তো সে আবার আসে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ।
মধ্যবিত্ত পরিবার আমার । দুই ভাই বড় আর আমি ছোট । ভাইরা বাবার সাথে মাঠে কাজ করে আর পড়াশোনা করে । টেনেটুনে পাশ করে উপর ক্লাসে যেতে পারলেই হলো । আমি অবশ্য তার উল্টো । ক্লাসে দুই,তিন রোলের মধ্যেই থাকি । পড়াশোনার ইচ্ছা অনেক । কিন্তু ওই যে মধ্যবিত্ত বাধ সাধে । তাই বাবা বা ভায়েরা চায় না আমি পড়াশোনা করি । মেয়ে মানুষ বিয়ে যখন করতেই হবে তখন এত পড়ে কি হবে? সেই তো হ্যাসেল ধরতেই হবে এককালে । ক্লাস টেন এ উঠতে না উঠতেই বিয়ের পিড়িতে আমার টানাটানি পরল । প্রতিবাদ করেও ফলাফল শূন্য । সবাই চায় আমার বিয়ে হোক । দ্বায়িত্ব নেওয়ার একজন অভিবাবক হোক সারাজীবনের জন্য ।
ঘটক চাচা এসে জানালো ছেলে নাকি ঢাকা চাকরি করে । গার্মেন্টসের জুট সেক্শন । চলার মত ভালো বেতন । মেয়েকে সুখে রাখবে । তাদের চাওয়া নাই । তবে মেয়ে পক্ষ মেয়ের জন্য যা দিতে চায় তা দিতে পারবে ।
সমাজের কত ভালো কৌশল এটা তাই না ? ছেলে পক্ষ চায় না । তবে মেয়ের বাপে দিলে সেইটা নিতে আপত্তি নাই । কিন্তু তাতে কম পরলে হু মেয়ের কপালে শনি আছে বৈকি । বাবা তাতেই রাজি হলেন । আমার বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করলেন । তারা আমাকে শুধু নাক ফুল দিলেন দ্বায়িত্ব রক্ষার্থে । বাবা আমার হাতে আর গলায় স্বর্ণ দিলেন । ওরা নাকি বলেছিল তারা নিজেরা কিছুই নিবে না তবে তাদের মেয়েকে যেন সাজিয়ে দেওয়া হয় । সমাজের অদ্ভুদ নিয়ম তাই না ?
ছেলের বাড়িতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা লাগে সব পাঠিয়ে দেওয়া হলো বিয়ের আগের দিন । ছেলে নাকি নতুন ঘর তুলেছে কিন্তু চাকরির জন্য ঘরে থাকে না জন্য কোনো আসবাব তৈরি করে নি । মেয়ের বাড়ি থেকে যাবে তারপর সেই ঘর সাজানো হবে । ছেলে নামানোর সময় তাকে আবার হাতঘড়ি, মোবাইলও দিতে হয়েছে । অসাধারণ ব্যাপার স্যাপার মানতেই হবে । ওরা কিন্তু কিছুই নিবে না । মেয়ের জন্য সব !!! বিয়েতে কাবিন নামা হলো কুড়ি হাজার টাকা । তারা নাকি এর চেয়ে বেশি দিবে না । বিয়ে তো আর খেলনা নয় যে তা ইচ্ছামত ভেঙে যাবে । তাদের এই কথার উপর আর কোনো কথা কেউ বলেনি । বিয়ে হলো । কিছুদিন সংসারের পর পরিবেশ পাল্টে গেল যথারীতি ।
উঠতে বসতে শুনতে হয় “আমরা তো কিছুই চাইনি ওনারা যা দিয়েছেন তা মেয়েকে দিয়েছেন । আমাদের ছেলেরও তো কিছু পাওনা আছে । জামাইকে একটু সাহায্য করতেই পারেন” একদিন , দুইদিন , তিনদিন এমন কথার সাথে বিরক্ত হয়ে গেলাম । স্বামী ঢাকায় থাকে আমাকে নেয় না । আমি বাড়িতে থেকে এসব শুনি । স্বামী তার পরিবারের পক্ষে । এক পর্যায়ে সে বাড়ি এসে গায়ে হাত তুলল । বাসায় এতদিন না জানালেও এখন জানাতেই হলো । বাবা আবার জমি বিক্রি করলেন । টাকা নিয়ে জামাইকে দিলো । জামাই টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে গেল । কিছুক্ষন সব চুপচাপ থাকলেও কিছুদিন পর আবার শুরু করে দেয় । এবার অত্যাচারের সাথে যোগ হলো আমার স্বামীর নিকা করা দ্বিতীয় বউ । সে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে । পুলিশে গেলে আমার বাপ ভায়ের ক্ষতি করবে এটা বলে আমাকে ডিভোর্স দেওয়াতে বাধ্য করেছে ।
যথারীতি ডিভোর্স দিয়ে আবার সেই বাপের ঘর । এর মধ্যে ভাই’রা বিয়ে করছে । তাদের সংসার হয়ছে । আমি এখন পরিবারের বোঝা । সুন্দরী একটা মেয়ে তাও ডিভোর্সি এটা সমাজের লোক মানবে কেনো? মেয়ের আবার বিয়ে দাও । আবার বিয়ে হল আমার । বয়স তখন কুড়ি । এবার বিয়ে হলো মধ্য বয়স্ক এক লোকের সাথে । যার বউয়ের বাচ্চা হয় না জন্য ডিভোর্স হয়ে গেছে । আমার বারণ এবারো গ্রহনযোগ্য হলো না । পরিবারের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করতে হলো তাও নিজের বয়সের দ্বিগুন কাউকে । এবারো বাবা মোটা অংকের টাকা যৌতুক হিসেবে ব্যয় করল ।
এক বছর পার হতেই সবাই বাচ্চা নেওয়ার কথা বলল । কিন্তু আমি আর আমার স্বামী অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছি কনসিভ হচ্ছে না । তাকে ডাক্তার দেখাতে বললে দেখায় না । আমাকেও দেখাতে দেয় না । আমি নিজেই লুকিয়ে গেলাম । ডাক্তারের মতে আমার কোনো সমস্যা নেই । তাকে ঝগড়া করে জোড় করে নিয়ে গেলাম । ডাক্তার বললেন সমস্যা তার । ব্যাপারটা বাধল তার ইগোতে । বাড়ি এসে বেধরক মাইর দিলো । কেনো আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম । হলো না এখানেও সংসার । সমস্যা তার ভুক্তভুগি আমি । আবার বাবার ঘাড়ে আমি । একদিন , দুইদিন কটু কথা আমার সঙ্গী । আশে পাশের সবাই বাঁকা চোখে দেখে । যেখানে বাড়ির লোক দেখতে পায়না সেখানে বাইরের লোক কোন ছাড় ??
এখন আমার একটা প্রশ্ন “” এই পরিস্থিতিতে আমার ভবিষৎ কি “” আমার ভবিষৎ গড়তেই পরিবারের এত চিন্তা । এত টাকা ব্যয় করে অন্যের ঘরে পাঠানো । সেখানে আমার ভবিষৎ কোথায় ? টাকার অভাবেই তো আমাকে বেশিদূর পড়ানো হয়নি !! তাহলে ? আমার বিয়েতে তারা যে লাখ লাখ টাকা খরচ করল সেই টাকা দিয়ে কি আমার পড়াশোনা হতো না ? আর পড়াশোনা করে চাকরিও করতে পারতাম । এখন আমার কি পজিশন? হারিয়ে ফেলা সেই দিন গুলো আর পাবো ? পড়াশোনা আর আগের মত হবে ? বাপের তো আর সেই সাধ্যটুকুও নাই যে আমাকে আবার পড়াবে ।
তাহলে আমার ভবিষৎ কি ? আবার কাউকে বিয়ে করা ? আর না হলে দাসীবাদী খাটা ! এর বাইরে তো আর কিছু না । আমার বলতে কিছু আছে আর ? যদি পড়াশোনা করতে পারতাম তবে “মেধা” থাকতো যা খাটিয়ে আমি নিজেকে
চালাতে পারতাম । বাস্তবতা আমার ভবিষৎ গড়তে গিয়ে ঢস নামিয়ে দিয়েছে । অভিবাবকদের এই উপলব্ধিটা থাকা উচিত । যে টাকা খরচ করে অন্যের ঘরের খুটি লাগাচ্ছেন সেই টাকা দিয়ে নিজের ঘরের খুটির গায়ে আলকাতরা দেন অনেকদিন টিকবে । ততদিনে হয়ত আপনার সেই খুটি পাল্টানোর যথেষ্ট ক্ষমতা হবে ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত