জীবন যেখা‌নে যেমন

জীবন যেখা‌নে যেমন
: সে‌কি! রু‌টিটা পু‌ড়ি‌য়ে ফেল‌লে? শ্বাশু‌ড়ির হঠাৎ ধম‌কে মিতু চম‌কে পেছ‌নে তাকায়। সা‌বেরা বেগম চোখ বড় বড় ক‌রে তা‌কি‌য়ে আ‌ছেন।
: কা‌জের সময় মন কোথায় থা‌কে ব‌লো‌তো? মিতু জবাব দেয় না। শ্বাশু‌ড়ীর মু‌খে মু‌খে তর্ক করা বারন। রু‌টিটা সেঁক‌তে গি‌য়ে পু‌ড়ে গে‌ছে। দোষটা অবশ‌্য পু‌রোপু‌রি মিতুর না। সে রান্নাঘ‌রে নাস্তা বানা‌তে ব‌্যস্ত ছিল। এর ম‌ধ্যেই শ্বাশুড়ীর ডাক পড়ে।
: বৌমা, তোমার শ্বশু‌ড়ের চা টা দি‌য়ে যাও‌নি এখ‌নো। মিতু চা‌য়ের ক‌াপটা দি‌য়ে এ‌সে স‌বে রু‌টি সেঁক‌তে শুরু করে। তখ‌নি আবার ডাক।
: বৌমা, এক গ্লাস পা‌নি দি‌য়ে যাও। নাস্তার আ‌গে গ‌্যা‌স্ট্রিকের ওষুধটা তো খে‌তে হ‌বে। বৌমা তাড়াহু‌ড়োয় রু‌টিটা না তু‌লেই পা‌নি দি‌য়ে আ‌সে। ততক্ষ‌নে রু‌টিটা পু‌ড়ে শেষ। এ প্রায় প্রতি‌দি‌নের গল্প। এক গ্লাস পা‌নি গ‌ড়ি‌য়ে খে‌তে না পারা শ্বাশুড়ী মাও কিভাবে ‌যেন রু‌টি পোড়ার মুহূ‌র্তেই চ‌লে আ‌সেন। ‌তারপরই তো এই কান্ড। মিতু জা‌নে এখন আবার নাটক শুরু হ‌বে। হ‌লোও তাই। শ্বাশুড়ী রী‌তিমত কান্নার হেঁচ‌কি তো‌লেন।
: আজ আমার ছে‌লেট‌া অচল ব‌লে বৌ‌য়ের সংসা‌রে মন নেই। সবই আমার কপাল।
তারপর শা‌হে‌দের ঘ‌রে গি‌য়ে আ‌রেক পশলা বৃ‌ষ্টি বর্ষন।
: হ‌্যা‌ঁরে, বাবা, ঘ‌রের বউ বাই‌রে গি‌য়ে চাক‌রি করলে, দশট‌া পর পুরু‌ষের সা‌থে চলা ফেরা কর‌লে তার আর অচল স্বামীর সংসা‌রে মন বস‌বে কেন? সবই আমার কপাল। শা‌হেদ অ‌নেকটা বিরক্ত হ‌য়েই ব‌লে,
–মা, ও য‌দি চাক‌রি টা না করত ত‌বে এই সংসার কিভা‌বে চলত? ছে‌লের কথা শু‌নে সা‌বেরা বেগ‌মের হাহাকার আরও তীব্র হয়।
: আমার ছে‌লে হ‌য়ে তুই বউ‌য়ের পক্ষ টান‌ছিস? হায়‌রে! রাক্ষসীটা আমার ছে‌লে‌কে জাদু ক‌রে রে‌খে‌ছে। শা‌হেদ চুপ ক‌রে থা‌কে। মা‌কে বোঝা‌নোর চেষ্টা বৃথা। মিতু একটা অচল সংসার টান‌ছে তবু মা‌য়ের ম‌নে এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। পা হারা‌নোর পর শা‌হে‌দের চাক‌রিটা চ‌লে যায়। সংসার যখন আর চল‌ছিলই না, তখন অ‌নেক ক‌ষ্টে মিতু একটা চাক‌রি জোগাড় ক‌রে। একটা মে‌য়ে যে সাম‌ান্য একটু হাত কে‌টে গে‌লে চিৎকার চেঁচা‌মে‌চি ক‌রে সবাই‌কে জড় কর‌তে‌া, এই তো সে‌দি‌নের কথা ও‌কে একটু বক‌লে ফর্সা মুখট‌া টকট‌কে লাল হ‌য়ে যেত ‌কে‌ঁদে বুক ভাসাত আর অ‌ল্পেই মন ভ‌রে হাসত, সেই মে‌য়েটা কেমন পাথ‌রের মূ‌র্তি হ‌য়ে গে‌ছে। যেন তা‌তে প্রান নেই। অথচ সেই মূ‌র্তির উপর ভর ক‌রে পরগাছার মত বে‌ঁচে আ‌ছে শা‌হেদ আর তার বাব‌া মা। যেটুকু প্রানশক্তি বা‌কি আ‌ছে সেটুকুও শু‌ষে নেয়ার অ‌পেক্ষা যেন। নি‌জের পঙ্গু অক্ষম জীব‌নের প্রতি রাগ হয় তার। মা‌য়ের আচর‌নে সেই রাগ তীব্র হতাশায় রূপ নেয়। মা তো সবই জা‌নেন। তবু বারব‌ার মিতু‌কে আঘাত ক‌রে কথা বল‌তে ছা‌ঁড়েন না। ‌কি সুখ পান কে জা‌নে! তার আহাজা‌রি চল‌ছেই।
: হতভাগী মে‌য়ে! অলক্ষ্মী একটা! আমার ছে‌লের জীবনটা শেষ ক‌রে দিল।
মিতু রান্না ঘরে ব‌সে সবই শো‌নে। সে যা‌তে শো‌নে ততটুকু জো‌রেই কথা ব‌লেন শা‌হে‌দের মা সা‌বেরা বেগম। তবু মিতু কখ‌নো কোন কথার জবাব দেয় না। রোজ সকা‌লেই ভা‌বেন আজ বউ‌য়ের সা‌থে খুব ঝগড়া কর‌বেন। ম‌নের যত রাগ আ‌ছে সব ঝাড়‌বেন ওই মে‌য়েটার উপর। কিন্তু মিতু তা‌কে বরাবরই হতাশ ক‌রে। সব‌কিছু চুপচাপ হজম ক‌রে নেয় এমন মে‌য়ে আবার তার পছন্দ নয়। মিতুর ম‌ধ্যে কোন উচ্ছাস বা উ‌ত্তেজনা‌ নেই। যখন রোড অ‌্যাক‌সি‌ডে‌ন্টে শা‌হেদ গুরুতর আহত হ‌য়ে হাসপাতা‌লে প‌ড়ে রইল মা‌সের পর মাস, সেই থে‌কে মিতু নি‌র্লিপ্ত। স্বামীর জীবন নি‌য়ে জ‌মে মানু‌ষে টানটা‌নি। শে‌ষে পা দু‌টো গি‌য়ে জীবনটা রক্ষা পে‌লো কোন ম‌তে। অথচ মে‌য়েটা একটু কা‌ঁদে‌নি। তারপর থে‌কেই মিতু সা‌বেরা বেগ‌মের চো‌খের বিষ। অবশ‌্য তার প্রিয়পাত্রী কখ‌নোই ছিল না ও। বি‌য়ে‌তে রা‌জি হ‌য়ে‌ছি‌লেন শুধু ছে‌লের মু‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে। কিন্তু সংসা‌রে যে এমন অলক্ষী জুট‌বে তা য‌দি ঘুনাক্ষ‌রেও টের পে‌তেন তি‌নি, এ অ‌নিষ্ট কিছু‌তেই হ‌তে দি‌তেন না। নই‌লে একই সা‌থে অ‌্যাক‌সি‌ডেন্ট হ‌লো, তার ছে‌লেটা ম‌রো ম‌রো অবস্থ‌া অথচ মে‌য়েটার দে‌হে সামান‌্য জখমও নেই। এও কি সম্ভব? ওই মে‌য়ে ম‌রে গি‌য়ে তার ছে‌লেটা কেন সুস্থ থাকল না। নেহা‌য়েৎই তার দুর্ভাগ‌্য ব‌লেই এসব হ‌লো। সবই তার কপাল!
মিতু আজ‌কেও চা‌য়ের কাপটা এত জো‌রে টে‌বি‌লের উপর রাখল যে খা‌নিকটা চা ছল‌কে পড়লই। বেশ‌কিছু‌দিন ধ‌রে শব্দটা শা‌হে‌দের কা‌নে খুব লা‌গে। কা‌নে যতটা না তার থে‌কে বে‌শি লা‌গে ম‌নে। শব্দটা নাহ্, ওই শ‌ব্দের সা‌থে মি‌শে থাকা শা‌হে‌দের প্রতি মিতুর বির‌ক্তি। সে‌দি‌কে মিতুর খেয়াল নেই। তার চো‌খে মু‌খে রা‌জ্যের বির‌ক্তি দিন দিন কেবল বে‌ড়েই চ‌লে‌ছে। এখনও নাস্তা তৈ‌রি হয়‌নি। ও‌দি‌কে‌ আটটা বে‌জে যা‌চ্ছে। অ‌ফি‌সের জন‌্য বে‌রো‌তে হ‌বে। তার ঘর সামলা‌তে হয় অ‌ফিস সামলা‌তে হয়। শ্বশুড় শ্বাশু‌ড়ির যত ফরমা‌য়েশ আর স্বামীর সেবা তারপর লেট ক‌রে অ‌ফি‌সে গি‌য়ে ব‌সের ঝা‌ড়ি খাওয়‌া, গাধার খাট‌নি খে‌টে রা‌তে বাসায় ফি‌রে আবার সংসা‌রের দা‌য়ি‌ত্বের সাগ‌রে ত‌লি‌য়ে যাওয়া, গত একবছর ধ‌রে এটাই মিতুর জীবন। ভা‌গ্যিস কোন ছে‌লে মে‌য়ে নেই। অ‌ফি‌সের নেক্সট ডেস্ক ক‌লিগ মি‌সেস খান ঠিকই ব‌লেন, যে সংসারের কোন ভ‌বিষ‌্যৎ নেই সেখা‌নে সন্তানের কথা ভাবাও ঠিক না। বি‌শেষ ক‌রে এমন অ‌নি‌শ্চিত জীবন যেখা‌নে নি‌জেরই অ‌স্তিত্ব সংকট! আজ‌কে শা‌হেদ সাহস ক‌রে ব‌লেই ফে‌লে,
–মিতু, চা‌য়ের কাপটা আ‌স্তে রাখ‌লেই পা‌রো। ভে‌ঙে গে‌লে তো আবার তোমা‌রই টাকা খরচ ক‌রে কিন‌তে হ‌বে। শা‌হেদ ভা‌বে এই বু‌ঝি মিতু চে‌ঁচি‌য়ে উঠ‌বে। আজকাল ওর মেজাজটা যা তি‌রি‌ক্ষি হ‌য়ে‌ছে ন‌া! কোন কথাই বলা যায় না। অবশ‌্য ওরও বা দোষ কি? এমন অশা‌ন্তির সংসা‌রে কত‌দিনই বা ভা‌লো ম‌নে থাকা যায়? হয়ত নি‌জের অজা‌ন্তেই কটু কথা ব‌লে ফে‌লে মে‌য়েটা। কিন্তু শা‌হেদ‌কে অবাক ক‌রে দি‌য়ে মিতু চুপ ক‌রে থাকল। একটু ভরসা পে‌য়ে শাহেদ কথা বাড়ায়।
–মিতু, তোমার কি শরীর খারাপ? ক‌য়েকদিন থে‌কে দেখ‌ছি মুুখটা কেমন শুক‌নে‌া শুক‌নো লাগ‌ছে। মিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফে‌লে জোর ক‌রে হা‌সে।
: না‌গো। এই অসুস্থ সংসা‌রে আ‌মি অসুস্থ হ‌লে চল‌বে কি ক‌রে বল‌তো? তোম‌ার আর তোমার বাব‌া মার মু‌খে অন্ন যোগা‌বে কে? স‌ত্যিই তো! এরপর আর শাহেদের মুখে কথা সরে না। সে চায়ে চুমুক দেয়। শা‌হেদ সকা‌লের চা টা শেষ না করা পর্যন্ত মিতু তার পা‌শে দা‌ড়ি‌য়ে থা‌কে। এটা তার অ‌নেক পুর‌নে‌া অভ‌্যাস। শত ব‌্যস্ততার মা‌ঝেও সে এই অভ‌্যাসটা ধ‌রে রে‌খে‌ছে। আ‌গে টুকটাক কথা হত। এখন আর হয় না। মিতু ধৈর্য‌্য ধ‌রে অ‌পেক্ষা কর‌ছে।
–মিতু, শুধু শুধু ব‌সে থে‌কো ন‌া। এম‌নিতেই তোমার অ‌ফিস যে‌তে দে‌রি হয়। শাহেদের কথায় এবার মিতুর মেজাজটা স‌ত্যি খারাপ হ‌য়ে যায়। অ‌নেকটা ঝা‌ঝের সা‌থেই জবাব দেয়।
: সে নি‌য়ে তোমাকে ভাব‌তে হ‌বে না। তু‌মি আর তোমার মা মি‌লে তো আমার জীবনের সব সুখ কে‌ড়ে নি‌য়েছ, যেটুকু বা‌কি আ‌ছে তা‌তেও ভাগ ব‌সিও না। মিতু কথাটা রাগ ক‌রে বল‌লেও শা‌হে‌দের মন ভা‌লো হ‌য়ে যায়। তারমা‌নে মিতুর ম‌নে ওর জন‌্য ভা‌লোবাসা এখনও অব‌শিষ্ট আ‌ছে। চা‌য়ের কাপটা না‌মি‌য়ে রাখার পরও যখন মিতু চ‌লে গেল না তখন শা‌হেদ আবার ধী‌রে ধী‌রে বল‌তে শুরু ক‌রে,
–মা আজও তোমা‌র সা‌থে খারাপ ব‌্যবহার ক‌রে‌ছে। আ‌মি সব দে‌খি, শু‌নি কিন্তু আমার তো বলার কিছু নেই, মিতু। শুধু মা‌য়ের হ‌য়ে তোমার কা‌ছে ক্ষমাই চাই‌তে পা‌রি।
: আ‌মিও তো তোমার সা‌থে খারাপ ব‌্যবহার ক‌রি।
–তা ক‌রো গি‌য়ে। ওসব তোমার রা‌গের কথা। কিন্তু এত কিছুর প‌রেও মা‌য়ের মু‌খের উপর কখ‌নো কথা ব‌লো না, তা‌কে সম্মান ক‌রো, এই তো অ‌নেক।
: মাও ওসব কথা রাগ ক‌রে ব‌লেন। মন খারাপ হয়, কিন্তু অত ভাব‌লে কি আর চ‌লে!
–মিতু?
: হু
–তু‌মি এত ভা‌লো কেন?
: তোমার বউ যে! এই জন‌্য।
শা‌হেদ হা‌সে। অ‌নেক‌দিন পর তার ঠোঁ‌টে সেই পুর‌নে‌া হা‌সিটা দে‌খে মিতুর চো‌খ ভি‌জে যায়। মিতুর কি‌শোরী মন মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া বোকা বোকা চেহারার ছে‌লেটা‌কে যতটা অপছন্দ ক‌রে‌ছিল, সে হাস‌তেই ঠিক ততটাই মুগ্ধ হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছিল। ছেলেটা একদিন হুট করে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। হাতে কোনো গোলাপ ছিল না। তারপর আবার কেমন ভাবলেশহীন মুখে বলেছিল, ভালোবাসি।
মিতু চোখ কটমট করে জবাব দেয়, তো আমি কি করবো? ওর কথা শুনে ছেলেটা হেসে ফেললো। মিতু আর চোখ সরাতে পারে না। বল‌তে গে‌লে শা‌হেদ নয় ওর এই হা‌সিকেই ভালোবেসে ছিল সে। ওদের ভালোবাসা যতটা মসৃন ছিল তাকে বি‌য়ের পরিনতি দিতে পারাটা ছিল একটু ক‌ঠিন। মিতুর বাবা মা প্রথম‌ থে‌কেই কোন এক অদ্ভুত কার‌নে শা‌হেদ‌কে পছন্দ কর‌তেন না। ছে‌লে লেখাপড়া জানা, ভা‌লো একটা চাক‌রিও পে‌য়ে‌ছে না‌কি। তবুও এলাকার ছে‌লে ছোকরা‌কে কি আর জামাই বানা‌নো যায়? কিন্তু শা‌হেদ আর মিতুর সম্পর্কটা যখন বাড়াবা‌ড়ি পর্যা‌য়ে চ‌লে গেল, শা‌হে‌দের বন্ধুরা মিতু‌কে ভা‌বি ডাক‌তে শুরু ক‌রে দিলো তখন বাবা মিতু‌কে ডে‌কে বেশ গ‌ম্ভীর গলায় ব‌লে‌ছি‌লেন,
–শোন মিতু, শা‌হেদ ছে‌লে খারাপ না। য‌থেষ্টই নম্র ভদ্র। কিন্তু ও‌কে আমার জামাই হিসে‌বে পছন্দ হয় না। বাবার কথা শু‌নে মিতু ফ‌্যাল ফ‌্যাল ক‌রে তা‌কি‌য়ে রইল।তারপর হঠাৎই কান্না শুরু ক‌রে দিল। সে‌ কান্না যেন আর থাম‌তেই চায় না। বাবা মে‌য়ের কান্না দে‌খে থতমত খে‌য়ে গে‌লেন। আর যাই হোক তি‌নি মে‌য়ের চো‌খে পা‌নি সহ‌্য কর‌তে পা‌রেন না। স্ত্রী‌কে ডে‌কে বল‌লেন,
–মিতুর মা, মে‌য়ে‌কে কান্না থামা‌তে ব‌লে‌া। এ কেমন বিড়ম্বনা! এত কান্নার কি আ‌ছে? যে মে‌য়ের হা‌সিমুখ দেখার জন‌্য অন‌্যত্র বি‌য়ে দি‌তে চা‌চ্ছি তার চো‌খেই পা‌নি? শেষ মেশ বাবা অ‌নেকটা বিরক্ত হ‌য়েই শা‌হে‌দের সা‌থে বি‌য়ে‌তে রা‌জি হ‌লেন। বি‌য়ের দিনও বারবার পায়চা‌রি করে‌ছেন আর নি‌জের ম‌নে বিড়‌বিড় ক‌রে ব‌লে‌ছেন, “এসব আবার কি? একটা ছে‌লে‌কে বি‌য়ে করার জন‌্য এত কান্না!” বাবা‌কে কান্না অস্ত্র দি‌য়ে এ‌কে বা‌রে পরাভূত ক‌রে ফেলে‌ছিল মিতু। পুর‌নো দি‌নের কথা ম‌নে পড়‌তেই তারও ঠোঁটের কো‌নে হা‌সি খে‌লে যায়। কত সা‌ধের ভা‌লোবাসা তার। অথচ এখন সময় ক‌রে শা‌হে‌দের সা‌থে কথাও বলা হয় না। জীবন তা‌কে এমন ক‌ঠিন পরীক্ষায় ফে‌লে‌ছে যেখা‌নে প্রতি‌নিয়ত নি‌জে‌দের একটু নিঃশ্বাস নেয়ার জন‌্য হাসফাঁস কর‌তে হ‌চ্ছে, ভা‌লোবাসা তো ক‌বেই সেখা‌নে দম আট‌কে প‌ড়ে আ‌ছে।
খুব বে‌শি হ‌লে ছ’ কি সাত মাস তার‌া স্ব‌প্নের মত সংসার ক‌রে‌ছিল। তারপরই তা‌দের জীব‌নে বিনা মে‌ঘে বজ্রপাত হয়ে নে‌মে আ‌সে ওই সড়ক দুর্ঘটনা। সদ‌্যই কক্সবাজার ঘু‌রে এ‌সে ঢাকায় ফির‌ছিল তারা। বাসটা নিয়ন্ত্রন হা‌রি‌য়ে খা‌দে প‌ড়ে যায়। মিতু হাসপাতা‌লের বারান্দায় নি‌জে‌কে অক্ষত দেখ‌তে পায়, অথচ তার স্বামী তখন মৃত‌্যুর সা‌থে পাঞ্জা লড়‌ছে। কোন দীর্ঘ সুখ স্বপ্ন ভে‌ঙে গি‌য়ে হঠাৎ ঘুম থে‌কে জে‌গে ওঠা মানু‌ষের মত থম‌কে যায় সে। একটুও কাঁদ‌তে পারে না মে‌য়েটা। বারবার সেই স্ব‌প্নে ফি‌রে যে‌তে মন চায়। কিন্তু চো‌খে যে ঘুম নেই। এক সময় মিত‌ু্ ইচ্ছা ক‌রে রাত জাগত। রা‌তের পর রাত ঘু‌মো‌তো না, শুধু শা‌হে‌দের সা‌থে কথা বল‌বে ব‌লে। অল্প কথায় তার আবার মন ভ‌রে না। ফো‌নের ওপা‌শে শা‌হেদ বারবার হাই তুল‌তো। কিন্তু মিতু ও‌কে কিছু‌তেই ঘু‌মো‌তে দিত না। শা‌হেদ যখ‌নি আকুল হ‌য়ে বলত,
–প্লিজ! মিতু, এখন একটু ঘুমাই?
: না, আ‌রেকটু কথা ব‌লি?
–মিতু, এমন ক‌রে রাত জাগলে পরে কিন্তু অভ‌্যাস হ‌য়ে যা‌বে। চাই‌লেও আর ঘুমা‌তে পার‌বে ন‌া। তখন মিতু কপট অ‌ভিমান দে‌খি‌য়ে বলত,
: হ‌্যা‌ঁগো, বি‌য়ের পর য‌দি আমার স‌ত্যিই ঘুম না আ‌সে, তু‌মি আমা‌কে ফে‌লে ঘু‌মি‌য়ে পড়‌বে?
–উহু, একদমই না। আ‌মি তোম‌ার চু‌লে বি‌লি কে‌টে ঘুম পা‌ড়ি‌য়ে দে‌বো।
: তারপরও য‌দি ঘুম না আ‌সে? তাহ‌লে? –তাহ‌লে? উমম..তাহ‌লে আর কি? আ‌মিও ঘুমা‌বো না।
: কি কর‌বে?
–সারা রাত দুজন গুটুর গুটুর ক‌রে গল্প করব।
: বেশ তো! তাহ‌লে এখনও গল্প ক‌রো। গুটুর গুটুর ক‌রে।‌
নি‌জের কথার ফা‌ঁদে নি‌জেই ফে‌ঁসে গি‌য়ে শা‌হে‌দেরও আর ঘুম‌ানো হ‌তো না। ফোনালা‌পে রাত ভোর হ‌য়ে যেত। কিন্তু বি‌য়ের পর তারা খুব একটা রাত জে‌গে গল্প করার সু‌যোগ পায়‌ নি। শা‌হেদ অসুস্থ শরী‌রে জে‌গে থাক‌তে পা‌রে ন‌া। শুধু তো আর পঙ্গুত্ব নয়, এমন বিছানায় প‌রে থাক‌লে মানু‌ষের রো‌গের শেষ থা‌কে না। মিতুও ঘু‌মো‌তে চায়। একটা স্বপ্ন দেখার জন‌্য হ‌লেও ঘু‌মো‌তে চায়। কিন্তু তার চো‌খে আর ঘুম নেই। রাতজাগাটা স‌ত্যিই অ‌ভ্যেস হ‌য়ে গে‌ছে। সে রাত জা‌গে কখ‌নো হঠাৎ জ্ব‌রে পড়া স্বামীর কপা‌লে জলপ‌ট্টি দি‌তে কিংবা চিড় ধরা হা‌ড়ের ব‌্যথার উপশ‌মে গরম সেঁক দি‌য়ে দি‌তে। স্বামীর সেবা করা স্ত্রীর ধর্ম, ওই গুটুর গুটুর গল্প করা বু‌ঝি তার সা‌জে না! ভালোবাসায় অনুরক্তা মিতু অ‌নেক স্বপ্ন‌ই দে‌খে‌ছি‌লো, কিন্তু একজন স্ত্রীর জীব‌নে সেই সব স্বপ্ন অধরাই থে‌কে গে‌ছে। স্বপ্নগু‌লো কখ‌নো জীবন হ‌তে পা‌রে না। জীবন স্বপ্নের মতোও না। জীবন তেমনই, যেখা‌নে যেমন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত