মায়ের মত শাশুড়ি

মায়ের মত শাশুড়ি
বিয়ের পর শশুর বাড়িতে এটা আমার প্রথম রোজা।প্রথম দিনই শাশুড়ি আম্মা আমাকে গম্ভীর মুখে বললেন ‘আতিকা আজকে সব ইফতারি তুমি বানাবে।আর পুরোটা একা একা করবে, কারো সাহায্য ছাড়া’।
শাশুড়ির মুখে কথাটা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কারন বিয়ের আগে কখনো এভাবে একা একা দায়িত্ব নিয়ে পুরো ইফতারিটা আমি বানাইনি। বাসায় মাকে টুকটাক সাহায্য করতাম।একেবারে পারিনা তা না, পরি টুকটাক।তবে ভালোভাবে পারি না। অনেক সাহস নিয়ে ঢুকলাম রান্না ঘরে।অনেক কষ্ট করে ইফতারি বানানো শেষ করলাম।ইফতারি সব খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেখলাম ৬রকম খাবার বানিয়েছি আমি। সাথে ছিলো লেবুর সরবত। সবাই ইফতারির জন্য খাবার টেবিলে এসে বসলো।শাশুড়ি আম্মা একবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন আর একবার টেবিলে সাজানো খাবারের দিকে।সেটা দেখে আমার স্বামী সৌরভ মিচমিচ করে হাসছে। শাশুড়ি আম্মা সব খাবার গুলো দেখতে দেখতে একটাখাবারের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন’এটা কী বৌমা?
-আম্মা ওটা পেগুনি।
-মানে?বেগুনি তো শুনেছি।এই পেগুনি নামটা তো জীবনের প্রথম শুনলাম।আর এত তেল দিয়েছো কেনো? পেটের সমস্যা হবে তো।আম্মা ভ্রু কুচকে বললেন’তোমার মা কি কিছুই শেখাননি বিয়ের আগে তোমাকে?’
-জ্বী আম্মা ইয়ে মানে।বাসায় বেগুন ছিলোনা তাই পেপে কেটে পেপে দিয়ে বানিয়েছি পেগুনি। আমি কথাটা বলা মাত্র বাসার সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে।সাথে সৌরভও। সৌরভ তো এক প্রকার খিলখিল করে জোরে হেসেই ফেললো।আমি লজ্জাই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম। সবাই ইফতারি শেষ করে যে যার রুমে চলে গেলো।কেউ ঠিক মত খাইনি।মনে হয় খাবার গুলো কারো পছন্দ হয়নি। আমি সবগুছিয়ে রুমে গিয়ে বসলাম।সৌরভ আস্তে করে পাশে এসে বসে বললো’সরি আতিকা।
-কেনো?
-তখন ঐভাবে আমার হাসাটা উচিৎ হয়নি।
-আমি সৌরভের কথা শুনে চুপ করে রইলাম।হাতটা পুড়ে গেছে।খুব জ্বালা করছে।মনের অজান্তে কখন চোখে পানি চলে এলো বুঝতেই পারি নি। সৌরভ আমার হাতটা ওর কাছে টেনে নিয়ে মলম লাগাতে লাগাতে বললো,
-এত ছেলেমানুষ কেনো তুমি?একটু সাবধানে কাজ করতে পারো না।একা একা না পারলে মাকে ডাকতে পারতে। কতটা পুড়িয়ে ফেলেছো দেখোতো।ইসসস। আমি চুপ করে রইলাম।ওকে আর বললাম না যে আম্মা সবটা আমাকে একা একা করতে বলেছেন।
পরেরদিনো ঠিক একি ভাবে একা একা সব রান্না করেছি শাশুড়ি আম্মা রান্নাঘরে একবারের জন্যে উকি দিয়েও দেখেননি।সেদিন খাবার সময় আম্মা বললেন ‘এটা কী মানুষের খাবার উপযুক্ত?এত ঝাল মানুষ খাই? আমারো তো একটা মেয়ে আছে সেও তো স্বামীর ঘর করছে।দেখো গিয়ে কোন কাজটা সে পারে না।এমন কোনো কাজ নেই যেটা সে পারে না। কথাটা বলে খাবার রেখে মা উঠে চলে গেলেন। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম ঐদিন।মনে হচ্ছিল যদি আজ আমার নিজের মা হতো তাহলে হয়তো আমাকে নিজের হাতে রান্না শিখিয়ে দিতো।মানুষ ঠিকি বলে ছেলের বৌ কখনো নিজের মেয়ে হতে পারে না।আমাকে যদি উনি নিজের মেয়ে ভাবতেন তাহলে একটু শিখিয়ে দিতেন।কথাগুলো ভাবছি আর কাঁদতে কাঁদতে রান্নাঘরে থালাবাসন পরীষ্কার করছি ঠিক তখনি কেউ একজন মাথাই হাত দিলো আমার তাকিয়ে দেখলাম আমার শশুর আব্বা।আব্বা কে দেখে চোখের পানি মুছে বললাম বাবা আপনার কিছু লাগবে?
-না মা।আমার কিছু লাগবে না।একটা কথা বলবো মা যদি কিছু মনে না করিস?
-জ্বী বাবা অবশ্যই বলুন।
-দেখ মা, তোর শাশুড়ি একটু ঐ রকমি মাথা গরম ওর একটু।
কিন্ত ওর মোনটা ভীষণ ভালো।তুই একটু ধৈর্য্য ধর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।একটা কথা মনে রাখিস মা কখনো হাল ছেড়ে দিবি না।কথাটা বলে বাবা চলে গেলেন। কিছুদিন পর আমার ননদ মিথিলা আর তার শাশুড়ি বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়, মিথিটা ওর শাশুড়িকে ডক্টর দেখাতে এনেছে এখানে। রোজকার মত আজো আমি সব ইফতারি বানালাম টেবিল ভর্তি করে।আজ বাসায় মেহমান তাই অন্যদিনের চেয়ে আজ খাবারের আয়োজন একটু বেশি। আমি রান্না করছি আর মা, মিথিলা, আর ওর শাশুড়ি রান্নাঘরের পাশে বসার রুমে বসে গল্প করছেন। আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম আমি কাজ করছি আর আমার ননদ মানে মিথিলার শাশুড়ি বার বার আমাকে দেখছেন আড় চোখে। রান্না শেষে খাবার গুলো টেবিলে সাজালাম।আজ মোট ১২ রকম খাবারের আয়োজন করেছি। সবাই খাবারের টেবিলে এসে বসলো।সাথে সাথে মিথিলার শাশুড়ি বলে উঠলেন,
-বাবারে বাবা এত কিছু সব তুমি একা করেছো আতিকা?
-জ্বী।
-বাহ্ তোমার তো বেশ গুন আছে বলতে হবে।বিয়ের এক মাসে হলো না আর এত কিছু সব একা একা কীভাবে?
-ইয়ে মানে।
-তোমার মত মিথিলা যখন প্রথম প্রথম আমার বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিলো তখন তো ও একটা ডিম ভেজেও খেতে পারতো না।ওকে আমি নিজের হাতে সব শিখিয়েছি।
-হ্যাঁ ভাবি, মা আমাকে সব রান্না নিজের হাতে শিখিয়েছেন।আমি তো কিছুই পারতাম না আগে। (মিথিলা)। মিথিলা কথাটা বলার সাথে সাথে দেখলাম আমার শাশুড়ি মা মাথা নিচু করে রইলেন।মনে হয় মা লজ্জা পেয়েছেন।
-আমি তখন বললাম হ্যাঁ মিথিলা আমিও তো কিছুই পারতাম না তোমার মায়ের কাছ থেকে সব শিখেছি।সব তো উনি শিখিয়েছেন আমাকে।
-হুম তাই তো বলি তোমার রান্না করা খাবারে মায়ের রান্নার স্বাদ কোথাথেকে আসলো।ভাবি তুমি তো একদম মায়ের মত রান্না করো,সেই স্বাদ সেই গন্ধ।আহা। একেবারে গন্ধ পেলে মুখে পানি চলে আসে। দেখলাম আমার শাশুড়ি টেবিল থেকে উঠে চলে গেলো। মিথিলারা পরেরদিন চলে গেলো চলে যাবার সময় ওর শাশুড়ি আমার মাথাই হাত রেখে বললেন, ‘সুখি হও মা। বেয়ান অনেক ভাগ্য করে এমন একটা বৌমা পেয়েছেন। একে বৌমা না মেয়ে বানিয়ে রাখবেন। কথাটা বলার সাথে সাথে আমার শাশুড়ি মা ভেতরে চলে গেলেন। সেদিন রাতে মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো বেলকনিতে দাড়িয়ে আছি তখন সৌরভ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-আতিকা তুমি কি সুখি আমাকে পেয়ে?
-এমন কেনো বলছো?হ্যাঁ সুখি আমি অনেক সুখি।
-আতিকা আমার মা এমনি, একটু রাগি।তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও। রাগ করোনা কখনো মায়ের উপরে।
-কি যে বলোনা তুমি রাগ কেনো করবো।মা তো মা-ই তাইনা।হোক সেটা নিজের মা অথবা শাশুড়ি মা।মা আমাকে বকবেন না তো কাকে বকবেন বলো।আমি তো ওনার মেয়ের মত তাইনা বলো? আমি কথাটা বলার সাথে সাথে সৌরভ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,’সত্যি আমার ভাগ্যটা ভীষণ ভালো যে তোমার মত একটা জীবনসাথী পেয়েছি আমি। পরেরদিন বিকালে শাশুড়ি আম্মা আমাকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন,
-বৌমা বৌমা।
-আমি দৌড়ে গিয়ে বললাম জ্বী মা বলুন কিছু লাগবে?
-তেলের কৌটোটা নিয়ে এসো।
-কেনো মা?
-নিয়ে আসতে বলেছি নিয়ে এসে।
-আচ্ছা মা।
-এই নিন মা।
-আমার সামনে বসো। মায়ের কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে।
-এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেনো বসো।
-আমি কিছু না বলে বসে পড়লাম মায়ের সামনে।
মা আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন এত লম্বা সুন্দর চুল যত্ন নাও না কেনো?নষ্ট হয়ে যাবে তো সব চুল। এখন থেকে রোজ আমার কাছে আসবে আমি তেল দিয়ে বিনুনি করে দেবো রোজ।কথাটা বলে মা আমর চুলে বিনুনি করে দিয়ে আমার সামনে এসে বসে আমার হাতদুটো ধরে হঠাৎ করে কেঁদে ফেললেন।তারপর বললেন, আমাকে ক্ষমা করে দিস মা।আমি তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেছি।আজ থেকে তুই আমার বৌমা নয় তুই আমার মিথিলার মত আরো একটা মেয়ে।আজ থেকে আমার দুটো মেয়ে।কথাটা বলে মা আমার কপালে একটা চুমু দিলেন।
-না না মা আমি আমি আপনার মেয়ে হবো না।
-কেনো?এখনো রেগে আছিস আমার উপরে?
-হতে পারি একটা শর্তে?
-কী শর্ত?
-আপনি যে মজার মজার রান্না গুলো করেন ওগুলো সব শিখিয়ে দিতে হবে আমাকে।
-হা হা হা।পাগলি মেয়ে একটা।ঠিকআছে সব শিখিয়ে দেবো।
আমরা দুজন হাসাহাসি করছি তারপর খেয়াল করলাম পর্দার আড়ালে বাবা আর সৌরভও দাড়িয়ে হাসছে। তখন মনে হলো এই তো আমি আমার ফেলা আসা পরিবার আবার ফিরে পেয়েছি।বাবা পেয়েছি মাও পেয়েছি। এখন মনে হয়, না বাড়ির বৌও ইচ্ছা করলে বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠতে পারে।শুধু দরকার ভালোবাসার।ভালো বাসা পেতে হলে আগে তাকে ভালোবাসতে হয়।দেখবেন ঘৃনা করতে করতে একটা সময় সেও আপনাকে ভালোবেসে ফেলবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত