মেয়েটির কন্ঠে “ভাই আগুন হবে” কথাটা শুনে অনেকটা চমকে গেছে অয়ন । একজন সুন্দরী ষোড়শীর মুখে আগুন চাওয়াটা অনেকেটাই বেমানান । আগুন দিয়ে কি করবেন জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল সিগারেট খাবে । অয়ন কয়েকটা কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিল । সে পুরুষ হয়ে সিগারেটকে এড়িয়ে চলে অথচ এক মেয়ে তার কাছে আগুন চাচ্ছে এটা বড়ই লজ্জার বিষয় ।
— দেখুন আমি সিগারেট খাই না তাই আগুন নেই, কিন্তু আপনি মেয়ে হয়ে সিগারেট খান এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়
— মেয়েরা কি সিগারেট খেতে পারে না ।
— পারবেনা কেন, ইচ্ছে করলে পারে কিন্তু সেটা ভালো দেখায় না । সিগারেট পুরুষের ঠোঁটেই ভাল মানায় ।
— আচ্ছা পুরুষেরা সিগারেট কেন খায় বলতে পারেন ?
— যদিও আমি সিগারেট খাই না, তবে যতটুকু জানি, সিগারেট খেলে নাকি টেনশন কমে । দুঃখ ভুলে থাকা যায় । অনেকের আবার নাকি মস্তিষ্ক ভালো কাজ করে সিগারেটের ধোঁয়ায় ।
— আপনি ঠিকই শুনেছেন আমি ঠিক একই কারনে সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি।
আপনার কিসের এতো দুঃখ ? প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সংযত রাখে অয়ন । কারন একজন অপরিচিত মেয়েকে সরাসরি প্রশ্নটা করা যায় না । হঠাৎ করেই মেয়েটা কয়েকটা কাশি দেয় । কাশি গুলো এতোটাই বিশ্রী মনে হচ্ছিলো যে তার কলিজা সহ বেড়িয়ে আসবে । কাশি থামতেই মেয়েটি অয়ন কে আবার জিজ্ঞেস করে
–আচ্ছা ভাই ট্রেন কখন আসবে বলতে পারেন ।
— এখনই তো এসে পড়ার কথা, কিন্তু আপনি তো মনে হয় অসুস্থ ।
— আমি ঠিক আছি আর ট্রেন আসলে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিব তাই দাঁড়িয়ে আছি ।
অয়ন আনেকটা চমকে উঠলো ! মেয়েটি কি বলে আবল তাবল । মেয়েটি আসলেই রহস্য ময় । মেয়েটি তার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তারপর হঠাৎ করে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল । কিন্তু অয়নের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আসলেই কি মেয়েটি ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিবে ! খুব সুন্দর একটি সিট পেয়েছে অয়ন । একেবারে জানালার পাশে, ফুরফুরে বাতাস তাকে বিমহিত করে তুলছে । চোখ বুঝে ভালোলাগাটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিল ।
— আমি কি এখানে একটু বসতে পারি ? হঠাৎ করে আসা প্রশ্নটায় অয়ন চমকে গেছে ।
— কি ব্যাপার, আপনি এখানে ? আপনার না ট্রেনের নিচে থাকার কথা । উপরে আসলেন কিভাবে ?
— না একটা কাজ আছে পূবাইল নামতে হবে । কাজটা সেরেই চিন্তা ভাবনা করব ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়া যায় কিনা — ট্রেন তো অনেক আগেই ছেড়েছে । এতক্ষণ আপনি কোথায় ছিলেন ?
— পাশের কেবিনে ছিলাম । কিন্তু পাশের কেবিনের মানুষ গুলোকে আমার তেমন সুবিধার মনে হলো না । আমি আগেই লক্ষ্য করেছি আপনি এই কেবিনে আছেন তাই এখানেই চলে আসলাম ।
— ঐ কেবিনের লোক গুলো কে ভালো মনে হলো না কিন্তু আমাকে ভালো মনে হওয়ার কারন ?
— আপনাকে আমার ভালো মনে হয়েছে । আর যারা সিগারেট খায় না তারা আরো বেশি ভালো হয় ।
অয়নের সাথে মেয়েটির আরো কিছু টুকটাক কথা হয়েছে । মেয়েটি এখন একটি ডাইরি বের করেছে । সেখানে কি যেন লেখার চেষ্টা করছে তবে ট্রেনের ঝাকিতে লিখতে হয়তো কিছুটা কষ্ট হচ্ছে ।
ট্রেন কতদূর চলে এসেছে অয়ন ঠিক জানে না । কারন সে ঘুমিয়ে পরেছিল । এখন আর পাশের মেয়েটি নেই হয়তো নেমে গেছে । কিন্তু হঠাৎ করে অয়নের চোখ পড়লো পাশের সিটের নিচের পাটাতনে । সেখানে একটি ডাইরি পরে আছে । ডাইরিটি তার পরিচিত । হয়তো তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে মেয়েটি ডাইরিটা ফেলে রেখে গেছে । কৌতূহল বসত ডাইরিটি হাতে তুলে নেয় অয়ন । অন্যের ডাইরি পড়া হয়তো অন্যায় তারপরও একটু চোখ বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করে ডাইরিতে কি লেখা আছে । পাতা উল্টাতেই চোখে পরে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা, আবেগ, ভালোবাসা, অনুভুতি আরো অনেক কিছু । যতটুকু বুঝা গেল মেয়েটি কোন এক ছেলেকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু হঠাৎ শেষ পাতায় এসে তার চোখ আটকে গেল । লেখা গুলো অনেকটা আঁকা বাঁকা, যে লেখা গুলো সে ট্রেনে বসে লেখে ছিল ।
–পলাশ আজ তোমার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকি । আমি আসছি তোমাকে দেখার জন্য । হয়তো তোমাকে দেখতে পাব না কিন্তু তোমার কবরের মাটি ছুঁয়ে তোমাকে অনুভব করার চেষ্টা করব । জানো পালাশ আমি না তোমার কাছে আসার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না । আত্মহত্যা যদি মহা পাপ না হতো তবে এতদিন আমি তোমার কাছে চলে আসতাম । অতিরিক্ত ধুমপানে তোমার ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছিলো । পৃথিবীর কোন ডাক্তার তোমাকে বাঁচাতে পারেনি । তোমার কিসের এতো কষ্ট ছিল সেটা কখনই আমাকে বলনি । এতো বারণ করার পরেও সিগারেট ছাড়তে পারনি কিন্তু আমাকে ছেড়ে ঠিকই পরপার চলে গেছ । জানো পলাশ আমিও না তোমার মত সিগারেট ধরেছি । প্রতি মিনিটে মিনিটে সিগারেট না হলে এখন আমার চলে না । আমি যে ঠিক তোমার মতোই ফুসফুসটাকে পঁচাতে চাই তারপর চলে আসতে চাই তোমার কাছে । আমি ঠিক জানিনা আমার মৃত দেহটা কবে তোমার কবরের পাশে শোয়ানো হবে ।
আজকাল বড্ড কাশি আসে । কাশির সাথে রক্তও বের হয় মাঝে মাঝে । আমি সবাই কে বলে রেখেছি আমার মৃত্যু হলে তোমার পাশে যেন শুইয়ে দেয় আমায় । কিন্তু কেউ আমায় মরতে দিতে চায় না, জানো পলাশ তারপর আর কিছু লেখা নেই । ডাইরিটা পড়ে অয়নের হৃদয়টা বিষণ্নতায় ভরে গেছে । ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । কেন মানুষ কে সিগারেট খেতে হবে ? কেন একজনের ভালোবাসার জন্য আরেকজন ঠিক একই ভাবে মরতে চাইবে । কই আমি তো সিগারেট খাই না । আমার টেনসন গুলোকে আমি কি প্রতিহত করতে পারি না ? আমার সুস্থ মস্তিষ্ক কি সিগারেট না খেলে উজ্জিবিত হয় না ?? আসলে সিগারেট একটা খারাপ নেশা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক দিন চলে গেছে । তার ছয় বছর পর অয়ন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেই আগের জায়গাটায় । একটি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে অয়ন চমকে উঠলো ।
— এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে লাইটার হবে ?
— আরে আপনি ! এখনো সিগারেট খান বুঝি ?
— না এখন আর সিগারেট খাই না । তবে আপনাকে চিনতে পেরেছি তাই কথা বলার জন্যে এগিয়ে আসলাম ।
আসলে আমার প্রিয় মানুষ গুলো আমাকে মরতে দিতে চায়নি। এক ভালোবাসা কে আলিঙ্গন করতে গিয়ে আমি তো হাজার ভালোবাসা কে অপমান করতে পারি না । জীবনটা আসলেই সুন্দর, কিছু সময়ের জন্য হয়তো জীবনটা অসুন্দর লাগে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই অসুন্দরও একসময় সুন্দর হয়ে উঠে ।
— আম্মু আম্মু আব্বু না তোমাকে ডাকছে ? অয়ন তাকিয়ে আছে ছোট্ট মেয়েটির দিকে । কি হাস্যজ্জল এবং মায়াবী ।
— আমার মেয়ে, পেছনের বেঞ্চিতে আমার স্বামী বসে আছে । ভালো থাকবেন ।
— শুনুন আপনার হারিয়ে যাওয়া ডাইরিটা কিন্তু আমার কাছে ।
— আপনার কাছেই থাক কিছু কিছু স্মৃতি মুছে ফেলতে হয় । মেয়েটি চলে গেছে, মেয়েটির মুখে রহস্যময় হাসি অথচ এই মুখেই এক সময় সিগারেটের আগুনে ধোঁয়া উড়তো ।
গল্পের বিষয়:
গল্প