মনে মনে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম, করবনা সংসার এই ভাবলেশহীন রোবটের সাথে যে কিনা আমার ইমোশনের কোনও মূল্য দেয়না। বন্ধু, আত্মীয় যারা বিয়ে করেছে তাঁদের মুখে প্রায়ই শুনি, ওদের বর ওদের নানাভাবে সারপ্রাইজ দেয়। মনে করে বিশেষ দিনগুলোতে বিভিন্নভাবে উইশ্ করে, গিফ্ট নিয়ে আসে, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যায়, একসাথে বাইরে খেতে যায়। কিন্তু আমার বেলায় এসবের কিচ্ছুটি পাইনি আমি। খুব কস্ট হয় আমার। খুব কি বেশী কিছু চাওয়া আমার! আমিও অন্যদের মতো হাজবেন্ডকে নিয়ে গর্ব করে বলতে চাই, আমার বর এই করেছে, সেই করেছে। কিন্তু সেসব বলার মুখ ইমন রাখেনি আমার।
ও তো প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলেনা। আজ অব্দি যতবার বাইরে গিয়েছি আমি বলেছি তবেই গিয়েছি তবে এটাও সত্যি কিছু আবদার করলে আবার না করেনি কোনওদিন। কিন্তু তাইবলে কি সবসময় চেয়ে নেয়া যায়! সেবার পয়লা বৈশাখের আগেরদিন সব বান্ধবীরা গ্ৰুপ চ্যাটে যার যার হাজবেন্ডের দেয়া শাড়ি, অর্নামেন্টস এর ছবি দিচ্ছে। মনটা আমার ভীষণ খারাপ হলো। ইমন কি পারতনা আমাকে অন্তত একটা শাড়ী গিফ্ট করতে! আমার ফ্রেন্ডরা চ্যাটে এক একজন বলতে লাগলো, কিরে রিমি, কি এক কিপ্টে আর আনসোশ্যাল লোককে তুই বিয়ে করলি! আড়াই বছরেও মানুষ করতে পারলি না! আমার তখন ভীষণ কান্না পেয়েছে।
পারিবারিক ভাবেই হঠাৎ করে বিয়ে হয় আমার আর ইমনের। তাই আগে থেকে চেনার কোনও উপায় ছিলনা। তাই বলে এইটুকু কার্টেসী সে মেইনটেইন করবে না! সেদিন ইমন বাসায় ফিরে এলে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দিই ওর সাথে। ও তো পুরো আহাম্মক হয়ে গেছে আর ওর এই ব্যাপারটা আমার রাগ আরও বাড়িয়ে দেয়। আমি ওকে ডিরেক্ট কিপ্টে আর আনসোশ্যাল বলে গালি দিই। ও শুধু আস্ক করে কেন আমি ওকে এভাবে গালি দিচ্ছি! আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, আগামীকাল দিনটা কি তোমার মনে আছে? হ্যাঁ, মনে থাকবেনা কেন! আগামীকাল পয়লা বৈশাখ, বললো ইমন।
ওহ, তবু ভাল যে দিনটা জানো। তা এই দিনে একটু বিশেষ ড্রেসে প্রিয় মানুষদের নিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেতে হয় এটা জানতো! ঘুরতে যেতে চাও, যাবে। আমি কি মানা করি তুমি কোথাও যেতে চাইলে? সবসময় আমাকেই কেন বলতে হবে! আর ঘুরতে যে যাবো কোনও শাড়ী এনেছো আমার জন্য? শাড়ী তো তোমার আলমারী ভর্তি আর এরপরও লাগলে তো তুমি কিনেই নিতে পারো। ঘরে টাকা তো থাকেই আর ব্যাংকে তোমার একাউন্টে তো টাকা জমা হয়ে যায় প্রতি মাসেই। তুমি টাকা যা লাগে নিয়ে খরচ তো করতেই পারো। আমি কি মানা করেছি? বলেই খাটে বসতে গেল ইমন। আমি রাগে, জেদে ওকে বাহু ধরে টান দিয়ে আমার মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নিজের কোনও দায়িত্ব নেই!
ও কাচুমাচু করে শুধু বললো, রিমি আমি এসব একটু কম বুঝি। প্লিজ এসব নিয়ে আমাকে ব্লেম দিওনা। আচ্ছা চলো, মাত্র তো সন্ধ্যা, আমরা শপিং মল এ গিয়ে তোমার যা যা প্রয়োজন কিনে নিয়ে আসি। চরম বিরক্তি থাকলেও বন্ধুদের কাছে সন্মান বাঁচাতে হলেও ওকে নিয়ে শপিং এ যেতেই হবে। শো রুমে ঢুকে আগেই ওকে নিয়ে একটা সেল্ফি তুলে সেটা গ্ৰুপ চ্যাটে আর নিজের ওয়ালে শেয়ার করে দিলাম, বরকে নিয়ে পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা। আমার এসব করা দেখে ইমন বললো, এখনই পোস্ট দিতে হলো! আরে বলোনা, সব কটার মুখ বন্ধ করলাম। পরের দিন নতুন শাড়ি, অর্নামেন্টস আর ইমন নতুন পাঞ্জাবী পরে ঘুরতে গিয়ে সেখানেও অনেক অনেক ছবি তুলে এফবিতে আপলোড করে দিলাম।
এরকম প্রায় সব কাজই ওকে বলে বলে করাতে হয়। আমার বার্থডে টা পর্যন্ত মনে রাখেনা এমনকি এনিভার্সারী। খুব কষ্ট পেয়ে কাঁদতাম, ওকে বকতাম , তুমুল ঝগড়া করতাম কিন্তু তবুও ও যেন পরিবর্তন হবার নয়। আসলে ভালোবাসা বলেই কিছু নেই এই মানুষটার। বেশ কয়েকবার রাগ করে বাবারবাড়ী চলে গিয়েছি কিন্তু আজব ব্যাপার আমি কি কারণে রাগ করেছি সেটা কখনও বুঝতে পারেনা তাই এবার পাকাপাকি ভাবেই চলে যাবো। কিছুদিন আগে দুপুরে হঠাৎ খুব জ্বর হলো আমার। আমার আব্বু, আম্মু সবাই গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। আর আমার শ্বশুর,শ্বাশুড়ী এমনিতেও আমেরিকা তাঁর ছোট ছেলের কাছে থাকেন। তুমুল জ্বরে কাঁপছি দেখে কাজের খালা ইমনকে ফোন দিতেই আধঘন্টার মধ্যে ইমন বাড়ী চলে আসে। তীব্র জ্বরেও আমি ওকে দেখে অবাক হলাম, ব্যবসার কাজ রেখে ও এই অসময়ে বাড়ী এসেছে।
কোনও রকম ভাবলেশহীন মানুষটাকে সেদিন দেখলাম অস্থির হয়ে গেছে আমার জন্য। তাড়াতাড়ি শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি দেয়া, শরীর-মাথা ম্যাসেজ করে দিতে লাগলো। এর মধ্যে ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে গেলেন। রাতে জ্বর আরও বাড়লো। কপালে পট্টি দেয়া, একটু পরপর পুরো শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দেয়া, একটু একটু খাবার খাওয়ানো এসব নিজের হাতে করে যাচ্ছে ইমন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যাই আমি। ও ফ্লোরে বসে আমার সিঁথানের পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। কি যে মায়াবী লাগছিল ওর মুখখানা! তবে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারিনি, জ্বরটা আবার তীব্রভাবে এট্যাক করে, সাথে প্রচন্ড বমি। ও আমার বমির শব্দে তাড়াতাড়ি উঠে আমাকে ধরে বমি করিয়ে, নিজ হাতে পরিষ্কার করিয়ে দেয়। আমি আর চোখ খুলে রাখার শক্তি পাইনি।
দুদিন পর জ্বর একটু কমতে থাকে। আমি দুর্বল শরীর নিয়ে শুয়ে আছি আর ইমন আমার জন্য খাবার বানাচ্ছিল, সেই সময়ে খালা এসে আমার হাত জড়িয়ে বললো, আম্মা আফনে কতডা বাইগ্যবতী হেইডা খালি আল্লাহ ই জানে, তয় এহন আমিও জানি। দুইডা দিন ধইরা খালুজান একটুও গুমায়নাই। চোখ লাইগ্যা গেলেও আফ্নের হিতানে পইড়্যা রইছে। আফনে ইট্টু পরপর বমি করছেন, খালুজান আফনেরে পরিষ্কার করছে, মাতায় পানি ডালছে। আমি এমন স্বোয়ামী জীবনেও দেহিনাই। আমগো জ্বর অইলে তো আমগো স্বোয়ামী কোনওদিন ফিরাও দেখেনাই। আর খালুজান যা করলো! হের আম্মারে ফোন কইরা কানছে, কয়, আফ্নের কিছু হইয়া গেলে খালুজান বাঁচবোনা। বারেবারে ডাক্তরসাবরে ফোন দিছে আফনেরে হাসপাতাল লইয়া যাইব। ডাক্তরসাব কইছে দুইদিনেই জ্বর থাইম্যা যাইব। খালু পাগল অইয়া গেছিল এই দুইডা দিন।
খালার কথা শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি ভাবতাম ও আমাকে ভালোবাসেনা, আমি শুধু প্রয়োজন মাত্র। কিন্তু না, আমি ভুল ভেবেছি। জ্বরের ঘোরেও দু একবার ওকে দেখেছি আমার জন্য ছটফট করতে। অথচ এই আমি কতই না বকাঝকা করি ওকে বিভিন্ন অজুহাতে আর ও সেসবের দায় মাথায় পেতে নিয়ে নির্বাক থাকে, তাতেও আমি বিরক্ত হই। শেষ অব্দি ওকে ছেড়ে যাবার কথাও ভাবী আমি। এর মধ্যেই ইমন আমার জন্য খাবার নিয়ে এসে নিজহাতে খাইয়ে দিচ্ছে। তুমি অফিসে যাবেনা? অফিসে যাবো মানে! তোমাকে অসুস্থ রেখে আমি অফিসে যাবো! কি আবোল তাবোল বলছো! আমি অফিসে জানিয়ে দিয়েছি আগামী এক সপ্তাহ আমি অফিসে যাচ্ছিনা। ওর জবাবটা শুনে ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠলো তবু আবার বললাম, এভাবে অফিসে না গেলে তোমার কথাটা শেষ করার আগেই জবাব ইমনের, আমার জীবনে তোমার চেয়ে ইম্পরট্যান্ট আমার ব্যবসা নয়। তুমি আমার জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি।
আমি জানি আমাকে নিয়ে তোমার অনেক অভিযোগ। কিন্তু কি বলবো বলো! আমি হয়তো মানুষটাই এমন। নিজের ভালোবাসা হয়তো অন্যদের মতো সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারিনা। আমি বুঝিনা কোনও অকেশনে কি করলে তুমি বেশী খুশী হবে তবে বিশ্বাস করো মনেমনে অপেক্ষায় থাকি কখন তুমি আমাকে কিছু করতে বলবে যা তোমার ভালোলাগে। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ইমনের কথাগুলো শুনছিলাম। ওর মুখে বলা, আমি ওর জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি শুনে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। অথচ জীবনে কি ভুলটাই না করতে যাচ্ছিলাম আমি! এই জীবনে এতটা নিখাঁদ ভালোবাসা সত্যিই কি আমায় কেউ দিতে পারবে!
হঠাৎ ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম ইমনের ডাকে। ও আমার হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বাচ্চাদের মতো বলতে লাগল, রিমি আমি তোমাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি, নিজের জীবনের চাইতেও বেশী। তুমি আমাকে ছেড়ে কোনওদিন যেওনা প্লিজ। বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে এই লোকটা যা দেখে আমার মনে হলো পৃথিবীর মহাশ্চর্য আমার সামনে! আমি ওর চুলে বিলি কেটে বললাম, এই জীবনে তো তোমাকে ছেড়ে যাব ই না, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে সেখানেও আমি তোমার সাথেই থাকবো, নয়তো ইচ্ছেমতো ঝাড়বো কাকে বলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প