ধর্মের দেয়াল

ধর্মের দেয়াল
দিদি তোর দেবরের চরিত্র ভালো না। আজ আমার বুকে হাত দিয়ে বলল, “বেয়াইন সাব আপনার জ্বর এখনো কমেনি?” দিদি ফিক করে হেসে বললেন, “জাহিদ একটু ওরকমই পূজা। বেশি ফাজলামি করে, তুই মনে কিছু করিস না।” আমি দিদির দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললাম, “এগুলো কোন ধরনের ফাজলামি? গায়ে হাত দিয়ে কথা কেন বলবে?” দিদি চুপ হয়ে আছে। মিশু কোথা থেকে বল নিয়ে এসে বলল, “মাসি চলো ক্রিকেট খেলি।” দিদির উপর রাগ দেখাতে না পেরে চট করে এক থাপ্পর আমি মিশুর গালে বসিয়ে দিলাম।
“যাতো মিশু এখান থেকে।” – মিশু কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে গেলো। দিদি বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল।
“তুই আমার ছেলের গায়ে হাত দিলি কেনো পূজা?” আমিও ছেড়ে দিলাম না। “চরটা তো তোকে মারা উচিত ছিলো দিদি। তোকে পারিনি তাই মিশুর গালে মারলাম।” -দিদি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। “তুই আমাকে এমন কথা বলতে পারলি?” “পারলাম। ভালোবেসে ঘর ছারলি! তাতেও শেষ হয়নি।সনাতন ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়ে গেছিস। সেই শোকে বাবা মারা গেলেন। শুনছি এখন নাকি গরুর মাংসও খেয়ে বেড়াচ্ছিস। ছিঃ!” কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ লাল হয়ে গেলো আমার। দিদি মুখ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, “ভালোবেসেছিস কখনো কাউকে? বাসলে বুঝতি প্রেম ধর্ম-কর্ম মানে না।”
“আমার বুঝে কাজ নেই। কেমন ছেলেকে ভালোবেসেছিস তাতো তার ভাইয়ের চরিত্র দেখেই বুঝতে পারছি। তোর এখানে বেশিদিন থাকলে তোর সাথে আমিও নরকে যাব।” দিদি আবার আমার হাত ধরে বসে পরলেন। “আর ক’টা দিন থাক না পূজা, তোর দুলাভাই বিদেশে চলে যাওয়ার পর থেকে বড্ড একা লাগে আমার।” রাগ দেখালেও মায়া লাগে দিদির উপর। কী করব? মায়ের পেটের বোন তো। মায়ের কাছ থেকে আসার সময় বলে আসিনি দিদির এখানে আসব। আত্নীয়-স্বজনও জানে আমি দিদির সাথে যোগাযোগ রাখি না। উপড়ের দিকে ‘থু থু’ ছিটালে যে নিজের গায়ে পড়ে। আমি বললাম, “থাকতে পারি এক শর্তে। তুই আমার আর মায়ের সাথে ইন্ডিয়া চল। গঙ্গা স্নান সেরে পাপ মোচন করে আসবি।” দিদি আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন।
“বাবার মতো প্রত্যেকটা কথায় তুই ধর্ম কেনো টেনে আনিস পূজা? পরশু আসার পর থেকে একবারও আমাকে দেখেছিস নামাজ পরতে বল?” “ঠাকুর-দেবতার নাম নিতেও তো দেখেনি। সত্যি করে বলতো দিদি, তুই আর দুলাভাই কি নাস্তিক হয়ে গেছিস?” “না। তোর দুলাভাই ঠিকি মুসলিম আছে। আমি কী হয়ে গেছি নিজেও জানি না। জিহান কখনে ধর্ম নিয়ে জোর করে না তবে আমি মাঝে মাঝে ইশ্বর এর কাছে মাফ চেয়ে নেই। “তোর কথার মাথা-মুন্ডু না আমি ঠিক বুঝি না। শোন দিদি, মা আর আমি সামনের মাসে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি। কবে নাগাত তোর সাথে আবার দেখা হবে জানি না।” দিদি মন খারাপ করে বললেন, “মা একবার আসবেন না আমার সাথে দেখা করতে?”
“এত কিছুর পর কেউ কি আর আসে বল? আমি তো পড়েছি দোটানায়! না পারি মাকে ছাড়তে না পারি তোকে।মিথ্যা বলে তোর এখানে এসে দু’দিন ধরে পরে আছি। তার উপর এখন জ্বরে পড়লাম।” “চলে গেলেই তো গেলি। আজকের দিনটা থাক। তোর পছন্দের সব খাবার রান্না করে খাওয়াই। দিদির সাথে রাগ করে থাকতে নেই।” আমি আর কথা বাড়ালাম না। দিদি বের হতেই কোথা হতে জাহিদ বজ্জাদ আবার উদয় হলো। আমি মুখ গোমড়া করে খাটে বসে আছি। জাহিদ একটা চেয়ার টেনে আমার কাছে এগিয়ে বসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। “দেখুন, আপনি যদি আমাকে আবার বিরক্ত করেন ভালো হবেনা বলে দিচ্ছি। শুধু দিদির কথায় আজকের দিনটা এখানে আছি। আগামীকাল চলে যাব।”
জাহিদ বলল, “আহা! আপনি এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন বেয়াইন সাব? দেখুন, আমি কিন্তু আপনাকে বেশ পছন্দ করি। আপনার লাবণ্য দিদি আর আমার ভাইয়ের সম্পর্কটা ঠিক শারুখ খান আর গৌরির মতো। কোন ঝামেলা নেই।”
“লেকচার দিবেন না। লেকচার আমার পছন্দ না। দিদির মতো নরম মনের মেয়ে আমি নই। রেগে গেলে খুব খারাপ হবে।” “আপনি কিন্তু শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন। আচ্ছা আপনার জ্বর কমেছে?” “যদি আবার গায়ে হাত দেন। হাত কেটে দিবো বলে দিচ্ছি।” জাহিদ হো হো করে হাসছে। আমি ভ্রু কুঁচকে আরেকদিক তাকিয়ে সেই হাসি শুনছি।
বিকেল থেকে জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। দিদি আমাকে জোড় করে দু লোকমা ভাত খাইয়ে দিলেন। ব্যস! ওমনি বমি করে সব ফেলে দিলাম। শরীরটা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। মায়ের সাথে দুপুরে কথা হয়েছে। আর কথা বলার মতো শক্তি নেই। বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পর দিদি ফোন ধরতেই মা বুঝতে পেরে ফোন কেটে দেন। দিদি হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন। আমি জ্বরের ঘোরেই বলে উঠি, “কাঁদবি না দিদি।একদম কাঁদবি না।তুই এতো বাজে ভাবে কাঁদিস আমার জ্বর তাতে আরো বাড়ে।” জাহিদ তিন বার আমার কাছে এসে বলল, “বেয়াইনসাব, সামনে রিকশা নিয়ে এসেছি। চলেন ডাক্তার এর কাছে যাই। কথা দিচ্ছি, গায়ে হাত দিবো না। প্রয়োজন হলে রিকশার মাঝখানে কোলবালিশ রেখে দেবো।” আমি বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলি, “চুপ থাকুন তো। কোন দরকার নেই। আমার লাশ শশানে চলে যাক, তবু আপনার সাথে ডাক্তারের কাছে যাব না।”
দিদি বললেন, “জিদ করিস না পূজা। আমার বড্ড ভয় করছে। জ্বর তো বেড়েই যাচ্ছে তোর।” আমার নিশ্বাসেই গরম শ্বাস-প্রশ্বাস আমি অনুভব করছি। মনে মনে ভাবছি সৃষ্টিকর্তা এতো ধর্মের মানুষ কেনো সৃষ্টি করলেন। দিদির সাথে যখন-তখন দেখা করতে পারি না। মনটা বড় কাঁদে আমার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। সাত নম্বর বিপদ সংকেত। চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাজপথ বন্ধ। আমার শরীর খারাপের চেয়ে ও খারাপ লাগছে। উঠে দাঁড়াতে পারছি না। দিদি বারান্দায় গিয়ে খানিককাল পরে বৃষ্টির তেজ দেখছে আর বলছেন, “হে ইশ্বর! রক্ষা করো। আমার বোনটা বোধহয় মরে যাচ্ছে।” আমি শুধু একবার ছোট নিশ্বাস নিয়ে বললাম, “এই মিশু, দিদিকে বলতো লেবু কেটে আনতে আমার আবার বমি আসছে।”
দিদি লেবু এনেছিলো কিনা আমার মনে নেই। তবে জাহিদ যে বাইরে বেবিট্যাক্সি নিয়ে এসেছে তার আওয়াজ আমার কানে এসেছে। বেবিট্যাক্সিতে বসে ছিলাম ঝিম মেরে। দু’হাত দিয়ে দিদি আমাকে ধরে রেখেছেন। আরো দুবার বমি করে দিয়েছি জাহিদের গায়ে। খেয়াল করলাম বমি করার সময় জাহিদ বুকের উপর মালিশ করছে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে জাহিদের দিকে তাকিয়ে আবার একবার বললাম, “তুই আবার আমার গায়ে হাত দিয়েছিস?” দিদি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “ছিঃ পূজা। জাহিদকে ‘তুই-তোকারি’ করছিস কেন?” জাহিদ বলল, “বাদ দেন ভাবী। জ্বরের ঘোড়ে আছে। আমি কিছু মনে করিনি।”
বেবিট্যাক্সি রাস্তায় জ্যামে পরেছে। আমি দিদির কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। এই ঘুম আমার ভাঙলো পরেরদিন সকালে। আমার মাথার কাছে মা পুষ্পা দেবী বসে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই মুচকি হাসি দিলেন। আশে-পাশে আর কেউ নেই। মা মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “এখন কেমন লাগছে মা আমার?” আমি একবার চারদিকে তাকিয়ে বললাম, “চোখ খুলে মাকে দেখলে পৃথিবীর কোন সন্তানের আর খারাপ লাগে মা? দিদি কোথায়?” মায়ের মুখটা কালো হয়ে গেলো। তিনি বললেন, “কেনো গিয়েছিলি ওই মুসলমানের বাসায়?” “দিদি কোথায় বলো মা?”
“আছে হয়তো হাসপাতালের বারান্দায়। তোর বাবাকে শেষ করে সাধ মিটেনি, এখন তোকে শেষ করতে চাইছে।”
মায়ের কথা শেষ না হতেই দিদি কেবিনে ঢুকে পড়লেন।আমার কাছে প্রায় দৌড়ে এসে বললেন, “ইশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। পূজা তোর জ্ঞান ফিরেছে।” মা বিরক্ত হয়ে বললেন, “একটু সরে দাড়াতো লাবন্য। তুই পাশে থাকলে আমার গা কেমন ঘিন ঘিন করে।” মায়ের কথা শুনে দিদি কেঁদে ফেললাম। আমি বললাম, “এটা কেমন কথা মা? নিজের মেয়েকে কী বলছো এসব?” “ও আমার মেয়ে না ছাই। আগের জন্মে কোন পাপ করেছিলাম যার জন্য ওর জন্ম হয়েছে। কোন মুসলমানের বউ আমার মেয়ে না, আমার শুধু এখন একটাই মেয়ে তার নাম পূজা।”
দিদি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “তোমার এক মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করলে আরেক মেয়েও শরীরে মুসলমানের রক্ত নিয়ে বেড়াচ্ছে। দেখি! তোমার ধর্মে কেমনে সয় এসব? এখন নিজের মেয়ের শরীর কেটে জাহিদের রক্ত আলাদা করো দেখি।” আমি হাঁ করে দিদির দিকে তাকিয়ে আছি। “মা দিদি কি বলছে এসব?” দিদি বললেন, “তোর শরীরে রক্তশূন্যতা। দু’ব্যাগ ব্লাড দিয়েছেন ডাক্তার। যে দুর্বল ছিলি তুই। ঝড়-বৃষ্টির রাতে ও নেগেটিভ রক্ত কই পেতাম শুনি? ভাগ্য ভালো জাহিদের সাথে ব্লাডগ্রুপ মিলেছে।” কথাগুলো মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেই দিদি কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। মা রাগে ফোসফোস করছে। আমার চোখে জল কেন জানি না।
“রান্নাঘর থেকে বটিটা এনে আমার মাথায় একটা কোপ মারোতো মা, আমার মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে।” মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকে দেখছি তোর মাথা ব্যথাই কমছে না। সমস্যা কী তোর?
“সহ্য হচ্ছে না মা, শরীরে কেমন মুসলমান মুসলমান গন্ধ।” আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে মা’কে কথাগুলো বললাম। টানা আঠারো দিন ধরে ঘরে বসে রেষ্ট নিচ্ছি। মা আমাকে বাইরে যেতে দিচ্ছেন না। “তুইও লাবণ্যর মতো আমাকে উপহাস করছিস পূজা? যা তুই ও যা, জাহিদকে বিয়ে করে মুসলমান বাড়ির বউ হয়ে যা।” “বাবা ‘নারায়ণ ঠাকুর’ এর রক্ত আমার শরীরে বইছে মা।’চন্দন কাঠ’ দিয়ে পোড়ানোর আগ পর্যন্ত এই ‘পূজা’ ধর্ম ছাড়বেন না। তবে কৃতজ্ঞতাবোধ বলতে একটা জিনিস প্রত্যেক মানুষের থাকা উচিত। আমি দিদির সাথে আবারো দেখা করবো।”
ঊনিশ দিনের দিন আমি দিদিকে ফোন করলাম। ফোন ধরেই দিদি কাঁদছেন। আমি বললাম, “তোকে না নিষেধ করেছি দিদি কথায় কথায় কাঁদবি না। ফোনের ভিতর কান্নার আওয়াজ কী বাজে লাগে শুনতে তুই জানিস না।”
“মা আমার সাথে কী খারাপ ব্যবহার টাই না করলো পূজা?” “মায়ের কথা বাদ দে, সামনের মাসে চলে যাচ্ছি ইন্ডিয়া।ডিশিসন ফাইনাল। তোর সাথে দেখা করব।” আমার কথা শেষ না হতেই কেউ একজন ফোন নিয়েই বলে উঠলেন, “হ্যাল্লোওওওওওওও! বেয়াইসাব।”
“হে ভগবান! আপনি ফোন কেন নিলেন? দিদিকে ফোন দিন।”
“ভয়ের তো কিছু নেই। ফোনের ভিতর দিয়ে কারো গায়ে হাত দেয়া যায় না।”
“দিদির কাছে ফোন দিতে বলেছি।”
“আমার সাথে দেখা করবেন কবে?”
“আপনার সাথে দেখা কেন করব?”
“আমাকে ধন্যবাদ জানাতে…”
“ধন্যবাদ। এখন দিদির কাছে ফোন দিন।”
“উমম-হুম। এভাবে ধন্যবাদ দিলেতো হবে না, বাইরে বের হতে হবে। একসাথে কফি খেতে হবে।”
“অসম্ভব।”
“সবই সম্ভব। কবে বের হবেন বলুন?”
“আমি বাইরে বের হতে পারব না। মায়ের কড়া নির্দেশ আছে।”
“ভয় পাচ্ছেন? আমার প্রেমে পড়ে যাবেন তাই?”
“ছিঃ এই জনমে না, পরের সাত জনমেও না।”
“তাহলে?এক কাপ কফি খেতে সমস্যা কোথায়?”
“আমার মা ‘পুষ্পা দেবী’ কে চিনেন না?
যদি জানতে পারে আপনার সাথে দেখা করতে বের হয়েছি “বেয়াইনসাব, এক কাপ কফিই তো! চাইলেই কিন্তু আপনি বের হতে পারেন সেটা আমি জানি।” আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম, “পড়শু বিকেল পাঁচটায় নিউমার্কেটের সামনে থাকবেন। তবে মনে রাখবেন এটাই প্রথম আর এটাই শেষ।”
মা’দের সবকিছু বলতে হয় না তারা কেনো জানি এমনিতেই বুঝে যায়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় একবারও মা
জানতে চাইলেন না, “আমি কোথায় যাচ্ছি?” শুধু আমার হাতটি ধরে বললেন, “এই দুনিয়ায় তুই ছাড়া এখন আমার কেউ নেই পূজা। ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে, এই এক মাসে তোর যা ইচ্ছে কর। যেথায় ইচ্ছে যা। কিন্তু লাবণ্যর মতো কখনো আমাকে কষ্ট দিস না।” আমি মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বললাম, “কাঁদবে না মা। এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম। এমন কিছু করবো না, যাতে তুমি আমার জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলো।” রেষ্টুরেন্টের হালকা আলোতে বসে পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর জাহিদের আগমন ঘটলো। সে এসে চেয়ার টেনে আমার গা ঘেষে কাছে বসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
“যান। টেবিলের ওই মাথায় বসুন।”
“আজব! আমি কী করলাম?”
“কিছু করেননি, কিন্তু টেবিলের ওই মাথায় বসুন।” জাহিদ মুখ ভোতা করে টেবিলের অপর প্রান্তে বসলো।
“বেয়াইন সাব। আপনি কি এখনো আমার উপর রেগে আছেন?”
“না!”
“তাহলে আমার সাথে এতো রুড আচরন কেনো করেন?”
“আমি এমোনি। কথা না বাড়িয়ে কফির অর্ডার করুন। ধন্যবাদ দিন। তারপর চলে যান।”
“পূজা দেবী আপনার কি মনে হয় না? আপনি একটু বেশীই খারাপ আচরন করছেন?”
“আচ্ছা সরি। মন ভালো না। কিছু মনে করবেন না।” আমার কথা শেষ না হতেই জাহিদ চেয়ার টেনে অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে। “আজব, আপনি আবার কেনো এগিয়ে আসছেন?”
“এই যে সরি বলেছেন। এখন আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কিছুটা হলেও কাছাকাছি বসে কথা বলা যায়।”
আমি লম্বা এক নিশ্বাস নিয়ে বললাম, “জাহিদ সাহেব। আপনার চরিত্রে বেশ সমস্যা আছে। তবে চরিত্রহীন মানুষদেরও কিছু ভালো গুন থাকে। সেটা সেদিনের ঝড়-বৃষ্টির রাতে টের পেয়েছি।” জাহিদ হো হো করে হাসছে। “হাসছেন যে? আপনাকে চরিত্রহীন বললাম। কিছু মনে করেননি?” “না করিনি। মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করার খারাপ গুনটা আমার মাঝে আছে।তবে আমি ‘চরিত্রহীন’ খ্যাতি পাওয়ার মতোও খারাপ নই।” আমি কি ভেবেই যেন হেসে ফেললাম।
সেদিনের একসাথে কফি খাওয়ার পর আমি আমার কথা রাখিনি। জাহিদের সাথে আবার এবং আবার দেখা করলাম। কথা বললাম, বাইরে ঘুরে বেড়ালাম। বেশ কয়েকবার দিদি আর মিশুকে নিয়েও বের হলাম। জাহিদ আমাকে ফোন দিতো সকালে-দুপুরে কিংবা রাতে। ভোর রাতে হঠাৎ করেই ফোন দিয়েই বলতো, “হ্যাল্লোওওওও পূজা দেবী।”
কেনো জানিনা জাহিদের মুখে ‘বেয়াইনসাব’ কিংবা ‘পূজা দেবী’ নাম শুনতে আমার খারাপ লাগতো না। বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর সেদিন সন্ধ্যায় মন্দির থেকে পুজো দিয়ে বের হয়ে দেখলাম জাহিদ বাইরে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু অবাক হলেও আরেকদিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম। জাহিদ আমার পিছু পিছু আসছে, “পূজা দেবী, পূজা দেবী! দাড়ান! দাড়ান!” আমি হাঁটতে হাঁটতেই বললাম, “আপনার সমস্যা কী বলুন তো? মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কেনো আছেন?”
“আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“কেন? সন্ধ্যায় নামাজ পড়েননি?”
“হ্যাঁ পড়েছিতো। এই যে দেখুন পকেটে টুপি।” – জাহিদ পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় দিল।
এবার আমি দাঁড়িয়ে রাগন্বিত ভাবে বললাম, “নামাজ পড়ে আবার মন্দিরের সামনে এসে একটা হিন্দু মেয়ের জন্য দাড়িয়ে আছেন। বাহ! পাপ হবে না আপনার?” জাহিদ বেশ কোমল গলায় বলল, “ভালোবেসে অপেক্ষা করছিলাম পূজা দেবী, পাপ হবে না।”
আমি ঠিক এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মনের ভিতরটা কেমন করে উঠলো। বাইরে বাতাস হচ্ছে। মনে হচ্ছে আবার ঝড় হচ্ছে। মন্দিরের ঘন্টা গুলো ঝড়ের বেগে বেজে উঠছে, আর আমার হৃদয়ে কাঁপন লাগতে শুরু করেছে এই অল্প সময়ে এই বজ্জাদ, চরিত্রহীন ছেলেটা আমার মনের অনেকটা জায়গা দখল করে ফেলে। কিন্তু তার জন্য ভালোবাসা নামক শব্দটা যেন উচ্চারণ করাও ‘পাপ’ অথবা আমার জন্য ‘নরক’। বছরের পর বছর মানুষের পাশে থাকলেও নাকি তাকে চেনা যায় না, সেটা আমি মানি। তবে জাহিদের মধ্যে যে মনুষ্যত্ব বোধ অনেক বেশী তা আমি এই কিছুদিনে বুঝেছি।
কাজের মধ্যে তেমন কিছু সে করে না একটা DSLR আর ক্যামেরা নিয়ে সারাক্ষন বিয়ে বাড়িতে ছবি তুলে বেড়ায়।বিয়ে বাড়ি আর বড় কোন অনুষ্ঠানের বাড়তি খাবারগুলো আবার গরীব ও পথশিশুদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। দিদির কাছে শুনেছি ঈদ-কুরবানী কিংবা পুজোতে অসহায় মানুষদের কাপড় এবং খাবার প্রদানের জন্য ও নাকি সে কী সব কমিটিতে যুক্ত আছে। ক্যামেরা নিয়ে বেশ কিছুদিন আমার সাথেও ঘুরেছে। নদীর পাড়ে, পাহাড়ের উপরপ কিংবা রাস্তার পিচঢালা পথে জ্যোৎসা রাতে আমার সাথে গল্প করেছে আর ছবি তুলে দিয়েছে। নিষেধ করিনি কোন কিছুতেই আমি। ক’টা দিন পর তো মায়ের সাথে চলেই যাচ্ছি। চুপচাপ দেখি না হয়, এই পাগলের পাগলামি!
জাহিদের পাগলামি যে ‘ভালোবাসি’ নামক শব্দে এসে থামবে। কোনদিন কল্পনাও করিনি। বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। ফোন-ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সব ডিয়েক্টিভ করে দিলাম। কাজ হয়নি। জাহিদের মতো ছেলেরা প্রেমে পড়লে অনেক কিছু করতে পারে। বাসার সামনে রাতভর কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দে বুঝেছি, এখানে এসেও শুরু করেছে। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না।দিদিকে বললে, আনন্দে লাফিয়ে উঠবেন আর মাকে বললে পুলিশে ফোন করবেন। বাধ্য হয়ে বাসার নিচে নামতেই দেখি জাহিদ দাঁত বের করে হাসছে।
“বেয়াইনসাব, আমি জানতাম আপনি আসবেন।” আমার মাথায় অনেক যন্ত্রনা হচ্ছিলো। তারপরও বললাম, “চলে যান প্লিজ। আমাকে একা থাকতে দিন।”
“সেদিন মন্দির থেকে ওভাবে চলে এলেন। কিছুই বলে এলেন না।”
“জাহিদ সাহেব, আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
“কিন্তু পূজা দেবী আমি আপনাকে ভালোবাসি। সত্যি ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই, খাটি ভালোবাসা কোনো ভেজাল নেই।”
“হে ভগবান! এটা মরে গেলেও সম্ভব না। কোনদিন না।কিছুতেই না। আপনার পায়ে ধরি প্লিজ চলে যান।” আমার কথা শেষ না হতেই জাহিদ পায়ের কাছে বসে পড়ে। “আমিও আপনার পায়ে পড়ি পূজা দেবী, প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না।” আমি দ্রুত খানিকটা পিছনে সরে গেলাম। চোখে জল চলে এলো। “জাহিদ সাহেব। রাত বাড়ছে, কেউ দেখলে আমি বেঁচে থাকতে পারব না। আমি যে কেনো আবার আপনার সাথে দেখা করলাম?” আমি দৌড়ে বাসার দিকে চলে এলাম। উপরের বারান্দা থেকে মা বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। বাসায় ঢুকেই মায়ের সামনে পড়ার মতো সাহস আর ছিল না। নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই দেখি জাহিদ ফোন দিচ্ছে। ফোন ধরেই বললাম, “আপনি আমাকে আজ মায়ের কাছে ছোট করেছেন। আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না।”
“পূজা দেবী, সন্তানেরা মায়ের কাছে কখনো ছোট হয় না।বরং ভালোই হয়েছে তিনি দেখেছেন।” “আপনি যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন আমাকে একা থাকতে দিন।” “আপনাকে ভালোবাসি বলেই একা থাকতে দিতে পারছি না। আচ্ছা সমস্যাটা কোথায় বলুন তো, আমি মুসলিম শুধু এই তুচ্ছ সমস্যা?” আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “এটা আপনার কাছে তুচ্ছ সমস্যা মনে হচ্ছে?” “হ্যাঁ হচ্ছে। ভালোবাসার কাছে এসব তুচ্ছ।” “জাহিদ সাহেব। একই মায়ের পেটে জন্ম নিলেও আমি লাবন্য নই। ভুল মানুষকে ভুল কথা বলছেন। আমি অনেক কঠিন মেয়ে।”
“পূজা দেবী, আমি কিন্তু একবার ও আমার ভাই আর আপনার বোনকে কথার মাঝে টানছি না। আপনিও দয়া করে আনবেন না।” “রাখছি জাহিদ সাহেব। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।” “আমি আমার উত্তর জানতে কাল আবার আসবো পূজা দেবী। বারবার আসবো মনে রাখবেন।” আমি ফোন কেটে দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। মা দরজা ধাক্কাচ্ছেন, “পূজা এই পূজা, দরজা খোল। তোর সাথে কথা আছে আমার।” “এখন যাও মা। আমি একটু একা থাকতে চাই।” আমি কখন? কেন? কীভাবে? জাহিদকে পছন্দ করে ফেলেছি বুঝিনি। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে আর জাহিদের পাগলামি বন্ধ করতে ইন্ডিয়া যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত আমি জাহিদের সাথে দিনগুলো একসাথে কাটাই।
বলা যায় প্রেমের প্রস্তাব ঝুলিয়ে রাখার মতো শুধুই ওর ভালো লাগা আর ভালোবাসার কথাগুলো শুনতাম। এই দিনগুলোতে একবারও আমি জাহিদকে বলিনি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। জাহিদ এতোই পাগল হয়ে গেছিলো যে ধরেই নিয়েছে আমিও তাকে ভালোবাসি। মনের কথাগুলো আমার মতো বদমেজাজি মেয়ে মুখে বলতে পারতো না। তাই সাদা কাগজ আর কালো কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসলাম, “হে আমার চরিত্রহীন বন্ধু, আমি জানি আপনি চিঠির প্রথমেই চরিত্রহীন বলাতে রাগ করেননি কিন্তু বন্ধু বলাতে খুব রাগ করেছেন। কী করব বলুন? আপনার আর আমার সম্পর্ক শুধু এটুকুর মাঝেই যে সীমাবদ্ধ। আপনার মসজিদ আর আমার মন্দির আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সাক্ষী। সেই বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে বলছি, আপনি আমাকে ভুলে যান।
আপনি মুসলিম বলে নয়, কিংবা দিদির ভুলের কারনেও নয়। আমি আপনাকে ঠিক প্রেমিক হিসেবে কখনো ভালোবাসিনি। তবে হ্যাঁ একথা সত্যি ‘আপনার আর আমার মাঝে বিশাল এক ধর্মের দেয়াল আছে। যে দেয়াল জিহান ভাই আর লাবণ্য দিদিও ভাঙতে পারেননি। কেউ পারেনি আর কোনোদিন পারবেন না। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম জানেন সেদিন মিশুর স্কুলে গিয়েও দেখি বন্ধুরা ওকে আঙ্গুল তুলে বলছে, “ওই দেখ অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলিম ছেলেটা যাচ্ছে। মিশু আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো। আপনি কী চান সেরকম নতুন আবারো মিশুর জন্ম হোক?” আমি জানি এই কথা আমি আপনার সামনে বললে আপনি কোন না কোন যুক্তি দ্বার করাতেন। কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক। জাহিদ সাহেব, আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন।
আমি আপনার সাথে কখনো সুখি হতে পারতাম না। দিদিও পারেনি জাহিন ভাইয়ের সাথে সুখি হতে। কিন্তু আমি চাই আপনি একজন মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে সুখি হন। ভাববেন না, আমিও মায়ের পছন্দমতো কাউকে না কাউকে বিয়ে করে নিবো। তবে আমি আর দেশে ফিরতে চাই না।” আপনাকে ইন্ডিয়া আসার কথা যখনই বলেছি দেখেছি আপনার চোখে জল। তাই কোনদিন আপনার সামনে আর পড়তে চাই না। যদি এই জল আমাকে দূর্বল করে দেয়। সবকথার শেষ কথা, “আমি গায়ে হাত দেয়ার জন্য আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আপনি আমার জন্য দু’ফোটা জল ফেলেছেন। আমি আপনার কথা দূর থেকে মনে করে সারাজীবন চোখের জল ফেলব।”
ইতি পূজা দেবী দিদির সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখি দিদি আগে থেকেই কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছেন। আমি চোখ মুছে দিতে দিতে বললাম, “এতো কীভাবে কাঁদিস তুই দিদি।”
“যারা ভালোবাসতে জানে তারা কাঁদতে ও জানে। মা এতো পাষান কি করে হলো? একবারও দেখা করতে এলো না?”
“আগে এমন ছিলেন না বাবার মৃত্যুর পর হয়ে গেছে। তুই যেমন স্বামীর জন্য ঘর ছেড়েছিস, সেও তেমনি স্বামী হারিয়েছে।”
“জাহিদের সাথে দেখা করে যাবি না?”
“কই সে?”
“বিয়ে বাড়ির ফটোশুটের কাজে গেছে। তুই বললি বিকেলে আসবি, সকাল সকাল আসলি যে?”
“থাক, তোর আর মিশুর সাথেতো দেখা হয়েছে।”
মিশুকে কাছে টেনে আদর করে চিঠিটা ওর কাছে দিয়ে বললাম, “এটা চাচ্চু আসলে দিবি, আর স্কুলের পচা বন্ধুদের সাথে একদম মিশবি না। মাসি ফোন করে মাঝেমধ্যে খোঁজ নেবে কেমন?” মিশু ‘হু’ বলে মাথা নাড়লো।
আমি মাকে দেওয়া কথা রেখেছি তাই আমার স্বাভাবিক আচরনে মা খুব খুশি ছিলেন। বিমানে পা দেয়ার আগে বুকের বাম দিকটা ব্যথা করছে। চারদিক ঝাপসা লাগছে।আমার, আমার আগের মতো জ্বর বোধ হয় আবার আসছে এই গল্প এখানেই শেষ, জাহিদ চিঠি পেয়েছিল কি না পূজা জানতে পারেনি। কারন পূজা কখনো আর যোগাযোগ করেনি এমনকি তার বোনের সাথেও না। তবে জাহিদ পূজাকে খুঁজতে ইন্ডিয়া গিয়েছিল, এবং তিন বছর পর দূর্গা পুজোয় কলকাতায় তার সাথে দেখা হয়েছিল তখন পূজার হাতে শাখা এবং কপালে সিঁদুর।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত