আব্দুল বাসেত সাহেব স্ত্রীর দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকালেন । তার বিয়ের ২ বছর হয়েছে । স্ত্রী এখনো অনেক ফিট । মেয়েটা যৌবনের দূরন্ত সময় পার করছে মাত্র । অথচ সেই তুলনায় তিনি বয়স্কই বলা চলে । ৪৫ বছর চলছে । স্ত্রীর সাথে বয়েসের পার্থক্য প্রায় ২০ বছরের । এই বয়েসে চিৎকার চেঁচামেচি করতে ভালো লাগে না । মৃদু হেসে খুব ঠাণ্ডা গলায় স্ত্রীকে বললেন …
— তুমি কি ছেলেটাকে ভালোবাসো ?
তার স্ত্রীর মুখে শব্দ নেই । হয়তো ভয় পেয়েছে । নতুবা বলতে চাইছে না । তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন , তুমি কি সত্যিই ছেলেটাকে ভালোবাসো । মেয়েটা এইবার মাথা নেড়ে উত্তর দিলো , হ্যা …ভালোবাসি । আব্দুল বাসেত সাহেব স্ত্রীর মেসেঞ্জারটা দেখেছেন । রোমান্টিক কথোপকথন । সাথে অনেকগুলো ছবি । তার স্ত্রী সুনয়না কোমড়ের ছবিটাও দিয়েছে । আব্দুল বাসেত সাহেব স্ত্রীকে বকা দেননি । মারার তো প্রশ্নই উঠে না । শুধু জানতে চেয়েছেন স্ত্রী সেই ছেলেকে ভালোবাসে কিনা । উত্তর তিনি পেয়ে গেছেন । এইসব ব্যাপারে কৌতূহল সাধারণত মেটে না । সুনয়নাকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন …
–আচ্ছা ছেলেটার সাথে তোমার সম্পর্ক কতো দিনের ?
— ৩ বছরের । বাসেত সাহেব অবাক হলেন । অথচ তাদের বিয়ের ২ বছর হয়েছে । তার মানে বিয়ের আগে থেকেই সম্পর্কটা ছিল ।
— তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন ? ওকে বিয়ে করে নিলেই পারতে !!! সুনয়না কোন উত্তর দেয় না । চুপ করে বসে থাকে । আব্দুল বাসেত সাহেবের মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে এই ভর সন্ধ্যাতেও । অফিস থেকে কিছু খেয়ে আসেননি । ক্ষুধা লেগেছে খুব । যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে স্ত্রীকে বললেন …
— আচ্ছা , একটা কফি হবে ?
সুনয়না অবাক । এমন পরিস্থিতি আশা করেনি । চুপচাপ উঠে কিচেনের দিকে চলে গেলো । বাসেত সাহেব নিজের পকেটে থাকা কন্ডমের প্যাকেটটা এক টানে ছুড়ে ফেলে দিলেন । কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে তার । সুনয়না কফি এনেছে। আব্দুল বাসেত বারান্দার দোলনায় বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন আস্তে আস্তে । মেয়েটা ভালো কফি বানায় । সুনয়না বলল , একটা কথা বলবো ? বাসেত সাহেব মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন । সুনয়না তাড়াতাড়ি বলল , তুমি না জিজ্ঞেস করেছিলে কেন তোমাকে বিয়ে করেছি ? কারনটা শুনবে না ?
– হুম … বলো , শুনি । বাসেত সাহেব বললেন । সুনয়না বলল , বাবা আমার পড়াশুনা শেষ না করিয়েই বিয়ে দিতে চাইলো । আমি জানি চাইলেও বিয়ের পর পড়াশুনা করতে পারবো না । শুধু তুমি ছিলে ভিন্ন । কথা দিলে আমাকে বিয়ের পরেও পড়াশুনা করাবেন । সেটা করিয়েছেনও । বাসেত বাধা দিয়ে বললেন , তোমার মাস্টার্সের রেজাল্ট দিয়েছে না ?
– হুম দিয়েছে । মেরিট পজিশনে ফোর্থ হয়েছি । , সুনয়না বলল । বাসেত সাহেব চুপ হয়ে গেলেন । তিনিও খুব ভালো ছাত্র ছিলেন । পড়াশুনা করেছেন ঢাবিতে । সরকারী ব্যাংকে চাকুরী করছেন । তাই পড়াশুনার গুরুত্বটা বোঝেন । বিয়ের আগে যখন জানলেন সুনয়না পড়তে চায় তখন আর বাধা দেন নি । নীরবতা ভেঙে সুনয়না বলল , পড়াশুনা শেষ করতেই আপনাকে বিয়ে করেছি । তবে আমি ভালোবাসতাম ওই ছেলেটাকেই ।
— তাহলে ওকে বিয়ে করলে না কেন ? , জিজ্ঞেস করলেন বাসেত সাহেব ।
— আসলে তখন ওর বিয়ের মতো অবস্থা ছিল না । আমরা দুজনেই তো সমবয়সী ।
আর তাই তুমি আমার উপর ভর করে সাগরটা পাড়ি দিয়ে দিলে ? এই তো ? কথাটা বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন বাসেত সাহেব । তবে সুনয়না চুপ করে রইলো । কিছুই বলতে পারছে না । ছেলেটার ব্যাপারে আগেই কিছু কিছু জানতেন বাসেত সাহেব । সুনয়নার ক্লাসমেট । ভালো বন্ধু । যদিও কখনো বাসায় আসেনি ,তবে ক্যাম্পাসে গেলেই ওর সাথে সুনয়নাকে দেখতেন । সন্দেহ করেননি কখনো । আর এখন আর সন্দেহ করেই বা কি হবে ? যা হওয়ার তা হয়েই গেছে ।
সিঙ্গেল লাইফের কথা মনে পড়লো আব্দুল বাসেত সাহেবের । নিম্নবিত্ত পরিবারটাকে টানতে গিয়ে ঠিক সময়ে বিয়েটা করতে পারেন নি । জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ঢাকা শহরের মেসেই । নিজের রান্নাটা নিজেই করে খেয়েছেন বহু বছর । হিসেব কষে দেখলেন ,স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়েছেন মাত্র ২ বছর ১১ মাস ১৫ দিন । আর কয়েকদিন পরেই তাঁদের ৩য় বিবাহবার্ষিকী । মনে হয় না সেটা আর হবে । সিঙ্গেল লাইফ আবারও আব্দুল বাসেতকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । যবনিকা টেনে দিলেন আব্দুল বাসেত সাহেব । সুনয়নাকে বললেন , ডিভোর্সটা কবে হচ্ছে ? সুনয়না কিছুটা অবাক । ভাবেনি এতো সহজে সব কিছু হয়ে যাবে । সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ডিভোর্স না পেলে পালিয়ে যাবে সে । অথচ সেরকম কিছুই করতে হচ্ছে না । তার স্বামী ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু মেনে নিচ্ছে ।
কমলাপুর রেলস্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে সুনয়নাকে বিদায় জানাতে এসেছেন আব্দুল বাসেত সাহেব । তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে । সুনয়নার পড়াশুনাও কমপ্লিট । মেয়েটা ঠিক করেছে সে চট্টগ্রাম চলে যাবে । কেন চট্টগ্রামেই যাবে সেটা বাসেত সাহেব জিজ্ঞেস করেননি । কারনটা তিনি জানেন । তবে দুঃখ পেলেন অন্য কারণে । এই শেষ সময়ে এসেও সুনয়না মিথ্যে কথা বলেছে । বলেছে সে একাই যাচ্ছে চট্টগ্রাম । আসলে ওই ছেলেটাও সাথে যাচ্ছে । সুনয়নার বগির দুই বগি আগে উঠেছে সে । আব্দুল বাসেত সাহেব আগেই দেখেছেন । হয়তো তার প্রাক্তন স্ত্রী তাকে দুঃখ দিতে চায় নি । তাই এমন বলেছে । বাসেত সাহেবের ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা করিয়ে স্ত্রীকে বিসিএস দেয়াবেন । তিনি নিজে ক্যাডার হতে পারেননি ।; তবে তার স্ত্রী ক্যাডার হলে আনন্দ কম হতো না । তবে এখন এইসব স্বপ্ন দেখে লাভ নেই ।
ট্রেনটা ছেড়ে যাচ্ছে । আব্দুল বাসেত কাঁদেন না । পেছনে ফিরেও তাকান না । সোজা হাঁটতে থাকেন । একটা মেস খুঁজতে হবে । আবার তার সিঙ্গেল লাইফ শুরু হতে যাচ্ছে । এখন আর বড় বাসা নিয়ে লাভ নেই । এখন আর ফার্মেসিতে গিয়ে চুপিচুপি জন্মনিরোধক চাওয়ারও প্রয়োজন নেই । এক মাস আগেও জীবনে চলার জন্য যা যা প্রয়োজন ছিল এখন আর সেসবের দরকার নেই । আব্দুল বাসেত সাহেবেরা এই সমাজে ভদ্র লোক হিসাবে পরিচিত । বউ চলে গেলে লোকেরা মুখ টিপে তাদের পেছনে হাসে । বাসেত সাহেবরা চুপ থাকেন । সঠিক গন্তব্যের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে নিজেকে প্ল্যাটফর্মের মতো বিছিয়ে দেয়া এই মানুষগুলোর গল্প হয়তো অনেক সময়েই শোনা হয় না । হয়তো শোনা হবেও না ।
গল্পের বিষয়:
গল্প