‘খুব বেশি চাহিদা নেই আমার। ছোটবেলা থেকেই অনেক সংগ্রাম করে জীবনে বড়ো হয়েছি। বাবার মৃত্যুর পর একটি দোকানে পার্টটাইম কাজ করে একদিকে ছোট ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আবার নিজেও মাদরাসায় লেখাপড়া করেছি। ভাইটি আজ প্রতিষ্ঠিত আর বোনকেও বিয়ে দিয়েছি এলাকার ভালো পাত্র দেখে। কিন্তু তুমি তো বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আমার সাথে মানিয়ে চলা তোমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।’
শিরিন জামালের এত ঝাঁঝালো কথা শুনেও বলে,
‘আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই। তোমার মত সৎ ও যোগ্য ছেলেকে স্বামী হিসেবে পাওয়া যেকোন নারীর জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
‘কিন্তু আমার সাথে তোমাকে থাকতে হবে সেই অজেয় পাড়া গাঁয়ে। কারণ আমাদের এলাকার একটি মসজিদে ইমাম হিসেবে কাজ পেয়েছি। বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাতে চাই।’
জামালের কথা শুনে শিরিন বলে,
তুমি চাইলে আমার বাবার ব্যবসাও দেখাশোনা করতে পার। বাড়ি গাড়ি সবকিছুই তোমার হবে।
দেখ শিরিন! আমি বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন পছন্দ করি না। তুমি বরং ভিন্ন চিন্তা ভাবনা কর। আমাকে আমার মত থাকতে দাও।
: কেন? সবাই যদি ভালো খেতে, ভালো পড়তে পছন্দ করে তাহলে তুমি কেন চাইবে না? একটা মসজিদের ইমামের কতই বা বেতন হবে? এই সামান্য অর্থের জন্য সেই পাড়া গাঁয়ে পড়ে থাকবে?
: হুমম! এটা তোমার কাছে সামান্যই হবার কথা, কিন্তু আমার জন্য যথেষ্ট। এই দুনিয়ার জীবন সত্তর /আশি বছর বা কম বেশি যাই হোক না কেন পরকালের কোটি কোটি বছরের তুলনায় খুবই সামান্য কয়েকটি বছর মাত্র। এই সামান্য জীবনে ভোগ বিলাসিতা করে পরকালের অনন্ত জীবনের সুখকে হারাতে চাই না আমি।
তার জবাব শুনে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে শিরিন জিজ্ঞাসা করে,
টাকা -পয়সা বেশি থাকলেই মানুষ জাহান্নামে যাবে আর কম থাকলেই যে জান্নাতে যাবে এমন কোন কথা আছে?
: না বিষয়টা তা নয়। তবে সম্পদ যত অধিক থাকে, সেই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে পেরেশানিও তত বেশি আর ইবাদত বন্দেগীও কম হয় আবার পরকালের হিসাবও তত বেশি। তাই সম্পদের লোভে জড়াতে চাই না। মসজিদে ইমামতি আর শিশুদের কুরআন শিখিয়ে সময়গুলো কাটিয়ে দিতে চাই। আর অবসরে নিজেও কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করার মাঝে ডুবে থাকতে চাই। আল্লাহ্ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন কেবলই তার ইবাদতের জন্য; সম্পদের পাহাড় গড়তে নয়। যাহোক নয়ন সহীহভাবে কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করা শিখে গেছে। আগামী কাল থেকে আমি আর তোমাদের বাসায় আসছি না।
মাত্র বছর খানিকের মধ্যেই শিরিনের ছোটভাই নয়ন কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে শিক্ষা অর্জন করেছে জামালের ঐকান্তিক চেষ্টায় আল্লাহ্ র রহমতে। সে নামাজের দিকেও বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছে এই অল্প সময়ের মধ্যেই। তাই জামালের প্রতি শিরিনের শ্রদ্ধার লেভেলটা অনেক উচ্চ ছিল। কিন্তু তাই বলে একেবারেই অজো পাড়া গাঁয়ে থাকাটা তার পরিবার মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছিল না তার।
জামাল চলে যাবার পর থেকে শিরিন কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে নিজের মধ্যে। তার ভীষণ একাকী লাগছিল আর অহেতুক চোখের কোণে পানি চলে আসছিল। অবশেষে বুঝতে পারে জামালকে সে মনেপ্রাণে অনেকখানি ভালোবেসে ফেলেছে। মায়ের সঙ্গে শিরিনের ছিল বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তাই শেষমেষ শিরিন তার ইচ্ছার কথা মাকেই খুলে বলে। তার মা জামালকে বেশ পছন্দ করতেন। বর্তমান যুগে তার মতো সৎ ছেলে খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার তারপর আবার জামাল দেখতেও যথেষ্ট সুদর্শন ছিল। তাই মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে চাননি তিনি কিন্তু গ্রামে থাকার কথা শুনে কিছুটা দমে যান। শিরিন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে দু’গালে চুমু খেয়ে বলে,
‘মা! ধরুন আপনারা আমাকে এমন একটি ছেলের সাথে বিয়ে দিলেন যার টাকা পয়সা সব আছে কিন্তু ইমান আখলাক ভালো না বা অন্য কোন কারণে তাকে আমার পছন্দ হল না বা সে ছেলেই আমাকে পছন্দ করল না তাহলে কি আমি সুখী হতে পারব? অথচ আমি জানি জামালের আর কিছু থাক বা না থাক সততা আছে,আছে শিক্ষা। ও আমাকে টাকা পয়সা না দিতে পারলেও কখনও অযতœ করবে না। আর তাছাড়া আমিও তো শিক্ষিতা নারী। তেমন কোন সমস্যা হলে নিজেও কোন না কোন ভালো ইনকামের ব্যবস্থা করতে পারব।
এমনই বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়ে শিরিন তার মাকে রাজি করাতে সক্ষম হয় অবশেষে। তাদের বিয়ের পর শিরিন চলে আসে বাবার প্রাসাদ তুল্য বাড়ি রেখে জামালের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে। বিলাসিতাপূর্ণ জীবন ছেড়ে সাদামাটা একটা জীবন। ‘প্রথম দিকে ভালো লাগলেও পরে শিরিনের আর ভালো লাগবে না’- বন্ধুদের এমন হাজারো উক্তিকে ভুল প্রমাণিত করে শিরিন তার স্বামীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। তাদের ফুটফুটে এক ছেলে আর এক মেয়ে কুরআনের হাফেজ হচ্ছে, নামাজ পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত আর বেশ আদবের সাথে চলে। জামাল সারাদিন মসজিদ আর মক্তব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাড়ি ফিরে এসে রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে স্বামী-স্ত্রী একত্রে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে তাদের সন্তানদের, পিতামাতা আর আত্মীয় স্বজনদের কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে দোয়া করে, দোয়া করে সমস্ত বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য। নিজের সংসারের কাজ সেরে বাড়িতে তালিম করে এলাকার নারীদেরকে শিরিন ইসলামের দাওয়াত দেয়, কল্যাণকর কাজের জন্য উৎসাহিত করে। তাদের ঘরটি পুরো এলাকার মাঝে আলোকিত মনে হয় গ্রামবাসীদের কাছে, আর তার চেয়েও বেশী আলোকিত মনে হতে থাকে আসমান বাসীদের কাছে।