ছেলেটা আগে হিন্দু ধর্মের ছিলো।ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে খুব বেশিদিন হয় নি।ছেলেটার নতুন নাম আনাস।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কথা শুনে তার বাবা-মা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিয়েছে।মাত্র অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র সে।ন্যাশনালে ইংরেজিতে অনার্স করছে।বাবা-মা বাসা থেকে বের করে দেয়ার পর থেকে টাংগাইল সদরেই ছোট্ট একটা রুম ভাড়া করে থাকে।টুকটাক টিউশনি করে নিজের খরচ টা চালায়।
বাবা-মা,ভাই-বোন,আত্নীয়-স্বজনহীন এই মানুষটা হয়তো কাউকে পাশে পাওয়ার আশায় এই বয়সে বিয়ে করার মতো দুঃসাহসিক কাজের চিন্তা-ভাবনা করতে পেরেছে।তাও আবার আমাদের মতো সমাজে বসবাস করে!
মাস ছয়েক আগে ফেসবুকের একটা ইসলামিক মেট্রিমনি পেজে আমার বায়োডাটা দিয়েছিলাম।বায়োডাটায় আমার বাবার নাম্বারও ছিলো।সেখান থেকেই নাম্বার পেয়ে সে নিঃসংকোচে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজেই দিয়েছিল।
বিয়ের তো জীবনে একটাই করব।একদম দেখেশুনে পারফেক্ট কাউকেই বিয়ে করবো।কোনোদিকেই যেন কম না থাকে।
দেখতে অন্তত মোটামুটি সুন্দর তো হতেই হবে,কালো-খাটো একদমই চলবে না,আর্থিক সচ্ছলতাও থাকতে হবে।টাকা ছাড়া দুনিয়াতে চলা বড় দায়! পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ ধার্মিকও থাকতে হবে।
এর কোনোটাও যদি কম থাকে বিয়ে আমি করব না।দরকার হলে সারাজীবন কুমারীই থেকে যাবো।
এরকম চিন্তাভাবনায় মগ্ন থাকা সেই আমি আনাসের কথা শোনার পর কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে,এরকম কেউ আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে পারে।মনে হচ্ছিল,আমি যেন না চাইতেই আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছিলাম!
আনাসের বর্ননা বাবার মুখে শোনার পর বাবাকে আমি বলেছিলাম যে,
-খোঁজ খবর নিয়ে দেখো।যদি সে নিজের ব্যাপারে যতটুকু বলছে ততটুকু সত্যি হয় তাইলে আমি তাকেই বিয়ে করব।
আম্মা আমার পাশেই ছিলো।আম্মা আমার কথায় অবাক হয়ে বলেছিল,
-তুই ওরে বিয়ে করবি!? ও তোরে খাওয়াবে কি,পরাবে কি? মাথা ঠিক আছে তোর?
আমি আম্মাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম,
-আহ আম্মা…থামো তো। আমাকে সে খাওয়াবে,পরাবে কেন? আল্লাহ আছে না?
-আল্লাহয় কি তোরে উপর থেকে খাবার পাঠিয়ে দেবে?
-আম্মা…! এই মুহুর্তে আমি বাবার সাথে কথা বলতেছি।বাবার সাথে কথা শেষ করতে দাও।তারপর তোমার সাথে কথা বলতেছি।
আমার কথা শুনে আম্মা অই মুহুর্তে রাগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গিয়েছিলেন।
আজ আমি সেদিনের কথা ভেবে নিজেও বেশ অবাক হই।বিয়ের ব্যাপারে যে আমার একশ একটা রিকোয়্যারমেন্ট ছিল,সে আমিই সব রিকোয়্যারমেন্টের নিকুচি করে আগে পিছে কিছু না ভেবেই শুধুমাত্র তার হেদায়েতের কথা শুনেই আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম!
আমার অই মুহুর্তে একটাবারের জন্যও মনে হয় নি যে,
টিউশনির অই কয়টা টাকায় কিভাবে চলবো আমি?
সে আমাকে কেমন খাবার খাওয়াবে,কেমন কাপড় পরাবে,আমার প্রসাধনী সামগ্রী গুলা আদৌ কিনে দিতে পারবে কিনা,আমার ফোনে কখনো অতিরিক্ত ২০ টা টাকা লোড করে দিতে পারবে কিনা,আমাকে কখনো দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে পারবে কিনা,আমাকে কতটুকু বিলাসিতার মধ্যে সে রাখতে পারবে;কিচ্ছু মাথায় আসে নি…কিচ্ছু না!
শুধু মাথায় এতটুকু আসতেছিল যে,তাকে আমার বিয়ে করতে হবে।তাকে বিয়ে করতে না পারলে যেন অনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলবো।
আচ্ছা,
আল্লাহর প্রতি,ইসলামের প্রতি ঠিক কতখানি ভালোবাসার সৃষ্টি হলে একটা মানুষ নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে আসতে পারে?
ইমানের জোর ঠিক কতখানি প্রবল হলে একটা মানুষ তার পরিবারের সবাইকে ছেড়ে,এত সুখ-শান্তি ছেড়ে,পরিবার প্রদত্ত অর্থ-সম্পদ ছেড়ে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য এত কষ্ট সহ্য করতে পারে?
সে আল্লাহর ঠিক কতখানি প্রিয় হলে,আল্লাহ তাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসলে তাঁর রহমতের বৃষ্টি এভাবে এই ছেলেটার উপর বর্ষন করতে পারে!?
কই….অনেকে তো জন্মগতভাবে মুসলিম হয়েও প্রকৃত মুসলিম হয়ে উঠতে পারলো না।নিজেকে তারা মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিলেও নামাজটাও ঠিক মতো পড়ে না।অথচ রাসূল (সঃ) ঘোষণা দিয়েছেন যে,নামাজ হলো মুসলিম আর কাফেরের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী।
অর্থাৎ,কেউ শরীয়তসম্মত কারণ ব্যতীত নামাজ ত্যাগ করলে সে আর মুসলিম থাকবে না।কাফের হয়ে যাবে!
কতটা ভয়ংকর একটা ব্যাপার ভাবা যায়?
জন্ম মুসলিমের ঘরে,নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয়;অথচ আল্লাহর কাছে তারা কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত! হায়..!
তবে কিছু কিছু জন্মসূত্রে মুসলিম আছে যারা প্রকৃত মুসলিম।
কিন্তু এই মুসলিমদের চেয়েও আমার কাছে অই নওমুসলিমকে বেটার মনে হয়।মনে হয় যে,এই নওমুসলিমের ইমানের জোর বরাবরই জন্মসূত্রে যারা মুসলিম তাদের চেয়ে বেশি।
আর এরকম নওমুসলিম এর কাছ থেকে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে সেটা আমার জন্য সত্যিই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই ব্যাপার ছিলো।তাই প্রস্তাব টা পাওয়ার সাথে সাথে সাত-পাঁচ কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা,আমার বাবা আদর্শ বাবা। আমার বাবা সবসময়ই ইসলামের ব্যাপারে আমাকে সাপোর্ট দিয়ে এসেছে।জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামকে বুকে ধারণা করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।কখনো কখনো বাবার কথা শুনেছি,কখনো বা শয়তানের পাল্লায় পড়ে শুনি নি।
কিন্তু বাবা কখনো হতাশ হয়ে পরেন নি।তিনি তাঁর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সবসময়।আমাকে আগলে রাখতে চেয়েছেন দূষিত এই পৃথিবীর সবরকম দূষণ থেকে।
ওদিকে আমার আম্মা ছিলেন একটু ভিন্ন।বাবার মতো দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকে বেশি প্রাধান্য দেয়ার মন-মানসিকতা আম্মার ছিল না।তিনি আখিরাতকে গুরুত্ব দিতেন না এমনও না।তবে দুনিয়া ও আখিরাত উনার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।দুনিয়ার সুখও ভোগ করতে চাইতেন।আর আখিরাতেও জান্নাত চাইতেন।উনার কাছে দুইটা সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আম্মা এই ব্যাপারে নিজের পক্ষে অনেক যুক্তিও দাড় করাতেন।সেসব যুক্তির খপ্পরে পরেই বিয়েতে রিকোয়্যারমেন্ট হিসেবে আমি দ্বীনদারও চাইতাম আবার টাকাপয়সা-ওয়ালাও চাইতাম।দুইটার কোনোটাই বাদ থাকা যাবে না।
দুনিয়াবি অর্থ-সম্পদের চেয়ে দ্বীনদারীতাই যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেইটা যেন বুঝেও বুঝতাম না আমি।বাবা যতবার বলতো যে,”আমি আমার মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারীতাকেই বেশি প্রাধান্য দেবো।ছেলে যদি দ্বীনদার হয় তাহলে তার মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকা হলেও আমি আপত্তি করবো না।”
বাবার এরকম কথা শুনে আমি আর আম্মা দুজনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতাম।ইশ,কি ঢং এর কথা! অই পাঁচ হাজার টাকা তো আমার ফোনের বিল আর প্রসাধনীর পেছনেই চলে যাবে!
বাবা আমার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসতেন।বুঝতাম যে উনার ভেতরে ভেতরে মন খারাপ হয়েছে।বাবা হয়তো দুয়া করতেন আল্লাহর কাছে যাতে আল্লাহ উনার মেয়েকে সঠিক বুঝ দান করেন।আল্লাহ হয়তো আমার বাবার দুয়া কবুল করেছেন।আর সেজন্যই বুঝি আনাসের বেলায় আমার দুনিয়াবি চিন্তা মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল।আনাসের ব্যাপারে আমার অইরকম আগ্রহ দেখে বাবা যতটা খুশি হয়েছিলেন আম্মা ঠিক ততটাই রেগে গিয়েছিলেন।কিন্তু আমার সম্মতি নিয়ে বাবা বাবার জায়গায় অটল রইলেন।খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করলেন আনাসের ব্যাপারে।ছেলে হিসেবে খারাপ না আনাস।৭ মাস যাবত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে একই মহল্লায় আছে।মহল্লার কেউ এই সাত মাসে তার ব্যাপারে খারাপ কিছু দেখে নি।মহল্লার যত মানুষের কাছে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে সবাই এক কথায় বলেছে যে,তার মতো ছেলে নাকি দ্বিতীয় টা হয় না!
এরপর আর কি চাই..! আর আল্লাহ তো আছেনই !
বাবা এই বিয়ের ব্যাপারে আস্তে আস্তে সিরিয়াস হতে লাগলেন।বাবা যত সিরিয়াস হচ্ছিলেন আম্মা ততই বাধা দিতে লাগলেন।আমাকে,বাবাকে দুজনকেই বিভিন্নভাবে বুঝাতে লাগলেন যে, এভাবে যেন এখানে আমাকে বিয়ে না দেন।আমি যেন এই ছেলেকে বিয়ে না করি।
আম্মা বুঝাতে লাগলেন যে,এই ছেলের বংশের কোনো পরিচয় নেই এখন।বাবা-মা,আত্নীয় স্বজন কেউ পাশে নেই।কোনো বিপদ আপদে তার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।সবচেয়ে বড় কথা,আমার মতো মেয়ে অই অভাব সহ্য করতে পারবে না।
মধ্যবিত্ত আমরা…অভাব আমাদের সংসারেও আছে।
কিন্তু সেই অভাব বাবা-মা কখনো বুঝতেই দেন নি তাদের একমাত্র মেয়েকে।কোনো কিছু মুখ ফুটে চেয়েও পাই নি এমন ঘটনা আজ অবদি ঘটে নি।অভাব কি,কাকে বলে কখনো বুঝতেই দেন নি তারা আমাকে।এক প্রকার বিলাসিতা করেই কাটিয়ে এসেছি এই পর্যন্ত।
এইরকম একটা বিলাসবহুল মেয়ে কিভাবে অই অভাবের ভেতর টিকবে? এই আতঙ্ক টা আম্মার সবচেয়ে বেশি ছিলো।কিন্তু আমার ভেতরে কেমন যেন একটা অদম্য আত্নবিশ্বাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল,হঠাৎ করেই যেন আমার ঈমানী শক্তি বেড়ে গিয়েছিল।সেই ঈমানী শক্তির জোরেই মায়ের এরকম আকুতি মিনতি,বাধাকে উপেক্ষা করে জেদ ধরেই বসেছিলাম আনাসকে বিয়ে করার জন্য।
আম্মা আমাকে আর বাবাকে নিজে বুঝাতে না পেরে আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে বুঝাতে লাগলেন।সব আত্মীয়-স্বজনকে উনি নিজের পক্ষে নিয়ে নিলেন।সবাই মিলে বাবাকে বুঝাতে লাগলেন যে,এভাবে এইখানে বিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না।বাবা এক পর্যায়ে যেন কনফিউশানে পরে গেলেন এই ব্যাপারে!
কিন্তু আমি ইস্তেখারা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।বাবাকেও জানালাম যে আমি ইস্তেখারা করতে চাই।আর বাবাকেও বললাম যেন উনিও ইস্তেখারা করেন।এই ব্যাপারে আমাদের কি সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত সেইটা আল্লাহ নিজেই না হয় ঠিক করে দিক!
ইস্তেখারা করার পর আনাসের প্রতি আমার দুর্বলতা যেন আরো বেড়ে গেলো।আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে,আল্লাহ কি চাচ্ছেন!
বাবা আর কারো কথা শুনেন নি। আনাসকে ডেকে এনে একদম ঘরোয়া পরিবেশে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে পরিয়ে দেন।যত আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশি,পরিচিত লোক আছে সবাই বাবাকে তিরস্কার করতে লাগলো।নানা ভাবে বাবাকে কথা শুনাতে লাগতো।অবশেষে আমার বাবা যে উনার একমাত্র আদরের মেয়েটাকে এভাবে নর্দমায় ফেলে দিবেন সেইটা যেন সবার কল্পনার বাইরে ছিল!
আম্মা তো খাওয়া-দাওয়াই বাদ দিয়ে দিয়েছেন।বিয়ের দুইদিন আগে থেকে পানি ছাড়া মুখে কিছু দেন না।বিয়ের দিন বিয়ে পরানোর পর আম্মার হাতে বিয়ের খুরমা দিলে সেই খুরমাটাও হাত থেকে ফেলে দেন! কি ভাবে এই অভিশপ্ত খুরমা উনি মুখে তুলবেন…!?
বিদায় বেলায়ও আম্মা পাথর হয়ে বসে ছিলেন।কিছুতেই যেন তিনি সহজ-স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না।এক পর্যায়ে আমি নিজেই গিয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলছিলাম যে,
-আম্মা…কষ্ট দিছি তোমাকে জানি।ক্ষমা করে দিয়ো আমাকে।দুয়া কইরো আমাদের জন্য।
আম্মাকে কান্না করে এই কথা বলার আম্মাও হঠাৎ বাচ্চাদের মতো কান্না করে দিলেন! সে কি বাধ ভাঙ্গা কান্না!
মনে হচ্ছে,আমি যেন মরেই গিয়েছি!
বুকের ভেতরের চেপে রাখা,ক্ষোভ,কষ্ট,অভিমানগুলো আম্মার চোখ দিয়ে পানি হয়ে ঝড়লো দীর্ঘক্ষণ।
অবশেষে বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে স্বামীর সেই ভাড়াবাড়ির ছোট্ট রুমটাতে ঢুকলাম।ছোট্ট একটা রুম।ইটের দেয়ার,উপরে টিনের চাল।একটা চৌকি,চৌকির পাশে একটা পড়ার টেবিল,একটা আরএফএল এর সেল্ফ আর একটা আলনা ছাড়া কিছুই নজরে পড়লো না।বাসর ঘর সাজিয়েছে ওর বন্ধুরা।ছোট্ট ঘরটাতে কাচা ফুলের তীব্র গন্ধ মৌ মৌ করছে।আমি বিছানার এক কোণে বসলাম।আমাদের বাসা থেকে আসার সময় টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে দিয়েছিল রাতের জন্য।যদিও এখন রাত বেশি হয় নি।সবে মাত্র ৮ টা বাজে।দুপুরে ঠিকমতো খেতে না পারায় ক্ষুধা লেগেছিল প্রচন্ড।
আমি তখন ওকে বিছানার এক কোণে বসে অসহায় কন্ঠে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলেছিলাম,
-ক্ষুধা লাগছে প্রচন্ড।খেতে দিবা কিছু?
বাসর রাতে অইটাই ছিলো আমার প্রথম কথা।আনাস বেচারা কিছুক্ষণ হাবলার মতো হা করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।যেন আমার কথার আগামাথা কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না!
কি এইরকম বোকার মতো চাহনিটাও কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তখন আমার চোখে! আমিও বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।কিছুক্ষণ এক ধ্যানে দুজন দুজনের দিয়ে তাকিয়ে থাকার পর আমি ফিক করে হেসে দিয়ে সেই ধ্যান ভাংগালাম।ওকে আহ্লাদী ভঙ্গিতে আবারো বললাম,
-আমার ক্ষুধা লাগছে আনাস।টিফিন ক্যারিয়ার টা কোন ব্যাগে? নিয়া আসো না প্লিজ…!
বেচারা এবারও বুঝি আমার কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিল।সদ্য বিবাহিতা বউ যার সাথে কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না;সে যে এভাবে বাসর রাতের প্রথম কথাবার্তায় কোনো পারমিশন ছাড়াই তার স্বামীকে তুমি বলে সম্বোধন করতে পারে সেইটা বোধহয় আনাসের কল্পনার বাইরে ছিল!
বেচারা আমার কথায় থতমত খেয়ে বলল,
-ইয়ে…আগে ফ্রেশ হয়ে নিলে ভালো হতো না?
-ক্ষুধায় আমার পেট চো চো করতেছে।এখন না খেতে পারলে অজ্ঞান হয়ে যাবো আমি।
আমার এরকম সহজ স্বাভাবিক কথা শুনে আনাস বিব্রত হয়ে গিয়েছিল প্রচুর।কেমন হাবলু হাবলু লাগছিল ওকে।কি যে ভালো লাগছিল আমার তখন…!
***
বিয়ের পরের তিনটা বছর ছিলো ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ! আমাদের মধ্যে আন্ডার্স্ট্যান্ডিং,ভালোবাসা যতটা তীব্র ছিল,আর্থিক সমস্যাটাও ঠিক ততটাই তীব্র ছিলো।
অনার্স ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার মাসখানেক আগেই বিয়ে হয়েছিল।বিয়ের পর লেখাপড়ার কথা আর ভাবতে পারি নি।
আনাস প্রচন্ড আত্নমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ।এত অভাবের মাঝেও আমাকে আমার বাবার বাড়ি থেকে কখনো এক পয়সার জিনিসও আনতে দেয় নি।
টিউশনি করে ৮-১০ হাজার টাকার মতো পেতো।
অই টাকার মধ্য থেকে ২৮০০ টাকা রুম ভাড়া দেয়া লাগতো।তার নিজের লেখাপড়ার খরচ,সংসার খরচ সব কোনোরকমে টেনেটুনে চলতো এখান থেকেই।এত্ত অভাবের মাঝেও আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার প্রচেষ্টার শেষ ছিলো না।নিজের হাত খরচ থেকেই টাকা বাঁচিয়ে আমার জন্য এটা সেটা কিনে আনতো।
ওর কষ্ট গুলো বুঝতাম আমি।এই আর্থিক সংকট টা অনেক কষ্টকর হলেও কেমন যেন একটা প্রশান্তি খুঁজে পেতাম আমি।
কখনো ওর কাছে মুখ ফুটে কিছুই চাই নি।বিয়ের পর মুখে ফেসওয়াশ লাগানোটাও ছেড়ে দিয়েছিলাম।ফেসওয়াশের বদলে গায়ে দেয়া সাবানটাই মুখে ব্যবহার করতাম।গরমের দিনে ক্রিম ব্যবহার করতাম না মুখে।শীতের সময় ব্যবহার না করলে চলেই না তাই টিব্বত প্রমিট মুখে লাগাতাম।
মাঝেমধ্যে আনাস নিজে থেকেই খেয়াল করে করে ক্রিম ট্রিম এনে দিতো।এনে দিলেও আমি একদম একটু একটু করে মুখে লাগাতাম।যাতে তাড়াতাড়ি শেষ না হয়।ক্রিম যখন তলানিতে পৌঁছাতো তখন আর ব্যবহার করতাম না।রেখে দিতাম অবশিষ্ট টুকু।যাতে করে আনাস ক্রিমের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারি যে,ক্রিম শেষ হয় নাই এখনও!
শীতের দিনে শরীরের চামড়া টান টান হয়ে যেতো।তবুও লোশন লাগাতাম না শরীরে।সরিষার তেল লাগাতাম।কখনো বলিও নি যে আমাকে লোশন কিনে দাও একটা।আমাকে সরিষার তেল লাগাতে দেখে সে নিজেই একদিন বলল,
-কাল তোমার জন্য লোশন নিয়ে আসবো নি একটা।
-আরে না না…লাগবে না লোশন।লোশন যা ঠান্ডা..! অইসব লাগালে আমার শরীরে কাপুনি উঠে যায় শীতে।আমি সরিষার তেলই লাগাই।এইটাতে ওম ধরে!
আমার কথা শুনে সে আর কিছু বলে নি আমায়।শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।আমি যে মিথ্যা অজুহাত দেখাচ্ছি সেইটা হয়তো সে বুঝতে পারতো কিংবা পারতো না।
কিন্তু আমি তো বুঝতাম ওর কষ্ট, আমি বুঝতাম ওর যন্ত্রনা।
আমি তো বুঝতাম যে,অন্য সবার মতো ওরও তো ইচ্ছে করতো বউকে মন ভরে এটা সেইটা দিতে।কিন্তু অই যে,টাকা নাই।
এই অভাবের মাঝে আমি আবার মুখ ফুটে কিছু যদি চাইতাম সেইটা দিতে না পারলে ওর যে আরো বেশি কষ্ট লাগতো।এসব ভেবেই কখনো চাই নি।এই যে আনাস আমাকে এত্ত ভালোবাসে,আমার জন্য ওর মন এত কাঁদে এটাই বা কম কিসে…!?
আমি শ্যামবর্ণা মেয়ে।বিয়ের আগে এই সেই প্রসাধনী ব্যবহার করায় গায়ের রঙ উজ্জ্বল লাগতো।কিন্তু বিয়ের পর ওসব ছেড়ে দেয়ায় চেহারার উজ্জ্বলতা কমে যাচ্ছিল দিন দিন।তবুও আনাস বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে।ওর চাহনিতে মনে হতো আমার রূপ যেন উপচে পরছে!
কারণে-অকারণে আমার রূপের প্রশংসা করতো।মাঝে মাঝে আমার রাগ আর লজ্জা দুটোই লাগতো।বলতাম যে,
-হইছে…এত পাম দেয়া লাগবে না।এই পাম না দিলেও কোনো ক্ষতি হবে না।আমি এমনিতেই তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
আমার কথা শুনে আনাস গাল ফুলিয়ে অভিমান করে বলতো,
-এটাকে তোমার পাম মনে হয় সুমু..!?
ওর কথা শুনে আমি মুচকি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরতাম।
বিয়ের আগে তিনবেলা মাছ কিংবা মাংস কোনোটার একটা না হলে চলতোই না।মাছ-মাংস না থাকলে ডিম থাকতো।
অথচ বিয়ের পর মাছ/ডিম মাসে একদিন চোখে দেখতাম কি দেখতাম না।আর মাংসের কথা তো ভাবতেও পারতাম না।
ভর্তা,শাক এইসবই খেতে হতো তিনবেলা।কখনো কখনো সেসবও থাকতো না।পানি আর লবণ দিয়ে ভাত খেতে হতো।
প্রথম প্রথম এসব খেতে খুব কষ্ট হতো।খুউউব..!
কিন্তু ওর সামনে তবুও সেসব গাপুসগুপুস খেতাম।না খেলে তো আনাস বুঝে ফেলবে যে আমি কষ্ট পাচ্ছি।ওকে যে আমি কিছুতেই কষ্ট দিতে চাই না।কিছুতেই না…!
ওর প্রতি তো আমার কোনো অভিযোগ নেই।আমি সবকিছুর পরেও ওর সাথেই সুখী আছি।
যে আমার প্রতিমাসে একটা করে নতুন জামা না হলে ভালো লাগতো না।দুই-তিন মাস পর পর একটা করে নতুন বোরকা না হলে চলতোই না।সেই আমিই অই সময়টাতে অল্পতেই কত্ত তুষ্ট ছিলাম!
আমার দুইটা ভালো শাড়ি ছিলো।সেগুলো ট্রাংকের ভেতর তুলে রেখেছিলাম কোথাও গেলে পড়ে যাওয়ার জন্য।আর এমনি সবসময় পরার জন্য দুইটা থ্রিপিস ছিলো।এক সেট বোরকা দিয়েই তিনবছর পাড় করেছি।একটুও কষ্ট হয় নি আমার।একটুও না।বরং কেমন যেন একটা প্রশান্তি চলে আসতো অন্তরে।এইতো…চলছে তো এতেই।আলহামদুলিল্লাহ!
বাবার বাড়ি প্রতিবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অই দুই শাড়ি পরেই যেতাম।এই নিয়ে আশেপাশের লোকদের কম কথা শুনি নি।কেউ তো অপবাদ দিতেও ছাড়ে নি।
আমার মতো এমন পরিবারের মেয়ে অইরকম একটা ছেলেকে জেনে-বুঝে কেন বিয়ে করলো..!? নিশ্চয়ই আগে থেকে প্রেম ছিলো।হয়তো প্রেমের টানেই ছেলেটা মুসলমান হয়েছে।
এই টাইপ আরো কতো কথা…! আল্লাহর জন্য দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছি সেসব।
আমাকে এই অবস্থা দেখে আম্মা কান্না করতো সবসময়ই।
আম্মাকে আমি বুঝাতেই পারতাম না যে,আমি সত্যিই খুব ভালো আছি।খুউউব!
সূরা ইনশিরাহ এর ৬-৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,”নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।”
এই আয়াতটা আগেও বহুবার পড়েছি।কিন্তু কখনোই আমি এই আয়াতটার মর্ম অনুভব করতে পারি নি।আমার মাথায়ই আসে নি যে কিভাবে কষ্টের সাথে স্বস্তি থাকতে পারে..!?
কষ্ট আর স্বস্তি তো দুটো বিপরীতমুখী শব্দ।অথচ আল্লাহ৷ এত্ত জোর দিয়ে বলছেন যে,কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে..!
এখন বুঝি এই আয়াতটার মর্ম…এখন এই আয়াতটাকে মন থেকে অনুভব করি আমি।এই যে কত কষ্টে থেকেও কি অদ্ভুত প্রশান্তি পেতাম মনে…একটা অদ্ভুত রকমের স্বস্তি আসতো।আল্লাহ তো এটার কথাই বলেছেন!
আমি আম্মার মাথায় সূরা ইনশিরার সেই আয়াতটাও ঢুকাইতে পারতাম না।যে আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,”নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি হয়েছে।অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।”
আমি যে সত্যিই সুখে আছি আম্মা।কেন তুমি বুঝো না..!?
বিয়ের ছয়মাসের মাথায়ই আমি কনসিভ করি।প্রেগন্যান্সির সময় ভাত মুখেও নিতে পারতাম না।ভাত খেলেই বমি হতো।আমার এই অবস্থা দেখে আম্মা আনাসকে বলে আমাকে পুরো প্রেগন্যান্সির সময়ের জন্য উনার কাছে নিয়ে রাখতে চায়।আনাসও রাজি হয়ে যায়।পুরো প্রেগন্যান্সির সময়টা আমি বাবার বাড়িতে ছিলাম।সেখানে খাবার-দাবার,যত্ন কোনোকিছুরই কম ছিলো না।কিন্তু আনাসকে প্রতি মুহুর্তে মিস করতাম।আনাস প্রতি বৃহস্পতিবার আসতো আর শনিবার সকালে চলে যেতো।সপ্তাহের বাকি দিনগুলো নিজেকে গ্রীষ্মের খা খা রোদে উড়তে থাকা এক তৃষ্ণার্ত কাকের মতো মনে হতো।
যথাসময়ে একটা ছেলেসন্তান জন্ম দেই আমি।আমার ‘সুমাইয়া’ নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখা হলো ‘সামির’।
এই অভাবের সংসারে আমার ছোট্ট সামির একটু একটু করে বড় হতে লাগলো।
এদিকে আনাসের ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা কাছাকাছি চলে এসেছে।এক্সামের পড়ার পাশাপাশি বিসিএস এর জন্য পড়াশোনা করে যাচ্ছে।সেই সাথে ৫-৬ টা টিউশনি!
বেচারা দম ফালানোর সময় পেতো না।খুব কষ্ট হতো ওর জন্য আমার।
গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পর বিসিএস এর জন্য আরো জোড়ালো ভাবে পড়াশোনা শুরু করে আনাস।
বিসিএস পরীক্ষা দেয়। কিন্তু উত্তীর্ণ হয়ে গেজেটে নাম প্রকাশ করতে পারেনি। অবশেষে পিএসসি জবের সুপারিশ ক্রমে নন-ক্যাডার থেকে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ওকে নিয়োগ করা হয়।
চাকরি টা পাওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ অভাব দূর হতে থাকে আস্তে আস্তে।এখন তো আলহামদুলিল্লাহ কোনো অভাবই আর নেই।নিজেরা সচ্ছল ভাবে চলে কিছুটা দান-খয়রাতও করতে পারি।
যদিও এখনো নিজের একটা বাড়ি করার মতো টাকা জমিয়ে উঠতে পারি নি,এখনো ভাড়া বাসায়ই থাকতে হয়।তবুও আলহামদুলিল্লাহ…! আশা রাখি, যে আল্লাহ আমাদের অই কঠিন অভাব দূর করেছেন সেই আল্লাহ কোনো একদিন নিজেদের বাড়ি করারও তৌফিক দান করবেন।
বিয়ের আজ ৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।
শুনেছিলাম,অভাবের সংসারে অভাব থাকলে নাকি ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়…কিন্তু কই? অই কঠিন অভাবেও তো আমাদের ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমে নি।বরং দিন দিন বেড়েই চলেছিল,আজও বেড়েই যাচ্ছে।আজও আমি আর আনাস দুজন দুজনের কাছে আগের মতই আছি।সম্পর্ক পুরোনো হলে নাকি ভালোবাসাও কমে যায়!
নাহ…আমাদের ক্ষেত্রে তো তেমনটা ঘটে নি!
সবই আল্লাহর ইচ্ছা…আল্লাহ যদি আমাকে ধৈর্য্য ধরার তৌফিক দান না করতেন,যদি উনি আমাদের সাহায্য না করতেন কখনোই এতকিছু সম্ভব হতো না।
আনাসের অই কঠিন সময়টাতে ওর হাত ধরে ওর পাশে থাকতে পারাটা আমার মতো মেয়ের জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিলো।হ্যা,আমি পেরেছিলাম অই সময়টাতে ওর পাশে থেকে ওকে সাপোর্ট দিতে।এটা ভাবলেই মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি চলে আসে।
ইশ,আল্লাহ সাহায্য না করলে কি আদৌ আমি পারতাম?আলহামদুলিল্লাহ!
আমার জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত হিসেবে আল্লাহ আমার আনাসকেই আমার জন্য পাঠিয়েছেন।বাকি জীবনটাও আমি এভাবেই আনাসের পাশে থেকে ওর অর্ধাঙ্গিনী,ওর একমাত্র আত্মার আত্মীয় হয়েই থাকতে চাই।
শুধু এই জীবনে নয়…জান্নাতেও আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া এই শ্রেষ্ঠ নিয়ামত,আমার আত্মার আত্মীয়,আমার এই আনাসকেই চাই।