আজও খাবার টেবিলে উপর দিয়ে সাইক্লোন বয়ে গেল। আর একটু হলেই টেবিলের সব খাবার ছুঁড়ে ফেলতো রাফসান। নিত্যদিন এই পারিবারিক অশান্তি তার আর ভালো লাগে না। সারাদিন অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে একটু শান্তি খোঁজে রাফসান। কিন্তু তার ভাগ্যে এত সুখ কোথায়?
বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই শুরু হয় যত অশান্তি। খাবার টেবিলে বসে খাবার দিতে বললেই মাহনূর তার ঝাঁঝালো কণ্ঠে উত্তর দেয়,
-” সব খাবার টেবিলেই আছে নিয়ে খাও।”
কার না ইচ্ছে হয় অনেক যত্নে খাবার খাওয়ার? তেমনি রাফসানও স্বপ্ন দেখতো তার স্ত্রী মাহনূর তাকে অনেক যত্নে নিজের হাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। বিয়ের প্রথম প্রথম মাহনূর সে দ্বায়িত্ব পালন করলেও এখন রাফসানের সে আশায় গুড়েবালি। মাহনূর টিভির নেশায় মত্ত। এইতো আজকে যখন রাফসান খেতে বসেছে তখন সে দেখলো তরকারিতে লবন কম। আশেপাশে লবনের বাটিটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেই মাহনূরকে হাঁক ছুড়লো ওমনি সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
-” আমি ব্যস্ত আছি। খুঁজে নাও।”
রাফসানের রাগটা তখন মূহুর্তেই বেড়ে গেল। খাবার খাওয়ার ইচ্ছেটা সাথে সাথেই উবে গেল। মনের মধ্যে একরাশ দুঃখ নিয়ে রাফসান বেলকনিতে রাখা রুকিং চেয়ার টায় বসল। চিন্তায় মাথার দুপা পাশ ধপধপ করে লাফাচ্ছে।
চোখ বন্ধ করতেই অতীতের স্মৃতি গুলো রাফসানের মানসপটে ভেসে উঠতে লাগলো। কয়েকবছর আগে পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় রাফসান ও মাহনূরের। গ্রামের খুব সহজ সরল মেয়ে ছিল মাহনূর। রুপে গুনে সে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। দ্বীন পালনের ব্যাপারেও সে যথেষ্ট সচেতন ছিল।
বিয়ের প্রথম প্রথম রাফসান এইরকম একজন স্ত্রী পেয়ে সুখের সাগরে ভাসছিল। তার চাওয়ার থেকেও সে বেশি কিছু পেয়েছে এই ভেবে তার নিজেকে খুব সুখী মনে হতো। কিন্তু এই সুখ তার বেশিদিন রইল না। জীবিকার তাগিদে সে যখন তার চাকরির স্থানে চলে আসলো তখন মাহনূরকেও সাথে নিল।সারাদিন অফিস শেষে খাটাখাটুনির পর বাড়িতে এসে স্ত্রীর হাসিমাখা মুখ খানি দেখলেই তার সমস্ত গ্লানি মুছে যেত।
কিন্তু রাফসানের অফিসে থাকাকালীন মাহনূরের একাকীত্বটা তাকে ভাবিয়ে তুলতো। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনা করে রাফসান বাড়িতে একটা টিভি কিনে নিয়ে আসল। যাতে অবসর সময়টা মাহনূরের টিভি দেখেই কেটে যায়। সে যেন একাকীত্ব বোধ না করে।মাহনূর প্রথমে আপত্তি করেছিল যে টিভিতে ভালো জিনিসের পাশাপাশি খারাপ জিনিসও দেখায়। কিন্তু পরে নিজের মনকে মানিয়ে নিয়েছে যে সে সবসময় ভালো জিনিস গুলোই দেখবে। খারাপ চ্যানেল গুলো এড়িয়ে চললেই তো হলো।
এভাবে সময় তার নিজস্ব গতিতে চলছিল। মাহনূর অবসর সময় টা টিভিতে ইসলামিক জলসা, নিউজ বা বিভিন্ন শিক্ষনীয় অনুষ্ঠান দেখেই কাটায়। অবশ্য আগে তার অবসরের সঙ্গী ছিল কিছু ইসলামিক বই। কিন্তু বাড়িতে টিভি স্থান পাওয়ার পর ইসলামিক বইগুলো এখন র্যাকেই গোছানো থাকে।তবুও এভাবে আর কতদিন? প্রতিদিন টিভিতে এক জিনিস দেখতে দেখতে মাহনূর বিরক্ত হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে আশেপাশের চ্যানেলগুলোতে একটু চোখ বুলাতে। বিশেষ করে স্টার জলসা, স্টার প্লাস, জি বাংলা ও জলসা মুভিজের মতো চ্যানেলগুলোতে একনজর ঢু মেরে আসতে। তখন তার নফসও বলে, একদিন এসব চ্যানেল দেখলে কি এমন ক্ষতি হবে?
আস্তে আস্তে মাহনূর নিজের অজান্তেই বিজাতীয় সিরিয়ালের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এখন আর সেগুলো তার কাছে বড় পাপ মনেই হয় না। সকাল বিকাল কোনো রকম রান্নার কাজগুলো শেষ করেই টিভির সামনে বসাটা তার রুটিনে পরিনত হয়েছে। সালাতের ব্যাপারেও বড্ড উদাসীন হয়ে গেছে মাহনূর। কোনো সিরিয়ালের মাঝে যখন আজান পড়ে যায় তখন তার নফস তাকে এই বলে শান্তনা দেয় যে, ” কেবল তো আযান দিল। এখনো সালাতের অনেক সময় আছে।এই পর্ব টা আগে শেষ হোক। যখন বিজ্ঞাপন শুরু হবে তখন সালাত আদায় করা যাবে।”
এভাবেই মাহনূর খুব সহজেই তার নফসের কাছে হেরে যায়। একপর্যায়ে সে বিজাতীয় সিরিয়ালের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে মাঝে মাঝে রাফসানের উপদেশ বানীগুলো তার কাছে বিরক্ত লাগে। শুরু হয়ে যায় পারিবারিক অশান্তি। রাফসানের প্রতি বাড়তি যত্ন গুলোও আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়।
আর মাহনূরও আস্তে আস্তে দ্বীনের পথ থেকে সরে আসতে থাকে।
====
কোনো মানুষ যখন বিজাতীয় সংস্কৃতি মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তখন সেই মানুষ টা নিজের অজান্তেই তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু কোনো অবস্হাতেই এটা তারা মানতে চাইবে না। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে আপনি সিরিয়াল দেখতে টিভি অন করেন। কেন জানেন? কারণ আপনি তাদের মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছেন। যে কারণে আপনি বিজাতীয় সিরিয়াল থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছেন না। এটা আপনার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আবার যখন তাদেরকে এগুলো থেকে নিষেধ করা হয় তখন তারা অধিকাংশই বলে, ” আমি তো শুধু কয়েকটা নাটক দেখি। নারীদের জন্য কিছু শিক্ষনীয় নাটক দিচ্ছে তো। “
আচ্ছা আপনি স্টার জলসা, জি বাংলার মতো চ্যানেলে শিক্ষনীয় নাটক দেখছেন? আপনি একজন মুসলিম হয়ে বিধর্মীদের কাছ থেকে কি শিখবেন? তারা তো আপনার রাব্বে কারীমকেই অস্বীকার করে। তাহলে কোন সাহসে সেই বিধর্মীদের কাছ থেকে আপনি শিখতে চান? বিধর্মীরা আপনাকে কতটুকু নিরাপত্তার শিক্ষা দিবে? যেখানে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ। তার পরিবর্তে কি আপনি পারেন না আপনার ধর্মের ফাতিমা(রাঃ), আয়েশা( রাঃ), উম্মে আম্মার(রাঃ) এর মতো মহীয়সী নারীদের জীবনী পড়তে? তাতে আপনাদের যথেষ্ট অজুহাত । পড়াশোনা, রান্নাবান্না, ঘর গোছানো থেকে শুরু করে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া আবার এসে পারিবারিক দ্বায়িত্ব পালন করা। এসব করার পর একদমই সময় হয়ে উঠে না ইসলামিক বই পড়ার। কিন্তু আপনারাই আবার টিভিতে সিরিয়ালের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু আপনি কি জানেন আপনি চাইলে সবই সম্ভব? আপনি যখন বাচচাকে স্কুলে নিয়ে যাবেন তখন যাওয়ার সময় ব্যাগে কয়েকটি ইসলামি সাহিত্য নিয়ে যান। লং জার্নি হলে আপনি রিকশা, অটোতে বসেও পড়তে পারেন। আর সেটা সম্ভব না হলে আপনি যতক্ষণ বাচ্চার ক্লাসের সময়গুলোতে অনেক অভিভাবকের সাথে বসে সময় কাটান তখন গিবত চর্চা না করে ইসলামি সাহিত্যগুলো নিজে পড়বেন সাথে অন্যকেও দিবেন।