বৃত্তবন্দী জীবন

বৃত্তবন্দী জীবন
পেঁয়াজ পুড়ে আসছে, তাড়াতাড়ি করে তরকারিটা ঢালতে যাব তখনই পরপর তিনবার কলিংবেলের আওয়াজে আঁতকে উঠলাম। তারাহুরো করে তরকারিটা ঢালতে গিয়ে ছ্যাৎ করে তেল ছিটকে হাতে পরলো। সেটা উপেক্ষা করেই বাহিরের দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম। ইতিমধ্যে ঘনঘন আরও তিনবার বেল বেজেছে। দরজা খুলতেই জুতোসহ হনহন করে মিরাজ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
–তুমি কানে কালা নাকি! কতবার বেল বাজাচ্ছি শুনতে পাচ্ছো না? যাও এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো। –বলতে বলতেই ঘরে চলে গেলো, আমার কিছু বলার সুযোগ কই!
এটা নতুন কিছু না। ও এমনই। নিজে যা বলার, করার করে চলে যায় এভাবেই। আমার কোনোকিছু বলার সুযোগ কোথায়! আমার আবেগ-অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়ার কোনো কিছুর মূল্য ওর কাছে নেই। সারাদিন এক ঘরে পাশাপাশি শুয়ে-বসে থাকলেই আমি সেটাকে কাছে থাকা বলি না। অপ্রয়োজনে হাতে কারি কারি টাকা গুঁজে দেয়াকেই ভালোবাসা বলি না। এক ঘরে, এক ছাদের নিচে থেকেও যোজন যোজন দূরে থাকা যায়। যেমন আমরা আছি!
ও কে আমার বুঝতে কষ্ট হয়। মাঝেমাঝে মনে হয় ওর কাছে আমি শুধুমাত্র সামাজিক আর প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া আর কিছুই না। আর এভাবেই নিয়মমাফিক বাধ্যতামূলক সাংসারিক জীবনেই কেটে গেলো পাঁচটা বছর। আজ আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। তাতে কি! ও তো সবসময়ই এক। ওর মেজাজের জন্য বিশেষ-অবিশেষ কোনো দিন নেই! মিরাজ আর আমার এরেঞ্জ ম্যারিজ ছিলো৷ অতি রক্ষণশীলতায় বড় হওয়ায় আলিফকে ভালোবাসা সত্বেও ভয়ে-লজ্জায় বাবাকে বলতে পারিনি৷ মা’কে বলেছিলাম। সব শুনে মা বললেন,
— এ কি কথা বলে মেয়ে! তুই তোর বাবাকে চিনিস না? এই কথা বললে তোকে তো মেরেই ফেলবে আর আমাকেও ছাড়বে না। ভালো চাস তো তুই ওই ছেলেকে ভুলে যা। তোর বড় চাচা একটা ভালো সম্বন্ধ এনেছে, সেটা নিয়েই কথা চলছে। তোর বাবা এখন এ বেপারে কোনোকিছু জানতে পারলে আমাকে তালাকই দিয়ে দিবে। আমার মেয়ে হয়ে থাকলে তুই উল্টোপাল্টা কিছু করবি না, আমার কসম! এরপর আমার বলার আর করার হয়তো কিছুই থাকে না। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েই গেলো। গায়ে হলুদের দিন রাতে মা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন,
— মা-বাবা যা করে ভালোর জন্যই করে মা। আমি তোর মন বুঝতে পারছি কিন্তু তুইও জানিস কিচ্ছু করার নেই৷ দশের কথায় মরাও ভালো। দোহায় মা তুই অতীত ভুলে যা বর্তমানের কথা ভাব। শুধু শুধু কষ্ট বাড়াস না যা হওয়ার তাই হবে। কথাগুলো পাথরের মতো শুনছিলাম। হয়তো চোখের কোনে পানিও জমেছিলো আমি তাকে প্রশ্রয় দিইনি।
আমার বান্ধবী রূপা বলেছিলো,
— অতো ভাবলে হবে না, একটাসময় সব ঠিক হয়ে যাবে আর আলিফকে ভালোবেসে থাকলে তার প্রতিও তোর একটা দায় থাকে।
এই দু’বছরে আলিফ-আমি আমাদের ঘিরে তো আর কম স্বপ্ন সাজায়নি! মাঝপথে তাকে ছেড়ে আসলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না আমিও জানি। তাই বন্ধু-বান্ধবদের কথা মতোই পালানোর সব প্রস্তুতিই নিয়েছিলাম । ভোররাতে চারটার দিকে একটা ট্রেনে উঠার কথা। সবাই ঘুমিয়ে গেলে সিফাত এসে এগিয়ে নিয়ে যাবে রূপার বাসায়। তারপর সেখান থেকে রেডি হয়ে রূপা, সিফাত,সিয়াম আর আমাদের আরেক বন্ধু হৃদয় ট্রেনে উঠব৷ তারপর আলিফকে চমকে দিয়েই কাজি অফিসে ডেকে আমাদের বিয়ে হবে৷ এই সব পরিকল্পনাই হচ্ছিলো আলিফকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। আর আলিফ তখনও ভাবছিলো আগামীকাল আমার বিয়ে তারপরই সব শেষ হয়ে যাবে। আর এখানে অন্য কিছু ঘটার এতটুকুও আশ্বাস নেই। হলোও শেষ পর্যন্ত তা-ই! আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। সবাই ঘুমানোর পর রাত তিনটার দিকে যখন তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছাচ্ছি বেরুনোর জন্য, ঠিক তখনই দরজায় টোকার শব্দে ব্যাগ পায়ে ঠেলে খাটের নিচে রেখে দিলাম৷ বাবা ঘরে ঢুকে আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
–কিরে মা এখনো ঘুমাসনি? এতো রাত জেগে থাকলে অসুস্থ্য হয়ে যাবি তো! বাবাকে বড় হওয়ার পর থেকে কখনো এভাবে কাছে পাইনি। আদর করা সত্বেও সবসময় ভয়ে দূরে দূরে থেকেছি। আজ হঠাৎ আবেগে চোখ ভেসে উঠলো। বাবা আমার ভেজা চোখ দেখে হঠাৎই বুকে জাপটে ধরে হু হু করে মেয়েদের মতো কেঁদে ফেললেন,
— মা’ রে, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস পরের ঘরে যে যেতেই হবে। সব বাবা-মা’রাই তার সন্তানকে ভালোবেসে, স্নেহে বড় করে তাও পরের ঘরে দিতেই হয়। এটাই নিয়ম মা। তুই মন খারাপ করিস না। ওই বাড়িতে সবাই খুব ভালো, তোকে খুব ভালোবাসবে। মিরাজ ছেলেটাও ভালো। দেখিস তুই সুখী হবি! কথাগুলো বলেই বাবা আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বাবাকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি। বুকের ভেতরটায় সেদিন দুমড়েমুচড়ে ঝড় উঠলো। একদিকে বাইশ বছর আদর-স্নেহে বড় করা মা-বাবা অন্যদিকে দুই বছরের ভালোবাসা! সব এক মুহুর্তে একাকার হয়ে বাবা-মা’র কান্নাভেজা চেহারাটা চোখে ভেসে উঠলো। পরদিন বুকে পাথর রেখে আলিফকে চিরবিদায় দিয়ে চুপচাপ বিয়ের আয়োজনে বসে গেলাম।
–কই এখনো পানি আনো নাই? কখন বললাম পানি আনতে? বেডরুম থেকে মিরাজের কর্কশ গলায় ডাক শুনে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে শাড়িতে পা আটকে পরে গেলাম। গ্লাস ভাঙার আওয়াজে মিরাজ ছুটে এলো,
— একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না। এ কি মেয়েকে বিয়ে করলাম হাঁটতে গেলেও একশোবার আছাড় খায়।– বলতে বলতে আমার হাত টেনে উঠিয়ে দাঁড় করিয়েই পাশ কাটিয়ে বড় বড় লাফ দিয়ে কাঁচের টুকরো ডিঙিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম একদৃষ্টিতে! রাত এগারোটা বাজতে চললো মিরাজের আসার কোনো খবর নেই। চোখে লেগে আসছে এমনসময় কলিংবেলের আওয়াজে এক লাফে উঠে দরজা খুলে দিয়েই আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম তরকারি গরম করতে। মিরাজ এসেছে। ফ্রেশ হয়েই খেতে চাইবে নিশ্চয়। যেই কথা সেই কাজ! টেবিলে বসেই ডাক শুরু করেছে৷ রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতেই চেচামেচি করছে বাচ্চাদের মতো,
— কই খেতে দাও! খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। কি করো এতক্ষণ রান্নাঘরে! আমি তার পাতে ভাত দিতে দিতে বললাম,
— রান্নাঘরে মানুষ রান্না ছাড়া আরও কিছু করে কিনা গিয়ে দেখলেই পারো।
— হ্যাঁ, সে-ই কোনো কাজ তো তাড়াতাড়ি ঠিক করে করতে পারো না। সরল পথে হাঁটলেও ধাক্কা খাও আর বাকি রইলো অন্য কাজ! আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। সে নয় নম্বর লোকমা মুখে নিতে নিতে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো–কি রান্না করেছো এটা! পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে। আমিও ভ্রু কুচকে ব্যাঙ্গ করেই বললাম,
— ওহ আচ্ছা খাওয়া প্রায় শেষ করে মনে হলো?
— হ্যাঁ, এতক্ষণ খিদেয় টের পাইনি কি খেয়েছি। এখন বুঝতে পারছি এতক্ষণ আমি কি গিলছিলাম৷ — বেশ তো খেয়ো না।
— হ্যাঁ, সে-ই। এসব খাওয়া যায় নাকি! – বলেই ঘট ঘট চেয়ার টেনে রেগে গজগজ করতে করতে উঠে চলে গেলো। আমি চুপচাপ খেয়ে নিলাম চোখের পানি এক করে৷
ঘন্টা খানেক হলো ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের ওই রাস্তার গাড়ি-ঘোড়ার ব্যাস্ত আনাগোনা দেখছি। রাতের অন্ধকারে গাড়িগুলোকে অনেকটা জোনাকির মতো লাগে। গাড়ির লাইটগুলো জ্বলছে নিভছে! একটা সময় আলিফ আর আমি স্বপ্ন দেখতাম, ব্যাস্ততা শেষে মাঝে মাঝেই আমরা অনেক রাত অবধি রাস্তায় শুধু হাঁটব। ব্যাস্ত শহরে ব্যাস্ত মানুষের গাড়ির আনাগোনা দেখব। মাঝেমাঝে ল্যাম্পোস্টের হলুদ বাতির নিচে দাঁড়িয়েই বিশ্রাম নেব, আর আলিফ বিষ্ময় নিয়ে আমাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরবে! আলিফ বলতো আমাকে হলুদ আলোয় আরও সুন্দর দেখায়! আলিফের কথা মনে হলে বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব হয়, চিন চিন ব্যাথা এখনও হয় । তবে এখন আর চোখে পানি আসে না ওকে ভেবে। ওটা আগেই ফুরিয়েছে। এখন আছে দীর্ঘশ্বাস আর মিরাজ!
বেডরুমে লাইট অফ মিরাজও নেই৷ বেলকনিতে গিয়ে দেখি ওখানে পরেই ঘুমোচ্ছে বুকে বই নিয়ে, আরও ৪/৫ টা বই চারপাশে এলোমেলো পরে আছে। এশ-ট্রেতে ছাই নেই, ছাই মেঝেতে পরে আছে। ছাই মেঝেতেই যদি ফেলার হয় এশ-ট্রে কেন পাশে রেখেছে বুঝি না! ছাই পরিষ্কার করে পাশে বসলাম। ঘুমন্ত মুখটার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। এই মানুষটাকে এই মুহুর্তে কত নিষ্পাপ লাগছে! যার কোনো রাগ নেই, নেই কোনো অভিযোগ। এর সাথে আমার যেনো শুধু বাধ্যগত জীবন নয় এই মানুষটাকেই যেনো যুগে যুগে ভালোবেসেছি বহুভাবে বহুবার!
আলিফের প্রতি বিকেলে বেলী ফুল নিয়ে বাড়িতে ফেরার প্রতিশ্রুতিমূলক স্বপ্ন একসময় তাড়া করলেও এই লোকটার খালি হাতে সান্ধ্য বাড়িফেরাটাও বুঝি ভালোবাসারই লাগে এখন ! মাথায় হাত রাখতে ইচ্ছে হলেও হাত গুটিয়ে নিলাম৷ বুকের উপর থেকে আস্তে করে বই সরিয়ে, ছড়িয়ে থাকা বইগুলো হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে গুছাতে গুছাতে চোখ গেলো ড্রসিং টেবিলের সামনে। ওখানে একটা বক্স রাখা,তার উপরে লেখা–“টু মাই বিলাভ্ড ওয়াইফ!” খুলে কিছু চুড়ি আর ঝুমকো পেলাম। চুড়িগুলো হাতে নিয়ে বেলকনিতে ফিরে গেলাম। অভিমান ভুলে মিরাজের মাথায় হাত রাখতেই চোখ খুলে ও খপ করে হাত চেপে ধরলো। আঁতকে উঠে হাসতে হাসতেই বললাম,
— ওহ মা! তুমি ঘুমাওনি? ও কাছে টেনে বুকে জরিয়েই বললো,
— নাহ্, ঘুমাইনি। ঘুমের ভান করছিলাম!
ভালো না থাকার অনেক কারণই থাকে। সেসব মানিয়ে নিয়ে তার মাধ্যেই এই ছোট দু-একটা ভালোবাসা খুঁজেই হয়তো আমার মতো অসংখ্য মানুষ এভাবেই বছরের পর বছর , যুগের পর যুগ জীবন কাটিয়ে দেয় ভালোবেসে, মায়া করে নয়তো শুধুই অভ্যাসে!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত