পরিশেষে

পরিশেষে
মাস্টার্স পাশ করে জব করা পিয়াসের বিয়ের জন্য ওর বাবা মা মেয়ে খুঁজছেন। এসএসসি দিবে কিংবা ইন্টার ফার্ট ইয়ারে পড়ে এমন বয়সের মেয়ে। পিয়াস বহুবার ওর বাবা-মাকে বুঝাবার চেষ্টা করেছে যে এমন হাঁটুর বয়সী মেয়েকে সে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু ওর বাবা- মা পিয়াসের কোনো কথাই শুনে নি। শেষমেষ পিয়াস ওর বাবা মায়ের অমতে ওর ক্লাসমেট শ্রাবণীকে বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকেই শ্রাবণীর উপর ওর শ্বশুর -শাশুড়ি নানা রকমের অত্যাচার শুরু করে। তরকারি লবণ বা ঝাল সামান্য কম-বেশি হলে শ্রাবণীর কথা শুনতে হয়, রুম ঝাড়ু দেওয়ার সময় মেঝেতে একটা চুল পড়ে থাকলেও শ্রাবণীর কথা শুনতে হয়। এমন কি ঠান্ডা লাগলে যদি সে কাঁশি দেয়, তবুও শ্বশুর শাশুড়ির থেকে কথা শুনতে হয়। সকাল সকাল শাশুড়ির চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে শ্রাবণীর ঘুম ভেঙে গেলো। তড়িঘড়ি করে ড্রয়িং রুমে এসে শাশুড়িকে দেখে মাথার ঘোমটা টানতে টানতে বললো,
– কী হয়েছে মা? শাশুড়ি রাগী রাগী চোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
~ কী আর হবে, এই সংসারে অলক্ষ্মী এসেছে, তাই এমন হচ্ছে। এত বছর ধরে সংসার করলাম কখনো আমার হাত থেকে পড়ে কোনো কিছু ভাঙে নি। আর তুমি এই সংসারে আসার পর থেকেই আমার হাত থেকে সব সময় এটা ওটা পড়ে ভেঙে যায়। আজকে আবার আমার এত সুন্দর ডিনার সেটের প্লেটটা ভেঙে গেলো! শাশুড়ির কথা শুনে শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,
– প্লেট ভাঙলো আপনার হাত থেকে পড়ে আর বদনাম হলো আমার? শাশুড়ি আগের চেয়েও আরো বেশি রেগে গিয়ে বললো,
~এ জন্যই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের সাথে বিয়ে করাতে চাই নি। দুই কলম পড়াশোনা জেনে শ্বশুর শাশুড়িকে সম্মান করতে ভুলে যায়। শ্রাবণী আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ অন্য রুমে চলে গেলো। টবের ফুলগাছে নিয়মিত পানি না দেওয়ার জন্য গাছ গুলো মরে যাচ্ছে, আর এতেও দোষ হয় শ্রাবণীর। শ্রাবণী সন্ধ্যার পর ছাদে হাঁটাহাঁটি করে।মাঝে মধ্যে গুণগুণিয়ে গান গায়। এইজন্য নাকি গাছগুলো মরে গেছে। শ্বশুরের মুখ থেকে এমন অদ্ভুত কথা শুনে শ্রাবণী শ্বশুরকে বললো,
-বাবা, ছাদে হাঁটাহাঁটি করা আর গান গাওয়ার সাথে গাছের মরে যাওয়ার কী সম্পর্ক আছে? শ্রাবণীর প্রশ্ন শুনে শ্বশুর রেগে গিয়ে বললো,
~এই সংসারে আল্লাহর গজব নামছে। স্বামীকে সম্মান না করে তুই করে বলা, বাড়ির বউ হয়ে রাত- বিরাতে ছাদে গিয়ে স্বামীকে নিয়ে রঙ তামাশা করা; এইসব দেখে আল্লাহ আমাদের সংসার থেকে বরকত জিনিসটা উঠিয়ে নিয়েছেন। শ্রাবণী সচরাচর শ্বশুর শাশুড়ির মুখে মুখে কখনোই কিছু বলে না কিন্তু এইবার আর না বলে থাকতে পারলো না। শ্রাবণী তখন বললো,
– বাবা, তুই করে বললেই কী স্বামীর অসম্মান হয়ে যায়? আপনার ছেলে আমার ক্লাসমেট ছিলো। ৬ বছর একসাথে আমরা পড়াশোনা করেছি। ৬টা বছর যাকে তুই করে বলেছি তাকে হুট করেই আপনি করে বলতে কেমন যেন লাগে। তবুও আমি চেষ্টা করছি আপনি করে বলতে। ৬ বছরের অভ্যাসটা পাল্টাতে একটু তো সময় লাগবে। আর স্ত্রী স্বামীর সাথে রঙ তামাশা করবে না তো পর পুরুষের সাথে রঙ তামাশা করবে? শ্রাবণীর কথা শুনে শ্বশুর প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললো,
~ তোমার বাবা মা দেখছি তোমাকে শুধু পড়াশোনাই শিখিয়েছে। কিভাবে বড়দের সম্মান করতে হয় সেটা পর্যন্ত শেখায় নি। শ্রাবণী অবাক হয়ে রইলো। এইখানে সে কোথায় অসম্মান করলো সেটাই বুঝতে পারছে না শুধু শ্বশুর শাশুড়ি না পাড়া প্রতিবেশীরাও শ্রাবণীকে মাঝে মধ্যে নানা রকম কথা বলে। সেদিন পাশের বাসার রিনা আন্টি এসে শ্রাবণীর শ্বাশুড়িকে বললো,
-“কথায় আছে মেয়ে মানুষ কুড়িতে বুড়ি। মাস্টার্স পাস করা মেয়েকে বিয়ে করেছে মানে মেয়ের বয়স ২৫-২৬ বছর হবেই। এখন ভালোয়-ভালোয় বাচ্চা হলেই হয়। ছেলেকে ১৬-১৭ বছরের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে বিয়ের ১ বছরের ভিতরেই বাচ্চা হতো। এত বয়সী মেয়ের বাচ্চা হয় কি না কে জানে। আন্টির এমন কুরুচিপূর্ণ ফালতু কথা শুনে শ্রাবণী কিছু বলতে যাবে এমন সময় কোথা থেকে যেন হুট করে পিয়াস এসে আন্টিকে বললো,
— আন্টি, সেদিন একটা খবরে দেখলাম সুইজারল্যান্ডে ৭৫ বয়সী একজন বৃদ্ধা মহিলা বাচ্চা প্রসব করেছে। সেই তুলনায় আমার বউয়ের বয়স অনেক কম। আমার বউয়ের বাচ্চা হবে কি না সেই বিষয়ে চিন্তা করে মাথার চুল সাদা না করে বরং দোয়া করেন খুব তাড়াতাড়ি যেন আপনাকে মিষ্টি খাওয়াতে পারি। শ্রাবণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিয়াস বললো,
— তুই আন্টির কথায় রাগ করিস না প্লিজ। কার বউ কালো, কার বউ মোটা, কার বউয়ের বয়স বেশি এই সব চিন্তা করে করে আন্টির ডায়বেটিস, হাই প্রেসার সব বেড়ে গেছে। বেশি হলে আন্টি আর বছর দুয়েক বাঁচবে। আন্টি মরে গেলে আন্টির চল্লিশার সময় গলা অব্দি খেয়ে সব রাগ মিটিয়ে নিস। কেমন? পিয়াসের কথাশুনে শ্রাবণী মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো আর রিনা আন্টি রাগে হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
মাস খানেক পর একটা এক্সিডেন্টে পিয়াসের বাম পা খানিকটা প্যারালাইসিসের মত হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দিলে পা’টা আগের মত স্বাভাবিক হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শে শ্রাবণী পিয়াসকে মহাখালী CRP তে ভর্তি করিয়ে দেয়। CRP এ শুধু রোগী থাকে। রোগীর সাথে কাউকে থাকতে দেয় না। অসুস্থতার জন্য পিয়াসের জবটাও চলে যায়। এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে সংসারের হাল ধরার মত কেউ নেই। শ্রাবণী তখন নিজ চেষ্টা আর যোগ্যতায় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে খুব ভালো একটা পোস্টে জব পেয়ে যায়। আর সংসারের হালটা ও সেই ধরে। যে শ্বশুর শাশুড়ি শ্রাবণীকে এত কথা শোনাতো সেই শ্বশুর শাশুড়িই এখন শ্রাবণীকে উঁচু গলায় একটা কথাও বলে না। সেদিন রাতে শ্রাবণীর হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেলো অথচ ওর শাশুড়ি ওকে কিছু না বলে বরং বললো,
-“মা তোমার কোথাও লাগে নি তো?” পাশের বাসার রিনা আন্টি যখন শ্রাবণীর শাশুড়িকে বললো,
~তোমার ছেলে অসুস্থ আর তোমার ছেলের বউ বাহিরে পর পুরুষদের সাথে কাজ করে। কয়েকদিন পর দেখবে তোমার অসুস্থ ছেলেকে ফেলে তোমার ছেলের বউ অন্য লোকের সাথে পালিয়ে গেছে। শাশুড়ি তখন রেগে গিয়ে বললো,
– আমার বউয়ের নামে আর একটা উল্টা-পাল্টা কথা বললে এর ফল ভালো হবে না, বলে দিলাম। আমার বৌমা ১৬-১৭ বছরের মেয়ে না যে শরীরে যৌবনের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পর পুরুষের সাথে পালিয়ে যাবে। আমার ছেলের বউ শিক্ষিত; সে এমন কিছু করবে না যাতে পরিবারের বদনাম হয়। রাতে যখন বেলকনির গ্রিল ধরে শ্রাবণী বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে তখন ওর শ্বশুর এসে বলে,
-“পিয়াসের জন্য কি তোমার মন খুব খারাপ লাগছে? এক কাজ করো, ছাদে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসো। দেখবে, মন ভালো হয়ে যাবে। আর কাল অফিস শেষে পিয়াসকে একবার দেখে এসো । ” শ্রাবণী পিয়াসের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর পিয়াস শ্রাবণীর দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণী পিয়াসের সামনে বসে ওর হাতটা ধরে আহ্লাদের স্বরে বললো,
– প্লিজ বাবু, আরো ১০ দিনের ছুটি নিয়ে নে। ৮০% কাজ হয়ে গেছে এই ১০ দিনে। বাকি ২০% কাজ ও হয়ে যাবে।
পিয়াস শ্রাবণীর হাতটা সরিয়ে বললো,
— তুই কি চাস তোর চক্করে পড়ে আমার চাকরিটা সারা জীবনের জন্য চলে যাক? নিজের চাকরি, ঘর-সংসার ফেলে ২১ দিন ধরে এই হোটেলে পড়ে আছি। অফিসের বস বারবার ফোন করে বলছে আমার সমস্যাটা কি। এখন বসকে কি বলি বল তো? শ্রাবণী পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-তুই তো দেখেছিস বাবা মা আমাকে একদম সহ্য করতে পারতো না। এমন অবস্থায় আমি যদি জব করতে চাইতাম বাবা মা কখনোই রাজি হতো না। উল্টো আমাকে আরো নানা রকম কথা শোনাতো। এত কষ্ট করে এত ভালো একটা জব পেয়েছি! কোনোভাবেই আমি জবটা হারাতে চাই না! পিয়াস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণীকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
— আমার উচিত ছিলো ১৬ বছরের এসএসসি দিবে এমন একটা নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে করা। তাহলে মেয়ের পেটে এত প্যাঁচও থাকতো না। আর আমাকেও ঘর ছেড়ে হোটেলে থাকতে হতো না! শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,
– চল, আজ দুইজন মিলে অনেকটা পথ হাঁটবো! রাস্তার পাশে থাকা হলুদ সোডিয়ামের বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আলোর নিচ দিয়ে শ্রাবণী আর পিয়াস দুজন দুজনের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। এমন সময় শ্রাবণী বললো,
-“তোকে তো বলাই হয় নি, আজ মা রিনা আন্টিকে কি কি বলেছে…!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত