সে কাছে আসে

সে কাছে আসে
লিনিয়ার গাড়িটা ঠিক আমাদের রিক্সার সামনে এসে থামলো। আমি আর অপরূপা সবে রিক্সা থেকে নামলাম তখন। লিনিয়া গাড়ি থেকে নেমেই ভেতর ঢুকে গেল। আমাদের দিকে তাকালোও না৷ হাই হ্যালো তো দূরে থাক৷ রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে আসতেই দেখলাম লিনিয়া লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অপরূপা হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেল। বলল,
-চা খাবে? আমি খানিকটা অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে৷ বললাম,
-এই অসময়ে চা?
-হ্যাঁ৷ চলো তো! মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। চা’টার বিশেষ প্রয়োজন। আমরা আর লিফটের দিকে গেলাম না৷ বাইরেই চায়ের দোকান৷ ওখানে গিয়ে দোকানিকে চা দিতে বললাম৷ লিনিয়া একবার পেছন ফিরে দেখছিল হয়তো৷ আমি তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিল৷ চা হাতে আসতেই অপরূপা বলল,
-পদন্নোতির সাথে মানুষের যে ভাবন্নোতিও হয় তার একটা তরতাজা প্রমাণ দিয়ে গেল মেয়েটা৷ আমি চট করেই অপরূপার কথাটা বুঝতে পারলাম না৷ খানিকটা ভাবতেই লিনিয়ার কথা মনে পড়ে গেল৷ ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম অপরূপা কেন চা খেতে বলেছে৷ মেয়েদের এই একটা ব্যাপার, কেউই কারো ভাবটা সহজে নিতে পারে না৷ যদিও লিনিয়ার ব্যাপারটা অতিরিক্ত! ব্যাপারটা আমাকেও কিছুটা আঘাত দিয়েছে৷ বললাম,
-সময় এবং অবস্থান দুটোই মানুষের আসল পরিচয় তুলে ধরে, বুঝলে! এই বলে আমি খানিকটা হাসলাম। অপরূপার চেহারায় হাসি নেই৷ মুখটা কেমন লালচে হয়ে আছে। বলল,
-এমডি স্যার কাজটা ঠিক করেননি৷ ওর জায়গাটা তোমার পাওয়ার কথা ছিল৷ আমি আবারও হাসলাম৷ বললাম,
-আমাদের এমডি স্যার খুব চালাক মানুষ। ভদ্রলোকের মাথাভর্তি বুদ্ধি। অবশ্য উনার জায়গায় আমি থাকলে আমিও সেইম কাজটাই করতাম। অপরূপা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
-এখানে বুদ্ধির কী দেখলে তুমি?
-লিনিয়ার যথার্থ যোগ্যতা আছে ওই চেয়ারে বসার। এটা কি তুমি বিশ্বাস করো? অপরূপা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-হ্যাঁ। বিশ্বার করি। কিন্তু তুমিও তো তার সমান যোগ্যতাধারী। তোমার আর ওর মাঝে তেমন পার্থক্য আমি দেখছি না৷ আমি না হয় দেরিতে জয়েন করেছি। লিনিয়ার আগে তুমিই কিন্তু ছিলে অফিসে এবং ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে অফিসে তুমিই আসতে৷
-এমডি স্যার ঠিক এখানেই নিজের আবেগটা ঝেড়ে দিয়ে মস্তিষ্ক দিয়ে ভেবেছেন৷
-মানে? আমি চায়ে আরেক চুমুক দিয়ে বললাম,
-লিনিয়ার আরেকটা ব্যাপার কি তুমি লক্ষ্য করেছো? মেয়েটা মানুষকে সহজেই ইমপ্রেস করতে পারে৷ যেমন আমাদের করেছিল! আমরা খুব সহজেই কতো আপন হয়ে গিয়েছিলাম ওর সাথে৷ তাই না?
-হ্যাঁ৷ তখন তো ভাবলাম মাটির মতো মেয়েটা।
-এমডি স্যার এই জিনিসটাই দেখলেন৷ আমার যা মনে হয় আরকি৷ তিনি হয়তো ভাবলেন মেয়েটা খুব সহজেই মানুষকে কনভিন্স করতে পারে৷ যেটা একটা প্লাস পয়েন্ট৷ দেশি কিংবা বিদেশি বায়ারদের কনভিন্স করার ব্যাপারে কাজে দিবে। অপরূপা যেন চট করেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে বলল,
-আসলেই তো! এই দিকটা তো আমি ভেবে দেখিনি! আমি বললাম,
-আর তাছাড়া মেয়েটা যথেষ্ট আধুনিকও বটে। চেহারা সুন্দর, গুছিয়ে কথা বলে, বুদ্ধিমতী, অফিসিয়াল ড্রেসে অফিসে আসে, স্যুট-কোট পরে, বুঝোই তো! এ ধরনের কিছু স্পেশাল ব্যাপার স্যাপার আছে লিনিয়ার ভেতর। তার কারণেই বস হয়তো ওকেই ওই চেয়ারটার জন্যে যোগ্য ভেবেছেন। অপরূপার চা খাওয়া শেষ৷ সে কাপটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-সবই বুঝলাম। সুন্দরীরা এসব দিক দিয়েই এগিয়ে যায়৷ তার মানে সুন্দরের বিচারটাই বেশি।
-কী করবে বলো। সবাই যে সৌন্দর্যতাই খোঁজে। আমরা সকলেই তেমন। যেমন চায়, তেমন দিতে হয়, বুঝলে।
অপরূপার যেন খানিকটা মন খারাপ হলো। হয়তো সুন্দর-অসুন্দরের বিচারটা সে সহজে নিতে পারেনি৷ সে আর কিছু বলল না৷ আমি বাকি চা টুকু এক চুমুকে শেষ করেই বললাম,
-তা তুমিও কিন্তু যথার্থ সুন্দরী আছো। কে জানে হয়তো বছর গাড়লে চেয়ারটা তুমিই পেয়ে যাও কি না! মেয়েটার মুখটা চট করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো৷ লাজুক একটা আভা হঠাৎই ভেসে উঠল চেহারায়৷ মেয়েদের খুশি করতে বেশি কিছু লাগে না৷ রূপের প্রশংসা করলেই যেন এরা আমোদিত হয়ে উঠে৷ কথাটা শতভাগ সত্য। অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
-ফাইজলামি করো না তো? আমিও খানিকটা হাসলাম। বললাম,
-ফাজলামো নয়৷ সত্যিই বলেছি৷
-অফিসে চলো৷ কে জানি মেডাম লিনিয়া আবার কী শুরু করেন! এই বলে মেয়েটা খানিক হাসলো। আমি একটু শব্দ করেই হাসলাম। অফিসের দিকে এগিয়ে গিয়েই বললাম,
-তবে ওর এভাবে ভাব বেড়ে যাওয়াটা সত্যিই কষ্টকর। পদন্নোতি না হয় হয়েছে। কিন্তু আমাদের এভাবে ভুলে যাওয়াটা তার ঠিক হয়নি৷ এতোদিন এক সাথে ছিলাম। মেয়েটা সেসব ভুলেই গেল! অপরূপার আবারো যেন মনটা খারাপ হয়ে এলো। বলল,
-আমি ওকে বন্ধুর মতো ভেবেছিলাম। বিশ্বাস করো, অফিসে এসে এমন একটা বান্ধুবি পাবো আমি তা ভাবিনিও। এ জন্যেই এখন তার পরিবর্তনটা ঠিক নিতে পারছি না। আমি কিছু বললাম না আর। চুপ করে থাকলাম৷ লিফটের ভেতর ঢুকে পড়ালাম৷ লিনিয়া আমার পরেই অফিসে জয়েন করেছে। তারপর অপরূপা। এরপর সাদিক। রিমন ভাই অবশ্য আমার সাথেই জয়েন করেছেন। আমাদের এই ক’জনের সাথেই বেশ মেলামেশা। তবে অপরূপা, আমি, লিনিয়া ও সাদিক এই ক’জনেই অফিসের বাইরেও বেশ মেলামেশা করেছি। আড্ডা দিয়েছি, ঘুরেছি, বলতে গেলে বেশ ভালোই মজা করেছি। একদম বন্ধুদের মতো৷ অফিস শেষে সন্ধ্যায় রিক্সায় চড়ে ঘুরতাম, চাঁদের আলোয় রাস্তায় খালি পাঁয়ে হাঁটতাম, ফুচকা তো প্রায় প্রতিদিনিই খাওয়া হতো৷
লিনিয়া অবশ্য আইস্ক্রিম বেশি পছন্দ করতো। সে জন্যে আমাদের প্রায়ই আইস্ক্রিম খাওয়া হতো৷ একবার এমন আইস্ক্রিম খেয়ে আমার সাধারণ একটু ঠান্ডা লেগে যায়৷ বলতে গেলে আগের দিন মেঘে ভিজেছিলাম বলে ঠান্ডাটা লাই পেয়ে গিয়েছিল৷ তাই ওদের সাথে আইস্ক্রিম খেতেই ঠান্ডাটা যেন গলায় ধরে বসে। আমি অবশ্য নিষেধ করেছিলাম। খাওয়ার ইচ্ছে নেই৷ লিনিয়া নিজেই জোর করলো বলে খেলাম। ভারী চঞ্চল মেয়েটা। জেদিও বটে৷ যেটা করবে বলেছে তো করবেই৷ সেদিন বাসায় আসতেই আমার সে কী কাশি! মানে কাশিটা যেন মারাত্মক ভাবে ধরে গিয়েছে৷ একটু একটু জ্বর জ্বর করছিল গায়ে৷ ঘুমানোর ঠিক আগ মূহুর্তে লিনিয়ার ফোন আসে৷ আমি ফোন ধরেই কিছু বলতে পারলাম না। ওপাশ থেকে লিনিয়া বলল,
-কী ব্যাপার! এতো কাশছো কেন? আমি কোনো মতে বললাম,
-জানি না৷ মেঘে ভিজেছিলাম বলে হয়েছে হয়তো! লিনিয়া চট করেই কিছু বলল না৷ খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-আইস্ক্রিম খাওয়াতে এমন হয়নি তো!
-আরে নাহ! তা নয়৷ আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম সেদিন৷ তাই কাশি ধরেছে৷ জ্বর জ্বর করছে৷ সমস্যা নেই৷ সেরে যাবে। এই বলে আবার কাশতে থাকলাম৷ লিনিয়া ওপাশ থেকে বলল,
-রেডি হয়ে নাও তো৷ ডাক্তারের কাছে যাবো৷ আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম,
-ডাক্তারের কাছে মানে? হালকা কাশিতেও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে? হাসালে তুমি৷
-চুপ! বেশি কথা বলবা না৷ এটা হালকা কাশি হ্যাঁ? কথাও ঠিক মতো বলতে পারছো না তুমি। আবার এটা নাকি হালকা কাশি। যা বলছি চুপচাপ তাই করো৷ আমি আসছি। আমি বললাম,
-লিনিয়া?
ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেল না৷ ফোন কাটা গেল। অল্প কিছুক্ষণ পরেই নিজেদের গাড়ি নিয়ে হাজির হলো সে। নিজে ড্রাইভিং করে এসেছে। ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগল৷ আমি ওকে দেখতেই বললাম,
-ড্রাইভিং জানো তুমি? ও মৃদু হেসে বলল,
-শিখে নিয়েছি। আমি কিছুটা দুষ্টামির স্বরে বললাম,
-লাইসেন্স আছে? ও এবারেও হাসলো। বলল,
-সব আছে। তুমি এসো তো আমার সাথে। তোমাকে আইস্ক্রিম খাওয়ানোটাই আমার অপরাধ হয়েছে।
-আইস্ক্রিমে এমন হয়নি তো!
-আমাকে শিখিয়ো না। আমার যথেষ্ট বুঝ হয়েছে। বুঝেছো? আমি কিছু বললাম না। গাড়িতে উঠে বসলাম। ডাক্তার দেখানো শেষে ও নিজেই আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলো৷ বলল,
-ঔষধ গুলো নিয়ম মতো করে খেও। ঠিক আছে?
আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। লিনিয়া আরো কিছু সময় থাকলো এখানে৷ আমরা গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বললাম। মাথার উপর তখন নিয়নবাতি। অদ্ভুত সুন্দর একটি রাত কেটেছিল সেদিন৷ সে রাতেই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে আমার। সেই ব্যাপারটা লিনিয়াকে জানাইনি। জানালে কী করতো কে জানে। যাই হোক, এমন অনেক দিনই আছে আমার স্মৃতিতে যেখানে লিনিয়া মেয়েটা ভীষণ ভাবে জড়িত৷ আজ হঠাৎ এই স্মৃতিজোড়িত মানুষটার এমন পরিবর্তন সত্যিই কষ্টকর, ব্যাথাময়। লিফট থামলো। আমি বের হতেই অপরূপাকে ডাকলাম,
-অপরূপা? ও পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
-হ্যাঁ?
-একটা কথা বলি শুনো।
-হ্যাঁ বলো!
-আমার না অহংকার জিনিসটা খুব অপছন্দের। অহংকার কিংবা দাপটে মানুষদের সঙ্গ আমি সব সময় এড়িয়ে চলি।
-লিনিয়ার কথা বলছো? আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-হ্যাঁ।
আমি আজ থেকে ওর সাথে একজন এমপ্লয়ি ও একজন বসের সাথে যেমন সম্পর্ক কিংবা বিহেভ করা উচিৎ, ঠিক তেমন করবো৷ এটা একান্তই আমার অভিমত। তোমাদেরটা ভিন্ন ব্যাপার৷ তোমরা যদি ওর সাথে অফিস শেষে বাইরে কোথাও যাও তবে আমাকে ডেকো না প্লীজ৷ ও যদি জিজ্ঞেসও করে তবে বলিও আমি ব্যস্ত আছি৷ কিংবা কোনো কাজে যাচ্ছি৷ বুঝেছো? অপরূপ মাথা নেড়ে সায় দিলো। বলল,
-আমারও ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও এখন বস বলে কথা৷ কী করবো বলো! আমি হেসে বললাম,
-সেটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার। তবে আমার এই উপকারটুকু করিও৷ কেমন? অপরূপা হাসলো৷ আমরা অফিসে ঢুকে পড়লাম। নিজের ডেক্সে পৌঁছাতেই অফিসের পিয়ন মুনির চাচা এসে পাশে দাঁড়ালেন। এক গাল হেসে বললেন,
-বাবা ভালো আছো? আমি উনাকে দেখতেই হাসলাম। সালাম দিয়ে বললাম,
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি চাচা৷ আপনার কী খবর? তিনি হাসি মুখেই বললেন,
-ভালো। মেডাম ডাকছে তোমাকে।
-কে? লিনিয়া মেম? তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললাম,
-আচ্ছা। আমি আসছি৷ মুনির চাচা চলে গেলেন৷ আমি ব্যাগ খুলে ফাইলটা বের করে নিলাম। এই ফাইলটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের নেক্সট প্রোজেক্টের ডিটেইলস। আমি ফাইল হাতে লিনিয়ার রুমে গেলাম৷ দরজায় নক করে বললাম,
-মেম? আসবো? লিনিয়া মাথা তুলে দেখলো আমায়। বলল,
-এসো। বসো এখানে। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। লিনিয়া নিজের সামনের ফাইলটা সরিয়ে আমারটা চাইলো। আমি সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-সব কিছু ডিটেইলে লিখা আছে মেম৷ আপনি যেমনটা চেয়েছেন৷ আর নতুন যে দুটো বিষয় আমাকে এড করতে বলেছেন সেগুলোও এড করে নিয়েছি। আপনি একবার দেখে নিলে ভালো হয়৷ লিনিয়া ফাইল থেকে চোখ তুলে আমার দিকে দেখলো। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। আমার অস্বস্তি হতে শুরু করলো৷ কেউ এভাবেই তাকিয়ে থাকলে তো অস্বস্তি হবেই। তার উপরে সে যদি সুন্দরী হয় তাহলে তো কথাই নেই৷ আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললাম,
-মেম? কোনো ভুল হয়েছে? লিনিয়া এবার চোখ গরম করে দেখলো আমায়৷ ভ্রু কুচকে এলো তার। বলল,
-সমস্যা কী তোমার? আমি প্রশ্নটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম। বললাম,
-কই? কী সমস্যা হবে? আপনি-আপনি করছো, মেম বলছো, এসব কী?
-এই হুকুমটা তো আপনারই ছিল তাই না? বসকে বস ডাকতে হবে। কলিগের সাথে অতি বন্ধুত্ব নয়।
-আরে তখন এমডি স্যারের সামনে বলেছিলাম আরকি৷ তুমি দেখছি ব্যাপার সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-যাই হোক। যেভাবেই বলুন, বলেছেন তো! আর আমার জন্যে অফিসে এমপ্লয়ি আর বসের রিলেশনটাই কম্পোর্টেবল।
-হোয়াট? আমি আবারো হাসলাম। বললাম,
-ফাইলটা দেখুন প্লীজ। লিনিয়ার মুখটা কেমন লাল হয়ে এলো। যেন নিজের রাগটাকে খুব কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করছে সে৷ বলল,
-তাসফি? কী হয়েছে তোমার? এমন বিহেভ করছো কেন?
-আশ্চর্য মেম! কেমন বিহেভ করছি আমি।
-ফাজলামো করবা না বলছি। তোমার মুখ থেকে এই মেম শব্দটা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না আমার৷
-কেন মেম? ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমরা না বন্ধু। আমি, তুমি, অপরূপ, সাদিক। তুমি কি সে সব ভুলে গেলে? আমি মৃদু হেসে বললাম,
-আপনার সে সব মনে আছে? আমি, সাদিক, অপরূপার কথা মনে আছে আপনার? অবাক করা ব্যাপার! আপনি কীভাবে মনে রেখেছেন? লিনিয়ার মুখটা কেমন রক্তিম হয়ে এলো৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর সামনে থেকে ফাইলটা নিতে গেলাম। তখনই আমার হাতটা ধরে ফেলল ও। বলল,
-ভুল করছো তুমি তাসফি৷ আমাকে রাগাবা না বলে দিচ্ছি। ভালো হবে না কিন্তু। আমি এবারেও হেসে বললাম,
-ভয় দেখাচ্ছেন? চাকরি খেয়ে দিবেন? হাউ ফানি! আমি হাসলাম। লিনিয়া আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকলো কেবল৷ সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, আমি ওর সাথে এমন বিহেভ করছি৷ আমি বললাম,
-প্রেজেন্টেশন আছে। সাড়ে দশটায়৷ এখন দশটা বত্রিশ বাজে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমডি স্যার অপেক্ষা করছেন৷ মিটিং রুমে আসুন৷ এই বলে আমি ওর কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম৷ বের হতেই ভেতরে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ হলো৷ শব্দের সাথে সাথেই সবাই আমার দিকে তাকালো৷ তাকিয়েই থাকলো৷ আমি মৃদু হাসলাম। মুনির চাচাকে দেখলাম তাড়াহুড়ো করে লিনিয়ার কেবিনে যাচ্ছে। সোহান ভাইকেও দেখলাম লিনিয়ার রুমের দিকে দৌড়ে যেতে। আমি নিজের ডেক্সে এসে অপরূপাকে বললাম,
-সবাইকে মিটিং রুমে আসতে বলো৷ প্রেজেন্টেশন আছে না? অপরূপা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো৷ জানতে চাইলো ভেতর কী হয়েছে? বললাম,
-আরেহ কিছু না৷ মিটিং রুমে আসো জলদি৷
প্রেজেন্টেশনের দায়ভারটা আমার উপর ছিল। গত কয়েকদিন এটার পেছনে লেগে থাকতে হয়েছে আমার৷ দিনরাত এক করে তৈরী করেছি। বলতে গেলে এটার প্রতি আমার আগ্রহও ছিল বেশ৷ তাই প্রেজেন্টেশনটাও বেশ ভালো ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সবাই বেশ প্রশংসা করলো৷ কেবল লিনিয়া ছাড়া৷ সে নিজের চেয়ারেই চুপচাপ বসে থাকলো। এদিকে তাকালোও না একটু। আমি অবশ্য তা গায়ে মাখলাম না। ফাইল, ল্যাপটপ গোছাতে থাকলাম। ঠিক তখনই এমডি স্যার বলে উঠলেন,
-তাসফি?
-জ্বী স্যার।
-এক কাজ করো। লিনিয়ার সাথে আমাদের মিরপুরের সাইটটা ভিজিট করে এসো। দেখো সেখানকার কী অবস্থা৷ কাজের অগ্রগতি কেমন তা এসে আমাকে রিপোর্ট করবে৷ ঠিকাছে? আমি হাসলাম। বললাম,
-ঠিকাছে স্যার৷ লিনিয়া কিছু বলল। আগের মতোই বসে থাকলো। স্যারের কথাটা সে শুনেছে কী না তাও বুঝা গেল না৷ আমি ডেক্সে ফিরে এলাম। সব কিছু গুছিয়ে রেখে গেলাম লিনিয়ার রুমে। নক করেই বললাম,
-মেম আসবো? লিনিয়া কিছু বলল না৷ এদিকে তাকিয়েও দেখলো না৷ আমি ওর ডেক্সের সামনে গিয়ে বললাম,
-মেম, স্যার আপনাকে নিয়ে মিরপুরের সাইটটা ভিজিট করতে বলেছেন। লিনিয়া কিছু বলল না। উঠে গিয়ে রুমের দরজাটা লক করে দিলো৷ তারপর আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকলো৷ ওর চোখ দুটো কেমন লালছে হয়ে আছে৷ মলিন মুখ৷ ও আমার কাছে এলো। আমি ভ্রু কুচকে দেখলাম ওকে। আশ্চর্য! এই মেয়ের মতলব কী? লিনিয়া আমাকে চেয়ারে বসতে বলল। নিজেও বসলো আমার সামনের চেয়ারটাতে। বললাম,
-কী হয়েছে?
লিনিয়া জবাব দিলো না৷ এক দৃষ্টিতে আমায় দেখে গেল। আমি তার জবাবের অপেক্ষায় থাকলাম। কিছু সময় পর লিনিয়া নিজ থেকেই কোমল স্বরে বলল,
-তাসফি? কী হয়েছে তোমার বলতো? আমি কিছু জানি না এমন একটি ভাব নিয়ে বললাম,
-কই? কী হবে? ও কেমন ধরে আসা স্বরে বলল,
-তুমি কেমন অদ্ভুত একটা বিহেভ করলে তখন। এখনও করছো৷ মেম, আপনি এসব কী? তুমি জানো তোমার মুখ থেকে মেম শব্দটা শুনতে কতটা খারাপ লাগে আমার? আমি কতোটা হার্ট হয়েছি তা কি তুমি জানো?
আমি কঠিন স্বরে বললাম,
-দেখুন, আপনি এখন আমার বস সমতুল্য। চাকরির যোগ্যতায় আপনি আমার আগে৷ আপনাকে হার্ট করা আমার ঠিক হয়নি। আর আমি আপনাকে একটুও হার্ট করতে চাইনি মেম। বিশ্বাস করুন।
-তাসফি? তুমি এখনও আগের মতো মেম মেম করছো? আশ্চর্য! তোমার হয়েছেটা কী? কেন হঠাৎ এমন চেঞ্জ হয়ে গিয়েছো? আমি হাসলাম। বললাম,
-আমার একদিনের চেঞ্জ আপনি নিতে পারছেন না মেম। অথচ আজ সপ্তাহ কয়েক আপনার পরিবর্তন সয়ে আসছি৷ একটু ভেবে দেখুন, আমার কিংবা আমাদের কেমন লাগছে!
-আমার মাঝে কী চেঞ্জ দেখলে তুমি? আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম,
-বাসায় গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখবেন৷ গত কয়েক সপ্তাহের স্মৃতি গুলো একটু খুঁটিয়ে দেখবেন৷ তাহলে অবশ্যই টের পাবেন৷ তখন আয়নায় নিজেকে দেখতেও পারবেন না আপনি। লিনিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ আমি দরজার কাছে গিয়ে বললাম,
-সরি মেম। এমডি স্যার যেতে বলছেন। আপনি কি যাবেন? লিনিয়া মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-না, আমি যাবো না। আমি বললাম,
-তাহলে মেম অপরূপাকে নিয়ে যাই? লিনিয়া চট করেই তাকালো আমার দিকে। বলল,
-ইদানিং তোমাকে অপরূপার সাথে বেশি দেখা যাচ্ছে। কাহিনী কী বলতো? ও-ই কি তোমার মাথায় এসব ঢুকিয়েছে?
-অফিসে আপনি যেমন আমার বস, সেও আমার কলিগ। ব্যস৷ এতটুকুই৷ আর সে আমার মাথায় কিছু ঢুকায়নি। অযথা কাউকে নিয়ে উল্টাপাল্টা ভাববেন না৷
-তা অফিসের বাইরে তার সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? আমি হাসি মুখে বললাম,
-পার্সোনাল লাইফ অফিসের বাইরের ব্যাপার মেম। এগুলো নিয়ে অফিসে আলোচানা না করাই ভালো৷ লিনিয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। যেন এই ব্যাপারটা মেয়েটা মেনে নিতেই পারছে না৷ আমি এভাবে তার মুখের উপর কথা বলছি সে এটা যেন মানতেই পারছে না৷ বললাম,
-কাকে নিয়ে যাবো বলুন মেম। লিনিয়া কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
-অপেক্ষা করো৷ আমি আসছি৷
-আচ্ছা মেম।
এভাবে প্রায় দুদিন কেটে গেল৷ তৃতীয় দিন অফিস থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ আমি, অপরূপা আর সাদিক এক সাথেই অফিস থেকে বের হলাম। সাদিক বলল,
-আজ কোথায় যাওয়া যায়? অপরূপা চট করেই বলে উঠল,
-অনেকদিন ফুচকা খাওয়া হয় না৷ আমার ভীষণ ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে৷ আমি বললাম,
-তাহলে চলো! মতিন মামার দোকানে হানা দেই।
কথাটা বলেই আমি হেসে দিলাম। ওরা দু’জনও হাসলো। আমরা রিক্সায় করে মতিন মামার দোকানের সামনে এলাম। মামাকে ফুচকা বানাতে বলে আমরা বসলাম সবে৷ ঠিক তখনই লিনিয়ার গাড়িটা দেখলাম আমি। রাস্তার পাশে পার্ক করালো। তারপর নেমেই আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো। আমি বললাম,
-আমার মনে হয় চলে যেতে হবে৷ অপরূপা ব্যাপারটা খেয়াল করলো৷ বললো,
-সমস্যা নেই। তুমি তোমার মতো থাকো।
-নাহ৷ অযথাই অস্বস্তিকর একটা মোমেন্ট ক্রিয়েট হবে৷ আমি বরং উঠেই যাই৷ এই বলে আমি উঠতে যাবো, ঠিক সে সময় লিনিয়া দৌড়ে এসে বলল,
-উঠার দরকার নেই। বসে থাকো এখানে৷
আমি ওর দিকে তাকাতেই কেমন হকচকিয়ে গেলাম। মেয়েটার চোখ দুটো কেমন লালছে হয়ে আছে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা যেন৷ যেন ভীষণ কান্না করেছে সে৷ হয়তো এই ব্যাপারটা দেখে আমার যেতে মন চাইলো না। আমি বসে পড়লাম। হঠাৎই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল আমার। লিনিয়া চেয়ারে বসে চুপ থাকলো কিছু সময়৷ আমরা সবাইও চুপ করে ছিলাম। কিছু সময় পর লিনিয়া কিছুটা ধরে আসা স্বরে বলল,
-অপরূপা, সাদিক। কেমন আছো তোমরা? সাদিক খানিকটা হেসে বলল,
-এই তো! ভালো৷ তোমার খবর কী? লিনিয়া তার জবাব দিলো না৷ বলল,
-অপরূপা? তুমি কথা বলবে না? অপরূপা লিনিয়ার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো৷ বলল,
-জানি না৷ কেন জানি কথা বলতে পারছি না আমি৷ লিনিয়া চুপ করে থাকলো৷ এরপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
-তাসফি? অফিসের বাইরে আমার সাথে কেমন বিহেভ করার কথা ভেবে রেখেছো? নাকি আমার সাথে অফিসের বাইরে কথাই বলবে না? আমি বললাম,
-কিছু বলতে এসেছো? লিনিয়া মাথা নাড়ল৷ তারপর কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
-আমি আসলে হঠাৎ কেমন জানি হয়ে যাই। অফিসের কাজের প্রতি আমার চট করেই কেমন আগ্রহ বেড়ে যাই৷ কাজের প্রতি আমি এতোটাই এক্টিভ হয়ে যাই যে তোমাদের কথা প্রায় ভুলেই যাই আমি। এরপর দাম্ভিকতা আমায় কেমন জানি গ্রাস করে নেয়৷ আনি কেমন জানি হয়ে যাই। তারপর কিছুটা থেমে আবার বলল,
-আমি আসলে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। জানি ক্ষমা চাওয়ার কোনো অধিকার নেই আমার। তবুও প্লীজ! আমাকে ক্ষমা করে দাও৷ আমি আগের মতো হয়ে যেতে চাই৷ তোমাদের সাথে মিশতে চাই। তাসফি সেদিন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, পরিবর্তন হওয়ার ব্যাথা কেমন৷ আমি জানি তোমরাও সেই ব্যাথাটা পেয়েছো৷ এই ব্যাথা মোছনের জন্যে তোমরা যা বলবে আমি তা-ই করবো। তবুও প্লীজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি চাই আমাদের সম্পর্কটা আগের মতো হোক৷ হাসি-খুশি প্রাণবন্ত। আমরা সবাই চুপ করে থাকলাম। আমি কী বলব ভেবে পেলাম না৷ মাথা নিচু করে রাখলাম৷ লিনিয়া আবার বলল,
-প্লীজ! আমি হাত জোড় করছি! অপরূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তাসফি? এই বারের মতো রাগ ছেড়ে দাও৷ মেয়েটা ক্ষমা চাইছে। এমন সময় ক্ষমাও’বা ক’জনে চায় বলো!
কথাটা আসলেই সত্য৷ মানুষের মাঝে ক্ষমা চাওয়ার প্রবণতাটা উঠে গিয়েছে৷ সবাই কেবল নিজের ইগোকে প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে৷ যেটা আসলেই অনৈতিক। আমি মাথা লিনিয়ার দিকে তাকালাম। খানিকটা হেসে মতিন মামাকে বললাম,
-মামা, আরেক প্লেয় ফুচকা দিয়েন৷ লিনিয়ার চোখে জল জমে গেল। ভেজা চোখে হাসলো মেয়েটা। আমি বললাম,
-এমন আর করলে খবর আছে তোমার।
কথাটা শুনেই সাদিক আর অপরূপা হেসে দিলো৷ লিনিয়া হাসলো চাপা ভাবে৷ সন্ধ্যাটা খুব দ্রুতই পেরিয়ে গেল। অনেকদিন পর লিনিয়ার আগমনে মজাটা আরেকটু বেশিই হলো। আমরা অনেক্ষণ বাইরে ঘুরাঘুরি করলাম। রাত প্রায় তখন দশটা বাজে। লিনিয়া আমাকে বাসার কাছে ড্রপ করে দিলো৷ আমি গাড়ি থেকে নেমে ওকে বাই বলতে যাবো ঠিক তখনই ওকে গাড়ি নামতে দেখলাম। ও নেমে গাড়ি সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো৷ আমি ভালো করে দেখলাম ওকে। সে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে অভিমানী স্বরে বলে,
-আমার মন ভালো নেই৷ আমি গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াই। বলি,
-কেন? হঠাৎ মন খারাপের কী হলো?
-হঠাৎ নয়।
-তাহলে?
-সেদিনের পর থেকে।
-কোন দিনের?
-মনে নেই? নাকি ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছো।
মেয়েটার কণ্ঠে রাগি মিষ্টি অভিমান৷ কেমন করে তাকিয়ে দেখছে আমায়৷ কী মলিন মুখ! ব্যাথায় যেন জর্জরিত সে। আমি খানিকটা সময় ভাবি। তার ব্যাথার উৎস খুঁজি৷ হঠাৎই আমার মনে পড়ে যায়। বলি,
-মেম? মেয়েটা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়৷ যেন গিলে খাবে। ধরে আসা স্বরে বলে,
-আই উইল কিল ইউ! আমি হাসি৷ অদ্ভুত আনন্দ লাগে আমার৷ মেয়েটা বলে,
-আবার হাসেও৷ লজ্জা নেই৷
-লজ্জা কিসের।
-বুঝো না?
-উহু।
-তা বুঝবে কোত্থেকে। সারাদিন তো অপরূপার কাছে পড়ে থাকো৷ আমার কেন জানি রাগ হয়। বলি,
-অপরূপা আসছে কোত্থেকে? সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
-যেখান থেকে আসার কথা! তুমিই তাকে নিয়ে আসছো।
-আমি?
-হ্যাঁ।
-কীভাবে?
-নিজেকে জিজ্ঞেস করো?
-আমার কাছে এর জবাব নেই লিনিয়া। লিনিয়া কিছু সময় চুপ থাকে৷ এরপর কেমন জানি একটা স্বরে বলে,
-তোমাকে ওর পাশে সহ্য হয় না আমার। আমি যেন অবাক হই৷ বলি,
-সে না তোমার বান্ধুবি! একটু আগেও তো কোলাকুলি করে আসলে।
-সে যাই হোক! বান্ধুবি হোক! তোমাকে সব সময় আমার পাশে থাকতে হবে৷ কেবলই আমার পাশে৷
-নিজের করে নিয়েছো নাকি? মেয়েটা চট করেই চুপ করে যায়। আমার দিকে তাকায়৷ চোখে চোখ রাখে৷ আমি ওর কাজলের মায়ায় পড়ি৷ তাকিয়ে থাকি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে। বলি,
-যখন কোনো সিঙ্গেল যুবকের সুন্দরী কলিগ থাকে তখন তার কী করা উচিৎ জানো? মেয়েটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়৷ আমি বলি,
-তার সাথে বন্ধুত্ব করে নেওয়া উচিৎ। যাতে করে যুবকটা নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে না পারে৷ বন্ধুত্বভাবের আড়ালেই এই প্রেম ভাবটা যেন লুকিয়ে থাকে।
-তুমি কি তাই করেছো? আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি৷ বলি,
-সেই প্রথম থেকে৷ এবং আমি জানি, সেই কাজটা আমি নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করেছি৷
-কীভাবে বুঝলে?
-কারণ তুমি টের পাওনি। লিনিয়া আমার দিকে তাকায় ভালো করে৷ মৃদু হাসে। বলে,
-মেয়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ নয় মিষ্টার তাসফি! আমি যেন রহস্যের গন্ধ পাই৷ ভ্রু কুচকে বলি,
-তাহলে আমি কি ফাঁকি দিতে পারিনি?
-একদমই না।
-তুমি টের পেয়েছিলে?
-হু।
-কখন?
-সেই প্রথম থেকে৷ যখন তুমি আড় চোখে দেখতে আমায়।
কিংবা যখন কথা বলতে আমার সাথে, আমি যখন কথা বলতাম, কী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে। তুমি জানো, তখন তোমার চেহারার ওই মুগ্ধতা, ওই উজ্জ্বলতা, আমাকে কী পরিমান অভিভূত করতো? আমি কী পরিমাণ খুশি হতাম? এ জন্যে আমি তখন বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলতাম। তুমি যেন তাকিয়ে থাকার সুযোগ পাও৷ তোমার চেহারার মুগ্ধতা যেন বিলীন না হয়৷ আমি যেন বাক শক্তি হারিয়ে ফেললাম। কী বলবো ভেবে পেলাম না৷ লিনিয়া আরেকটু কাছে এলো আমার। আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় সে। বলে,
-তোমার মুখে মেম শব্দটা আমায় এমন ভাবে হার্ট করেছে যেন আমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি৷ তুমি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছো! আমাকে পর করে দিচ্ছো। আমরা অচেনা কেউ৷ তখন আমার পৃথিবীটা কেমন উলোটপালোট হয়ে গিয়েছিল তাসফি। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কেবল তোমার সামনে কাঁদতে পারিনি। পাথর হয়ে বসে ছিলাম। মেয়েটার গলাটা ধরে আসে। কেমন ভিজে আসা কণ্ঠে কথা গুলো বলে সে৷ আমি ওর দিকে তাকাই৷ সে তখনও চোখেমুখে কী ভীষণ মায়া নিয়ে আমায় দেখছিল৷ আমি বললাম,
-আ’ম সরি লিনিয়া৷ আমার ওইদিন এভাবে বিহেভ করা ঠিক হয়নি। ঠিক তখনই লিনিয়ার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি পড়ে যায়। চট করেই মেয়েটা জড়িয়ে ধরে আমাকে। কান্না করে দেয়৷ আমার কাঁধে মাথা রেখে কান্না করে৷ ভেজা স্বরে বলে,
-আমি খুব কষ্ট পেয়েছি তাসফি! আমারও কেন জানি খারাপ লেগে যায়৷ মন ভার হয়ে৷ আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। বলি,
-সরি বলেছি তো! লিনিয়া কান্না করে৷ কেবল কান্না করেই যায়৷ আমি কিছু বলি না আর৷ তাকে আগলে রাখি পরম মায়া। মেয়েটা হঠাৎই বলে উঠে,
-তাসফি?
-হু?
-আমি একটা কিছু চাই তোমার কাছে।
-কী চাই বলো? মেয়েটা খানিকটা চুপ থাকে। এরপর বলে,
-অধিকার। তোমার বুকে মাথা রাখার অধিকার চাই আমি। এভাবে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই৷ আমার ভয় হয়৷ তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা মনের মধ্যে মিশে গিয়েছে৷ আমি তোমাকে নিজের করে নিতে চাই৷ হারিয়ে ফেলার ভয়টা দূর করে ফেলতে চাই। আমি মৃদু হাসি। মেয়েটাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। বলি,
-অপরূপাকে এতো ভয় পাও তুমি? জানতাম না তো!
কথাটা শুনেই আমার মাথায় মৃদু আঘাত করে লিনিয়া৷ তারপর হাসে৷ পরম আত্মবিশ্বাসে আমার কাঁধে মাথা রাখে সে৷ আমিও হাসি। মনে মনে তখন আনন্দের ঝড় বইছে৷ ভাবনারা পাগলপারা হয়ে ছুটছে এপাশ থেকে ওপাশ।
বাসায় বিয়ের কথা বলতে হবে দ্রুত। অনেক হয়েছে একা একা থাকা৷ এবার বিয়েটা করেই ফেলি৷ কারো হাতে নিজেকে দিয়ে দেই৷ কেউ আমাকে আগলে রাখুক৷ ভালোবাসুক নিজের মতো৷ আমি ভাবি। ভাবতে ভাবতে ভাবনায় হারিয়ে যাই৷ ভাবনায় হারিয়ে যেতে যে এতো আনন্দ তা কেবল আজ টের পেলাম। আজ, এই মূহুর্তে, এই বিশাল আকাশে নিচে থেকে আমি জানতে পারলাম, এই পৃথিবীতে প্রেমে পড়লে ভাবনায় হারিয়ে যেতেও মহানন্দ লাগে৷ ঘোর লাগে চোখে, মস্তিষ্কে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত